#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৬
🍁
নিশুতি রাত, শান্ত শীতল পৃথিবী। হৈ হুল্লোড় নেই কোথাও। হঠাৎ দুই একটা গাড়ির হর্ণ বাজছে, আবার কখনও বা শোনা যাচ্ছে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া পাখির কিচিরমিচির ডাক।
পাঁচ তলায় অবস্থিত এক ব’দ্ধ রুমের নিকষ কালো আঁধারে দুটো চোখ তাকিয়ে আছে সম্মুখে। বিশাল আকাশে জ্ব/লজ্ব/ল করে জ্ব/লতে থাকা থালার মতো মস্ত বড় চাঁদের কিঞ্চিৎ আলো খোলা জানালা ভেদ করে পর্দার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢুকে মীরার কপাল থেকে থুতনিতে তীর্যক ভাবে লেপ্টে আছে৷ সদ্য নববধূ তার গালের নিচে মেহেদী রাঙা হাত রেখে বিভর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মাথায় পেঁচানো শাড়ির আঁচল টা সরে গিয়ে বালিশের উপর পরে আছে। খোঁপা করে রাখা চুল বাঁধন ছেড়ে চোখ স্পর্শ করে গালের উপর লেপ্টে আছে। মাথার উপর ভনভন করে চলা ফ্যানের বাতাসে মৃদু উড়ছে সেগুলো। গায়ের উপর পাতলা কাঁথা জড়িয়ে আরাম করেই ঘুম দিয়েছে মীরা। এই শহরের সবাই হয়তো মীরার মতোই গভীর নিদ্রায় কিন্তু নিদ্রাবিহীন শুধু তার পাশে শুয়ে থাকা পুরুষটি। চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকার রুমে কাত হয়ে এক হাতের উপর ভর দিয়ে মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইফ। পলক ফেলছে অনেক ক্ষণ পর পর। মীরার শরীর থেকে আসা বেলীফুলের মেয়েলি সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে সুগভীর ভাবে গ্রহণ করছে সে।
রাইফের সাথে ঘুমানোর আগে মীরার মাঝে ভীষণ সংকোচ কাজ করছিলো। মীরার আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থা দেখে রাইফ আর তাকে খুব একটা ঘাটে নি তখন। নাজুক মীরাকে তার ব্যাক্তিগত বিছানা ছেড়ে দিয়ে ঘুমাতে বলে কাজের বাহানা দিয়ে চলে গিয়েছিল বাহিরে। মীরা দুরুদুরু মনে খাটের এক কোণায় শুয়ে পড়েছিলো রাইফের কথা মতো। সারাদিনের ধকল শেষে ক্লান্ত মীরা গা এলিয়ে দিয়েছিলো রাইফের নরম বিছানায়। শোয়ার সাথে সাথেই সেই পরিচিত ঘ্রাণ হালকা হালকা অনুভব করছিলো মীরা। পাবেই বা না কেনো? যেখানে সেই ঘ্রাণের ব্যাক্তিটির ই বসবাস, সেখানে ঘ্রাণের ছোঁয়া থাকাটাই তো স্বাভাবিক। অতিরিক্ত কান্নার ফলে ফোলা ফোলা চোখ দুটো জ্ব/লছিলো মীরার। ক্লান্তিকর চোখ বুজে জেগে থাকা মীরা ঘুমের দেশে যে কখন পাড়ি জমিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। রাইফ পাঁচ-সাত মিনিট পরেই যখন উঁকি দিয়েছিলো রুমে, মীরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে অবাক হয়েছিলো বেশ। এতো অল্প সময়েই কেউ গভীর নিদ্রায় কিভাবে যেতে পারে? তাও আবার বাসর রাতে?
বিছানার কাছাকাছি এসে একটা বালিশ দূরত্ব রেখে মীরার পাশে রাখা দেখে মুচকি হেসেছিলো রাইফ। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করেছিলো তখন। মীরা যে রাইফের জন্য বিছানায় জায়গা রেখে ঘুমিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না তার। ফুটফুটে মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখাবয়ব অনেক ক্ষণ দেখার ইচ্ছা থাকলেও লাইট টা অফ করে দিয়েছিলো যেনো মীরার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।
টিকটিক করে চলা দেয়াল ঘড়িটা শব্দ করে জানান দিলো এখন রাত্রী তিনটা। মৃদু শব্দ কানে যেতেই মীরা নড়েচড়ে উঠলো কিছুটা। রাইফের ধ্যান ভা/ঙলো। অন্ধকারেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলো অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমানো উচিত তার। মীরা এখন তার অর্ধাঙ্গিনী, জীবনসঙ্গী। রাইফের জীবনের সাথে ওৎপৎ ভাবে জড়িয়ে গেছে সে। সারাটা জীবন এভাবেই পাশাপাশি থাকবে তারা। কাল দিনের আলোয় দেখা যাবে ভেবে দুচোখের পাতা এক করলো ঘুমানোর উদ্দেশ্য। নাহ, কিছুতেই ঘুম আসছে না রাইফের। বালিশ টা মীরার দিকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে সে নিজেও সামনে আগালো, মীরার কাছাকাছি এলো কিছুটা। রাইফের শ/ক্তপো/ক্ত হাতটা চুপিসারে মীরার মেহেদী রাঙা কোমল হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। ছোট্ট হাত টা রাইফের হাতের তালুতে আব/দ্ধ করে বুকের কাছে টেনে নিলো। নির্ঘুম দু চোখ কে রেহাই দিয়ে চোখ বুজলো রাইফ। মীরার দেখা পাওয়ার পর থেকেই শান্তির ঘুম উড়ে গিয়েছিলো তার চোখ হতে। চোখ বুজলেই মীরার প্রথম দিনের হতভম্ব চেহারা অকপটে ভেসে উঠতো তার। আজ আর তেমন হচ্ছে না রাইফের। এই তো পাশেই সে। মীরার নরম হাতটা রাইফের মুঠোব’ন্দী। মুঠোব’ন্দী তার লাজুকলতা।
তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। নিত্যদিনের অভ্যাসরত মীরা আজানের ধ্বনিতে নড়েচড়ে উঠলো। হালকা হলো তার গভীর নিদ্রা। অন্য দিকে পাশ ফেরার জন্য কাত ঘুরতেই টান লাগলো হাতে। ভ্রু কুঞ্চিত করে অন্ধকারেই চোখ মেলল, শ’ক্ত করে ধরে রাখা হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অন্য হাতে বালিশের নিচে রাখা ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করল। কাছাকাছি পাশে শুয়ে থাকা রাইফ কে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো সে। বলিষ্ঠ হাত দুটো বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে মীরার হাত। মীরা কি যেনো ভেবে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসলো। বেখেয়ালি ভাবে ফোনের আলো রাইফের মুখে পরতেই রাইফ চোখ কুঁচকালো। মীরা দ্রুত ফোন সরিয়ে অন্য দিক করে রাখল। হালকা উঁচু করে রাখা মাথাটা আবারও বালিশে রাখল সে। মুখের পাশ দিয়ে বির/ক্ত করা এলোমেলো চুল গুলো কানে গুঁজে রাইফের দিকে দৃষ্টি দিলো। বাহিরে এখনও অন্ধকার ভাব কাটেনি। ফ্লাশ লাইট এর আলোয় রাইফের অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মীরা। এই সেই পুরুষ, যার উপস্থিতি মীরার তনুমন উচাটন করে তোলে, যার স্পর্শে মীরার হৃদ স্পন্দন বেগতিক হারে বাড়ে। যার ঠোঁট কা/টা স্বভাব মীরাকে লজ্জায় ফেলে, যার তীক্ষ্ণ নজর মীরাকে আড়ষ্ট করে তোলে।
এই প্রথম মীরা সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রাইফের মুখে। চৌকস চেহারার অধিকারী লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সরু নাক, ব’দ্ধ চোখ এ নজর বুলালো। আগে অনেক বার সাক্ষাৎ হলেও এতো কাছাকাছি থেকে গভীর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কখনও দেখেনি মীরা। সুগভীর ভাবে পরখ করে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের রাইফকে সুপুরুষ থেকে কম মনে হলো না মীরার। সময়ে কে/টে গেলো বেশ। ফর্সা হতে শুরু করেছে ধরণী। মীরা রাইফের মুঠোয় পরে থাকা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। উহু, পেশিবহুল হাতটা দিয়ে এমন ভাবে ধরে রেখেছে, ছাড়ানো যাচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা একটু জোর প্রয়োগ করে হাত টা আরেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শ/ক্ত করে ধরে ফেলল রাইফ। ভ্রু কুঁচকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে আদেশ সূচকে বলল,
-‘আহ! নড়াচড়া করো না তো মীরা। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। ঘুমাতে পারি নি আমি।’
হুট করে রাইফের কন্ঠস্বর শুনে মীরা চমকে উঠল, কপালে ভাঁজ পরলো দু একটা। নড়াচড়াই বা সে করলো কখন? হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে মাত্র। এটা কে কি নড়াচড়া বলে? মীরা নোয়ানো গলায় বলল,
-‘হাত টা ছাড়ুন, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমার। নামাজ পড়বো।’
মীরা অপেক্ষা করলো, কিন্তু রাইফ ছাড়লো না। এভাবে আর কতোক্ষণ থাকবে সে। হতাশ হয়ে আবারও মীরাই বলে উঠলো,
-‘ছাড়ুন না। সত্যি দেড়ি হয়ে গেছে। আর আপনি ঘুমাতে পারেননি কেনো?’
মীরার করা প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে তুলল রাইফ। মীরার দৃষ্টিগোচর হলো সেই হাসি। রাইফের এই হাসি তার চেনা, ভীষণ চেনা। এই হাসির অর্থ সে বুঝে গেছে এ ক’দিনে। এখনি কিছু বলে ফেলবে এই লোক তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। মীরা এই সাত সকালে আর লজ্জায় পরতে চায় না। তাই তো দ্রুত এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল। পা দুটো ফ্লোরে রেখে উঠে দাঁড়াতেই শাড়ির আঁচলে টান লাগলো। অগ্রসর হওয়া পা থেমে গেল, চোখ বুজে ফেলল মীরা। শেষ রক্ষা তার হলো না আজকেও। রাইফ হাতে শাড়ির আঁচল কিছুটা পেঁচিয়ে মীরাকে কাছে টানল। ঘুমুঘুমু চোখ মেলে মীরাকে বলল,
-‘সদ্য প্রস্ফুটিত একটা ফুল যদি পাশে থাকে, কি করে ঘুমাই বলো? তোমার মতো নি’ষ্ঠুর তো আমি নই যে বাসর রাতে ঘুমিয়ে যাবো।’
কথাটা বলে ইউঠে বসে রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো তার দিকে। হাতটা টেনে নিয়ে পুরুষালী কন্ঠটা আরো খাঁদে নামিয়ে আনলো রাইফ। মীরার হাত টা নেড়েচেড়ে স্মিত স্বরে বলল,
-‘তুমি আমার হৃদয়হ’রণ করেছো মীরা। অ|প|রা|ধ করে ফেলেছো, কঠিন অ|পরা|ধ। তোমাকে যাবত জীবন কা/রাদ/ন্ডে দ/ন্ডিত করা হলো আজ থেকে।’
রাইফ প্রেয়সীর হাতটা উপরে তুলে ধরলো। মীরার এদিক সেদিক তাকানো দৃষ্টি থেমে গেলো হাতে জ্ব/লজ্ব/ল করা হীরার ছোট্ট আংটিটাতে এসে। ভুল দেখছে না সে। রাইফ মাত্র পরিয়ে দিয়েছে তাকে। মীরার তনুমন আবারও কেঁপে উঠল। পিটপিট করে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল কাঁথা মুড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পরেছে রাইফ।
চলবে….
টুকুস করে ছোট্ট একটা মন্তব্য করে যাবেন। রাইফ মীরার তরফ থেকে ভালোবাসা নিবেন💛💛💛