#শেষ_বিকেলের_মায়া (১৫)
সকালের মৃদুমন্দ হাওয়ায় নড়ছে ফারিহার কেশ। সে দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে আদীব। মেয়েটা যখন প্রথমবার তাদের বাড়িতে এল তখন থেকেই কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করত। কী, কেন, কীভাবে হলো জানা নেই। শুধু মনের ভেতর জাগল অন্যরকম ভালো লাগা ভালোবাসা। সকালটা আরেকটু দীঘল হতেই ফারিহা ওঠে পড়ল। মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে বলল,”ফিরে যাই চলুন।”
আদীব বিনাবাক্যে পথ আগালো। ওদের মাঝের দূরত্ব অনেকটা। ফারিহা কিছু ভাবছে কী না বোঝা যাচ্ছে না। তবে আদীব ভাবছে। ভাবছে এক সুন্দর সংসারের কথা। মোড়ের কাছ থেকে চা নিয়ে নিল আদীব। ধন্যবাদ না জানিয়ে মৃদু হাসল ফারিহা। চা কাপে চুমুক দিয়ে বলল,”জীবন কত সুন্দর কত রঙিন।”
হঠাৎ কেন এমনটা বলল বুঝতে পারল না আদীব। তবে চেয়ে রইল। ওর চাহনি বুঝতে পারছে ফারিহা। তবে মুখে কিছু বলছে না। চা শেষ করে পাশেই ওয়ান টাইম কাপটা ফেলে দিল। বাড়ি ফিরে এসে দেখল বেশ ভীড় জমেছে। ফারিহার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠল। সে ছুটে ঘরের ভেতর এল। ফাহিমা ঠিক আছেন দেখে বুক ভরে শ্বাস নিল। মায়ের পায়ের কাছে বসে ডাকল।
“মা, মা গো।”
ফাহিমা ধীর হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“মা, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
ফাহিমা কথা বললেন না। ওনার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। প্রথমত অসুস্থতা। দ্বিতীয়ত মেয়েটির করুণ অবস্থা। সব মিলিয়ে অসহ্য আন্দোলন চলছে ওনার হৃদয়ে।
“ফারিহা, পেসেন্ট কে নিয়ে আসো।”
হঠাৎ কণ্ঠ পেয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ফারিহার দেহে। দরজার কাছে রিহান দাঁড়িয়ে। ও ওঠে দাঁড়াল।
“রিহান স্যার?”
“আজ, বিকেলে ওনার ফ্লাইট।”
সব কেমন দ্রুত ঘটে গেল। ফারিহা কিছু বলতে চাইল। সেটা বুঝতে পারল রিহান।
“ফোন সুইচ অফ করে রেখেছো। রাত থেকে কল করছি খোঁজ নেই। তাই একেবারে চলে এসেছি।”
এতক্ষণে ভীড়ের কারণ বুঝতে পারল ফারিহা। রিহান এত সময় মরজিনার বাসায় অবস্থান করছিল।
“দ্রুত আসো। সময় নেই।”
ফারিহা সম্মতি জানাল। ফাহিমাকে তৈরি করে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র গুছিয়ে নিল। এসবে সাহায্য করলেন মরজিনা। পুরো সময় জুড়ে যদি কেউ নীরব থেকে থাকে তাহলে সে হচ্ছে আদীব। অদূরে বুকে হাত গুজে দাঁড়ানো পুরুষটি। তার মুখশ্রী কঠিন দেখাচ্ছে। এসবে যে সে খুশি হতে পারছে না তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফারিহা গাড়িতে ওঠার পূর্বে বলল,”খালা। দোয়া করবেন।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে মা। টেনশন করিস না। ফাহিমা, নিজের খেয়াল রাখবে।”
“দোয়া করবেন আপা।”
“সব সময়।”
বিদায় বেলা এসে মরজিনা কেঁদে ফেললেন। ওনাদের সম্পর্ক কতটা গভীর তা চোখের জলেই প্রমাণ হলো। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে আদীব বলল,”ফিরবে তো ফারিহা?”
এ প্রশ্নের জবাব মিলল না। ফারিহা আদীবের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটার দু চোখের যন্ত্রণা, বুকের ভেতর হাহাকার সব কেমন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফারিহা। অথচ সে নির্বিকার।
মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে সমস্ত শপিং শেষ করল ফারিহা। মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু কেনা হলো। চিকিৎসাটা দীর্ঘ মেয়াদী। তিন মাস কিংবা আরো বেশি সময় লাগতে পারে। ফারিহার বুকের ভেতর কেমন করছে। সে ফাহিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“মা, নিজের খেয়াল রেখো। তোমার সাথে যেতে পারব না আমি।”
“তুই নিজের যত্ন নিস মা। আর কল করিস সময় করে। দেখে শুনে চলবি।”
ঠিক তার পরেই রিহানের দিকে চাইলেন তিনি।
“আল্লাহ, ছেলেটার ভালো করুক। তুই কিন্তু নিজের যত্ন নিস।”
“নিব মা।”
মা মেয়ে দুজনেই কথা হারিয়ে ফেলল। অথচ বুকের ভেতর কত কথাই না জমে আছে। কিছু সময় মৌনতায় গত হলেও খানিকবাদে মা মেয়ে ঝরঝরে কেঁদে উঠল।
সব কেমন আলোর গতিতে হয়ে গেল। ফারিহার মা সিঙ্গাপুরে পৌছে গেছেন। মেয়েটি কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। সারা রাত এয়ারপোর্টে বসে ছিল। ওর থেকে একটু দূরে বসে আছে রিহান। মশার ভনভন আওয়াজে মাথা নষ্ট হবার অবস্থা। এরই মধ্যে রুনা কল করলেন। কি যেন আয়োজন করবেন। সেই জন্য ফারিহাকে সাথে নিয়ে আসতে বললেন। রিহান দীঘল নিশ্বাস ফেলল।
“ফারিহা, সকাল হয়েছে। এখন তো ফিরে চলো।”
মেয়েটি নড়ল না। ওর হৃদয়ে কত ব্যথা কেমন করে জানবে এই পুরুষটি?
“ফারিহা।”
এবার এপাশ ফিরল ফারিহা। তার দু চোখ কেমন অন্ধকার।
“রিহান স্যার। আমি সত্যিই এতিম হয়ে গেলাম? মা কে ছাড়া আমি কখনো থাকি নি। কখনোই না।”
ওর ঝরঝরে কান্নার শব্দে চারপাশের মানুষ ঘুরে তাকাল। রিহান একটু অপ্রস্তুত বোধ করছে। তার শক্ত বিশাল হাত মেয়েটির মাথায় স্পর্শ করাল।
“কিচ্ছু হয় নি। আসো, বাড়ি যেতে হবে।”
রাস্তা জুড়ে মেয়েটি কোনো কথাই বলল না। রিহান ও ডাকল না। তবে কিছু সময় পর পর তাকিয়ে দেখছিল। ওরা যখন বাড়ি পৌছাল তখন সূর্য মুখ তুলে তাকিয়েছে। মৃদু রোদ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে রিহানদের বিশাল অট্টালিকার প্রাচীর। সে দিকে তাকিয়ে ফারিহার মন খারাপ হলো। মনে পড়ে গেল মায়ের সাথে তার ছোট্ট সংসার। আরো মনে পড়ল বাবার স্নেহ। ওর বুক ভে ঙে কান্না আসতে চায়। রিহান তাকে ধীর কণ্ঠে ডেকে নেয়।
“একি,মেয়ের চোখ মুখ এমন কেন দেখাচ্ছে?”
ফারিহার দিকে এগিয়ে এলেন রুনা। ভদ্রমহিলা চট করেই ওর মন খারাপ ধরে ফেলেছেন।
“কি হয়েছে মা?”
ফারিহাকে নিরুত্তর দেখে রিহান নিজ থেকেই বলল,”খাবার খায় না ঠিক মতো। এডমিশনের প্রেসার নিচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্ধেক অসুস্থ হয়ে আছে।”
“হায় আল্লাহ!”
রুনার আঁতকে ওঠা গলা। তিনি প্রায় জাপটে ধরলেন ফারিহাকে। ওর হৃদয় কেমন করে ওঠল। রুনার শরীর থেকে আসা মা মা গন্ধটা মস্তিষ্কে ভীষণ প্রভাব ফেলল। থমথমে কণ্ঠে কেঁদে ওঠল ও।
“পাগল মেয়ে। এতটা অযত্ন অবহেলা কেন? নিজের শরীর দেখেছ? এখন থেকে আর কোনো অজুহাত নয়। তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার হোস্টেলে রিহান কথা বলে নিবে।”
“না আন্টি এটা হয় না।”
“কেন হয় না? তুমি এ বাড়ির হবু বউ। তাহলে?”
ফারিহা চুপ করে রইল। রিহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। রুনাই বললেন,”রিহান ওর সমস্ত জিনিস আনার ব্যবস্থা করবে।”
“জি, মম।”
“আন্টি এটা করার দরকার নেই।”
“কোনো কথা নয়। বোসো তুমি।”
রুনা চলে যেতেই ফারিহা বলল,”রিহান স্যার। আমি এখানে থাকতে চাই না।”
রিহান কিছু বলল না। ফারিহা পুনরায় বলল,”আন্টিকে বোঝাবেন প্লিজ?”
এবার ও জবাব মিলল না। রিহান নিজের ঘরে চলে এল। তার খুব একটা ভালো লাগছে না। ফারিহার সাথে সম্পর্কটা যত কম আগাবে ভবিষ্যৎ এর জন্য ততই মঙ্গল। কিন্তু রুনাকে এ বিষয়ে বলেও কি লাভ হবে? আর বলবেই বা কি? পরিস্থিতি এমন যে এক পা আগাতে গেলে দু পা পিছিয়ে যেতে হবে। বেশ কিছু সময় পর রিহানের দরজায় নক পড়ল।
“কে?”
“আমি।”
ফারিহার কণ্ঠ পেয়ে দরজা খুলে দিল রিহান। মেয়েটির চোখ মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
“কিছু হয়েছে?”
“আন্টি নাস্তার জন্য ডাকতে পাঠাল।”
“ও। ভেতরে এসে বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
রুমে প্রবেশ করতেই কেমন একটা সমীরণ অনুভব হলো ফারিহার। রিহানের ঘরে এর আগেও আসা হয়েছে। সে এক পলক দেখে নজর নত করে রইল। রিহান ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,”মম কে বলে লাভ হবে না। এখানে থাকতে পারো। কথা দিচ্ছি প্রবলেম হবে না।”
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি