মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ১

0
201

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
সূচনা পর্ব

মধ্যরাত্রি, নিস্তব্ধ চারিদিক। একফালি চাঁদ কালো মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় যেনো মত্ত হয়েছে আজ। আলো আধাঁরির এই আয়োজন একজন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেই যাচ্ছে ঘন্টা দুয়েক হলো। বিছানার সাথের জানালায় হেলান দিয়ে আকাশের পানে তার ভাবলেশহীন দৃষ্টি। জোৎস্নার রুপালি আলো এসে মেখে দিচ্ছে তার মুখাবয়ব। কোমড় সমান চুল গুলো বেশ পরিপাটি করে বেণি করা। সামান্য কিছু অলস চুল মুখের সামনে খেলা করছে। হঠাৎ কারো ডাকে ধ্যান ভাংলো মীরার। ধরফর করে তাকিয়ে দেখলো তার সমবয়সী উর্মি চোখ পাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখটা কাচুমাচু করে আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞাসা করল মীরা,

– ‘উর্মিমালা তুই! কখন এলি?’

-‘আসা কেনো, এখানে যদি একটা হাতিও জ’বাই করা হয় সেটা কি তুই বুঝবি?’

বেশ ঝাঁঝালো স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো উর্মি। মীরার ফুপুর মেয়ে সে। মীরাদের পাশের ভবনটাই উর্মিদের।
তৎক্ষনাৎ মীরার মনে দুষ্টুমি খেলা করল, বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

-‘আরেহ বাহ, হাতি জ’বাই করে ফেলছিস! কান দুইটা আমাকে দিস, বাতাস খাবো। যে গরম পরছে বাবা।’

উর্মিকে আরেকটু জ্বা লাতে এতোটুকু কথায় যেনো বাকি ছিলো। উর্মি রেগে হনহনিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। শুতে যাবে তখনি মীরা বলে উঠলো,

-‘গলার মালা, যাই কর আর তাই কর, আমি কিন্তু কাল সকালে উঠতে পারবো না। খবরদার ডাকবি না সকালে। ইয়া আল্লাহ! কত্তো দিন হলো ঘুমায় না। দেখি দেখি কোল বালিশ টা দে তো।’

উর্মি যেনো আকাশ থেকে পরলো। এই মেয়ে বলে কি, যে কিনা দিনের বেশির ভাগ সময় শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে কাটায় সে নাকি কতো দিন হলো ঘুমায় না। আর গলার মালা, উর্মিমালা এসব কি নাম। তার নাম তো উর্মি, শুধুই উর্মি। মীরার মাথার বাকি তার টুকুও নিশ্চিত ছিড়ে গেছে ভেবে দুদিকে মাথা নেড়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,
‘মামুজান কে বলে এর মাথার তার জোরা দিতে হবে খুব দ্রুত। কি মেয়েরে বাবা!’

________________

স্নিগ্ধ সকাল, কর্মব্যাস্ত হয়ে পরেছে বাড়ির গিন্নিরা। মশলা মাখানো রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক মুখরিত হয়েছে। কর্তা রা খবরের কাগজ হাতে চা পানে ব্যাস্ত।
পর্দা ভেদ করে সূর্যরশ্মি উঁকি দিচ্ছে। সোনালি আভা ছুঁয়ে দিচ্ছে কারোর কোমল গাল, নাক, মুখ, চোখ, গোলাপি ঠোঁট। মিনিট সময় পেরোতেই ভ্রু কুচকে গেলো মীরার। কাঁথা টেনে মুখ ঢাকলো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

-‘আম্মা, আজকের মতো ছেড়ে দেন আম্মা। একটু ঘুমাই।’

-‘একটু করতে করতে সকাল ১০ টা বেজে গেছে। ওঠ, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবি আয়।’

পর্দা টেনে জানালা খুলে দিয়ে খাদিজা বেগম ঘর হতে প্রস্থান করবে সেই সময় কোমল কন্ঠের গাঢ় ডাক ভেসে এলো,

-‘আম্মা’

-‘হ্যাঁ বল। কিছু লাগবে? চা আনবো?’

পেছন ফিরে তাকালো খাদিজা বেগম। গুটিগুটি পায়ে মীরার কাছে এলো। মা কে টেনে কাছে বসালো। হাত টা মুঠোয় পুরে মিনমিন করে বলল,

-‘আমি আর যাবো না আম্মা। তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না হলে। পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিবো। তুমি আব্বাকে বুঝাও। আমার সেখানে খুব শূন্য শূন্য লাগে। আমি অসুস্থ হয়ে যাই।’

-‘ ক্লাস না করলে পড়াশোনা হবে কিভাবে।আর তো একটা সেমিস্টার। কষ্ট করে থাকতে পারবি না?’

-‘পারবো না কেনো আম্মা, এতো দিন যখন পেরেছি, এখন ও পারবো। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভেতর টা ম রে যাবে।’

-‘এভাবে কেনো বলছিস মীরা? আমরা আছি তো। আচ্ছা ঠিক আছে, তোর আব্বার সাথে কথা বলবো আমি। এবার ওঠ।’

-‘আম্মা প্লিজ।’

অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে মীরার থমথমে কন্ঠে। খাদিজা বেগম নমনীয় দৃষ্টিতে তাকালেন মীরার দিকে। মেয়ের গালে হাত রেখে শুধালেন,

-‘পাগল মেয়ে, বললাম তো তোর আব্বাকে বলবো। ভয় কিসের। আমরা থাকতে কোনো ভয় নেই। আমার মীরা ভীষণ সাহসী।’

কথার মাঝেই শওকত রহমান এর ডাক ভেসে এলো,

‘ খাদিজা, ওষুধ টা কোথায় রাখছো?’

উচ্চস্বরে ‘আসছি’ বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন খাদিজা বেগম। হন্তদন্ত পায়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন রুম হতে। দরজার কাছাকাছি গিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি গেলাম। তুই ও আয় দ্রুত’

______________

রৌদ্রজ্বল তপ্ত দুপুর। কেউ অলস ঘুমে আচ্ছন্ন, কেউবা ব্যাস্ত তার দৈনন্দিন কাজ-কর্মে। শওকত রহমান আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বই পড়ছেন। মাথার উপর ভনভন শব্দ করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। গুটিগুটি পায়ে শওকত রহমানের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। হালকা গোলাপি রঙের ঢোলা-ঢিলা সালোয়ার-কামিজ পরিহিত সে৷ সাদা ওড়নাটা এক প্যাঁচে মাথায় এমন ভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে শুধু মুখ টুকু দৃশ্যমান। দু আংগুল ভাঁজ করে টোকা দিলো দরজায়। ভেতর থেকে উত্তর এলো,

-‘আমার আম্মাজান, ভেতরে আসেন।’

হৃদয় টা পরম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় সিক্ত হলো মীরার। এই দরজায় এসে একটা টোকাতেই শওকত রহমান কিভাবে যেনো বুঝে যায় তার একমাত্র আদরের কন্যার উপস্থিতি। মীরা কপাট ঠেলে ভেতরে পা রাখলো। মুচকি হেসে শওকত সাহেব কে সালাম জানালো তার মিষ্টি কন্ঠে,

-‘আস সালামু আলাইকুম আব্বাজান?’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাহতুহু। আমার কাছে দ্রুত আসেন আম্মাজান। আমার হৃদয়টাকে শীতল করেন।’

বইটা পাশ্ববর্তী টেবিলে রেখে দুহাত মেলে দিলেন তিনি। মেয়েকে বুকের বাহুডোরে আগলে রাখার আকুল আবেদন তার চোখে মুখে। মীরার নেত্রপল্লব এ জল ভীর করলো বাবার আদুরে ডাকে৷ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে নোনাজল। গিলে ফেলতে চাচ্ছে কান্না গুলো, কিন্তু তারা কি আর এতো সহজে বাঁধা মানে। মীরা বড় বড় পা ফেলে বাবার পাশে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। মাথা রাখলো বাবার কাঁধে। আগলে নিলেন শওকত রহমান। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। এবার আর বাঁধা মানলো না অশ্রু। ঝরঝর করে নোনাজল গুলো গাল ভিজিয়ে দিলো। ভাংগা ভাংগা কন্ঠে হেঁচকি তুলে শওকত রহমান কে শুধাল,

-‘আপনি কেমন আছেন আব্বাজান? আপনার শরীর ভালো তো?’

-‘একি, কান্না করছেন কেনো আম্মাজান! আপনি জানেন না আপনার বিষন্ন মুখ আমাকে কতো কষ্ট দেয়। আপনার ছেলে একদম ঠিক আছে। আপনি এসেছেন, আমার আর কোনো চিন্তা নাই। চোখের জল মুছে ফেলেন তো দেখি।’

-‘আপনি শুধু শুধু কেনো চিন্তা করেন আমার জন্য। আমি তো ভালো আছি আব্বাজান। কেমন শুকিয়ে গেছেন আপনি।’

– শুকাই নাই আম্মাজান। অনেক দিন পর দেখছেন বলে এমন মনে হচ্ছে। কাল আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনার?

-‘না আব্বাজান। আপনাদের দোয়ায় আর আল্লাহর অশেষ রহমতে সহি-সালামতে এসেছি সন্ধ্যায়। রুমে দু চক্কর ও দিয়েছি রাতে। আপনি বাহিরে ছিলেন।’

-‘মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো আমার আম্মার? খেয়েছেন পেট ভরে? আপনার জন্য নদীর মাছ এনেছি। দুপুরে খাবো একসাথে।’

-‘ঠিক আছে আব্বাজান।’

শওকত রহমানের আরেকটু কাছ ঘেষে বসলো মীরা। আমতা আমতা করছে কথাটা বলতে। তবে না বললে মনে হয় স্বস্তি পাবে না সে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতে করতে মাথানিচু অবস্থায় জড়ানো কন্ঠে বলেই ফেললো সে,

-‘আব্বাজান’

-‘জ্বী।’

-‘একটা জরুরি কথা ছিলো আপনার সাথে।’

-‘হ্যাঁ বলেন।’

-‘আমি আপনার অনুমতি না নিয়েই একেবারে চলে এসেছি। আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু আমি কি করবো বলেন। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার একা একা। আমি আর যাবো না সেখানে। আপনি প্লিজ দ্বিমত করবেন না।’

-‘আপনি কি পড়াশোনা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’

-‘তা না। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিবো। কিন্তু আপনাদের ছাড়া আমি আর থাকতে পারবো না। আমাকে মাফ করবেন আব্বাজান।’

মীরার মাথাটা আরেকটু ঝুঁকে গেলো অপরাধবোধে। বুকটা উচাটন করছে, না জানি কি জবাব দেয় তার বাবা। শওকত রহমান বুঝলেন মেয়ের ভেতরের অবস্থা। মেয়ের হাত টা মুঠোয় নিয়ে বললেন,

-‘মাথা উঁচু করেন আমার প্রাণের আম্মাজান। নিচু মাথায় আমার আম্মাকে মানায় না। আমি আপনাকে আর ফোর্স করবো না। তবে হল কিন্তু ছাড়া যাবে না। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। আমি আপনার এমন মুখ দেখতে চাইনা আর। আমার সেই হাসিখুশি আম্মাকে দেখতে চাই। আপনার হাসিতে যে আমার প্রাণ ভরে যায়।’

মীরার আতংক গ্রস্থ মন বাবার কথা শুনে স্থির হলো। শওকত সাহেব এর হাতের উপর হাত রাখলো। নীচু স্বরে বলল,

-‘আপনাকে অনেক ভালোবাসি আব্বাজান, আমি কোনো ভুল করলে শুধরে দিবেন দয়াকরে।’

-‘আমার আম্মাজানের সব ভুল মাফ আমার দরবারে।’

বাবা-মেয়ের আলাপচারিতায় রুমে প্রবেশ করলেন খাদিজা বেগম। হাতে চা এর ট্রে। শওকত রহমান এ সময় এক কাপ চা খেয়ে গোসলে যান। টি টেবিলে রেখে মীরাকে বললেন,

-‘কিচেনে যা তো মা একটু। মাছ চুলায়, এক পিঠ ভাঁজা হলে উল্টে দিস। আমি আসছি।’

-‘ঠিক আছে আম্মা, আসি আব্বাজান।’

-‘হ্যাঁ যান, গোসল দিয়েন দ্রুত।’

-‘ঠিক আছে।’

_____________

ঝকঝকে বিকাল, মীরা ঘুম থেকে উঠে আসরের সালাত আদায় করেছে কিছুক্ষণ হলো। এখনও সে জায়নামাজে বসা। এর মাঝে রুমে হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো উর্মি। মীরার পাশে ধপাস করে বসে পরলো।

-‘ ছাদে যাবো চল, খুব সুন্দর বাতাস। রুমে ভ্যাপসা গরম।’

-‘কখন এলি?’

-‘এক ঘন্টা হলো। তুই ঘুমাচ্ছিস বলে ডাকি নি। তোর নামে মামুর কাছে নালিশ দিতে গিয়ে শুনলাম তুই নাকি একেবারে এসেছিস?’

মীরা অবাক নেত্রে তাকালো উর্মির দিকে৷ মনে মনে ভাবছে ‘নালিশ দেওয়ার মতো আমি কি করেছি আশ্চর্য!’ জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালো। মাথার হিজাব টা খুলে বিছানায় বসলো। উর্মিও পেছন পেছন বিছানায় এসে পাশাপাশি বসলো। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-‘কি হলো বল? একেবারে এসেছিস?’

-‘হুম।’

ছোট্ট জবাব মীরার। উর্মি যেনো এই জবাবের ই অপেক্ষায় ছিলো। লাফিয়ে উঠলো বিছানায়। খুশিতে আত্মহারা সে। খুশি হবেই না বা কেনো। সকালে যখন মামীর কাছে শুনেছে মীরা একেবারে এসেছে তখনি মসজিদে একশত টাকা দিবে বলে মনস্থির করেছে৷ সকালের কথা মনে হতেই উর্মির মুখ চুপসে গেলো৷ এলোমেলো দৃষ্টিতে কিছু খুঁজতে লাগলো সে। ড্রেসিং টেবিলের উপর পেয়েও গেলো বস্তুটি। দৌড়ে ঝটপট হাতে নিলো পার্সব্যাগ টা। চেইন খুলে দুইশত টাকার একটা নোট নিয়ে জায়গা মতো রেখে দিলো ব্যাগটি। উর্মির কর্মকান্ডে হতভম্ব মীরা। উর্মি বোকাবোকা হেসে বলল,

-‘তুই যেনো একেবারে থেকে যাস এজন্য মানত করেছিলাম একশ টাকা। দিতে হবে তো।’

-‘আচ্ছা, তা বাকি ১০০ টাকা কিসের জন্য?’

-‘কিসের আবার। সকাল থেকে টেনশনে আমার ছোট্ট আত্মাটা শুকিয়ে গেছে। কোল্ড ড্রিংকস খেতে হবে। চল নারে ভাই, এখন উপরে চল।’

মীরা চুল গুলো হাত খোঁপা করে ওড়না টা মাথায় জড়িয়ে নিলো। স্লিপার পায়ে সিঁড়ির ধাপ গুটিগুটি পায়ে অতিক্রম করছে। কিন্তু উর্মি, সেতো খরস্রোতা নদীর মতোই চঞ্চল। স্থিরতা নেই একটুও। বড় বড় পা ফেলে দুই সিড়ি অতিক্রম করে ছয় তলা বিল্ডিং এর ছাদে ওঠা শেষ। মীরা ধীর পায়ে খুব সতর্কতার সহিত উপরে উঠলো। রেলিং এর ধারে উর্মির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হিমেল হাওয়াতে মীরার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো মূহুর্তেই। চার মাস পর আবার সেই চিরচেনা ছাদে সে দাঁড়িয়ে। এই বিস্তৃত খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা রমনীর ধ্যান জ্ঞান সবটাই এখন স্মৃতিচারণে ব্যাস্ত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here