#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৩
🍁
গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ মুখে এগিয়ে যাচ্ছে মীরা এবং উর্মি। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। ছাদের কাছাকাছি আসতেই ধীর হলো মীরার হাঁটার গতি। কিছুটা পিছিয়ে গেলো উর্মির থেকে। পা ফেলছে কোনোরকমে, অবশ অবশ লাগছে মীরার। উর্মির জোর করে পরিয়ে দেওয়া লাল ওড়নাটা টেনে মাথাটা পুরোপুরি ঢেকে নিলো। ঢিপঢিপ করে কাঁপছে হৃদয়।
রাইফের সামনা সামনি হতে মীরার এখন সংকোচ হয় অনেক। যে লোকটাকে সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে বলেছিলো, সে সত্যি সত্যি স্বপ্ন টাকে বাস্তব করে দিচ্ছে কয়েক দিনের ব্যাবধানে।
ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকেই তাকিয়ে রাইফ। তার গভীর চোখ দুটো প্রেয়সীর অপেক্ষায়। পায়ের আওয়াজ শুনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতে রাখা মুঠোফোন পকেটে গুজলো।
ছাদের দরজা দিয়ে উর্মি ঢুকল প্রথমে। তাকে দেখা মাত্র রাইফের মুখটা ভারাক্রান্ত হলো। আসতে বলল মীরাকে আর এলো কে? এই মেয়েটা এবার সত্যি সত্যি ওর ঘরে আনতে হবে। সময় দিচ্ছে তো, গায়ে লাগছে না ওর। রাগ হলো খানিক, বিরক্তও হলো সাথে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে উর্মির পেছন তাকাতেই ছলাৎ করে উঠলো বুকের বা পাশটা। ওইতো কাংখিত নারী, পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজের সাথে মাথায় লাল ওড়না। কি স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে। ধবধবে সাদা মেঘের মাঝে যেনো মীরার লাল ওড়না পেঁচানো আদলটুকু রক্তিম সূর্য ন্যায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে চতুর্দিক।
সাদা পোশাকে পবিত্র লাগছে ভীষণ। লালের মাঝে ফর্সা মুখাবয়ব টা ফুটে উঠেছে বেশ।
নীচু দৃষ্টিতে এগিয়ে আসা মীরা আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত রাইফকে এক পলক দেখেছে। নজর নিম্নে আবদ্ধ করেই উর্মির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাইফ এর সাথে বেশ ব্যাবধান নিয়েই দাঁড়িয়েছে সে।
হাসি মুখে উর্মির সাথে কুশল বিনিময় করে রাইফ এর চোখ ঘুরে ফিরে মীরার দিকেই ছুটে যাচ্ছে। মন ভরে দেখার জন্য ছটফট করছে চোখের কালো মনিটা।
কিন্তু একটা সুক্ষ্ণ বিপত্তি দেখা দিলো। মাঝে উর্মি দাঁড়ানোতে ঠিক মতো দেখতেও পাচ্ছে না রাইফ। গুনে গুনে পাঁচ দিন পর দেখা, আর এই মেয়ে কিনা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, রাইফের উঁকি মেরে দেখা লাগছে। হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো। রাগ হলো সাথে বিরক্তও। জোরপূর্বক মুখে বোকাসোকা একটা হাসি ঝুলিয়ে ভণিতা না করে সরাসরি রাইফ উর্মিকে বলে উঠলো,
-‘এখানে কেনো আসছো উর্মি? কাবাব মে হাড্ডি হতে?’
-‘আমি হাড্ডি হতে চাই নি রাইফ ভাই। আমাকে জোর করে বানানো হইছে।’
মীরা মাথা নিচু করেই গাল ফুলালো কিন্তু কিছু বলল না। রাইফ পুনরায় উর্মিকে বলল,
-‘তাহলে তোমার ইচ্ছা নেই কাবাবের হাড্ডি হওয়ার?’
কন্ঠে জোর দিয়ে জবাব দিলো উর্মি,
-‘মোটেও না। আমি ওতোটাও মীর জাফর না যে আপনাদের মাঝে এসে দাঁড়াবো।’
তাৎক্ষণিক বা ভ্রুটা উঁচু করে রাইফের সহজ সরল জবাব,
-‘দাঁড়িয়েই তো আছো।’
উর্মি দ্রুত দুজনের মাঝ হতে সরে আসলো। সত্যি সত্যি সে যে বেখেয়ালি তে দাঁড়িয়ে আছে দুজনের মাঝে বুঝতেই পারে নি। লজ্জা পেলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। মীরার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলল,
-‘মীরা পেছনে আসছে জন্য পেছনে পরছে৷ দোষ ওর।’
মীরা চোখ বড়সড় করে উর্মির দিকে তাকালো। রাইফ কথা বাড়ালো না। সময় নষ্ট হচ্ছে, এখন কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ালে ওর নিজের ই লস। তাই সুক্ষ্ণ কৌশলের সহিত বলল,
-“দোষ আমার, আমার ই উচিত ছিলো ওপাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এবার তাহলে কি করা উচিত তোমার বলো তো?
উর্মি রাইফের কথার ধরণে হেসে দিলো। মীরা বারংবার উর্মিকে মাথা নেড়ে না করছে। অনুরোধের সুরে বলল ,
-‘উর্মি, এটা করিস না। যাবি না, প্লিজ যাস না।’
উর্মি কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,
-‘পেয়েছিস কি দুজন। একজন নিচে ঠেলে তো আরেক জন উপরে। এ ভাই, তোরাই নিচে যা। আমি এখানে থাকি।’
মীরা এগিয়ে গেলো উর্মির দিকে। আবারো অনুরোধ করছে যেনো চলে না যায়। কিন্তু উর্মির চেহারা বলছে সে মীরার মতামত কে গ্রাহ্য করছে না একটুও। রাইফ সুক্ষ্ণ ইশারা দিলো উর্মিকে যার অর্থ
‘ভালো মেয়ের মতো এবার ফটাফট একটা দৌড় দাও তো বাসার দিকে।’
বুদ্ধিদীপ্ত উর্মি ইশারার মানে ধরে ফেলল সহজেই।
মূহুর্তেই দ্রুত পায়ে মীরাকে পাশ কেটে চলে গেলো, মীরা বাঁধা দেওয়ার সময় টুকু পর্যন্ত পেলো না। তাজ্জব বনে গেলো উর্মির কান্ডকারখানা দেখে। ভয় মিশ্রিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সিঁড়ির দরজার দিকে। কি হবে এখন? উর্মি বাসায় গেলে আব্বাজান যদি জিজ্ঞাস করে মীরার কথা তখন কি ও বলে দিবে রাইফের সাথে ছাদে থাকার কথা! ছিহ ছিহ! এ কেমন পরিস্থিতিতে পরলো ও। চোখ নামিয়ে নিতেই হুট করে উর্মি আবারও দৌড়ে প্রবেশ করলো ধপাধপ শব্দ করে। মীরার সম্মুখে এসে বলল,
-‘টেনশন করিস না। আমি সিঁড়িতেই বসে আছি তোর জন্য।’
কথাটুকু বলেই উর্মি যেভাবে তড়িৎগতিতে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে৷ মীরা স্বস্তি পেলো, কিন্তু রাইফের কথা ভেবে অস্থির মনটাকে স্থির করতে পারলো না পুরোপুরি। সময় কে/টে গেলো কিছুক্ষণ ওভাবেই। রাইফ রেলিং এ হেলান দিয়ে
নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে ডেকে উঠলো,
-‘মীরা?’
রাইফের দিকে তাকালো না মীরা। দৃষ্টি নিচে রেখেই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘জ্বী’
-‘ভ/য় পাচ্ছো?’
মীরা অকপটে স্বীকার করলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘কিছুটা’
-‘কিছুটা না, অনেকটায় মনে হচ্ছে। দেখি, এদিকে আসো।’
রাইফের ইশারায় নির্দেশ করা জায়গায় দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা।
রাইফ মুচকি হাসলো। কৌতূহল সুরে শুধালো,
-‘আমাকে ভয় পাচ্ছো?’
মীরা নিশ্চুপ। এখানে আর কে আছে যে উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে! রাইফ জানে ওর প্রশ্নের উত্তর মীরা দিবে না। মীরার দুরুদুরু মনটা হালকা করতে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-‘ফর্ম ফিলাপ কমপ্লিট?’
-‘জ্বী।’
-‘কখন আসছো বাসায়?’
-‘রাতে।’
-‘এক্সাম কবে হওয়ার সম্ভাবনা?’
-‘এক দু মাস পরেই।’
রাইফের মুখাবয়ব ভাবুক হলো। কিছু ভেবে ভরাট গলায় শীতল কন্ঠে পুনরায় ডেকে উঠলো,
-‘মীরা?’
মীরা কেঁপে উঠলো। সবাই তো ওকে মীরা বলেই ডাকে। কিন্তু রাইফের গলায় মীরা ডাকটা তাকে শিরশিরে অনুভূতি দেয়। কেঁপে তুলে শিরা উপশিরা। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে জবাব দিলো সে,
-‘জ্বী’
রাইফের পুরুষালি কন্ঠস্বর আদেশ সূচকে বলল,
-‘আমার দিকে ঘুড়ে দাঁড়াও।’
মীরার কি হলো জানে না। ননীর পুতুলের ন্যায় ঘুরে রাইফের সামনাসামনি হয়ে দাঁড়ালো।
রাইফ এক কদম এগিয়ে এলো মীরার দিকে। আপাদমস্তক পরখ করলো মীরার। ওড়নার একটা সুতা কখন থেকে টেনেই যাচ্ছে সে। রাইফ নম্র গলায় বলল,
-‘সুতাটাকে রেহাই দিয়ে একটু আমার দিকে তাকাবা?’
মীরা সুতা ছেড়ে দিলো সাথে সাথেই। রেহাই তো দিলো ঠিকি কিন্তু রাইফের দিকে তাকাতে পারলো না। রাইফ কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে আরো শীতল কন্ঠে বলল,
-‘আজ আর তোমাকে লজ্জায় ফেলবো না মীরা। শুধুই দেখবো। একটু দেখি তোমাকে?
রাইফের কন্ঠ থেকে শুরু করে চোখে মুখে আকুল আবেদন ঠিকরে পরছে মীরাকে দেখার। তীব্র মনোবাসনা বেঁধেছে বুকের ভেতর। আরো এক কদম এগিয়ে নম্র কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে পুনরায় বলল,
-‘মাথাটা তোলো প্লিজ, তাকাও আমার দিকে।’
মূহুর্তেই বশবর্তী হলো রাইফের ঠন্ডা কন্ঠের আকুল আহ্বানে। মিশমিশে কালো পল্লবের আঁখিদ্বয় মেলে তাকালো রাইফের পানে। নজর আবদ্ধ হলো রাইফের শান্ত স্থির চোখ দুটিতে। অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাইফ। মুখে তার অনিন্দ্য সুন্দর মুচকি হাসি লেপ্টে আছে। দুষ্ট মিষ্ট চাহনি নেই আজ। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি, পরিপাটি চুল। আকাশি রংয়ের শার্ট আঁটসাঁট ভাবে লেগে আছে বলিষ্ঠ দেহে। উপরের দু বোতাম খোলা। হাত দুটো কালো প্যান্টের পকেটে গুজে দাম্ভিকতার সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। মীরার ডাগর ডাগর চাহনিতে মুচকি হাসি প্রসস্থ হলো রাইফের। মীরা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। রাইফের আজকের চেহারা এবং চোখদুটোতে ভালোলাগা ফুটে ওঠেছে, প্রেয়সীর নজরে নজর রেখে আচ্ছন্ন হয়েছে ভালোবাসায়। প্রকৃতিতে শিরশিরে হাওয়া বইছে। তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। নীলাভ বিশাল আকাশের নীচে ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন। একজন লজ্জায় টুইটুম্বুর হয়ে নজর ফিরিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে তো অন্যজন অপলক নয়নে মন জুড়িয়ে নিচ্ছে। আসলেই কি জুড়িয়ে যাচ্ছে? যদি জুড়িয়েই যেতো তবে কেন একের পর এক অবাধ্য ইচ্ছে গুলো হানা দিচ্ছে তার হৃদয় কুঠরে! মাঝের সামান্য ব্যাবধান টুকু ঘুচিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ক্রমশ বাড়ছে কেনো তবে? পারছে না আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে, পাচ্ছে না ওড়নার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা চুল গুলো কানে গুজে দিতে। এই যে দেখছে, দেখেই যাচ্ছে তবুও মন ভরছে না কিছুতেই। রাইফের মনে হচ্ছে তু/লে বাসায় নিয়ে রেখে দিতে। আরাম করে বসে দেখা যাবে। চুপটি মেরে বসে থাকা মীরাকে রাতদিন ভর দেখবে সে।
সময়ের পর সময় চলে যাচ্ছে, রাইফ এর নজর সরছেই না মীরার থেকে। কখনও নাকে, গালে, চোখে তো কখনও মীরার সরু পাতলা গোলাপি অধরে।
রাইফের অনিমেষ চাহনিতে মীরার সংকোচ বাড়তে থাকল। কাঁচুমাচু করে রাইফের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নেওয়ার স্বরে বলল,
-‘এবার যাই?’
রাইফ দুদিকে মাথা নাড়ালো। তার অর্থ ‘না’। মীরা বাধ্যগত মেয়ের মতো আবারও নিরব হলো। রাইফ পকেট থেকে হাত বের করে বলল,
-‘আমার নাম্বারটা সেভ করে নিও। রাতে কল দিব।’
মীরা মাথা তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে ধীর আওয়াজে বলল,
-‘আপনি আমার নাম্বার কবে নিলেন, কার কাছ থেকে নিলেন?’
রাইফ জবাব দিলো না। রহস্য ময় বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো শুধু। মীরার মনে জাগা একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় থেকেই। রাইফের জবাব না পেয়ে মীরা পুনরায় শুধালো,
-‘আমিতো তখন কথা বলি নি, কি করে বুঝলেন কলে আমি ছিলাম?’
রাইফ বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করল। মাথাটা মীরার দিকে ঝুঁকে উল্টো প্রশ্ন করল,
-‘আমার লাজুকলতা ব্যাতীত তোমাদের বাসায় কল রিসিভ করে নিরব থাকার মতো কি কেউ আছে মীরাবতী?’
রাইফের মুখে উচ্চারিত ‘লাজুকলতা এবং মীরাবতী’ সম্বোধন শুনে মীরা লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে ফেলল তৎক্ষনাৎ। এখানে আর কোনো ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না সে। কোনো রকমে মিন মিন করে বলল,
-‘আসছি।’
রাইফের জবাবের অপেক্ষা না করেই মীরা ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। মীরার লজুক মুখ দেখে রাইফের মুখে অমায়িক হাসি ফুটলো। দুষ্টমি খেলা করলো মস্তিস্কে। কন্ঠ উঁচু করে ডেকে উঠল,
-‘মীরা?’
প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাল মীরা।
রাইফ ডান হাত টা বুকের বা পাশে নিলো। ইশারায় বুকের বা পাশটা দেখিয়ে দুষ্টমি মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
-“দেড়ি কিসের তবে, দ্রুত এসো। বুকের বা পাশ টা শুধুই তোমার জন্য বরাদ্দ। অপেক্ষায় তোমার জন্য।’
চলবে……
কেমন লাগলো আজকের পর্ব? সুন্দর সুন্দর মন্তব্য কিন্তু আশা করছি আমি।
💛💛