নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ১৬

0
180

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মেয়েরা হলো টিস্যুর মতো। ব্যবহার শেষে ছুঁড়ে ফেলতে হয়। এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ততদিনই রাখা উচিত যতদিন না সেই মেয়েকে বিছানা অবধি নিয়ে যাওয়া যায়। কাজ শেষ তো ছুঁড়ে ফেলে দাও। আর যারা বিছানা অবধি যাবে না তাদের তিলে তিলে শেষ করা উচিত আমাদের বীরপুরুষের মতো ছেলেদের সময় নষ্ট করার জন্য!”

সিরাতের কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক চোখে তাকায় তার দিকে৷ তুরাগের গালে হাত দিয়ে সিরাত আদুরে কণ্ঠে বলে,

“কী? তাই না তুরাগ? আরে তুরাগের মতো ছেলেদের তো তুলনা হয় না। একজন ছেলে একসাথে এতজন মেয়ের সাথে সময় কাটাতে পারে, এটা তো গর্বের বিষয়। অনেকে একজনকেই সামলাতে পারে না। সেখানে সে এক নয়, দুই না, তিন তিনজন মেয়ের সাথে সম্পর্কে যুক্ত। ব্যাপারটা সুন্দর না?”

সিরাতের কথায় তুরাগ চমকে ওঠে। আরেকজনের কথা এই মেয়ে কীভাবে জেনে গেল!

মাওয়া সিরাতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

“তিনজন মানে? এসব কী বলছিস তুই?”

“তোরা কেউ আমার কথা বুঝতে পারছিস না তাই না? আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি। তোরা এক কাজ কর, প্রত্যেকে ফোনের ক্যামেরা অন কর। ইভান, নাবিল আর অভি তোরা তিনজন সামনের গ্যারেজে গিয়ে কিছু পে*ট্রল আর সাইকেলের চেইন নিয়ে আয় যা।”

“এসব দিয়ে তুই কী করবি?”

“আহা নাবিল এত প্রশ্ন করছিস কেন? যা বলছি সেটা কর।”

ইভান, নাবিল আর অভি সিরাতের কথামতো গ্যারেজে চলে যায়। সিরাত তুরাগের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

“তরুলতার কথা মনে আছে তুরাগ?”

তুরাগ চোখ বড়ো করে তাকায় সিরাতের দিকে। ঢোক গিয়ে বলে,

“তরুলতা কে?”

“ওমাহ্ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন স্যার? কিছুদিন আগেই না তরুলতাকে বললেন তাকে আপনি ভীষণ ভালোবাসেন। তাকে বিয়ে করতে চান।”

তুরাগ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সিরাত পুনরায় বলে ওঠে,

“এখনো মনে পড়ছে না? আচ্ছা আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। গত দুই মাস আগে অনলাইনে আপনার একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আপনারা দু’জন বেশিরভাগ সময় একে-অপরের সাথে কথা বলে সময় কাটাতেন। এইতো সতেরো দিন আগে আপনি তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেন। আপনাদের তো আগামী শনিবার দেখা করারও কথা ছিল। এখন মনে পড়ছে কিছু?”

“তুমি এতকিছু জানলে কীভাবে?”

“যাক, ভুলে যাননি তাহলে। আমি সবকিছু জানি। কারণ সেই তরুলতা আর কেউ নয়, আমি নিজেই ছিলাম স্যার।”

ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায় তুরাগ। সিরাত মুচকি হেসে এগিয়ে যায় তার দিকে।

“ভয় পেলেন স্যার? আসলে আপনার উপর আমার শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। আমি মাওয়াকে অনেক বার বলেছিলাম আপনার থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু মাওয়া শোনেনি আমার কথা। সে ভালোবাসার টানে আমার কথা অগ্রাহ্য করেছিল। অবশ্য এতে ওর কোনো দোষ নেই। আমাদের বয়সটাই এমন আবেগের। আমার বান্ধবী যেহেতু আমার কথা শোনেনি তাই পরীক্ষা করার জন্য আমি নকল তরুলতা সেজে আপনার সাথে কথা বলা শুরু করি। আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পারেননি, কারণ আমি কণ্ঠ বদলাতে পারি। আর রইল ছবির কথা। সেই ছবিগুলো আমার ছিল না। আমার পরিকল্পনা তেমন শক্তপোক্ত ছিল না। তবুও আপনি আমার পাতা ফাঁদে পড়েই গেলেন।”

সবকিছু শুনে তুরাগের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আঠারো বছর বয়সী ছোট্ট একটা মেয়ে তাকে এভাবে ঘোল খাইয়ে দিল!

মাওয়া ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সিরাতের দিকে। অতঃপর কান্নাগুলো চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে তাকে প্রশ্ন করে,

“তুই যদি সব আগে থেকেই জানতিস তাহলে আমাকে কেন বললি না?”

“শনিবারে প্রমাণসহ দেখাতে চেয়েছিলাম তোকে। কিন্তু তার আগেই নকশি অন্য একজনের সাথে একে দেখে ফেলল।”

“আমরা এসে গিয়েছি।”

সবকিছু নিয়ে অভিদের আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সিরাত। নাবিলের হাত থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে হাতে পেচিয়ে তুরাগকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মেয়েদের কেবল বিছানাতেই মানায় তাই না? তারা তো ভোগ করার বস্তু আপনার মতো ছেলেদের কাছে।”

কথাটা বলে মুহূর্তের মধ্যেই পরপর তিনবার সাইকেলের মোটা চেইন দিয়ে সজোরে আঘাত করে তুরাগের শরীরে। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সে। আশেপাশের প্রত্যেকের চোখ ততক্ষণে স্বাভাবিকের চেয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছে। আরো তিন/চারবার আঘাত করার পর তুরাগ ব্যথায় রাস্তার মাঝে শুয়ে পড়ে। সিরাত রাগে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু গেড়ে বসে তুরাগের গাল চেপে ধরে।

“মেয়েরা মায়ের জাত। তাদেরকে সম্মান করতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়, ভালোবাসতে হয়। অসভ্যতামি করে কিংবা প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কোনো বীরপুরুষের কাজ নয়। তোদের মতো ছেলেরা যদি এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে না থাকে তাহলেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তুরাগের বিশেষ জায়গায় ইচ্ছামত লাত্থি দিতে শুরু করে সিরাত। মাওয়া ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে সিরাতকে। কিন্তু তাকে কিছুতেই আটকানো যায় না। অভি গিয়েও সামলাতে পারে না তাকে। বাধ্য হয়ে ইভান তারিনকে ইশারা করে সিরাতের কাছে যাওয়ার জন্য। এখন সে নিজে গেলে সিরাতের কাছে গেলে সে আরো বেশি রেগে যাবে।

তারিন গিয়ে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেয় সিরাতকে। তুরাগ প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে থাকে রাস্তার মাঝে।

“এদের মতো ছেলেদের জন্য মানুষ ভালোবাসতে ভয় পায়। আমরা মেয়েরা একা বাইরে বের হতে ভয় পাই। এদের জন্যই পর*কীয়ার মতো জঘন্য একটা বিষয় তরতরিয়ে বাড়ছে। এরা পৃথিবীতে বসবাস করার অযোগ্য।”

চিৎকার করে কথাগুলো বলে থেমে যায় সিরাত। তার হাত বেয়ে র*ক্ত পড়ছে। সাইকেলের চেইন এত জোরে চেপে ধরার ফলে হাত কেটে গিয়েছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে নিজ মনে বলে যায়,

“চরিত্রহীন পুরুষেরা তখনই বেশি সাহস পায় যখন মেয়েরা নিজেদের সতিত্ব নির্দ্বিধায় বিসর্জন দেয় এদের কাছে। আরে মেয়ে, তুমি কেন বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে ঘনিষ্ঠ হবে? তুমি কেন তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার হাতে তুলে দেবে যে কি-না ভালোবাসার নামে সুযোগ নেয়। তুমি কি এতটা সস্তা যে বিয়ের আগে সতিত্ব হারিয়ে প্রেমিক দূরে সরে গেলে আত্মহ*ত্যা করবে? এই যদি হয় মেয়েদের অবস্থা তাহলে আমি বলব, আফসোস সেই বাবা-মায়ের জন্য যারা তোমাদের মতো মেয়েদের জন্ম দিয়েছে। তোমরা তো মেয়ে হওয়ারই যোগ্য না। মেয়েদের কখনো নরম তুলা হতে হয় না। মেয়েদের হতে হয় সূর্যের মতো প্রখর। মেয়েদের হতে হয় তেজস্বিনী। তবেই না তুমি হবে আদর্শ মেয়ে!”

উপস্থিত প্রতিটা মেয়েকে মা*থা নত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিরাত র*ক্তলাল হাতে চোখের পানি মুছে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একজন এসে সিরাতের হাতে একটা ফাইল দিলে সেটা নিয়ে পুনরায় তুরাগের সামনে গিয়ে বলে,

“এখানে তোর সমস্ত সার্টিফিকেট আছে। তোর মতো ছেলে কোনো পেশায় যাওয়ার যোগ্য নয়। তাই এসব রেখেও কোনো লাভ নেই।”

সিরাত ফাইল থেকে সমস্ত কাগজ বের করে তুরাগের সামনে রাখে। তারপর পে*ট্রল দিয়ে জ্বা*লিয়ে দেয় সবকিছু। তুরাগ চেয়েও আটকাতে পারে না তার সর্বনা*শ!

মাওয়া কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে নিজের গালে থা*প্পড় দেয়। সিরাত পাশে বসলে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমাকে মাফ করে দে দোস্ত। আমি মিথ্যা ভালোবাসার মোহে আটকে তোকে ভুল বুঝেছিলাম। নিজের এত বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছি কেবল তোর কথা শুনিনি বলে। আমাকে মাফ করে দে তুই।”

শেষ হয়ে যায় ভিডিয়ো। মাহতাব নিষ্পলক চেয়ে আছে ল্যাপটপের দিকে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এতক্ষণ কোনো অ্যাকশন মুভি দেখছিল। একজন মেয়ের এমন রূপ বাস্তবে এর আগে সে কখনোই দেখেনি। আর আজ যখন দেখল তখন জানতে পারল মেয়েটা তার নিজের স্ত্রী!

“সিরাত সেদিন আমার সাথে যা করেছিল তার জন্য আমি আমার পুরুষত্ব হারিয়েছি। হারিয়েছি পরিবার, হারিয়েছি মানসম্মান, হারিয়েছি চাকরি, হারিয়েছি ভালোবাসা, হারিয়েছি বেঁচে থাকার কারণ। আমি আজও বেঁচে আছি শুধুমাত্র সিরাতের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। সেদিনের পর আমি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। তারপর সুস্থ হয়ে তন্নতন্ন করে সিরাত আর মাওয়াকে খুঁজেছি। কিন্তু ওদের কোথাও পাইনি। একবার যখন সিরাতকে পেয়েছি তখন আমি নিশ্চিত মাওয়াকেও পাব। আর তারপর ওদের কাউকে আমি ছাড়ব না।”

“মানে? কী করবি তুই?”

“মাহতাব তুই না ভীষণ বোকা। আরে যে মেয়ে বান্ধবীর জন্য এমন করতে পারে সে তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে যখন তুই ওর স্বামী?”

“কী বলতে চাইছিস তুই?”

“আমি যতদূর সিরাতকে চিনি, ওই মেয়ে তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। তোর জীবন ধ্বং*স না করে থামবে না।”

“কিন্তু সিরাত তো এখনো চুপচাপই আছে।”

“এটাই তো সমস্যা। ওই মেয়ে চুপচাপ আছে মানে তোর জন্য খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।”

“তাহলে আমি এখন কী করব?”

“ওর থেকে বাঁচতে হলে ওকে বাঁচতে দেওয়া যাবে না।”

তুরাগের কথায় মাহতাব অবাক হয়ে বলে,

“মানে?”

“সিরাত বেঁচে থাকা মানে তোর মৃ*ত্যু। তাহলে তোকে বাঁচার জন্য কী করতে হবে? ভেবে দেখ!”

“ভাই সিরাত আমার সন্তানের মা। আমি ওকে মা*রতে পারব না। এসব দয়া করে আমাকে বলিস না।”

কথাটা বলে চলে যায় মাহতাব। তুরাগ চুপচাপ পেনড্রাইভ ঘুরিয়ে আপনমনে বলে,

“আমি যখন ফিরে এসেছি তখন তো সিরাতের বেঁচে থাকা কঠিন মাহতাব। তুই চাইলেও আমাকে আটকাতে পারবি না ভাই!”

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here