#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৩
হৃদিতার তিনদিন যাবৎ জ্বর। তিনদিনে একটা বারের জন্যও কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি সে। তার মা-বাবা দুজন মিলেই মেয়ের কাছে আছেন, মেয়ের দেখাশোনা করছেন। তিনটা দিন পর জ্বর খানিকটা কমতে শুরু করেছে। হৃদিতা এখন নিজেই একা টুকটাক এটা ওটা করতে পারছে। ভাড়াবাসায় মা-বাবার এই প্রথম আসা। বাবা-মার সঙ্গ দিনগুলো যেন রঙিন করে তুলেছে হৃদিতার।
মেয়েকে আগের তুলনায় বেশ সুস্থ দেখে রাসেল সাহেব এখানকারই বাজারে গিয়েছিলেন ছোটোমাছ আর টাটকা কিছু সবজি কিনে আনতে। নাহার বেগম চাচ্ছিলেন গোরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাসেল সাহেব আবদার করেছেন ছোটোমাছ খাওয়ার। নাহার বেগম না পেরে ছোটোমাছও রান্না করতে রাজি হয়েছেন। নাহার বেগম রাজি হওয়ার সাথে সাথে রাসেল সাহেব বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজারের দিকে বেরিয়ে গিয়েছেন।
নাহার বেগম ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রেখেছেন অনেকক্ষণ আগে। রান্নাঘরেই কাজ করছিলেন।
হৃদিতাকে রান্নাঘরের দরজায় দেখে নাহার বেগম মৃদু হেসে বলেন,“ভালো লাগছে এখন একটু?”
হৃদিতা বসার নিচু টুল টেনে নিয়ে বসে। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে বলে,“ আজহার রেজা আঙ্কেল কল দিয়েছিলেন। আমাকে একটু যেতে বলল।”
নাহার বেগম মেয়ের কথায় কাজ থামিয়ে বললেন,“ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছো না আর তুমি কি না বাহিরে যেতে চাইছো? তোমার হাতে কী ওটা?”
হৃদিতার হাতে সাদা পৃষ্টা দেখে কথাটা বললেন নাহার বেগম। হৃদিতা কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“রিজাইন লেটার। আমি আমার শখের জব ছেড়ে দিচ্ছি, আম্মু।”
আরেক দফায় চমকে গেলেন নাহার বেগম। পাত্রে রাখা পানিতে হাত ধুয়ে, হাতের পানি ঝেরে ওরনায় মুছতে মুছতে বললেন,“ ছেড়ে দিচ্ছিস কেন? তুই-ই তো আমাদের কথার অবাধ্য হয়ে এই জবে এসেছিলি। ”
হৃদিতা মাথানিচু করে বলে,“আমি এখানে শান্তি পাই না, আম্মু। কেমন অশান্তি লাগে। এখানে এসে আমি মানুষের আরেকটা বিচ্ছিরি চেহারা দেখতে পাই। হয়তো এই পেশা আমার জন্য না। তুমি ভাবতে পারো একটা মেয়ে কতটা নিকৃষ্ট হলে নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কাউকে খু**ন করতে পারে? যে ভাই কি না কোনো মেয়েকে ধর্ষ**ণ করেছিল? আর তাকে খু**ন করেছে যে কি সেই ধর্ষি**তার ভাই! বোনের জন্য লড়তে এসেছিল তাকেই কি নির্মমভাবে জাল বিছিয়ে খু*ন করল! এখন যেই খারাপ অবস্থা, মৃ*ত্যুর সাথে লড়ছে তখন নিজের দোষ স্বীকার করেছে। আয়ু শেষ হওয়ার সময় সবাই কেমন ধোয়া তুলসীপাতা হতে চায়! ”
কথাগুলো বলে আরেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হৃদিতা। নাহার বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,“ বেরিয়ে আয় মা। ওসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নে। যে যেমন করবে তার ফল সে ভোগ করবেই।”
নাহার বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলে,“ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানো, আম্মু?”
নাহার বেগম ভ্রু কুচকে বলেন,“কী?”
“এতগুলো বছর পর একজনকে এক দেখায় ভালো লেগেছিল। সে-ও কি না সেই মেয়েকে এই কাজে উস্কানি দিয়েছিল। সেই মেয়ে এত বড়ো অমানবিক, অন্যায় করার পর সেই পুরুষই তাকে সবদিক থেকে আগলে রেখেছে। ”
নাহার বেগম ভ্রু কুচকে বলে,“ তুই আবরারকে পছন্দ করিস?”
হৃদিতা মাথানিচু করে বলে,“ প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিল। ইথারের পর আর কাউকে সেরকম ভালো লাগেনি। ”
নাহার বেগম উঠে দাঁড়ায় চোয়াল শক্ত করে বলে,“ হৃদি, আমি তোর মুখ ইথার নামটা একদমই শুনতে চাই না। ওই নামটা অভিশপ্ত। ”
হৃদিতা দুইহাত দিয়ে নিজের পা জড়িয়ে মাথা ঠেকিয়ে বলে,“স্যরি। আমি কি বের হব একটু? ”
“ সাবধানে।”
হৃদিতা উঠে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে বাসা থেকেও বের হয়। বাসার নিচে এসে আজহার সাহেবকে কল দেয়। দুইবার রিং হয়ে কেটে যায়। হৃদিতা একটা রিকশা নিয়ে অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলে আজহার সাহেব কলব্যাক করেন।
ফোন বেজে উঠতেই হৃদিতা ফোনটা পার্সব্যাগ থেকে বের করে কলটা রিসিভ করে। আজহার রেজা ওপাশ থেকে বলে ওঠেন,“ হৃদিতা, আমি হাসপাতালে আছি। তুমিও এখানেই চলে এসো। এশার অপারেশন হয়েছে তোমাকে বলেছিলাম তখন, ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসার কথা কিন্তু ডাক্তাররা বলছে কোনো আশা দেখছে না তারা।”
হৃদিতা ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “শা*স্তি তো পেতেই হবে স্যার। কম অন্যায় তো করেনি। আবরার সাহেবের কী খবর?”
“উনি অনেকটা সুস্থ।”
“ উনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।”
“তুমি এসো আগে এখানে।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
হৃদিতা কল কেটে ফোনটা আবার রেখে দেয়। রিকশাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে চুপচাপ বসে থাকে।
___
ময়না বেগম বাড়ি ফিরেছেন বেশ কয়েকদিন পরে। বাড়ি ফেরার পরপরই শুনেছেন উমেদ ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ছোট ছেলের এমন একটা খবরে তিনি বেশ খুশি। বাড়িতে যে-ই আসছে তাকে ছেলের চাকরির কথা বলছেন তিনি।
ঘরে বসে এক প্রতিবেশী মহিলার সাথে গল্প করছিলেন ময়না বেগম। সুরাইয়া দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মহিলাটি হেসে বলে ওঠে,“ কী গো বউমা, নাতি-নাতনির মুখ দেখব কবে? কম দিন তো হলো না। এবার তোমার শাশুড়ির জন্য সময় কাটানোর সঙ্গী নিয়ে এসো। আর কতদিন সে এভাবে আমাদের সাথে গল্প করবে? তার তো নাতি নাতনিদের সাথে খেলাধুলার বয়স হয়েছে।”
সুরাইয়া চা এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,“ আমার শাশুড়ি কিন্তু কখনো বলেনি তার খেলার সঙ্গী লাগবে। বললে না হয় ব্যবস্থা করা যেত।”
ময়না বেগম চায়ের কাপ নিয়ে বলেন,“ এতদিন বলিনি এখন বলছি, জলদি বাচ্চা নাও বয়স তো অনেক হচ্ছে। নাতি-নাতনির মুখ দেখাও। ”
সুরাইয়া পাশে দাঁড়াতেই আশরাফ মায়ের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মাথা চুলকে বলে,“ মা, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।”
পাশে প্রতিবেশীকে দেখে আবার বলে ওঠে,“ কেমন আছেন চাচি? শরীর ভালো তো?”
মহিলাটি সহাস্য বলে,“ হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ তুমি ভালো আছো তো?”
আশরাফ হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“ হ্যাঁ আমিও ভালো আছি।”
ময়না বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,“ কী বলতে এসেছিলি? কোনো দরকার?”
আশরাফ সুরাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মায়ের দিকে তাকায়৷ নরমস্বরে বলে,“ ভাবছিলাম সুরাইয়াকে নিয়ে তিনদিনের জন্য বেড়াতে যাব কক্সবাজার। এই সময়ে সমুদ্র অন্যরকম সুন্দর হয়ে ওঠে। না আছে রোদ, গরম আর না আছে বৃষ্টি। আবহাওয়া অনেক বেশি সুন্দর থাকে। সুরাইয়াকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয়নি তাই ভাবলাম এবার ওকে নিয়ে একটু দূরে ঘুরতে যাই। ”
পাশে থেকে মহিলাটি বলে ওঠে,“ বাহ, বেশ ভালো তো। বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে এটা তো বেশ ভালো কথা। আমার মেয়ে-জামাইও গত বছর গিয়েছিল ওখানে। কতরকম শুটকিমাছ এনেছিল, আমাকে অনেক দিয়েছিল আমার মেয়ে। আচ্ছা ভাবি, আপনারা কথা বলেন, আমি বরং বাড়ি যাই।”
মহিলাটি চলে যেতেই ময়না বেগম বলে ওঠে,“ তুই একটু বেশিই বউ-পাগল হয়ে যাচ্ছিস না আশরাফ? বাড়ির বউকে নিয়ে বেড়াবি মানে? বউকে নিয়ে কেন এতদূর যেতে হবে? কোথাও যাবি না তোরা। তোর বউ তো একেবারেই না।”
সুরাইয়া মা-ছেলের সামনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সে জানে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে অযথা কথা শুনতে হবে। তার ছেলের ইচ্ছের জন্য নিজেকে দোষারোপ শুনতে হবে।
সুরাইয়া চলে যেতেই আশরাফ আবার বলে ওঠে,“ আম্মা প্লিজ, তিনটা দিনেরই তো ব্যাপার। এর আগে তো সুরাইয়াকে নিয়ে আমি কোথাও যাইনি। আমি চাইলে তোমার অনুমতি ছাড়া অনেককিছুই করতে পারি কিন্তু করি না। আমি চাই সবকিছুই তোমার অনুমতিতে হোক। ”
ময়না বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,“অনেক টাকার ব্যাপার। এতগুলো টাকা জলে ফেলতে আমি দেব না। ”
#চলবে….