ত্রিধারে তরঙ্গলীলা |৮৪|

0
198

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৪|
বাবা, মা হারিয়ে যে তীব্র ধাক্কা খেয়েছে। সে ধাক্কা সহ্য করতে পারছে না সিমরান। তাই এমন একটি সিদ্ধান্ত। অবুঝ আর অতি-আবেগি সিদ্ধান্ত।
এ পৃথিবীতে তাকে বাবা, মা’ই নিয়ে এসেছে। অথচ তাদের দু’জনের কেউই আজ বেঁচে নেই। তাদের ভাই, বোনকে ছেড়ে চলে গেছে চিরতরে। আর কখনো ফিরে আসবে না। এই নির্মম সত্যিটুকু মেনে নিতে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। স্মরণ হয়েছে একদিন এ পৃথিবী ছেড়ে তাকেও চলে যেতে হবে। এটাই নিয়ম। একদিন তার সন্তান হবে। তারাও বড়ো হবে। সে যখন মারা যাবে ওরাও ঠিক এমনই করে দুঃখ পাবে। ভেঙে পড়বে তীব্র যন্ত্রণায়। এতিম হওয়ার মতো দুর্বিষহ জীবন ভোগ করতে হবে৷ শিউরে উঠে অন্তঃকরণ। ভয়ে মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। যাদের এ পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্ব নেই৷ তাদের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়৷ যদি তার সন্তানরাও একদিন এই কষ্ট ভোগ করে? নাহ, সে কিছুতেই এমনটা হতে দেবে না৷ সন্তানদের দুনিয়াতে একা ছেড়ে যদি চলে যেতেই হয় তাহলে তাদের দুনিয়াতে আনার কী দরকার। অবুঝ, অশান্ত এক অভিমান হয়৷ তার নেওয়া সিদ্ধান্ত, কিছুক্ষণ পূর্বে বলা কথাটি সৌধর ভেতরে কী প্রভাব ফেলেছে খেয়াল করে না। আকস্মিক যখন খেয়াল করে দেখতে পায় সৌধ স্তম্ভিত মুখে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে নিমেষে। অসহায়, বেদনার্ত হয়ে বলে,

‘ আমি পারব না। ‘

সৌধর স্তব্ধতা কাটে। অস্থির হয়ে কাছে আসে৷ প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘ কী পারবে না তুমি? ‘

‘ আমাদের সন্তানকে দুনিয়ায় একা ছেড়ে চলে যেতে।’

সহসা নিভে যায় সৌধ। দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলে অল্পখানি। হাত বাড়িয়ে ডান গালটা ছুঁয়ে দেয়। গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ এমন পাগলামি করতে নেই সিনু। এ পৃথিবীর সব মানুষকে একদিন প্রাণ ত্যাগ করতে হবে৷ এই চিরন্তন সত্যিটা সবাই জানে। তাই বলে কি তাদের জীবন থেমে থাকে? তুমি জানো তুমি একদিন মারা যাবে। তাই বলে কি খাওয়া, দাওয়া ছেড়ে দেবে৷ পড়াশোনা থামিয়ে দেবে? আমি জানি একদিন আমি মরে যাব৷ তাই বলে কি সবকিছু ছেড়েছুড়ে বসে থাকব? নাহ, মৃত্যু যখন আসবে আসবেই। যতদিন বেঁচে থাকব জীবনের নিয়ম মেনে বাঁচতে হবে। পেটে খিদে পেলে খাবার খেতে হবে। খাবারের জন্য পরিশ্রম করে টাকা ইনকাম করতে হবে। একাকীত্ব গোচাতে সঙ্গী খুঁজতে হবে। এরপর সংসার। তারপর বংশধর বৃদ্ধি করা। বাবা, মা হওয়া৷ মানবজীবনের এই ধারাবাহিকতা মেনে চলতেই হবে। এসব ভালো না লাগলে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করতে হবে৷ ধর্মকর্ম মানো যবে মৃত্যু আসবে তবে মৃত্যুকে বরণ করো৷ কিন্তু তোমার পক্ষে তো সন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব না। কারণ তুমি আমাকে সন্ন্যাস জীবনে ঢুকতে দাওনি। যে পথে বাঁধা দিয়ে তোমাতে মত্ত করেছ। আজ সে পথ তোমার জন্য হারাম সিনুপাকনি। ‘

নিশ্চুপ সিমরান। দৃষ্টি নত করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে৷ সৌধ অপরহাত বাড়াল। দু-হাতের অঞ্জলিতে কোমল গালদুটো আঁকড়ে ধরে কপালে কপাল মিলিয়ে বলল,

‘ আমার একটা ছোট্ট পাকনি চাই। নিজের যত্ন করো বউপাখি৷ এক বছর সময় দিলাম তোমায়। এরমধ্যে ফাইনাল ইয়ারটা কমপ্লিট হয়ে যাবে। ব্যস, আর দেরি নয়। আমাদের হ্যাপিনেস ছোট্ট পাকনিকে আনতে হবে। ‘

সৌধর প্রগাঢ় চাউনি, মাতাল মাতাল স্বরে করা আবদারটিতে কী ছিল কী? জানে না সিমরান। শুধু জানে অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি বলে তার ভেতরের সমস্ত আগুন নিভে গেল৷ সর্বাঙ্গে বয়ে গেল কেবল শীতল স্রোত৷ বুকের বা পাশটায় কী যে আরাম আরাম অনুভব করল বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না৷ ভালো লাগার শিহরণে ম্রিয়মাণ হয়ে উঠল ওর দেহশ্রী। সৌধ টের পেল সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে সিমরানকে। পারবে নাই বা কেন? মেয়েটা যে তাকে ভালোবাসে৷ বেপরোয়া ভাবে ভালোবাসে। বেসামাল ভাবে অনুভব করে। যে ভালোবাসা এ পৃথিবী আর কোনো মেয়ের মাঝে খুঁজে পায়নি সে। একজন ব্যতীত কারো কাছে খোঁজার চেষ্টা করেনি। যার মাঝে খোঁজার চেষ্টা করেছে সে আজ অতীত। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ৷ পুরুষালি, উষ্ণ হাত দু’টোতে আরো গভীর করে চেপে ধরল গালে। সিমরানের নাকে নাক ঘঁষলো আলতো করে। ঠোঁটের অতি নিকটে ঠোঁট রেখে মোহঘোর স্বরে বলল,

‘ শুধু বন্ধু, বান্ধবীদের বাচ্চাদের মামা, কাকা হয়ে হয়ে বুড়ো হতে চাই না বউপাখি৷ বাবা ডাকটাও শুনতে চাই। যে তোমার, আমার অংশ হয়ে এ পৃথিবীতে জন্মাবে তার বাবা ডাক। ‘

সৌধর স্পর্শ, গাঢ় চাউনি আর গভীর ভালোবাসা দিয়ে বলা প্রতিটি কথা জাদুর মতো কাজ করল৷ ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠল মেয়েটা। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দৃষ্টি বুজে ফেলল আচমকা। সৌধ যেন শান্তি পেল৷ প্রশান্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে সিমরানকে দ্বিতীয়বার দম ফেলার সুযোগ দিল না। পুরুষালি উত্তপ্ত ঠোঁটের অসহন ভালোবাসায় ভিজে উঠল কোমল, মসৃণ ঠোঁটজোড়া৷

মানুষের জীবনে লক্ষ্য থাকা জরুরি। লক্ষ্যহীন মানুষ পৃথিবীতে জড়ো বস্তুর মতোই৷ সৌধ বিচক্ষণ। যে কোনো পরিস্থিতি, যে কোনো মানুষের ভুল সে সঠিক বুঝ দিয়ে শুধরে দিতে পারে৷ হয় যদি ঘরের বউ। আর বউটি যদি হয় সিমরানের মতো স্বামী অন্ত প্রাণ। তাহলে যুদ্ধে বজয়ী হওয়ার মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় নিগূঢ় ভালোবাসা। বউকে আদর দিয়ে কত কী বোঝাল, মানালো। বিনিময়ে বউটি শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে থাকল। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ একটি গুহা। পুরুষ মানুষের বক্ষঃগহ্বরের মতো শ্রেষ্ঠ গুহা আর দ্বিতীয়টি নেই। এই গুহায় যে নারী প্রকৃত স্থান পায় সেই জানে পৃথিবী কত সুন্দর! জীবন কত সুখময়!
.
.
ভোরবেলা সুহাস তৈরি হচ্ছিল। রাতে সুহৃদ জ্বালিয়েছে আজ খুব৷ ঘুম হয়নি নামীর৷ তাই সে ঘুমুচ্ছে। ঘুম সুহাসেরও হয়নি৷ তবু আজ বন্ধু, বান্ধবীরা আসবে। কিছু বাজার করতে বেরুচ্ছে সে। তৈরি হয়ে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই শুনতে পেল,

‘ কোথায় যাচ্ছো? ‘

হাই তুলতে তুলতে উঠে বসল নামী৷ সুহাস থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বলল,

‘ বাজারে। ‘

চকিতে বিছানা ছাড়ল নামী। চিন্তিত হয়ে বলল,

‘ তুমি বাজার করতে পারবে! ‘

‘ পারতে হবে। ‘

ইশ! সুহাসকে কি এত কাঠিন্য, গম্ভীরতা মানায়? এ যেন হঠাৎ করেই দুরন্ত কিশোর পরিপক্ব যুবকে পরিণত হয়েছে। চুলোয় যাক সে চিন্তা। সুহাস যেই রূপেই পদার্পণ করুক৷ আগে বুঝতে হবে তাকে নিয়ে ওর অনুভূতিটা এই মুহুর্তে ঠিক কী? অনুভূতি না বুঝে সে পূর্ণ অধিকার খাঁটাতে পারবে না৷ সে জানে সুহাসের কাঁধে এখন অনেক বোঝা৷ এসব বহন করতে প্রচণ্ড মানসিক শক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন শারীরিক সুস্থতাও। আর একজন যোগ্য সঙ্গিনী। নিজেকে অবশ্যই যোগ্য মনে করে নামী। সে আত্মবিশ্বাস আছে তার৷ কিন্তু তাকে সুহাস পজিটিভলি কতটুকু নেবে তা নিশ্চিত না হয়ে পা বাড়ানোর সাহস পাচ্ছে না৷ স্বামী শব্দটা আজ বড়ো ভারিক্কি লাগছে নামীর৷ বেআক্কল, চঞ্চল, মাথা খারাপ সুহাস যতটা সহজ ছিল আজ এই নির্লিপ্ত, গম্ভীর সুহাস ততটাই কঠিন৷ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নামী৷ রয়েসয়ে বলল,

‘ আমি আসি তোমার সঙ্গে? ‘

কপাল কুঁচকে তাকাল সুহাস৷ কিছু একটা ভেবে অনুমতি দিতে গিয়েও থেমে গেল৷ সুহৃদের পানে তাকিয়ে বলল,

‘ ঘুমুচ্ছে একা রেখে যাওয়া যাবে না। কান্না করবে। ‘

‘ কিচ্ছু হবে না৷ কাউকে বলে যাই খেয়াল রাখতে। কতক্ষণই বা দেরি হবে? ও উঠতে উঠতে আমরা চলে আসব। ‘

সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বাবা, মা৷ কাকে ভরসা করবে সুহাস? তার চিন্তা কমালো নামী। চট করে বাইরে গিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল সুহাসের মামাত বোন রঞ্জিতাকে। ওকে ডেকেই দায়িত্ব দিল। যদি তারা আসার আগে উঠে যায় খেলনা দিয়ে মন ভুলাতে। এরপর ঝটপট ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাজার দূরে নয়৷ হেঁটে পাঁচ মিনিট৷ তাই গাড়ি বা বাইক নিল না। সকালবেলা হাঁটা শরীর, মন উভয়ের পক্ষে ভালো৷ তাই নামীই বলল,

‘ চলো হেঁটেই যাই। মনটা ভালো লাগবে। ‘

এক পলক তাকাল সুহাস। কিছু বলল না৷ হাঁটতে শুরু করল। নামী তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বোঝার চেষ্টা করল হাবভাব। এরপর আশপাশে তাকিয়ে ওটা, সেটা প্রশ্ন করল। সুহাস উত্তর দিল কিছু। পথে দেখা হলো কয়েকজন পরিচিত মানুষের সঙ্গে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কথা বলল তাদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলে মন আরো বিষাদে ভরে গেল সুহাসের৷ সবাই আহারে, উহারে করছে। বাবার নামে প্রশংসা করছে। ‘ তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন ‘ সুহাস জানে তার বাবা কেমন ছিলেন। বাবার ছেলে হিসেবে নিজের প্রতি আজ ধিক্কার আসছে৷ এ জীবনে সে কিছুই করতে পারল না। পড়াশোনা করে ডাক্তারি সার্টিফিকেট অর্জন করলেই মানুষ হওয়া যায় না৷ সফলতাকেও স্পর্শ করা যায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। ওর মুখাবয়ব দেখে নামীর বুক চিনচিন করে উঠল। সুহাস কেন কিছু বলছে? ওর একটু রাগ ঝাড়া বোধহয় প্রয়োজন। একটু রাগ, একটু অভিযোগ আর বুক পরিষ্কার করে কান্না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাজারে পৌঁছে গেল। পরিচিত এক মুরুব্বি ডাক দিল,

‘ সুহাস না? ‘

‘ জি আংকেল আসসালামু আলাইকুম। ‘

‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম। বাজার করতে আসছ বাবা। পাশে কে? ‘

‘ আমার স্ত্রী নামী রহমান। ‘

ভদ্রলোক তাকালেন নামীর দিকে। বললেন,

‘ বেশ বেশ। শুনেছি বউও ডাক্তার। ‘

স্মিত হাসল সুহাস৷ নামী চুপ৷ ভদ্রলোক ফের বললেন,

‘ কী করবা তাহলে বাবার এতবড়ো ব্যবসা দুজন মিলেই হাল ধরো নাকি? দূরে চাকরিবাকরি করলে এগুলো কে দেখভাল করব৷ ‘

‘ জি ভাবছি৷ দোয়া করবেন। ‘

কথা বাড়াল না সুহাস৷ এগিয়ে গেল। নামী ওর পিছু নিয়ে চলল কাঁচা বাজারের দিকে। মাথায় রাখল ভদ্রলোকের বলা কথাটি। সত্যি তো! সোহান আংকেল নেই এখন৷ ক্লিনিক গুলোর দায়ভার কার ওপর রয়েছে? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো? এ ব্যাপারে সুহাসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সিমরানের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। মালিকানা তো দু’ভাইবোনই পাবে এবার৷ সুহাস চাইলে সে মিলেমিশে সবকিছুর হাল ধরবে। সোহান খন্দকার যে আশা প্রত্যাশ্যা নিয়ে তাকে পুত্রবধূ করেছিল। সেগুলো পূরণ না করতে পারলে, সংসারটাকে নতুন করে সাজাতে না পারলে অশান্ত মনটা শান্ত হবে না৷ রেহাই পাবে না অপরাধী মন।

সবকিছুর বেশ চড়া দাম৷ প্রথম দোকানে গিয়ে টমেটো কিনল সুহাস৷ যা দাম চাইল তাই দিল। নামী কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ কিন্তু পরের দোকানে অন্যান্য সবজি কিনতে গিয়ে সুহাসকে কিছু বলার সুযোগ দিল না৷ জামাকাপড়ের মতো সবজিতে তেমন দরদাম করা যায় না। তবু সবকিছুতে দশ টাকা হলেও কম দিল নামী। সুহাস ইশারা করল অনেক৷ তার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। এমন না যে সে কম টাকা নিয়ে বাজারে এসেছে। বর্তমান যা বাজারমূল্য জানে সে। তাই পকেটে টাকা থাকা সত্বেও এমন কিপ্টেমি করার মানে হয় না। সবজির দোকান থেকে ওরা এবার মুরগির দোকানে পা বাড়ায়। সুহাস স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘ এমন করে দাম করছ কেন! কী ভাববে উনারা? আমাদের কি পয়সা নেই?’

আশ্চর্য হয়ে তাকাল নামী। মানে টা কী? টাকা আছে বলে যে যা দাম চাইবে তাকে তাই দিতে হবে? চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে সে বলল,

‘ টাকা থাকলেই যা চাচ্ছে তাই দিব নাকি? ‘

‘ উনারা বিজনেস করে নামী৷ সবজি বিক্রি করেই সংসার চালায় উনারা। ‘

‘ আহারে দরদ, তোমার কি মনে হয় দু পয়সা লাভ না করেই যে দাম বলেছি তাতে দিয়েছে? ‘

‘ তুমি দামাদামি করবে না। জাস্ট সব দেখে দেখে নিবে। পে আমি করব৷ ‘

‘ শুধু দেখে দেয়ার জন্য তো আসিনি৷ জীবনে বাজারঘাট করোনি জানি বলেই কীভাবে দামাদামি করে ভালো জিনিস কিনতে হয় শেখাতে এসেছি। ‘

‘ দামাদামি শেখাতে হবে না। লোকে ছোটোলোক বলবে৷ ‘

‘ আরেহ বাবা ছোটোলোক বলবে কেন? তুমি কী বোকা সুহাস। এভাবে চলাফেরা, কেনাকাটা করলে তো আমার সংসারটা উচ্ছ্বন্নে যাবে! ‘

সহসা চুপসে গেল সুহাস। থমকানো দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে সরে গেল। নিশ্চুপ হয়ে গেল নামীও। চুপচাপ মুরগির দোকানে ঢুকল। সুহাস দামাদামি করতে নিলে সে ত্বরিত গিয়ে মুরগি কেজিতে পঞ্চাশ টাকা কম বলল। সুহাসের যেন মাথা কাটা গেল এবার। চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বলল। নামী কথা শুনল না। বিশ টাকা কমই দিল৷ সুহাস বিড়বিড় করে বলল,

‘ নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।’

নামী কথাটা স্পষ্ট না শুনলেও বুজে ফেলল। দোকান থেকে বেরিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ রাগ করছ কেন? জীবনে চলার পথে সবকিছুতে হিসেব নিকেশ করে চলতে হয়। বাবা, মায়ের অবর্তমানে গোটা সংসার এখন আমাদের হাতে। বাচ্চাদের মতো করে তো চলা যাবে না৷ পকেটে এক কোটি টাকা থাকুক। তবু হিসেব করে খরচ করতে হবে। বেহিসাবি মানুষের কখনো ধন হয় না৷ বাবা, মা তাদের যে ধন রেখে গেছে তা তো রক্ষা করতে হবে? তারা তৈরি করেছেন আমাদের জন্য। তা রক্ষা করে আরো বেশি তৈরি করতে হবে আমাদের বাচ্চাদের জন্য। ‘

অসন্তুষ্টি কিছুটা কমল সুহাসের। দু’জনের দু’হাতে বাজারের ব্যাগ৷ পাশাপাশি হাঁটছে আর নামীর কথা শুনছে। হঠাৎ পাড়ার কয়েকটা ছেলেকে আসতে দেখল। এই এক্ষুনি পাশ কাটিয়ে যাবে তাদের। সুহাস অতি কৌশলে নামীর ডান পাশে চলে এলো। নিমেষে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল বারো, তেরো জন যুবকের দলটি। কথা বলার ফাঁকে বিস্ময়কর এই ঘটনাটি মনে দাগ কাটল নামীর৷ নতুন করে এক টুকরো প্রেমের হাওয়া দোল দিল কি মনে? দিল বোধহয়। তাই তো শ্যামলাটে মুখটা আরক্ত হলো। ছেলের মা বুঝি টোপ করে প্রেমে পড়ে গেল ছেলের বাবার? সুপাত্র, সুকৌশলে যত্নবান পুরুষ হয় যদি ছেলের বাবা, লজ্জাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছেলের মা নতুন করে প্রেমে হাবুডুবু খেতেই পারে।
.
.
চলবে!
® জান্নাতুল নাঈমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here