#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৯
🍁
সকালের নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে আছে খাদিজা বেগম আর সানজিদা বেগম। পাঁচ দিন হলো তিনি এসেছেন মীরাদের বাসায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন গত কাল বিকেলেই। কিন্তু মীরা আর উর্মির বাঁধাতে যেতে পারেন নি। আজ যেতেই হবে। একেবারে তৈরি হয়েই বসেছেন সোফায়। রান্নাঘর হতে টুংটাং শব্দ আসছে। মীরা চা বানাচ্ছে। উর্মি ঘুরে ফিরে একেকটা বয়াম এর মুখ খুলছে আর লাগাচ্ছে। কিসের সন্ধানে যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। মীরা ফুটন্ত গরম দুধে চামচ দিয়ে চা পাতা ঢেলে দিয়ে উর্মিকে লক্ষ্য করে চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছে সে। মেয়েটা থানা ত’ল্লাশি দিয়েই যাচ্ছে কখন থেকে। কখনও নীচের তাকে তো কখনও মোড়ার উপর দাঁড়িয়ে উপরের তাকে। উর্মি মনে মনে ভাবল, মামী তো এখানেই বলেছিলো, তাহলে পাচ্ছে না কেনো। পুরো কিচেন খুঁজে কিছুতেই পাচ্ছে না কাংখিত বস্তুটি। শেষ মেষ হতাশ হয়ে বসে পরল মোড়ায়। উর্মির এহেন কান্ড দেখে মীরার হাসি পেলো। মুচকি হেসে বলল,
-‘পেলি?’
-‘দেখছিস না?’
রাগ হলো উর্মির। দেখতেই পাচ্ছে খুঁজে পায় নি তার পরেও খোঁচা দিচ্ছে। মুখ ভেংচি দিয়ে এক গ্লাস জল একটু একটু করে খাচ্ছে। মীরা ওর পাশে বসে বলল,
-‘কাল আসবি না?’
-‘ঠেকা পরে নাই আমার।’
-‘রেগে আছিস?’
-‘না, হাসছি আমি।’
-‘তোর হাসি এমন কেনো? দেখতে রাগ রাগ লাগে, মুখটাও কেমন বোচা বোচা।’
ঠাড্ডার সুরে কথাটা বলেই মীরা ঠোঁট চেপে হেসে দিল। এবার আর উর্মি রাগ সংবরণ করতে সক্ষম হল না। চেতে উঠে হড়বড় করে কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আর তুই হাসলে যেনো মনে হয় অস্পরা লাগে! শোন, তুই হাসলে পে’ত্নির মতো লাগে। সামনের দুইটা দাঁত বের হয়ে আসে। আমি তো ভয়ে দিশেহারা হয়ে যাই।’
-‘সত্যি!’
-‘জ্বী আপা মনি। ভুলেও দাঁত কেলায়ে হাসবি না।’
-‘তাহলে কিভাবে হাসব?’
-‘মুচকি হাসবি। তবু দাঁত বের করবি না।’
মীরা উর্মির আরেকটু কাছে ঘেষে মুখটা আলাভোলা করে বোকা বোকা কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
-‘জোরে হাসি পেলে তখন?’
-‘জোরে হাসি পেলে গাল কেলায়ে হাসবি। প্রয়োজনে চোখও কেলাবি। কিন্তু দাঁত, একেবারেই না।’
উর্মির কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই প্রাণখোলা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো মীরা। গা কাঁপিয়ে হাসছে সে। হাসির চোটে এদিক ওদিক ঢলে পরছে। উর্মি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে মীরাকে। এই মেয়েটা হাসলে কি অনিন্দ্য সুন্দর লাগে দেখতে। হৃদয় এবং আঁখি দুটোই জুড়িয়ে যায় এই প্রাণখোলা হাসিতে। অথচ মেয়েটা হাসতেই যেনো ভুলে গেছে নানীজানের মৃ’ত্যুতে। এভাবে রোজ একটু হাসলে কি হয়! এতো কেনো কিপ্টামি এই মেয়েটার। কেউ তো ওর হাসি নিয়ে নিচ্ছে না। তবে? মীরা চকচকে সাদা দন্তপাটি বের করে উর্মিকে বলল,
-‘নে, এবার হাসির তারিফ কর একটু।’
-‘তোর এই প্রাণখোলা এক চিলতে হাসি মূহুর্তের মাঝে যে কারো হৃদযন্ত্র থমকে দিতে সক্ষম।’
-‘ধ্যাত, বেশি বেশি বলছিস এবার।’
উর্মি এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ, ভালো কথার তো ভাত নায়।’
মীরা নীচু হয়ে একটা ছোট্ট বয়াম বের করে হাতে দিলো উর্মির। তা দেখে চোখ জোড়া চকচক করে উঠল। ছো মেরে হাতে নিয়ে খুলে ফেলল ঢাকনা। এক মুঠো কিসমিস বের করে তিন চারটে মুখে পুরলো। শান্তি লাগছে এখন তার। মামীর কিচেনে এসে কিসমিস এ হাত দেওয়া যেনো নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উর্মির। এই ফাঁকে মীরা ফুটন্ত গরম চা কাপে ঢেলে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে। ফুপুর বিদায় বেলায় আবেগপ্রবণ অনুভূতিতে কিছু সময়ের জন্য গল্প জুরে দিল।
__________________
খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। সাদা কালোর সংমিশ্রণে সুতার কারুকাজ করা শুভ্র রঙের ফিনফিনে পর্দা উড়ছে মৃদু বাতাসে। দু পাশে সাদা পর্দার মাঝে অবস্থান করা মানবী কে কালো সালোয়ার কামিজে আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে। মীরা চুপটি ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ভাবুক তার মুখাবয়ব। দৃষ্টি তার খোলা আকাশে তুলোর মতো উড়ে যাওয়া সাদা সাদা মেঘ পুঞ্জতে। মৃদু বাতাসে খোলা চুল উড়ছে দুপাশে। কালো ওড়নাটা ঢিলাঢালা করে মাথায় দেওয়া। জোরালো বাতাসেই পরে যাবে যেকোনো সময়। মীরার কোন ধ্যান জ্ঞান নেই আশে পাশে। সামনের ব্যাস্ত সড়কে শো শো করে গাড়ি যাচ্ছে। কোলাহল ময় পরিবেশ। হঠাৎ উচ্চশব্দে গাড়ির হর্ন কানে আসাতে ধ্যান ফিরলো মেয়েটির। বিরক্ত হলো, চোখ মুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেলল। শব্দের উৎসের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল। এদিক সেদিক তকাতেই আকাশী রঙের শার্ট পরিহিত বলিষ্ঠ মানবের কাছে দৃষ্টি এসে থামল। রাস্তার এক পাশে বাইকে বসা। সামনে কোনো গাড়ি নেয়। তারপরেও তুমুল বেগে হর্ণ দিয়েই যাচ্ছে। রাইফকে দেখার সাথে সাথেই মীরা পর্দার আড়াল করল নিজেকে। লোকটা এই ভর দুপুরে কি করে এখানে? কার জন্য অপেক্ষা করছে আর পা’গলের মতো এতো হর্ণ ও বা দিচ্ছে কেনো! মীরা চুপিচুপি পর্দার আড়াল হতে চোখ দুটো বের করে আবারও দৃষ্টি দিলো পুরুষটির পানে। লোকটাকে দেখে ভদ্রলোক ই মনে হয়, কিন্তু সুযোগ পেলেই মানুষকে লজ্জায় ফেলাতে ওস্তাদ যেনো। রাইফ তাকে দেখছে না ভেবে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পর্দার আড়াল হতে বেরিয়ে পরখ করতে থাকলো মীরার ভাষ্যমতে অসভ্য লোকটিকে। রাইফ এবার নড়েচড়ে বসলো। বেশ আরাম করে বসে সামনে ঝুঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। আরেকটু ঝুঁকে সময় নিয়ে খুব যত্নের সহিত ডান হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো আয়নার ভেতরের আবদ্ধ মানবী কে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বাইকটা একটু বাঁকা করল। শরীর টা একটু পিছিয়ে এনে লুকিং গ্লাসে হাত রাখল। বা হাতে চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল কিঞ্চিৎ বাঁকা রহস্যময় হাসি। ডান হাতের কব্জি ঘুড়িয়ে লুকিং গ্লাস সূর্য বরাবর তাক করল। রাইফের মুখের হাসি এবার প্রসারিত হলো। আঙুলের টোকায় লুকিং গ্লাস টা কিঞ্চিৎ নড়াতেই সেকেন্ড এর ব্যাবধানে মীরার চোখে মুখে গিয়ে পরলো সূর্যরশ্মি। মীরা চোখ মুখ কুঁচকে হাত দিয়ে ঝলমলে আলো থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। রাইফ ঘুরে তাকিয়েছে মীরার দিকে। মিরার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে চোখের ইশারায় বুকের বা পাশে তাক করে বুঝিয়ে দিলো মীরার স্থান টুকু।
চলবে…..