#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৪
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
টানা ছত্রিশ ঘন্টা একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বন্দী থেকে সিরাত নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার দেহে আর এক ফোঁটা শক্তি নেই নিজ পায়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো। এতগুলো ঘন্টায় এক ফোঁটা পানি সে পায়নি পান করার জন্য। তার তৃষ্ণার্ত চোখগুলো এক ফোঁটা পানির আশায় এখনো বন্ধ হয়নি। বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হয়েছে কেবল একটুখানি পানি পান করার জন্য। চক্ষুদ্বয় যেন এবার তাকিয়ে থাকার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। ধীরে ধীরে সিরাতের নিস্তেজ শরীরটা নুইয়ে পড়ে। যেন এক লজ্জাবতী গাছ লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। এতটা সাহসী এবং বুদ্ধিমতী হওয়ার পরেও যখন কারোর কাছে বন্দী হয়ে থাকতে হয় তখন তা নিজের কাছে লজ্জারই বটে!
ঘরের দরজা ঠেলে এক বলিষ্ঠ যুবক প্রবেশ করে ঘরে। সে সাথে করে একরাশ আলো নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই আলো যে ক্ষণস্থায়ী। যে নিজেই আঁধার, তার দ্বারা কি কারো জীবন আলোকিত হতে পারে? এ যে অসম্ভব!
হাতে একটা পানির বোতল নিয়ে এক পা, দুই পা করে আগন্তুক এগিয়ে যায় সিরাতের দিকে। এক বোতল পানির সম্পূর্ণটা সিরাতের চোখেমুখে ছুড়ে দেয় সে। আচমকা পানির ঝাপটায় চমকে ওঠে সিরাত। তার নিস্তেজ শরীরটা যেন আরো বেশি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকিয়ে সিরাত অবাক হয় না। অথচ এখন তার ভীষণভাবে চমকানোর কথা!
কণ্ঠস্বর থেকে আওয়াজ বের হতে না চাইলেও সিরাত নিজের উপর জোর দিয়ে হেসে বলে,
“আর কত নিচে নামবে তুমি? যাকে ভালোবেসে একদিন বাহুডোরে আগলে নিয়েছিলে আজ তাকেই নিজ হাতে মা*রতে চাইছ? কী আমার অপরাধ বলতে পারো তুমি? অন্যায় করলে তুমি। অথচ শাস্তি পেতে হচ্ছে আমাকে!”
সিরাতের কথায় কর্ণপাত না করে মাহতাব পাশ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে তার মুখোমুখি বসে পুরো মুখে হাত বুলিয়ে বলে,
“আমার সুন্দরী বউটার চেহারার এ কি বেহাল দশা! চোখের নিচে কালচে দাগ, ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে র*ক্ত জমেছে। চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে এখন কেবলই মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। কোথায় গেল তোমার সৌন্দর্য? কোথায় গেল তোমার তেজস্বী রূপ? নিভৃতে তেজস্বিনী আজ হেরে গেল তবে?”
সিরাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“নিভৃতে তেজস্বিনী আজ হেরে গিয়েছে কঠিন বাস্তবতার মঞ্চে!”
“হাহ্! তেজস্বিনী রূপ সবখানে মানায় না সিরাত। নিজের স্বামীর সাথে তুমি যে অন্যায় করেছ তার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে জান। মনে আছে? বিয়ের পর প্রথম ছ’মাস আমরা চুটিয়ে প্রেম করেছি। কত-শত বার আমি তোমাকে জান বলে ডেকেছি। আমার স্পর্শে তুমি লজ্জাবতী লতার মতো নুইয়ে পড়েছ আমার বুকে। আমি তো সেই লাজুকলতার প্রেমে পড়েছিলাম। তোমার এই তেজস্বী রূপ আমার মোটেই পছন্দ হয়নি সিরাত। নারীদের হতে হয় তুলার মতো কোমল। কিন্তু তুমি হতে চেয়েছ সূর্যের মতো প্রখর। কী দরকার ছিল এসবের? এত বেশি সাহসী না হলে আজ তুমি বেঁচে যেতে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো সংসারী হয়ে স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে পারতে।”
মাহতাবের কথাগুলো যেন সিরাতের নিস্তেজ শরীরে আ*গুন ধরিয়ে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে হাতের মুঠ শক্ত করে সিরাত জবাব দেয়,
“মেয়েরা তুলার মতো কোমল হলে তোমাদের মতো ছেলেরা সহজেই তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে খে*তে পারবে বলে এমন মেয়ে ভালো তাই না? নিজেদের রক্ষা করার জন্য হলেও প্রত্যেকটা মেয়ের তেজস্বিনী হওয়া উচিত। নয়তো তোমাদের মতো কাপুরুষদের শাস্তি দেবে কীভাবে?”
“কী লাভ হলো এত তেজস্বিনী হয়ে? সেই তো আজ তুমি আমার হাতের মুঠোয় বন্দী।”
“সেদিন যদি তুমি কলে আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথাগুলো না বলতে তাহলে আমি কখনোই তোমার মুখ দেখতাম না। আমি তো মা৷ আমার মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দিতে চাইবে, আর সেটা জেনেও আমি চুপ করে থাকব? তুমি খুব ভালো করেই জানতে যে এমন কথা শুনলে আমি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে তোমার সাথে দেখা করতে যাব। আর তাই এই নোং*রা চাল চাললে তুমি। তুমি কেমন বাবা বলো তো? নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য নিজের আপন মেয়েকেও ব্যবহার করলে তুমি। ছিঃ!”
“আরে তোমার ছিঃ তোমার কাছেই রাখো। তুমি তোমার মেয়ের কথা ভেবেছ? ভাবলে তার বাবার সাথে এতটা অন্যায় করতে পারতে না। আজ তোমার জন্য আমি পথের ভিখারি হয়ে গিয়েছি। এরপরেও তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায়?”
“তো কী করতে চাও আমার সাথে?”
“তোমাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মা*রতে চাই। আমার সুখের জীবন তো শেষ। সুতরাং তোমার সুখের জীবনও শেষ! একটা কথা জানো তো? টিট ফর ট্যাট।”
হাত, পা, ঘাড়, মা*থা, সর্বোপরি পুরো শরীরের ব্যথায় কাবু হয়ে আসে সিরাত। তার চোখ থেকে নিরবে অশ্রু ঝরে। বহুকষ্টে সিরাত মাহতাবকে বলে,
“আমাকে একটু পানি দেবে প্লিজ?”
“মৃ*ত্যুর আগে তুমি এক ফোঁটা পানিও পাবে না। কেন জানো? কারণ তোমার জন্য আমাকে তিনটা রাত না খেয়ে থাকতে হয়েছে। পেটের ক্ষুধার জ্বালায় আমি ছটফট করেছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু পকেটে একটা টাকা ছিল না আমার। রাজপ্রাসাদে বড়ো হওয়া ছেলেটার যখন এমন অবস্থা হয় তখন তার অন্যায়কারীকে তো কঠিন শাস্তি দিতেই হবে।”
সিরাত বুঝে যায় এদের কাছে এক ফোঁটা পানি চেয়েও কোনো লাভ নেই। সে ভেবে পায় না এই বন্দী জীবন থেকে কীভাবে ছাড়া পাবে। কে বাঁচাবে তাকে? আচ্ছা, তার ছোট্ট মেয়েটা মা’কে ছাড়া কেমন আছে? ভালো আছে তো? তার বয়স্ক মা-বাবা তার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যায়নি তো? এমন হাজারো কথা ভেবে ঠোঁট ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিরাত।
সম্পূর্ণ একটা দিন বন্ধুরা সবাই মিলে শত চেষ্টা করেও সিরাতের কোনো খোঁজ পায়নি৷ হতাশ হয়ে প্রত্যেকে মা*থা চেপে ধরে বসে রয় এক স্থানে।
কোথা থেকে যেন অভি আর মাওয়া একসাথে এসে হাজির হয় বাকিদের সামনে। তাদের এমন হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে উর্মি জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় ছিলি তোরা? আর এখন আমাদের খোঁজই বা পেলি কোথায়?”
মাওয়া অস্থির চিত্তে প্রশ্ন করে,
“আমাদের কথা বাদ দে। তোদের খবর আমাদের তারিন দিয়েছে। তারিন তো নাবিহার সাথে আছে এখন। আমাদের আগে বল, সিরাতের কী হয়েছে? ছত্রিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেল। এখনো মেয়েটা নিখোঁজ!”
“আমরা তো আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইভান সিরাতের ফোন ট্র্যাক করারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফোন বন্ধ। আশেপাশের সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা শেষ। কোথাও কোনো ক্লু পাইনি আমরা। মাহতাবের খোঁজও করেছি। কিন্তু ওই ছেলের কোনো খবর এখনো পাইনি আমরা।”
তামান্নার কথায় ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে মাওয়া। দীর্ঘক্ষণ নিরব থাকার পর অভি বলে ওঠে,
“আচ্ছা সিরাতের ফোনের লাস্ট লোকেশন কোথায়?”
ইভান চটজলদি উত্তর দেয়,
“নিউ ফরেস্ট স্টেশন নামের একটা একুরিয়ামের দোকানের সামনে ওর লাস্ট লোকেশন দেখাচ্ছে।”
“ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছিস তোরা?”
“হ্যা, দেখেছি। ওই জায়গা অবধি সিরাত পৌঁছাতেই পারেনি। ওই দোকানের পাশে একটা ডাস্টবিন আছে। সেখানেই ওর ফোন পাওয়া গিয়েছে।”
নকশির কথায় অভি কিছু একটা ভেবে বলে,
“ওই জায়গা থেকে কিছুটা পেছন দিকে গেলেই একটা বুকশপ আছে। আর সিরাত কিন্তু বই পড়তে অনেক ভালোবাসে৷ এমনও তো হতে পারে যে ওখানেই সিরাত মাহতাবের সাথে দেখা করেছে। যেহেতু বুকশপটা মেইন রোড থেকে কিছুটা ভেতরে তাই ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ হয়তো তোরা দেখিসনি।”
“আরেহ্ তাই তো! আমরা তো ওই বুকশপের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।”
নাবিলের কথায় অথৈ ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভাই যত দ্রুত সম্ভব তুই ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখার ব্যবস্থা কর। এত বড়ো একটা ক্লু আমাদের সামনে ছিল৷ আর আমরা সেটা দেখিইনি!”
“তোরা আমার সাথে ওখানে চল। আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখার ব্যবস্থা করছি।”
বন্ধুরা সবাই মিলে দ্রুত ‘কবিতার শহর’ নামক সেই বুকশপে চলে যায়। ইভান নিজের পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথেই দোকানের মালিক সিসিটিভি ফুটেজ দেখার অনুমতি দিয়ে দেয়। এই দোকানে মোট দুইটা সিসিটিভি লাগানো আছে। একটা ভেতরে, আরেকটা বাইরে। সবাই প্রথমে ভেতরের ফুটেজ দেখে। কিন্তু সিরাত এই দোকানের ভেতর অবধি আসেইনি। এরপর ইভান বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ বের করে। দোকান থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সিরাত বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। এখানে সিরাতকে দেখে সকলের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। অবশেষে মেয়েটার দেখা তো পাওয়া গেল।
প্রায় পাঁচ মিনিট একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সিরাত কারোর জন্য অপেক্ষা করছিল। এরইমাঝে একটা হুডি পরিহিত ছেলে এসে দাঁড়ায় তার সামনে। তাদের মধ্যে কী কথা হয় তা বুঝতে পারে না কেউ। ছেলেটা সিরাতের মুখে কিছু একটা স্প্রে করার সাথে সাথে মুহূর্তের মধ্যে সিরাত লুটিয়ে পড়ে ছেলেটার বুকে। হুডির আড়ালে মুখ ঢাকা থাকায় কেউ তার মুখ দেখতে পায় না।
“এতদূর অবধি এসেও কি আমরা কিচ্ছু করতে পারব না?”
মাওয়ার কান্না জড়িত কণ্ঠে পুনরায় সবাই আশাহত হয়। ছেলেটা সিরাতকে কোলে নিয়ে মিনিটের মধ্যেই আড়াল হয়ে যায়। মাওয়া কিছু একটা দেখে চিৎকার করে বলে,
“ইভান একটু পোজ কর ছেলেটার ডান হাতে।”
ছেলেটার ডান হাতে আঁকা একটা তীরের ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে মাওয়া বলে ওঠে,
“আমি এই চিহ্নটা চিনি।”
অভি অবাক হয়ে বলে,
“চিনিস মানে?”
“আরে এটা তুরাগের হাত। ওর হাতে এই একইরকম চিহ্ন আঁকা ছিল।”
“কী বলছিস তুই? তুরাগ এখানে আসবে কীভাবে?”
উর্মির প্রশ্নের উত্তরে মাওয়া বলে,
“আরে ভাই আমি এতকিছু জানি না। কিন্তু এটা যে তুরাগের হাত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ওর হাতে আঁকা এই চিহ্ন খুব ভালো করে চিনি। সুতরাং এটা যে তুরাগ সে বিষয়ে আমি শতভাব নিশ্চিত। তার মানে সিরাতের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তুরাগের হাত আছে।”
কথাটা বলেই মাওয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাকি সবাই স্তব্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে মাওয়ার দিকে।
চলবে??