মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ১৪

0
99

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৪

🍁
সেই কখন থেকে কলিং বেল বেজে চলেছে এক নাগারে এবং একই সাথে হাত দিয়ে দরজার উপর ধারাম ধারাম শব্দ করে ধা’ক্কা দিয়েই যাচ্ছে, দরজা খুলছে না কেউ ই। খুলবেই বা কি করে, বাসায় যে মীরা ছাড়া অন্য কেউ ই নেই। কিন্তু সেও চুপচাপ আরাম করে পা তুলে হেলান দিয়ে বসে আছে সোফায়। সাড়া দেওয়ার বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ নেয় তার মাঝে। এক ধ্যানে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে কিছু একটা চিবুচ্ছে। শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগম গিয়েছেন মীরার মামা বাড়ি। তার ছোট মামা অসুস্থ, তাই দেখতে গিয়েছেন। চলে আসবে আজকেই। উর্মিকে রেখে গিয়েছেন মীরার সাথে। বেশ চলছিলো দুজনের। খাওয়া দাওয়া, আনন্দ ফুর্তি, গল্প গুজব করে সময় ভালোই পার করছিলো৷ কিন্তু আসল ঘটনা ঘটল মিনিট দশেক হলো। মনখোলা চঞ্চল উর্মি খোশমেজাজে গল্প করতে করতে মীরার বিয়ের সমন্ধটার কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এবং তৎক্ষনাৎ জিভে কামড় বসিয়ে চুপ ও হয়ে গিয়েছে। যদিও সরাসরি বলে নি, কিন্তু বুদ্ধিমতী মীরা ঠিক ই বুঝতে পেরেছে। তখন থেকেই জব্দ করে যাচ্ছে উর্মির পেটের কথা শোনার জন্য। কিন্তু উর্মীও পণ করে বসেছে আর একটা টু শব্দও বের করবে না পেট থেকে। এখন যা বলবে তাতেই বিপদ। শুধু বিপদ বললে ভুল হবে, মহাবিপদ।

মীরার যে প্রখর জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তা, তাতে সে ‘ক বলতেই কলিকাতা’ ঠিক বুঝে যাবে। কিন্তু মীরা যেভাবেই হোক শুনেই ছাড়বে পেটের গোপন কথা। মীরা আত্মবিশ্বাসী ও বটে, সে জানে এক পর্যায়ে রসকস মিশিয়েই বিস্তারিত বর্ণনা করে শুনাবে তার অগোচরে পরিকল্পনা করা কাহিনি। শুধু দরকার একটু কৌশল অবলম্বন করার। তাইতো এক পর্যায়ে ছলে বলে কৌশলে দরজার বাহিরে বের করে দিয়ে ভেতর থেকে লক করে দিয়েছে। মীরা জানে উর্মি দরজাতেই দাঁড়িয়েই থাকবে এবং এক পর্যায়ে ঘটনা বলবে বলে কথা দিয়ে ভেতরে প্রবেশও করবে। চলে যাওয়ার সাহস তার মাঝে নেয়। দিনের বেলা হলে ঠিক চলে যেতো নিজের বাসায়, কিন্তু রাত হওয়ার কারণে এখান থেকে এক পা নড়তে পারবে না সে। চলে না যাওয়ার কারণও আছে একটা। সন্ধ্যার পর থেকে বাসার যে দারওয়ান গার্ড দেয় তার চোখ দুটো ধূসর বর্ণের। অনেকে এমন চোখকে বিড়াল চোখ বলে থাকে। যাইহোক, সেই দারওয়ানের গায়ের রঙ আবার চকচকে কালো। যার জন্য চোখ দুটো তার চেহারায় বেশি প্রস্ফুটিত হয়। যদিও তার বয়স অল্প, এই আঠারো উনিশের দিকেই হবে। অনেক ভালো মনের মানুষ, হাসি ছাড়া কথায় বলতে পারে না। কিন্তু উর্মীর মনে হয় তার মুখে হাসি ফোটার সাথে সাথেই সাদা ফকফকা দাঁত এবং ধূসর বর্ণের চোখ জোড়া জ্বল জ্বল করে জ্ব লে উঠে। এই যে উর্মি এখানে দাঁড়িয়ে আছে, এখন যদি বাসায় চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ায় নির্ঘাত দেখা হবে দারওয়ান বেটার সাথে। আর তার এক চিলতে নিস্পাপ হাসি এবং উর্মিকে ‘আপা’ বলে ডাকার সাথে সাথেই খামোখা উর্মি ঘায়েল হবে, জ্ঞান হারাবে সেখানেই।

অনেক আকুতি মিনতির পর না পেরে চুপচাপ সিঁড়িতে বসে পরলো উর্মি। ফোনটাও সাথে নেয়, থাকলে সময়টুকু অনায়সেই কাটাতে পারতো। বিরক্ত হলো, নিজেকে বকা দিয়ে নিজের চোদ্দগুষ্টি নিজেই উদ্ধার করলো। এতো পাকনামি করতে হবে কেনো তার? সানজিদা বেগম যে এখানে আসার আগে একশ বার করে কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো যেনো এ বিষয়ে কোনো কথা না বলে মীরার সাথে তবুও কথা পেটে হজম হলো না কেনো! বেশ হয়েছে শাস্তি পেয়েছে। মীরা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কান খাড়া করল। টিপ টিপ করে পা ফেলে দরজার সামনে এসে লুকিং গ্লাসে চোখ রাখল। ওই তো উর্মি, সামনের সিঁড়িতেই বসে পায়ের বৃদ্ধাঙুল দিয়ে ফ্লোর খোঁচাচ্ছে। যাক, আছে তবে। মীরা মুচকি হাসল।
অপরদিকে উর্মি ধ্যানে মগ্ন। বলবে নাকি বলবে না? বললে আর কি হবে? আগে পিছে তো জানতেই পারবে। উর্মি না হয় মামুজানের কাজ আগায়ে রাখল। ভাবনার মাঝেই দারোয়ান এর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ধড়ফড় করে ওঠে দাঁড়ালো। নীচ থেকে উপরে উঠছে তা পায়ের শব্দে বোঝা যাচ্ছে।
উর্মি তড়িঘড়ি করে দরজায় ধা’ক্কা দিতে দিতে মীরা কে ডেকে উঠে বলল,

-‘মীরু রেএএ, দরজা খোল তাড়াতাড়ি। দারোয়ান আসছে।’

-‘দরজা খুললে আমার কি লাভ?’

-‘লাভ ক্ষতি দিয়ে কি করবি? আমার কথা একবারও চিন্তা করবি না?’

-‘আমার কথাও তো তোর ভাবা উচিত তাই না?’

মীরার কথা শুনে উর্মি হতাশ হলো। বলল,

-‘তুই অনেক পাঁজি হয়ে গেছিস মীরা। বিজনেস ম্যান দের মতো কেমন ডিল করছিস আমার সাথে।’

-‘যা খুশি তাই ভাবতে পারিস, দারোয়ান ব্যাটা এলো বলে, দাঁড়ায়েই থাক।’

উর্মি নিচে উঁকি দিলো। ওই তো দেখা যাচ্ছে একটু একটু৷ সাথে আরো কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে। শেষ রক্ষা আর বুঝি হলো না। উর্মি চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো,

-‘মীরা, আপু বলছি, বড় আপু। প্লিজ দরজা খোল।’

-‘তারপরের লাইন বল। যেটা আমি শুনতে চাচ্ছি।’

-‘আচ্ছা বলব, খোল দ্রুত।’

-‘কি বলবি?’

উর্মির এবার রাগে আর দুঃখে মাথা কাজ করছে না। যখন বলেছে বলবে তখন তো বলবেই। এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে এতো বিস্তারিত শোনার কি আছে! মামু আসলে ঠিক একটা বিচার বসাবে সে। বিরক্তিকর স্বরে বলল,

-‘এতো কাহিনি করছিস কেনো? বললাম তো বলবো, যা শুনতে চাচ্ছিস তাই বলবো।’

-‘পাক্কা?’
অধৈর্য হলো উর্মি। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ রে বাপ, পাক্কা।’

মীরার মুখের হাসি প্রসারিত হলো। খট করে দরজা খুলে দিয়ে অপেক্ষা না করেই পুনরায় সোফায় গিয়ে বসলো।

উর্মি স্বস্তির শ্বাস ফেলল। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এতোকিছুর পর অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার কারণে দরজা লক না করেই মীরার দিকে ছুটে গেলো।
পেছনেই কয়েক সিঁড়ির নিচে দাঁড়ানো রাজিয়া বেগম খেয়াল করলেন উর্মিকে। মাঝে মাঝেই দেখেন তাকে। টুকটাক কথাও হয়। বেশ ভালো মেয়ে বলতে গেলে, ওই একটু বেখেয়ালি স্বভাবের। ওইটা ব্যাপার না, বয়স বাড়ার সাথে সাথেই ঠিক হয়ে যাবে।

রাইফ কে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন শপিংয়ে টুকটাক কেনাকাটার জন্য। কিন্তু একটা দুইটা করতে করতে অনেক গুলো হয়ে যাওয়ার কারণে দারোয়ান ব্যাগ পত্র নিয়ে উপরে তুলে দিচ্ছে। নিষেধ কথা সত্বেও নিষেধ মানে নি। রাইফ আর তিনি আগে আগে আগে হাঁটছেন আর দারোয়ান পেছন পেছন।
রাজিয়া বেগম একটু ভাবলেন, ছেলের মতিগতিও এর মধ্যে পরখ করলেন। ছেলেও তাকিয়ে আছে দরজার দিকে উৎসাহিত চোখে। এমন তাকানোর অর্থ তিনি বুঝেন। মনে মনে খুশি হলেন। এতো দিনে যদি তার শূন্য ঘর টা ভরে ওঠে কারো পদচারণায়। ছেলের কাছ থেকে পজেটিভ কিছুই আশা করলেন রাজিয়া বেগম। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

-‘উর্মি মেয়েটা ভালো আছে তাই না রাইফ?’

-‘হু।’

রাইফের ছোট্ট উত্তর। রাইফ কথা বলছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার বাসার আধো খোলা দরজাতেই। ফাঁকফোকর দিয়ে যদি একটু দেখা যায় সেই আশায় বার বার নজর তাক করছে। এমন অবস্থা দেখে রাজিয়া বেগম শতভাগ নিশ্চিত না হলেও পঞ্চাশ শতাংশ নিশ্চিত হলেন। আত্মবিশ্বাসের সহিত জিজ্ঞাসা করলেন,

-‘তোর কেমন লাগে?’

মা জননীর মুখে এমন কথা শুনে রাইফ এর পা থেমে গেলো। নজর ফিরিয়ে আনলো দরজা থেকে। পকেটে হাত রেখে শুধালো,

-‘কি ব্যাপার আম্মা? কি বুঝাতে চাও? না প্যাঁচায়ে খোলাখুলি বলো।’

রাজিয়া বেগম ছেলের এমন প্রতিক্রিয়ায় একটু চিন্তায় পরে গেলেন। তবে কি তিনি ভুল বুঝলেন? আমতা আমতা করে বললেন,

-‘তুই নিজেই তো দরজায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস। মা হিসেবে আমিও একটু জানতে চাইলাম।’

রাইফের হাসি পাচ্ছে, ভীষণ রকমের হাসি পাচ্ছে। জোর পূর্বক ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করল। মায়ের হাত ধরে টানতে টানতে উপরে নিয়ে যেতে লাগল আর বলল,

-‘রং নাম্বার ডায়াল করে ফেলেছো আম্মা, আসল জন ভেতরে। সহজে ধরা না দেওয়া পাব্লিক সে। আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি অপেক্ষা করছি, তুমিও না হয় আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here