#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩০
🍁
জায়নামাজে বসে অঝরে অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা। মিনিটের পর মিনিট অতিবাহিত হচ্ছে, এক ভাবেই বসে আছে সে। আজ তার কোমল হৃদয়টা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে। বিষাদের আনাগোনা তার মনিকোঠায়। দেখতে দেখতে গত হলো চারটি বছর, মীরাকে একা করে নূর জাহান বেগমের গত হওয়ার চার চারটি বছর। নিঃসঙ্গ মীরার সঙ্গী হয়েছে এখন কিন্তু দুচোখ ভরে যার দেখার কথা ছিলো সেই নেই।
মীরার কান্নায় ফুলে ফেঁপে ওঠা র’ক্তিম লাল চোখ দুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে জায়নামাজের উপর। নিরবে অশ্রুপাত করার আকুল চেষ্টা করছে মীরা, কিন্তু বারবার ঝড়ের বেগে দলা পাকিয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে আসছে কান্না গুলো। অবাধ্য কান্নাকে দমন করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা রত মীরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, গুঙিয়ে কেঁদে উঠছে মাঝে মাঝেই।
আজকের দিনে ভঙ্গুর হৃদয়ের মীরার খুব ইচ্ছে করছে দাদীজানের সান্দিধ্য পেতে। তাকে না ছুঁতে পেলো, তাকে জড়িয়ে রাখা সোদা মাটির ঘ্রাণ নিতে হৃদয়টা ভীষণ রকমের ব্যাকুল হয়ে আছে তার। চোখ মুছে পাশের টেবিল থেকে মুঠোফোন টা হাতে নিলো মীরা। কল লিস্টের দ্বিতীয় নাম্বার টাতে ডায়াল করলো সে। পরপর তিনবার রিং হতেই রিসিভ হলো। রাইফের কন্ঠস্বর শোনা গেলো কানে ধরে রাখা মুঠোফোন টায়। উৎকন্ঠিত কন্ঠে রাইফ বলছে,
-‘কি ব্যাপার আজ! আমার মহারানীর তলব পরেছে যে? কোনো সমস্যা মীরা?’
ছোট একটা ঢোক গিলে ভেজা গলায় বলল মীরা,
-‘না, সমস্যা না। আমি একটু বাহিরে যাবো। দাদীজানকে মনে পরছে খুব। যাই?’
-‘একা যাবা? আমি আসি?’
-‘না না। আপনার কষ্ট করে আসতে হবে না। উর্মিকে সাথে নিয়ে যাবো আমি।’
রাইফ হাত ঘড়িতে চোখ বুলাল। সময় দুইটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। সূর্য এখনও প্রখর তাপ দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাইফ,
-‘একটু পর বের হও মীরা। এখন বাহিরে অনেক রোদ। চারটা বা সাড়ে চারটা নাগাদ বের হবা কেমন? আর শোনো, আমি আসবো তোমাকে নিতে। ফোন কাছেই রেখো।’
-‘ঠিক আছে।’
মীরা ছোট্ট জবাবের পর ই নিরব হলো ফোনের দুই প্রান্তের মানুষ দুটো। কোনো সাড়াশব্দ নেই দুজনের মুখেই। রাইফ ইচ্ছা করেই কথা বলছে না এখন। সারাদিন তো নিজেই বকবক করে, এবার তার মহারানীর মুখ থেকে কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে। মীরার ধারণা ছিলো রাইফ ই কিছু বলবে এখন। কিন্তু যখন তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, তখন নীরবতা ভাঙ্গলো সে নিজেই।
-‘শুনছেন?’
-‘বলেন, শোনার জন্যই বসে আছি।’
রাইফের গলায় ঠাড্ডার সুর। মীরা ছোট করে প্রশ্ন করল,
-‘খেয়েছেন?’
-‘হুম।’
মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো রাইফের জবাবে। সবসময় তো কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসে থাকে, আর আজ হু হা বলে কে’টে পরছে। কথায় বলছে না। এমনি তেই মীরার মন খারাপ, তার উপর হু হা। ভালো লাগে না, এভাবে কি এক তরফা কথা বলা যায় নাকি? ধৈর্য হারা হয়ে মীরা নিজেই শুধালো,
-‘আপনি কি ব্যাস্ত?’
পিঠ টান টান করে বসে একটানা কাজ করা রাইফ আরাম করে হেলান দিলো চেয়ারে। লম্বা একটা হাই তুলে বলল,
-‘ব্যাস্ত হতে চাচ্ছিলাম। আমার মহারানীর কথা শুনে ব্যাস্ত হওয়ার শখ জেগেছিল খুব কিন্তু সে আর হলো না। আম্মা কি করে?
-‘ঘুমাচ্ছে।’
-‘তুমিও বিশ্রাম নাও একটু। সাবধানে এসো।’
-‘ঠিক আছে। রাখি?’
-‘রাখো।’
_____________
পড়ন্ত বিকেলে আসরের সালাত আদায় করেই বেড়িয়ে পরেছে মীরা এবং উর্মি। রিক্সা দিয়ে এসে মূল গন্তব্যের একটু আগেই নেমে পরেছে দুজন। ব্যাস্ততম শহরে দুজন পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায় কিছুক্ষণ। পাঁচমিনিটের পথ অতিক্রম করে কবর স্থানের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করল দুজন। দুরন্ত স্বভাবের উর্মিও আজ ঝিমিয়ে গেছে, মীরার মতো নেতিয়ে পরেছে মন। মীরার হাত টা ধরে ইট বাঁধা সরু পথটা দিয়ে সামনে এগিয়ে ডান দিকে বাঁধায় করা তিনটা কবরের পরের কবরেই এসে পা থামলো দুজনের। দাদীজানের মাথার কাছেই চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা। কোনো রা নেই দুজনের মুখে। নিরবে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা, থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠলো উর্মি। কি নিদারুণ যন্ত্রণা, কি নিষ্ঠুর বেদনাদায়ক অনুভূতি!
পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে সূরা তেলওয়াত করছে মীরা। ভেজা নয়নে সময় অতিবাহিত হলো অনেক ক্ষণ। সবুজ ঘাসে বসে আছে উর্মি কিন্তু মীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে।
পেছন থেকে রাইফের আওয়াজ শোনা মাত্র চমকিত হলো মীরা। চকিত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো তৎক্ষনাৎ। সাদা ফরমাল শার্ট, কালো প্যান্ট এর পরিপাটি বেশভূষা রাইফের যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম।
স্বামীর পানে ভেজা নয়নে এক পলক তাকিয়ে মুখটা আড়াল করে নিলো মীরা। চুপিসারে চোখের জল মুছে ফেলল, দু ঠোঁট হালকা গোলাকৃতি করে ছেড়ে দিলো ভেতরে জমে থাকা হাহাকার ভর্তি চাপা দীর্ঘশ্বাস।
উর্মি উঠে দাঁড়ালো রাইফ কে দেখে। রাইফের চোখে চোখ পরতেই বেদনা ভরা মুখটাতে ফুটিয়ে তুলল কিঞ্চিৎ হাসি। চোখে চোখে কথা হলো উর্মি এবং রাইফের। উর্মির কাছ থেকে রাইফ যা জানতে পারলো তার সারমর্ম ‘মীরার অবস্থা ভালো না। সরানো যাচ্ছে না এখান থেকে। কেঁদে কুঁদে একাকার অবস্থা। এবার আপনি সামলান।’
রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। চোখের কোল বেয়ে পরা অশ্রুটুকু স্বান্তনা দেওয়া হাতের অভাবে শুকিয়ে গেছে, দাগ হয়ে আছে ফর্সা গালে। মীরার লালচে হয়ে আসা গাল দুটোই হাত রাখল রাইফ। শুকনো দাগ টাতেই বৃদ্ধাংগুল ছোঁয়ালো, আলতো করে মুছে দিলো অশ্রুপাতের শেষ চিহ্ন টুকু।
রাইফের ভরসার হাত টা মীরার হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। সামনে পা আগাতে আগাতে মীরাকে ইশারা করলো তার সাথে পা মেলানোর। বোনের ভরসার হাতটা টেনে নিলো উর্মিকে। তিন জোড়া পা চলল একই পদক্রমে। দুজনের মনে নানী এবং দাদীজানকে হারানোর শোক তো অপর জনের মনে শুকরিয়া। মীরাকে নিজের করে পাওয়ার শুকরিয়া। এক সাথে চলা তিন জোড়া পায়ের এক জোড়া পা হঠাৎ কিছুটা ধীর হলো। এপর্যায়ে এসে বাম দিকের কোণায় সাদা রঙের কবরটাতে নজর রাখল রাইফ। পিতার শূন্যতা অনুভব হলো, চাপা কষ্টে র/ক্তক্ষ/রণ হলো শক্তপোক্ত বুকের বা পাশটাতে।
____________
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মীরা, উর্মি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না পায়ের ব্যাথায়। হেলান দিয়েছে স্ট্যান্ড করে রাখা রাইফের বাইকে।
সামনের দোকান থেকে ফার্স্টফুড পার্সেল করা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে মীরাদের কাছে এসে দাঁড়ালো রাইফ। পার্সেল টা উর্মির হাতে দিয়েই হাঁক ছাড়ল রিক্সার জন্য। হাত উঁচিয়ে ডাকলো একজন অর্ধবয়স্ক ব্যাক্তিকে যিনি পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটাতে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সার প্যাডেল ঘোরান জীবীকার তাগিদে৷
অর্ধবয়স্ক লোকটি কাছে আসলে বাসার এড্রেস বলল রাইফ। রিক্সাওয়ালা ব্যাক্তিটি এক গাল হেসে দিলেন, বললেন সেদিকে যেতে ইচ্ছুক তিনি।
ধৈর্য হারা উর্মি পায়ের ব্যাথায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে এক প্রকার লাফ দিয়েই রিক্সায় উঠে গেলো, বসে পরলো এক পাশে মীরার জন্য জায়গা রেখে। রাইফের পাশেই এক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা স্বভাব বশত মাথায় পেঁচানো ওড়নাটা শুধু শুধু টানলো একটু। রিক্সায় ওঠার জন্য দু কদম এগিয়ে গিয়ে রাইফ কে অতিক্রম করবে এমন সময় মীরার হাত রাইফের হাতে ব’ন্দী হলো, টান পরলো কোমল হাতে। প্রশ্নত্নাক দৃষ্টিতে পিছু ফিরল মীরা। রাইফ মীরাকে এক পলক দেখে সামনে চোখ রাখল। উর্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আমাদের ফিরতে দেড়ি হবে শালিকা। তোমার বোনটাকে নিয়ে একটু ঘুরবো। তুমি পৌঁছে একট কল দিবা ঠিক আছে? যাও।’
পা ব্যাথায় জর্জরিত উর্মির মুখে ফুটল দুষ্ট হাসি। রাইফ আজ উর্মিকে শালিকা সম্বোধন করছে। যেখানে ছেলে মেয়ে সমান অধিকার, সেখানে উর্মি কেনো পিছিয়ে থাকবে! ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে বলল উর্মি,
-‘আপনাদের ই সময় দুলাভাই। কাবাবের হাড্ডি হাড্ডি ফিল নিতে চাচ্ছি না আজ। দোয়া করিস মীরু, বাসায় পৌঁছানোর আগেই যেনো একটা আশিক মিলে যায়, দেওয়ানা হয়ে যায় আমার প্রেমে।’
🔳
গোধূলি লগ্ন। পশ্চিমাকাশে ঢলে পরা গোলাকার র’ক্তি’ম সূর্য টার তেজ এখন নেই বললেই চলে। শহর কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হতে শুরু করেছে।
মীরার ধরে রাখা হাত টা টেনে বাইকের সামনে এনে দাঁড় করালো রাইফ। এতো ক্ষণ মনের মাঝে চেপে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেলল মীরা,
-‘কোথাও যাবেন?’
-‘হুম, ঘুরে আসি চলো। ভালো লাগবে তোমার। আচ্ছা প্রিয় কোনো জায়গা আছে তোমার? কোথায় যেতে চাও বলো?’
পর পর প্রশ্ন করা রাইফের প্রস্তাব মীরার ভালো লাগলো। বিষন্ন মনটা যদি একটু ভালো হয় এই সুযোগে। এই শহরের কোলাহল থেকে দূর থেকে দূরান্তর যেতে চায় মীরা। ধীর কন্ঠে স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিলো সে,
-‘যে দিকে চোখ যায়।’
রাইফ এর স্বাভাবিক চেহারায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত সব কিছু। কেও ই দেখার জন্য কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনার জন্য থেমে নেই। তারপরেও পুরুষালী কন্ঠটা যতো টুকু সম্ভব খাঁদে নামালো রাইফ। ভরাট কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,
-‘আমার মন তো শুধু তোমাকেই চায়। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়াতে চায়, দু চোখ ভরে দেখতে চায়।’
চলবে…