#শেষ_বিকেলের_মায়া (১৪)
পৃথিবীতে অনেক সত্য রয়েছে। এই সত্যের মধ্যে একটি হলো টাকার জন্য নির্ভরতা। সত্যিকার অর্থে টাকার জন্যেই তো রিহানের সাথে ফারিহার সম্পর্কটা। দুজন দুজনার প্রয়োজন মেটাচ্ছে। ফারিহার মা কে ডিসচার্জ দেওয়া হলো। তাকে বাড়ি নেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। এর মধ্যে রিহান এসে উপস্থিত হয়েছে। শরীরে ক্লান্তি দৃশ্যমান। ফারিহা তার দিকে তাকাল ও না। সে নিজ থেকে প্রশ্ন করল।
“প্রেসেন্টের,অবস্থা কেমন?”
ফারিহা উত্তর দিচ্ছে না। একটু দূরে বসে ছিল আদীব। সে জবাব দিল।
“ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। খালার নানান সমস্যা। শরীরের ভেতর কিছু ঠিক নেই।”
অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফারিহার সামনেই পুনরায় কথা গুলো বলল আদীব। রিহান কে জবাব দিতে দেখা গেল না। আদীব ও অবশ্য কিছু মনে করে নি। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল শুধু। এদিকে রিহান ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। ফারিহাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। মায়ের চিন্তায় সে পাগল প্রায়।
“ফারিহা। খালা কে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে।”
নিরুত্তর ফারিহা। আসলে সে শুনতে পাচ্ছে না। তার দুটি চোখে মায়ের জন্য চিন্তা। যে মা তার একমাত্র দুনিয়া।
“ফারিহা।”
শরীরে ইষৎ ঝাকুনি দিল আদীব। এতে কিছুটা ধ্যান ফিরে পেল মেয়েটি। শুকিয়ে যাওয়া মুখ। কোটরাগত চোখ। সব কেমন যেন বুকে এসে লাগে। আদীব আদুরে হাতে মাথায় স্পর্শ করাল।
“উঠো। এভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট হচ্ছে।”
সমাপ্তিতে নিজেই উঠিয়ে নিল আদীব। পাতলা গড়নের মেয়েটি যেন আরো বেশি রোগা হয়ে গেছে। আদীব পূর্ণ নজরে তাকাল একবার।
“আয়নায় দেখো নিজেকে? কতটা পরিবর্তন এসেছে। সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলবে কি?”
ফারিহা কিছু বলল না। আদীব বেশ কিছু উপদেশ দিল। পাশেই ছিল রিহান। প্রতিটা কথা তার কানে প্রবেশ করল।
রিহানকে পাশ কাটিয়ে বিল দিতে গেল ফারিহা। রিহান একটু অবাক হয়ে বলল,”আমি দিচ্ছিলাম তো।”
মেয়েটি তখনো কিছু বলল না। ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত হচ্ছে রিহান। বিল মিটিয়ে দিয়ে ফারিহা বলল,”আপনার দেওয়া টাকা গুলোর মধ্যে এখনো বেশ কিছু টাকা রয়েছে রিহান স্যার। আপনাকে ফোন করেছি টাকার জন্য নয়। আমার মায়ের অবস্থা দেখানোর জন্য।”
রিহান বোধহয় লজ্জিত বোধ করল। যদিও এত শত ভাবে নি সে কিংবা ফারিহার সাথে তার টাকার সম্পর্ক। তবু একটা দায়িত্ব কাজ করছে। রিহান বাক্য না বাড়িয়ে ডাক্তারের সাথে পুনরায় আলোচনায় বসল। এ সময়টায় ফারিহা চুপ করে বসে রইল। তার দেহটা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
ফাহিমা কে বাসায় পাঠানো হয়েছে। রিহান ও চলে গিয়েছে। শুধু রয়েছে ফারিহা। সে ঔষধ কেনার জন্য ফার্মেসীতে এসেছিল। এরই মধ্যে সুন্দরী এক মেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। পরনের পোশাক বলে দিচ্ছে মেয়েটা বিলাসিতা কতটা পছন্দ করে। তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল ওমন সময় সুন্দরী যুবতীর ডাক পেল।
“ফারিহা আফরোজ?”
নিজের নামটি শুনতে পেয়ে অবাক ই হলো সে। যুবতী এগিয়ে এল। তাকে অবলেকন করল বোধহয়।
“তোমাকেই বলছি।”
“জি?”
আশে পাশে মানুষ আছে বিধায় একটু দূরে এল ওরা। ফারিহা তার ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,”আপনি কি আমাকে চিনেন?”
মেয়েটি হাসল। যেই হাসিতে শত পুরুষ ঘায়েল হতে পারে।
“চিনি বলেই তো ডেকেছি।”
ফারিহা কথা বলল না। সে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না।
“আমি কিয়া। রিহানের গার্লফ্রেন্ড।”
এবার যেন ধ্যান ফিরে পেল ফারিহা। রিহান তাকে শুরুতেই কিয়ার ছবি দেখিয়েছিল। দুশ্চিন্তায় সব ভুলে বসেছে।
“জি।”
“অল্পতেই কথা বলব। তোমার মা সম্ভবত অসুস্থ।”
“হ্যাঁ। তাকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে।”
“দেখেছি। আচ্ছা, চা কফি কিছু নাও?”
“এসবের প্রয়োজন নেই।”
“ঠিক আছে। তাহলে শুরু করছি। রিহানের সাথে তোমার একটা ডিল হয়েছে রাইট?”
“হ্যাঁ।”
“সেই ডিল অনুযায়ী একটা বছর তোমরা এক সাথে থাকবে। অর্থাৎ রিহানকে সঙ্গ দিবে তুমি।”
ফারিহা মৌন রইল। কিয়া হেসে বলল,”তুমি কি অন্যমনস্ক আছ?”
“না। শুনছি, আপনি বলুন।”
“আচ্ছা। দেখো একটা বছর একে অপরের সঙ্গে থাকা মানে অনেক বিশাল ব্যাপার। বাট তোমাদের সম্পর্কটা চুক্তির। আবার প্রেমে পড়ে যেও না।”
শেষ কথাটা বলে হেসে উঠল কিয়া। যেন খুব মজা পেয়েছে। ফারিহা অবশ্য কথা বলছে না। সে চুপ ই আছে।
“তুমি কি রাগ করলে?”
“না। রাগ করি নি। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া রিহান স্যার আপনাকে খুব ভালোবাসে। সে কখনো অন্য কারো প্রতি আসক্ত হবে না। যত সুন্দরীই হোক না কেন।”
ফারিহার কথাটা পছন্দ হলো কিয়ার। তার অধর কোণে যেন সর্বদাই হাসি মাখা। তারপর ও হতাশা মিশ্রিত বাক্য বলল সে।
“জানি। আমি আসলে কিছু সমস্যায় রয়েছি। একটা বছরের মধ্যে আই হোপ সব ঠিক করে দিব। এর জন্যেই রিহানের এত প্রেসার যাচ্ছে।”
তারপর পর ই ঘড়ির দিকে তাকাল কিয়া। সে দেখল, রাত প্রায় বারোটা।
“তোমার লেট করে দিলাম।”
“সমস্যা নেই। আমি তাহলে আসছি।”
“তোমাকে ড্রপ করে দেই?”
“একাই যেতে পারব। আপনাকে ধন্যবাদ।”
ফারিহা চলে গেল। কিয়া সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলল। ফারিহা সুন্দরী হলেও ভদ্র গোছের মেয়ে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই টুকু নিশ্চিত মেয়েটি লোভী নয়। নেহাত ই পরিস্থিতির শিকার।
কিয়া একটু রাগ করেছে। সেটা বুঝতে পারল রিহান। সে বলল,”সরি। তোমাকে সময় দিতে পারলাম না।”
কিয়া এ বিষয়ে কিছু বলল না। রিহান জবাবের অপেক্ষা না করে পুনরা বলল,”শুনছ তুমি?”
“হুম।”
“রেগে আছ?”
“না। রাগ করি নি। তবে, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
“হসপিটালে।”
“সেখানে, কেন?”
“ফারিহার মা অসুস্থ। তাই যেতে হলো।”
রিহান মিথ্যে না বলায় কিয়া খুশি হলো। ছেলেটা তাকে বড়ো বেশি ভালোবাসে। কিয়া কেন,পৃথিবীর কোনো বুদ্ধিমতী নারী রিহানের মতো পুরুষকে হারাতে চাইবে না। কিয়ার ভেতর থেকে খুব খারাপ লাগা কাজ করছে। বেশ কিছু মাস ধরে দুজনের সম্পর্ক কেমন যেন হয়ে গেল। অথচ শুরুর দিকে কত টা সুখী ছিল তারা।
“কিয়া,শুনছ আমার কথা?”
“হুম।”
“কিছু হয়েছে?”
“উহু।”
“তাহলে?”
“তোমার থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করছে না রিহান।”
“সেই জন্যেই বললাম জবটা ছেড়ে দিতে। তুমি শুনলে না। আমি ক্ষতি পূরণ দিতেও প্রস্তুত কিয়া।”
“আর তো কিছু সময়। কেটে যাবে রিহান। কি দরকার কথার খেলাপ করার? এমনিতেও আমরা কানাডায় সেটেল হতে পারব না। আন্টি আঙ্কেল নিশ্চয়ই দেশ ছাড়বেন না?”
রিহান চুপ করে রইল। কিয়ার কণ্ঠটা তেজহীন হয়ে আছে।
“রিহান। আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?”
“এমন কেন বলছো?”
“জানি না। আমার হুট করেই খারাপ লাগা কাজ করছে।”
“তুমি ঠিক আছ তো?”
“হুম।”
দুজনেই আবার চুপ। একে অপরের এক একটা নিশ্বাস যেন শুনতে পাচ্ছে তারা। ঘড়ির কাটা প্রায় শেষ প্রহরে এসে ঠেকেছে।
“ঘুমাও রিহান,ঘুমাও। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে।”
“তোমাকে মিস করছি। এতটা কাছে থেকেও আমরা কত দূরে আছি কিয়া।”
“সকালের নাস্তাটা এক সাথে করবে প্লিজ?”
রিহান যেন এমনটাই চাইছিল। তার ভেতরটা তপ্ত হয়ে আছে। কিয়ার দেওয়া অফারটা লুফে নিল সে। তারপর ই বলল,”তৈরি থেকো। শহরের বেস্ট জায়গায় নিয়ে যাব তোমায়।”
এদিকে ঘুমহীন ফারিহা। আকাশে বিশাল এক চাঁদ। হালকা শীতল বাতাসে উড়ছে তার চুল। রুপার থালা মতো চাঁদটা যেন এক চিলতে সুখ। অথচ ফারিহার দু চোখে নোনা জল। যে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। নিজ জীবন নিয়ে বড়ো আফসোস হচ্ছে তার। কেন এমন হলো তার জীবন? এই টুকু বয়সে এত দায়িত্ব কেন তার মস্তিষ্ক জুড়ে? আজানের কিছু পূর্বে আদীব কে বাইরে দেখা গেল। ছেলেটা সমস্ত রাত নির্ঘুম ছিল। ফারিহা চোখ মুছে ডাকল।
“আদীব ভাইয়া।”
গুমোট পরিবেশে সে ডাক যেন আদীবের সমস্ত শরীরে দোলা দিয়ে গেল। সে চট করেই ঘুরে তাকাল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল মেয়েটি। মাথায় তার ঘোমটা টানা।
“ঘুমাও নি?”
“না।”
“একটা সাহায্য করবেন প্লিজ?”
“সাহায্য! হ্যাঁ বলো?”
“আমাকে একটু লেকের পাড়ে নিয়ে যাবেন?”
কি কেন কিছুই জিজ্ঞাসা করল না আদীব। আকাশ কিছুটা সাদা হতে শুরু করেছে। মিহি বাতাসে চলছে তারা। ফারিহার ঘোমটা টানা মুখ যেন বুকের ভেতরটা শীতল করে তুলেছে। এই যে মেয়েটির প্রতি তার ভালো লাগা, ভালো বাসার এক অনুভূতি। কখনো কি রূপ নিবে দারুণ কোনো সম্পর্কে?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
|