#শেষ_বিকেলের_মায়া (১২)
একটা অসুস্থ মানুষ এত দ্রুত চাঙ্গা হতে পারে তা রিহানকে না দেখলে আসলেই বুঝত না ফারিহা। ছেলেটা যখন থেকে কিয়ার সাথে কথা বলেছে ঠিক তখন থেকেই যেন সুস্থ হয়ে উঠেছে। গাড়িতে বসে এসব ই ভাবছিল সে। রিহান তাকে দিতে এসেছে। ছোট রাস্তাটার কাছে এসে গাড়ি থামাল। তারপর বলল,”আর তো যাওয়া যাচ্ছে না।”
কণ্ঠ পেয়ে চকিত হলো মেয়েটি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”এই অবধিই ঠিক আছে। আপনাকে ধন্যবাদ। নিজের যত্ন নিবেন।”
রিহান জবাবে কিছু বলল না। বরং লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে নিজের চুল গোছাতে লাগল। ফারিহা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নেমে এল। কয়েক সেকেন্ড পর নেমে এল রিহান ও। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝল বড়ো বড়ো বিল্ডিং নেই। হাতে গোনা কিছু দালান রয়েছে সেগুলো ও দুই কি তিন তলা। রিহানের থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্য ফারিহা বলল,”আজ তাহলে আসি স্যার।”
“হুম। আচ্ছা শোনো, এ এলাকায় কত দিন আছ?”
“খুব বেশি সময় নয়।”
“এর আগে কোথায় ছিলে?”
“গ্রামে।”
“স্কুল সেখানেই শেষ করেছ?”
“হ্যাঁ।”
“হুট করে শহরে এলে যে?”
“বাবা মা রা যাওয়ার পর দাদা বাড়িতে ঠাই হয় নি। বের করে দিয়েছে। এদিকে মায়ের অসুখ ধরা পড়ল। সব মিলিয়ে এই তো চলছে জীবন।”
অসুখের কথাটা বলতেই রিহানের যেন কিছু মনে পড়ল। সে ভুলে বসেছিল।
“গুড নিউজ আছে। তোমার মায়ের ভিসা হয়ে গেছে। আমি ডাক্তার ঠিক করে টিকিটের ব্যবস্থা করছি।”
রিহান বললেও ফারিহার যেন ধ্যান নেই। ওর মনোযোগ পেতে হাতের আঙুল দ্বারা তুড়ি বাজাল রিহান।
“জি স্যার?”
“বাসায় যাও। আমাকেও ফিরতে হবে।”
অন্যদিন গুলোর থেকে রিহান যেন একটু বেশিই খুশি আজ। ফারিহা পথ এগোল। তার শরীর ইষৎ দুলছে। রাতে ঘুম হয় নি। এদিকে মস্তিষ্কে রাজ্যের চিন্তা।
মোড়ের কাছাকাছি আসতেই আদীব যোগ দিল সাথে। ওকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো ফারিহা। সেই সাথে কপালের রেখা গুলো জেগে উঠল।
“আদীব ভাইয়া, এ সময়ে এখানে কেন?”
“এমনিই এসেছিলাম। গত রাতে বাসায় ছিলে না?”
এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে থতমত খেল ফারিহা। তার শ্বাস বেড়ে হলো কয়েক গুণ। ওমন সময় হাতে থাকা মুঠো ফোন বেজে উঠল। সেখানে ভাসছে রিহানের নাম। সেদিকে তাকাল আদীব। ফারিহা যেন লুকোচুরি করছে।
“কল এসেছে।”
ধ্যান ফেরার মতো করে চাইল ফারিহা। ঠোঁটের কোণে ইষৎ হাসি রাঙিয়ে বলল,”জি।”
রিহান ওপাশ থেকে বলল,”ব্যাগ ফেলে গিয়েছ।”
“ও। পরে নিয়ে নিব না হয়।”
“দরকার নেই। আমি এসে গেছি। তুমি রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে যাও।”
রিহানকে নিষেধ করতে গিয়েও থেমে গেল ফারিহা। একটা আড়ষ্টতা বোধ থেকে রিহানের বিপরীতে কথা বলতে পারল না। আদীব পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো চুপচাপ। ফারিহা বড়ো সড়কের দিকটায় তাকাল। বেশ কিছু দূরে হলেও রিহানকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। লম্বা, চওড়া গড়নের সুঠাম পুরুষ। শরীরে আজ ব্লেজার জড়ানো নেই। বাসায় পরার টি শার্ট আর টাউজার পরেই এসেছে। রিহান যতক্ষণে এল ততক্ষণ এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইল ফারিহা। রিহান এসে যেন দম ফেলল।
“এই নাও। এত ভুলো মন….”
কথাটা শেষ করার পূর্বেই পাশে দাঁড়ানো আদীবকে লক্ষ্য করল রিহান। ছেলেটার উপস্থিতি বোধহয় পছন্দ হলো না ওর। ফারিহা ছোট করে বলল”থ্যাংক ইউ।”
সমাপ্তিতেই এগুতে পারল না ফারিহা। রিহান ওকে পুনরায় ডেকে নিল।
“বাসায় পৌছে কল করবে।”
“ঠিক আছে।”
ফারিহা যেন পালিয়ে বাঁচল। আশ্চর্য হলেও সত্য রিহান আর আদীব দুটো জ্যান্ত মানুষ একে অপরকে দেখার পর ও কথা বলল না। রিহান আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে আদীব আর ফারিহা পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। দৃশ্যটিতে অসুন্দরের মতো কিছু নেই। অথচ রিহানের দৃষ্টিতে বড়ো বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।
বাসায় ফিরে মা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফারিহা। ভুলে গেল রিহানের বলা শেষ কথা টুকু। সে খাবার রান্না করতে যাবে সে সময়েই ঘরে উপস্থিত হলেন মরজিনা। থালা ভরাট করা খাবার। নিশ্চয়ই আদীব গিয়ে বলেছে।
“এসবের প্রয়োজন ছিল না খালা।”
“জিরিয়ে নে মা। ঘেমে গিয়েছিস।”
“ফ্যানটা ঠিক ঠাক কাজ করছে না খালা। বদলাতে হবে।”
“আদীব কে বলে দিব।”
খাবারের প্লেট রেখে হাত মুখ ধুতে গেল ফারিহা। খাটে শুয়ে আছেন ফাহিমা। মরজিনা ওনার পাশে বসে বললেন,”হীরার টুকরা মাইয়া পাইছো গো ফাহিমা। তোমার চান যেই ঘরে যাইব সেই ঘর আলোয় আলোকিত হইয়া রইব।”
“দোয়া করবেন আপা।”
“দোয়া তো করি বোন। আসল কথা কি জানো, পরিস্থিতি মানুষরে বদলায় দেয়।”
“ঠিক বলেছেন। না হলে আমার এই টুকু মেয়েটা এত দায়িত্ব নিতে পারে?”
“সব ই ঠিক আছে। তবে মাইয়ার বিয়ে তো দিবা।”
এ চিন্তা যে ফাহিমার মাথায় আসে নি এমন না। তবে তিনি কুল পাচ্ছেন না। মরজিনা পান সাজিয়ে এনেছিলেন। সেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,”তোমরা মেয়ে তো আমার ও মেয়ে। চাইছিলাম আদীবের জন্য নিতে। তুমি কি বলো?”
প্রস্তাবে খুশি হলেন ফাহিমা। তবে মেয়ের মতামত ও প্রয়োজন। তাই তিনি কথা দিতে পারলেন না। এরই মধ্যে হাত মুখ ধুঁয়ে এল ফারিহা।
“খালা চা বানাই?”
“না। বোস তুই।”
ফারিহা বসল। তারপর তিনজনের কথা বার্তা হলো। এক পর্যায়ে রিহানের কল এল। ফোনের স্ক্রিন দেখেই মেয়েটির হৃদয়ের গতি বেড়ে গেল। সে যে একদমই ভুলে বসেছিল!
রিহান যে ড্রাইভ করছে তা বেশ ভালো বুঝে এল ফারিহার। সে নত সুরে বলল,”বাসায় এসেছি রিহান স্যার।”
“কল কর নি কেন?”
“ভুলে গিয়েছিলাম। মাফ করবেন।”
“সমস্যা নেই। তবে একটা কথা দায়িত্ব জিনিসটা বড়ো গুরুত্বপূর্ণ। তোমার ভুলে যাওয়াটা অবহেলার অংশ।”
“তেমন নয়।”
“তাহলে কেমন?”
“আমি আসলে….”
“তোমার থেকে আট বছরের বড়ো আমি। মিস ফারিহা আফরোজ,একটা কথা মনে রাখবে সব কালচার দেখে এসেছি আমি।”
“সরি।”
আসলেই খারাপ লাগছে ফারিহার। রিহান কিছুটা রেগেছে যেন।
“মাফ করবেন। আমি আসলেই বুঝতে পারি নি।”
কথা না বলেই কল রেখে দিল রিহান। কিয়ার পর ফারিহাই এক মাত্র নারী যাকে কল করতে বলার পর ও তাকে কল করে নি! ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর। চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠেছে। আর এর সব কিছু গিয়ে পড়ল কিয়ার উপর। রাতের দিকে কল করল কিয়া। রিসিভ করেই রিহান বলল,”এতটা অপরিচিত লাগছে কেন তোমায়?”
“অপরিচিত? রিহান, আর ইউ ওকে?”
“আমি ঠিক আছি। তবে তুমি ঠিক নেই কিয়া।”
“কি হলো আবার? সকালে তো সব ঠিক ছিল।”
“কিচ্ছু ঠিক নেই কিয়া। তুমি দূরে আছ। আমার মনে হচ্ছে তুমি বদলে গেছ। আমাদের সম্পর্কের যত্ন হারিয়ে গেছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না কিয়া। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।”
ওপাশ থেকে মৃদু হেসে কিয়া বলল,”তুমি কি সম্পর্কটা শেষ করতে চাইছ?”
রিহান জবাব দিল না। কিয়াই বলল,”আনসার মি রিহান। প্লিজ সে সামথিং।”
এবার ও জবাব এল না। এত সময় কিয়া শান্ত সুরে কথা বললেও এবার জ্বলে উঠল।
“রিহান আনসার মি। সরাসরি বলো ব্রেক আপ করতে চাচ্ছ।”
এবার ও রিহান জবাব দিল না। ওপাশ থেকে কিয়ার কান্নাভেজা কণ্ঠটা বেজে উঠল।
“আমাকে হারিয়ে দিও না রিহান। তোমায় সত্যিই খুব ভালোবাসি। কথা দিচ্ছি, একটা বছর সময় দেও আমায়। আমি কখনো এত দূরত্ব তৈরি করব না। আই প্রমিস ইউ রিহান। আই প্রমিস ইউ। সব টা ঠিক হয়ে যাবে। সব টা। জাস্ট একটা বছর।”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি