#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২২
সকালের মিঠে রোদ ঝলমলে করে তুলেছে ধরনীর বুক। আধোখোলা জানালার গ্রিল ভেদ করে সূর্য রশ্মি উঁকি দিয়ে সাদরে জায়গা করে নিয়েছে মীরার মুখাবয়বে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন সে। ডান হাত টা চোখের উপর রেখেছে সূর্যের আলোয় যেনো ঘুমের ব্যাঘাত না হয় তার। পাশেই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে উর্মি। সাধারণত মীরা নিয়ম মাফিক দশটা-সাড়ে দশটার মাঝেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু কাল ঘুমাতে ঘুমাতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছে। এতো দেড়িতে ঘুমানোর কারণ ও আছে বৈকি।
ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপের ডেট দিয়েছিলো রাজিয়া বেগম রা দেখে যাওয়ার পরের দিন ই। তাই সেদিন ই ঢাকা চলে গিয়েছিলো। চার দিন ছিলো হলে। গতকাল রাত্রে ফিরেছে মীরা। গাজীপুর চৌরাস্তার অসহ্যকর জ্যাম এর জন্য ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তার উপর অনেক ক্ষণ গল্পগুজব করে সবার সাথে কা’টিয়েছে সময়। উর্মিও চলে এসেছে, তাই আড্ডাটা আরো বেশি জমে উঠেছিলো।
দেড়ি করে ঘুমানোর ফলে কোনো রকমে চোখ কচলে ফজরের সালাত আদায় করে আবার শুয়ে পরেছে মীরা। খাদিজা বেগম এসেছিলেন কয়েক বার ডেকে তুলতে। গভীর নিদ্রায় দুজনকে দেখে ডেকেও আর ডাকতে পারেননি।
বালিশের নিচে রাখা সেলফোন টাতে এলার্ম বেজে চলেছে। এই বার নিয়ে তিন বার হয়ে গেলো। মীরা পিটপিট করে কোনো রকমে চোখ খুলে মোবাইল হাতরে কর্কশভাবে বেজে ওঠা এলার্ম অফ করে দিলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো। দুপাশে হাত টা/না দিয়ে আবারো হেলান দিয়ে আধো শোয়া হলো। শরীর টা আজ বড্ড বিছানা টা/নছে মীরার। আলসেমি যেনো ছাড়ছেই না। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে অনেক। এক দিকে পেট ভর্তি ক্ষুধা, অন্য দিকে চোখ ভর্তি ঘুম। সময় নিলো বিছানা ছাড়তে।
খোলা চুল গুলো হাত খোঁপা বেঁধে ধীরে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। মীরার লাগানো শখের পাতা বাহার গাছ গুলো কেমন নেতিয়ে গেছে এই কদিনে। শুকিয়েও গেছে অনেক পাতা। শুকনো পাতা গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল হলো হাত দুটো ফাঁকা ওর। ঢাকায় গিয়েছিলো বলে খুলে রেখেছিলো রাজিয়া বেগমের দেওয়া সরু বালা দুটো। রাইফের কথাও মনে পড়ে গেলো মনিকোঠায়। খাদিজা বেগমের ডাক কানে আসাতে আর ভাবতে পারলো না বেশিক্ষণ। উর্মিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দ্রুতপদে মায়ের কাছে ছুটলো সে।
খাদিজা বেগম ড্রয়িং রুমে কুশিকাটার কাজ নিয়ে বসেছেন সকাল সকাল। মীরাকে দেখে সুতা গুলো এক পাশে রেখে দিলেন। এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন,
-‘পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কখন খাবি? উর্মি উঠেছে?’
মীরা মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। জড়িয়ে ধরে ধাতস্থ গলায় বলল,
-‘উঠছে আম্মা। ফ্রেশ হতে গেছে।’
-‘আচ্ছা, তাহলে বস। ও চলেই আসবে, তুই খাওয়া শুরু কর। আমি দিচ্ছি ডাইনিং এ।’
-‘আম্মা, এভাবেই বসে থাকো কিছুক্ষণ। তোমাকে এভাবে ধরে থাকি একটু। ভালো লাগছে খুব।’
খাদিজা বেগম মেয়ের আচরণে খুব খুশি হলেন। মনটা ভরে উঠলো পরম মমতায়। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন, কাছে টেনে নিলেন আরেকটু।
উর্মি এসে বসলো মীরার পাশে। ফ্রেশ হয়ে এলেও এখনও ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরি কাটেনি তার। হাই তুলে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
-‘মীরু, এবার ছাড়। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে আমার।’
খাদিজা বেগম উর্মির দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখালেন। কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে বললেন,
-‘সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমালে তো ক্ষুধা লাগবেই। আরেকটু ঘুমিয়ে একেবারে দুপুরে উঠতি দুজন।’
রাগ দেখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাথে তাড়াহুড়োও দেখা যাচ্ছে তার আচরণে। উঠতে যাবেন তখনি মীরা টে’নে ধরলো। সে নিজে উঠে বলল,
-‘আমি আনছি আম্মা, তুমি বসো।’
উর্মি খাদিজা বেগমের কথা শুনে বলল,
-‘বকো না মামি, রাতে ঘুম হয়নি তো। এই দেখো, না ঘুমানোর জন্য চোখের নিচে কালি পরে গেছে।’
মীরা কিচেন থেকে হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসতে আসতে কন্ঠ সামান্য উঁচু করে বলল,
-‘ফজরের নামাজ টাও পরে নি আম্মা। আমার থেকে বেশি ঘুমিয়েছিস তুই। আমার কালি পরলো না, আর তোর পরে গেলো? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পেলি না উর্মিমালা!’
-‘কাজা নামাজ পরে নিবো। আর শোন, তোর স্কিন টোন আর আমার টোন এক না। আমার টোন টা কালি কালি বুঝছিস। এজন্য ঘুমাতে হয় একটু বেশি বেশি।’
উর্মির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মীরা আর খাদিজা বেগম হেসে দিলো এক সাথে। উর্মির পাশে বসে রুটির প্লেট টা ওর হাতে দিলো মীরা। ডাইনিং আর বসবে না, এখানেই বসে খাবে। পরোটার ছোট্ট এক টুকরোর সাথে ডিম নিয়ে মুখে দিলো। চিবুতে চিবুতে বলল,
-‘আরো বেশি বেশি ঘুমা, বেশি বেশি কালি কালি হবি।’
-‘উল্টা বলিস কেনো?’
-‘উল্টা বললাম কোথায়! তুই দেখ। আমি কম ঘুমিয়ে যদি স্কিন টোন ভালো হয়, তাহলে বেশি ঘুমিয়ে স্কিন টোন কালি।’
উর্মি ক্ষে/পে গেলো মীরার উপর। বোঝায় একটা আর বোঝে আরেকটা। বলেছে তো ওর স্কিন ভালো না। তারপরেও কথা প্যাচাচ্ছে! খাজিদা বেগম দুজনের তর্ক দেখে থামাতে লাগলেন। মীরা আলাভোলা মুখ করে কথার জালে ক্ষে/পিয়ে দিচ্ছে উর্মিকে। জমে উঠেছে রাতের ন্যায় আরেক দফা আড্ডার পসরা।
___________
আকাশি রংয়ের শার্ট পরিহিত সুঠাম দেহের অধিকারী রাইফ অফিসিয়াল কাজ করছে নিজের ডেস্কে। চোখ তার সামনে রাখা কম্পিউটারের স্কিনে। কাজের ফাঁকে ধোঁয়া উড়ানো কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ছোট্ট করে। এর মধ্যে মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ধ্যানমগ্ন রাইফের ধ্যান ভাঙলো তৎক্ষনাৎ।
ফোনটা প্যান্টের বা দিকের পকেট থেকে বের করে হেলান দিলো, গা ছেড়ে আরাম করে বসলো।
ফাহাদের নাম্বার ভাসছে স্কিনে। বৃদ্ধ আংগুলের সাহায্যে সোয়াইপ করে কানে নিলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,
-‘বল।’
-‘যাবি নাকি আজ রাইডে? দূরে যাওয়ার প্লান আছে আজ।’
-‘আজ সম্ভব না। হাতে কাজ আছে একটা।’
রাইফের হাতে আজ কাজ নেই, তবুও অজ্ঞাত মিথ্যে কথাটা বলতেই হলো। ফাহাদ স্বাভাবিক ভাবেই নিলো রাইফের বিষয়টি। আরো কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথা বার্তা বলে ফোন রাখল। রাইফ কালো হাত ঘড়িতেটাতে চোখ বুলিয়ে আশে পাশে তাকালো। ছুটির সময় চলে এসেছে, শেষ সময়ের কাজ টুকু সম্পূর্ণ করার জন্য আবারও হাত দিলো কম্পিউটারের মাউস এ।
____________
পড়ন্ত বিকেলে অলসতা কা’টাতে মীরা চা বানাচ্ছে কিচেনে। উর্মি ডেকে চলেছে রুম থেকে। চুলার আঁ/চ কমিয়ে ছুটলো রুমের দিকে। মীরা গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,
-‘কি হয়ছে, গন্ডারের মতো ডাকছিস কেনো?’
-‘তোর কল আসছে। তিনবার বাজলো।’
মীরা ফোন হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল,
-‘কে?’
-‘আননোন নাম্বার।’
-‘তাহলে থাক। কে না কে। দরকার হলে আবার করবে।’
-‘তিন বার করেছে মীরু। প্রয়োজনেই করেছে।’
মীরা মাথা নেড়ে বলল,
-হ্যাঁ, সেটাও ঠিক বলছিস।
কথাটা বলেও কল দিচ্ছে না মীরা। কেনো যেনো ইচ্ছে করছে না কল দিতে। এমনিতেই ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না, তার উপর আননোন নাম্বার। যার দরকার সে আবার কল দিবে বলে উঠে দাঁড়াতেই ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেট হয়ে রিংটোন বেজে উঠলো। এগারো ডিজিটের শেষ দুই ডিজিট নয়-দুই। উর্মির দিকে তাকাতেই দেখলো উর্মিও তাকিয়ে মীরার দিকে। ইশারায় দ্রুত রিসিভ করতে বলল সে। কল কে’টে যাবে সে মূহুর্তে দ্রুত রিসিভ করল। কানে নিয়ে ধরে থাকলো অপর প্রান্তের কথা শোনার জন্য। কি ব্যাপার, কিছু বলছে না কেনো? মীরার রাগ হলো, স্বাদের মালাই চা বানানো বাদ দিয়ে এখানে কে না কে কল করেছে, তার তামশা দেখবে নাকি এভাবে। বিরক্ত হয়ে কান থেকে ফোন সরানোর জন্য উদ্যত হতেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো ভরাট গলার আদেশ করা কন্ঠস্বর,
-‘মীরা, ছাদে আসো একটু। বেশি না, পাঁচ মিনিটের জন্য। অপেক্ষা করছি আমি।
টুট টুট শব্দ করে বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ। মীরার মুখাবয়বে স্পষ্ট বিস্ময় ভাব ফুটে উঠেছে। উর্মির দৃষ্টি গোচর হলো সেটা। তড়িৎগতিতে মীরার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে? মীরা চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,
-‘আমি পারবো না যেতে।’
-‘কোথায় যাবি?’
-‘ছাদে।”
মুচকি মুচকি হেসে আহ্লাদে আট খানা হয়ে উর্মি বলল,
-‘রাইফ ভাই?’
মীরা কোনো জবাব দিলো না। হনহন করে হাঁটা ধরলো কিচেনে। বললেই হলো নাকি? কেনো যাবে সে? যাবে না।
উর্মি ছুটলো মীরার পেছন পেছন। কমিয়ে দেওয়া চুলার আঁচ টা মিডিয়াম করে দিলো মীরা। উর্মি তার কাছে এসে বলল,
-‘এখানে এলি যে, যাবি না?’
-‘না।’
মীরার স্পষ্ট জবাব। উর্মি বিস্ময় কন্ঠে বলল,
-‘আল্লাহ মীরু! আজ বাদে কাল উনি তোর হাসব্যান্ড হবে। আর তুই তার কথা শুনছিস না!’
-‘যেদিন হবে সেদিন শুনবো। আমি পারবো না যেতে। তুই জানিস লোকটা কেমন অস/ভ্য!’
-‘কেমন অস/ভ্য? কি করেছে?’
উর্মি কথায় বিস্ময়? মীরা মুখ ফসকে হাতে চুমু দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও সামলে নিলো।
আমতা আমতা করে বলল,
-‘উল্টা পাল্টা কথাতে লজ্জায় ফেলে আমাকে।’
মীরার এহেন কথাতে উর্মির বিস্ময় ভরা মুখটাতে দু’ষ্টমির হাসি ফুটে উঠলো। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘ওহহোওওও, শুরু হয়েছে তবে।’
মীরা ভ্রু কুচকে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ রাঙ্গালো। চারটা কাপ নিয়ে চা ঢালবে সে মূহুর্তে উর্মি একটা সরিয়ে ফেলল। মীরা তাকাতেই বলল,
-‘তুই তো ছাদে যাবি। চা খেলে দেড়ি হবে। তুই যা আমি চা নিয়ে যাচ্ছি মামু মামির কাছে।’
মীরা যাবে না বলে আবারও টে’নে নিলো কাপ। উর্মি মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো। বলল,
-‘যাবি না কেনো আশ্চর্য! দুই দিন পর যখন বিয়ে হবে তখন লুকাবি কিভাবে? তুই না গেলে রাইফ ভাই যে রকম মানুষ, বাসায় চলে আসবে। বুঝিস তখন।’
মীরা উর্মির কথাতে একটু দমল। হ্যাঁ, উনার কাজ কর্মের কোনো নিশ্চয়তা নেই। হুটহাট কি করে বসে বলা যায় না। যদি বাসায় এসে বলে বসে মীরাকে দরকার, তখন কি করবে সে। লজ্জায় পরে যাবে বাবা মার সামনে। ছিহ ছিহ, এমন টা না হোক। মীরা আরেকটা কাপ সরিয়ে দুইটা কাপে চা ঢাললো। মীরার হাতে দিয়ে বলল,
-‘আব্বাজান আর আম্মাকে দিয়ে আয় দ্রুত।’
-‘আমার চা? শুনে রাখ মীরু, আমি চা খাই। শুধু খাই বললে ভুল হবে, নে*শা উঠলে বালতিতে করে খাই৷ আর তুই কি না আমাকে চা দিচ্ছিস না!’
-‘ছাদ থেকে এসে খাবি। আয় দ্রুত। আমার সাথে যাবি তুই।’
উর্মি আশ্চর্য হলো আরেক দফা। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁক করবে তখনি হনহন করে পাশ কেটে চলে গেলো। যেতে যেতে বলল,
-‘তুই না গেলে আমিও যাবো না ফাইনাল।’
চলবে…..
রাইফ বিহীন সাধারণ পর্ব। ইনশাআল্লাহ পরের পর্ব রাইফ-মীরা ময় থাকবে। 💛💛💛