নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ২৬

0
138

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট নাবিহাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢোকেন মিসেস ইতি ইসলাম। এসেই প্রথমে ইভানকে জিজ্ঞেস করেন,

“আমার মেয়ে কেমন আছে ইভান? সত্যি করে বলো আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো?”

ইভান নাবিহাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

“শান্তি হন আন্টি। সিরাতের কিচ্ছু হবে না। ও ঠিক হয়ে যাবে।”

“আর মাওয়া? মাওয়া ঠিক আছে তো? মেয়েটা সিরাতের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখল। ওর কিছু হলে আমরা কখনো নিজেদের মাফ করতে পারব না। ওর বাবা-মাকে খবর দিয়েছ তোমরা?”

“মাওয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। ওর বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়েছে।”

ইতি ইসলাম একটা চেয়ারের উপর বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সিরাতের বাবা মেয়ে আর তার বান্ধবীর এমন অবস্থার খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মালিহা আর তুবা মামার কাছে রয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাওয়ার বাবা-মা চলে আসে। ইতি ইসলামের পাশে বসে মাওয়ার মা মিসেস রেনু মন্ডল বলেন,

“আপা আমাদের মেয়েরা ঠিক হয়ে যাবে তো?”

ইতি ইসলাম কিছু বলতে পারেন না। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রয় অসহায়ের মতো।

মাওয়ার বাবা অভির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,

“সব সময় বাহাদুরি দেখাতে যাও হ্যা? আজ তোমাদের জন্য আমার মেয়ের এই অবস্থা। পুলিশ ছিল না? সিরাতকে তো পুলিশ উদ্ধার করতে পারত। তোমরা কেন এসব করতে গেলে? তোমরা গিয়েছ ভালো কথা। আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছ কেন? ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোমাদের কাউকে ছেড়ে দিব না বলে দিলাম।”

পাশ থেকে তারিন বলে,

“আংকেল আপনি একটু শান্ত হন প্লিজ। এখন রাগারাগির সময় নয়। আমরা সবাই বিধ্বস্ত অবস্থায় আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা সবাই ওদের দু’জনকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সিরাতের পরিবারের দিকে একবার তাকান। ওর ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন, মা’কে ছাড়া মেয়েটার কী অবস্থা!”

নাবিহার নিষ্পাপ চাহুনি দেখে মাওয়ার বাবা মিস্টার আরাফাত শিকদার কিছুটা দমে গেলেও রাগ তার কমে না। চেয়ারে বসে মেয়ের চিন্তায় ভাজ পড়ে তার কপালে।

মিনিট বিশেক পর ডাক্তার বের হলে নাবিল দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ডাক্তার সিরাত আর মাওয়া এখন ঠিক আছে তো?”

“মাওয়ার শরীর থেকে অনেক র*ক্ত ঝরেছে। তবে ওকে র*ক্ত দেওয়া হয়েছে। বিপদ কেটে গিয়েছে। আশা করছি আজকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“আর সিরাত?”

“ওর অবস্থা অনেকটাই খারাপ। ডান হাতে অনেক বেশি ব্যথা পেয়েছে। তাছাড়া পুরো শরীরেই অসংখ্য আঘাতের দাগ রয়েছে। ওর সেড়ে উঠতে সময় লাগবে।”

কথাটা শুনে ইতি ইসলাম শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তাকে সামলানোর জন্য রেনু মন্ডল বলেন,

“আপা কাঁদবেন না। আমাদের সিরাত ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সবার দোয়া ওর সাথে আছে। আমার মেয়েটা যখন বেঁচে আছে তখন সিরাতেরও বাঁচতেই হবে। ওদের কিছু হতে পারে না। মায়ের বুক খালি করে ওরা কোত্থাও যেতে পারে না।”

“তাই যেন হয়। বিয়ের পর থেকে আমার চঞ্চল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আগে যদি জানতাম ওই অমানুষ ছেলেটা আমার মেয়েকে এত অত্যাচার করে তাহলে কবেই ওই ন*রক থেকে ওকে নিয়ে আসতাম আমরা।”

“যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। এখন আল্লাহর কাছে ওদের সুস্থতা কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না আমরা।”

এক দুর্বিষহ ভোর কাটিয়ে যখন সকালের সূর্যোদয় হয় তখনই যেন সকলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জ্ঞান ফিরে আসে মাওয়ার। প্রথমে মাওয়ার বাবা-মা দেখা করে করে আসে। তারপর সিরাতের মা মাওয়ার কাছে গিয়ে বলেন,

“আমার মেয়ের বন্ধুদের আমি সব সময় নিজের ছেলেমেয়েদের মতো করে দেখেছি। কিন্তু তুমি আজ যা করলে মা সেই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”

পেটের ব্যথায় বারংবার আর্তনাদ করে ওঠা সত্ত্বেও মাওয়া বলে,

“এভাবে বলবেন না আন্টি। ছোট থেকে আমাদের সবার বিপদে সিরাত সবার আগে এগিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটাকে নিজের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে কীভাবে দেখি বলুন তো? সিরাত যে আমাদের বন্ধুমহলের প্রাণ। আচ্ছা ও ঠিক আছে তো?”

“এখনো মেয়েটার জ্ঞান ফেরেনি।”

“সে কি! বিপদ কাটেনি?”

দরজা ঠেলে অভি ভেতরে এসে বলে,

“বিপদ কেটে গিয়েছে। তবে অনেক আঘাত করা হয়েছে তো। তাই জ্ঞান ফিরতে সময় লাগছে। তুই চিন্তা করিস না।”

মাওয়া মন খারাপ করে বলে,

“ওর সাথে যারা এমন করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। এই অভি, মাহতাব আর তুরাগকে হাসপাতালে আনা হয়েছে?”

“হুম ইভান নিজ দায়িত্বে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করেছে।”

“বেঁচে আছে তো?”

“কই মাছের প্রাণ ওদের। বাঁচবে না আবার?”

অথৈ এর কথায় মাওয়া হালকা হেসে বলে,

“কোথায় আছে এখন ওরা? ওদের সাবধানে রাখবি যেন পালাতে না পারে।”

“নাবিল আর ফারহান ওদের সাথে আছে। সব ঘটনা শুনে ফারহান ভোরেই চলে এসেছে।”

“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এখন তুই বিশ্রাম নে। অসুস্থ শরীরে এত কথা বলা ঠিক না।”

“হ্যা মা তুমি এখন বিশ্রাম নাও। আমরা বাইরেই আছি। কিছু লাগলে ডাক দিয়ো।”

কথাটা বলে মিসেস ইতি ইসলাম বাকিদের নিয়ে চলে যায়। অভি বাইরে যেতে চাইলে মাওয়া পেছন থেকে ডেকে বলে,

“অভি একটু আমার কাছে আয়।”

অভি কাছে গেলে মাওয়া ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“কেঁদেছিস মনে হচ্ছে। আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছিলি বুঝি?”

অভিমানের সুরে অভি উত্তর দেয়,

“আমি কাঁদলে তোর কী? তুই তো আর আমাকে ভালোবাসিস না।”

প্রতিত্তোরে মাওয়া কিছু না বললে অভি এক পলক তাকিয়ে বের হয়ে যেতে চায়। মাওয়া বেশ মজা পায় তার এমন চেহারা দেখে। কিছুক্ষণ থেমে বলে,

“বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে মাওয়া ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। তার ঘরণী হওয়ার জন্য মাওয়া প্রস্তুত!”

মাওয়ার এমন কথা শুনে অভির পা থেমে যায়। অবাক চোখে মাওয়ার দিকে তাকালে সে খেয়াল করে মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি বিরাজমান। এই হাসিটা যে সত্যিকারের হাসি তা বুঝতে একটুও দেরি হয় না অভির। সে কিছু না বলে মুচকি হেসে বের হয়ে যায়।

“যাহ্! চলে গেল ছেলেটা। আমি যে আমার মনের কথা বললাম তার উত্তর না দিয়েই চলে গেল। ফাজিল ছেলে একটা হুহ।”

মাওয়ার জ্ঞান ফেরার আনন্দে সবার চোখমুখ উজ্জ্বল হলেও সিরাতের চিন্তায় উজ্জ্বল মুখগুলো কালো আঁধারে ছেয়ে যায়। মেয়েটার এখনো কেন জ্ঞান ফিরছে না এই ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সবাই।

হাসপাতালের করিডরে ইভানকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় তামান্না।

“কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না? তোর কী একবারও মনে হয় না এসব কিছুর জন্য কোথাও না কোথাও তুই দ্বায়ী?”

তামান্নার কথায় ইভান অসহায় কণ্ঠে বলে,

“আমি দ্বায়ী?”

“হ্যা, তুই দ্বায়ী৷ রাত কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা তো আমাদের কারোর অজানা নয়। তুই একাই যে রাতকে ভালোবেসেছিস তা তো নয়। রাতও তো তোকে ভালোবেসেছিল। তোর সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। যেদিন তুই ওকে ভালোবাসার কথা বললি সেদিন রাত বলেছিল ওকে বিয়ে করতে। রাত বিয়ের আগে প্রেম, ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না। তুই ওকে কথা দিয়েছিলি যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের জীবনসঙ্গী বানাবি। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং তোর বাবা আর তোর দাদুবাড়ির সবাই ওকে অপমান করেছিল। তুই নিশ্চয়ই সেইসব ভুলে যাসনি? সেদিন যদি তুই প্রতিবাদ করে রাতের হাত শক্ত করে ধরতিস তাহলে আজ এসব হয়তো হতো না। ওর জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।”

“আমি নিরুপায় ছিলাম তামান্না। চাইলেও ওই মুহূর্তে ওর হাত ধরা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি যদি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে বিয়ে করতাম তাহলে বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিত।”

“সেটাই। বাবার ছেলে হয়েই থাক তুই। রাতকে কাছে পাওয়ার চিন্তা আর কখনো করিস না ইভান। ও যেমন মেয়ে তাতে আমি এটুকু জোর দিয়ে বলতেই পারি যে ও কখনোই আর ফিরে আসবে না তোর কাছে। ওর আত্মসম্মানবোধ আমাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি৷ যে ছেলেটা ওর সম্মান রক্ষা করতে পারে না সে আর ওকে কী ভালো রাখবে!”

তামান্নার শেষ কথাটা শুনে যেন ইভানের বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়। সে কিছু না বলে চুপচাপ চলে যায়। তার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে তামান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,

“কেবল ভালোবাসলেই হয় না। ভালোবাসার মানুষটার সম্মান রক্ষা করা, তাকে আগলে রাখা, তার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা, ভরসার জায়গা হয়ে ওঠা, এই সবকিছু অর্জন করতে হয়। নতুবা নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেও প্রিয় মানুষটাকে আটকে রাখা যায় না। সে পাখি হয়ে উড়ে যায় অন্য খাঁচায় বন্দী হতে। তখন সত্যিকারের ভালোবেসেও আর কোনো লাভ হয় না। দু’জন মানুষ একে-অপরকে ভালোবেসেও চিরজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যায়। হয়তো কেউই সুখী হয় না। কেবল সুখে থাকার চেষ্টা করে। কিংবা সুখে আছি কথাটার উপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন ভালো থাকার অভিনয় করে যায়। তাই দিন ফুরাবার আগেই ভালোবাসার মানুষটাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের করে নিতে হয়। নয়তো সারাজীবন শুধু আফসোস করতে হয়। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়।”

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here