কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব ৮

0
98

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৮

প্রবল প্রণয়ঘোর বিপদসীমা পেরিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে এটাই নিয়ম৷ বৃষ্টির জীবনেও তেমনই এক বর্ষণ ছিল কলেজ জীবনে নাহিয়ান নামে। সে বর্ষণ থেমেছে আজ বছর দুই পেরিয়ে। বৃষ্টি ভুলে গেছে সে সময়গুলো কিংবা খুব একটা মনে পড়ে না নতুন প্রেমের আগমনে। প্রেমই বটে তার জীবনে অর্ণব। সে প্রেমে পড়ে গেছে ওই গম্ভীরমুখো, নীরব, শীতল চরিত্রটার। সৌম্যদর্শন অর্ণব ভাই যেদিন প্রথম খুব কাছে এসেছিল তার বিপদ মুহূর্তে সেদিন থেকেই ভালো লাগার শুরু। তার আগ পর্যন্ত তার জীবনের অসমাপ্ত ভালোবাসার প্রেমিকপুরুষ ছিল একমাত্র নাহিয়ান৷ নিজ ভুলে নাহিয়ান তাকে হারিয়েছে। আজ বছর দুই পর সে ভুল উপলব্ধি করে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু এখন যে বৃষ্টি আর চায় না তাকে! চাওয়ার কথাও না আর৷ কোন মানুষ তার নিজের অপমান সহ্য করে নিতে পারলেও ভালোবাসার অপমানটা কখনোই নিতে পারে না তবে কিছু সাইকোপ্যাথের হিসেব আলাদা। বৃষ্টি অন্তত সে পথের পথিক নয়। আজ ভার্সিটিতে আসার পরই আকষ্মিক ঝড়ের মত উপস্থিত হয় নাহিয়ান৷ আটাশ বছরের তাগড়া ব্যাংকার যুবক দারুণ ভাব নিয়েই সামনে এসেছিল তার। মিনিট কয়েক সময় নিয়ে বৃষ্টি তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করেছিল যেন মানুষ নয় কোন পন্য দেখছে সে৷ তার মুখের ভাব ছিল, এত পরিশ্রমে এইটুকুই পরিবর্তন! নাহিয়ান টলেনি পুরনো প্রেমিকার মনোভাবে উল্টো গলা ঝেড়ে কেশেছে সে।

– এভাবে দেখার কিছুই নেই আমি যথেষ্ট পরিমার্জিত রূপে এসেছ বৃষ্টি।

-আসলেই!
মুখ বাঁকিয়ে জবাব দেয় বৃষ্টি।

-একটু কি বসবে কোথায় আমার সাথে?

-প্রয়োজনবোধ করছি না।

-কথা ছিল আমার।

-আমার তো নেই।
কাটকাট সুরে জবাব দেয় বৃষ্টি।

-প্লিজ বৃষ্টি।

-বড়লোক বাপের বেটি আমি আবার না তোমাকে গোলাম টাইপ প্রেমিক বানিয়ে ফেলি ভয় করো নাহিয়ান।

বৃষ্টির এ কথাটা নাহিয়ানেরই এক সময়কার কটাক্ষ। বৃষ্টির খাঁটি ভালোবাসাকে নাহিয়ান তুচ্ছ করেছিল এমন কিছু অপমানজনক কথা বলেই। বৃষ্টির বাবা তাকে এমন কিছুই বলেছিল মেয়ের হয়ে অথচ বৃষ্টি জানতো না সেসব৷ হাজার বলার পরও নাহিয়ান মুখের ওপর বলেছিল, বাবা যেমন মেয়ে তেমন হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আজ থেকে তোমার আমার পথ আলাদা। বৃষ্টি অনেক বুঝিয়েছিল সে জানে না এসব৷ বাবা কি বলেছে কেন বলেছে সেসব বাদ দাও আমি ঠিক করে দেব সব ৷ নাহিয়ান সে কথায় কান দেয়নি পাছে তার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়! বড়লোক বাপের মেয়েকে বিয়ে করা মুশকিল তাই প্রেমের ইতি টেনেছিল।আর তাই বৃষ্টিও কষ্ট পাচ্ছে না আজ বরং মুখের ওপর অপমানের হুল ফুটিয়ে চলে গেল নিজ গন্তব্যে। বাড়ি ফিরে চমক পেল দারুণ। অর্ণব ভাই এসেছে! কই সে তো জানতো না আজ আসবে তিনি। ইশ, আগে জানলে নিশ্চয়ই সে বাড়ি থাকতো।কিছু একটা বানিয়ে খাওয়ানো যেত৷ কিন্তু কি বানাতো! রান্না-বান্নায় একদমই পারদর্শী নয় সে। শখের বশে সেমাই রেঁধেছে মায়ের কাছে জেনে নিয়ে। কিন্তু আজ কি করবে! ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো পাস্তা করা যায়। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় বদলে নিচে এলো সে।অর্ণব তখন বা হাতে চিবুক ছুঁয়ে কিছু কাগজপত্রে চোখ বুলাচ্ছে। অর্নি এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি এদিকে লান্চ টাইম বলে অর্ণব সময় নিয়ে খালার বাড়ি এসেছে।কাগজপত্র নিয়েই কিছু আলাপ ছিল খালুর সাথে।মাথার ওপর বড় বট ছায়া এখন খালুই আছেন বিশ্বাসযোগ্য। বাকিরা তো সবাই ওঁৎ পেতে আছে হায়েনার মত৷ কখন সুযোগ পাবে আর তাকে খুবলে খাবে। ভয়টা তার নিজের জন্য একটুও নেই কিন্তু বোনটাকে নিয়ে বেজায় টেনশন। হাতের কাগজপত্র টি টেবিলটায় ছড়িয়ে নিতেই খালু ফিরলেন বাড়ি। সকাল থেকে রিদওয়ান নেই বাড়িতে খালুর সাথে রিমনই আছে। আজ লাঞ্চ বাড়ি করবেন বলেই কিনা অর্ণবকে ডাকা। মিনিট দশেক পার হতেই খালু সাহেব এসে উপস্থিত হলেন অর্ণবের সামনে। কাগজ সংক্রান্ত কথাবার্তায় জানতে পারলেন গত রাতে অর্ণবকে অনুসরণকারীর কথা৷ খালু বুদ্ধিমান, চতুর আর অভিজ্ঞ মানুষ। বেশি সময় নিলেন না ঘটনা বুঝতে।

– তুমি যেটা বলছো তা বিপদের কথা। বাপ-দাদার সম্পত্তিতে বাপ-চাচারাই শত্রু হয়৷ তোমার চলাফেরায় সতর্ক থাকতে হবে।

-বুঝলাম না খালু।

-তুমি বলছো তোমার ছোট দাদার সম্পত্তির মালিক তোমার ছোট দাদী। আর ছোট দাদী নিঃসন্তান৷ তার দেখভাল চলছে তোমার কাছে। মানে বিগত চৌদ্দ পনেরো বছর ধরে সে তোমার সাথেই আছেন এমনকি সুখে আছেন৷ তাই আন্দাজ করা যায় ভদ্রমহিলা তার সম্পদের ভাগ তুমি ছাড়া কাউকে দেবেন না। আর তোমার বড় দাদার ছেলেপুলেতে ভরা ঘর। তাদের যতোই সম্পদ থাক নজরটা বেশ ছোট দাদার সম্পদেও রাখছে। হতে পারে তারা তোমার ক্ষতি করে সবটা নিতে চেষ্টা করবে। আমি যতদূর জানি তোমার বড় চাচা মানে আনিস সাহেব ধূর্ত লোক। হতে পারে সে তোমাকেই পথ থেকে সরিয়ে দিতে……. খালু সাহেব থেমে গেলেন এক মুহূর্তেই। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে সোফার সামনে।

-আব্বু লাঞ্চ করবে না! টেবিলে খাবার দিয়েছে।

-আসছি মা তুমি যাও বসো।

বৃষ্টি একবার তাকালো অর্ণব ভাইয়ের দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করলো অর্ণব ভাইও একটু তাকাক। তার জন্যই তো এখন গোসল সেরে দারুণ একটা স্কার্ট পরেছে। চোখের কোলে কাজল আর ঠোঁট রাঙিয়েছে হালকা রঙের লিপস্টিকে। কিন্তু মানুষটার তো নজরই নেই তাকে দেখার মত। বৃষ্টির মন চঞ্চল হলো, সে উসখুস করলো নিজেকে একটু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অথচ অর্ণব ফিরেও তাকাচ্ছে না৷ এদিক বাশার সাহেব টের পেয়ে গেলেন মেয়ের মনোভাব তাইতো তিনি লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-চলো অর্ণব খাবার খাই। ভয় পেয়ো না শুধু একটু সাবধান থেকো তবেই হবে।

কথাটা বলেই বাশার সাহেব প্রস্থান করলেন অর্ণব বসে রইলো আগের মতই। আর বৃষ্টি দাঁড়িয়ে রইলো মেঘাচ্ছন্ন চক্ষু নিয়ে।

______________

– শোন অর্নি আমি যা বুঝি তুই তা বুঝিস না।

-তাই নাকি!
আইসক্রিম কোণে জিভ ঠেঁকিয়ে নরম শীতল পরশ নেয় অর্নি।

-তবে আর বলছি কি? ওই শিবলী ভাই বয়সে বড় শুধু তা নয় স্বভাবেও খাইষ্টাই হবে ।
অভিজ্ঞ ব্যক্তির মত করে বলে নুপুর।

-তুই কি করে বুঝলি?

-সিম্পল একটা ব্যাপার৷ যে ছেলের অনেক বছর ধরেই কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সে ছেলে সুযোগ পেয়েও একটু কথা বলতে চায় না৷ এমনকি ফোন নম্বরটা পর্যন্ত নেয় না সেই ছেলেতে ঘাপলা আছেই আছে। দ্যাখ অর্নি তুই আমার একমাত্র বান্ধবী তোর জীবন নিয়ে হেলাফেলা আমি একদম সহ্য করব না বলে দিলাম।

-তাহলে কি করবি?
অর্নির ছোট্ট প্রশ্ন।

-যা একজন সচেতন বান্ধবীর করা উচিত। ওই শিবলীর নারী-নক্ষত্র জানব এবং অবশ্যই ঘাপলা পেলে নাক ভেঙে দিয়ে আসব।

-থাক তোর কিছু করতে হবে না। কোন ত্রুটি পেলে আমার ভাই নিজেই দেখে নেবে৷

দু বান্ধবীতে কথার পর্ব চলল অর্নির রিকশা পাওয়ার আগ পর্যন্ত। অর্নি রিকশায় চড়তেই নুপুরও স্কুটিতে বসল৷ প্র্যাকটিকেলের খাতার পেছনে আজ অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে বলে দুপুরে খাওয়ার সুযোগ হলো না নুপুরের। কিংবা আজকেই যেন পেটের খিদে মোচড় দিচ্ছে খুব করে৷ দুপুর এখন আড়াইটার বেশি স্টুডেন্ট এর বাড়িতে থাকতে হবে তিনটেয়৷ ভেবে দেখলো তার পৌঁছুতে সময় লাগবে পনেরো মিনিট মানে হাতে এক্সট্রা পনেরো মিনিট আছে৷ ক্ষুধা নিবারণ জরুরি হয়ে পড়ায় স্কুটি থামালো রাস্তার পাশে এক টঙ দোকানের সামনে। ইচ্ছে তো হচ্ছে ভারী কিছু খাওয়ার কিন্তু এমন করে রোজ রোজ বাইরে খেলে টাকা জমাবে কেমন করে! মনের ক্ষিদে বাদ দিয়ে আপাতত পেটের খিদে মেটাতে একটা পাউরুটি, কলা কিনলো নুপুর৷ ব্যাগে পট ভর্তি পানি আছে তাই পানির টাকা বেচে গেল। স্কুটিতে বসেই দু চার কামড়ে অর্ধেক রুটি আর কলাটা শেষ করে গন্তব্যে রওনা হলো সে। দুটো টিউশন শেষে বাড়ি ফিরতেই চমক পেল নুপুর বসার ঘরে মেহমান দেখে। কপাল কুঁচকে উপস্থিত প্রত্যেকটা মুখ দেখার পর বুঝতে পারল এগুলো সব ছোট মায়ের আত্মীয় স্বজন৷ ছোট মাও নুপুরকে দেখে এগিয়ে এলেন সামনে। মুখে তার জ্বলজ্বলে এক নকল হাসি।

-আসো মামনি সালাম দাও সবাইকে।

নুপুর সালাম দিলেও ভদ্রতা দেখানোর কোন আগ্রহ দেখালো না মেহমানদের সামনে। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে চাইলে জাকির ডাকল, আরেহ নুপুর কই যাও৷ মেহমানের সামনে আসো তোমারে একটু দেখব ওরা।

-আমাকে দেখার কি আছে?
নুপুর মুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন ছুড়তেই একজন মহিলা বলে উঠলো, তোমাকেই দেখব মা আমার ছেলের জন্য।

– বুঝলাম না।

-নুপুর তুমি ঘরে গিয়া জামা বদলাইয়া একটু সাজো আমি বলতেছি সব।

-বাবা কই?

-নিজের কাজে আছে তুমি যাও।

ছোট মা তাড়া দিয়েই নুপুরকে ভেতরে পাঠালেন৷ এই মেয়ে জন্মের ঘাড়ত্যাড়া একে কাঁধ থেকে নামানো মুশকিল সে কথা ভেবেই ছোট মার ঘাম ছোটে। নুপুর নিজের ঘরে ঢুকে পোশাক বদলে নেয় তবে ঘর থেকে আর বের হয় না। রাতে বাবা এলে কিছু একটা ঝামেলা সে পাকাবেই আজ। এ বাড়িতে সে ছোট মায়ের কিংবা ভাইয়ের ভাগের অন্ন গিলছে না তবে কেন ছোট মায়ের এত তাড়া তাকে বিদায় করার! নুপুর চুপ থাকার মেয়ে নয় সে। আজ বাবা বাড়ি এলেই একটা ঝামেলা পাকাবে বলে ঠিক করে নিলো। সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে মেহমান বাড়ি ছাড়লে নুপুর ঘর থেকে বের হলো। পেট আজকাল খাওয়ার পরিমাণ হুট করেই যেন দ্বিগুণ করেছে তার। আগে ছিল রোগা-পাতলা খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম আর এখন তার পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন মূলত মন থেকেই তৈরি৷ মন চায় নিজেকে সুন্দরী, সুহাসিনী তৈরি করতে সেজন্যই সবটা বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অবচেতন মন অপেক্ষা করে নিজেকে সুন্দর দেখার, অন্য একটা মানুষের চোখে সুন্দর দেখার। গায়ের রঙ বদলে নিতে ইচ্ছে করে নুপুরের খুব বেশিই আজকাল। বারংবার মনে হয় ওই মানুষটা অনেক সুন্দর, মানুষটার গায়ের রঙও সুন্দর৷ তার পাশে দাঁড়াতে গেলে নুপুরকে লাগবে আকাশ জুড়ে এক টুকরা কালো মেঘ৷ ছিহ! কি ভাবছে সে? লজ্জা লাগলো ভীষণ সে অর্নির ভাইকে এত গভীরে কেন ভাবছে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here