#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০২
আশরাফ এসে সুরাইয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। সুরাইয়া সেভাবে থেকেই বলে ওঠে,” শরীরের আগে মনের খোরাক মেটাতে শিখুন শেখ সাহেব।”
আশরাফ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত দিয়ে মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। সুরাইয়া পাশেই বসে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে।
আশরাফ সুরাইয়ার হাত ধরে নরমস্বরে বলে,” আ’ম স্যরি সুরাইয়া৷ এই তিনটা দিনের জন্য স্যরি। তুমি জানোই তো বাহিরের মানুষের সামনে আমার লজ্জা বেশি আর তাছাড়া মা অসুস্থ ছিল। আমাকে কাছে থেকে ছাড়ছিলই না৷ আমি যখনই বাড়ির বাহির বা মার কাছে থেকে ছাড় পেয়েছি ওমনি রুমে এসেছি। কখনো পেয়েছি তোমাকে তো কখনো পাইনি। দূর থেকে তোমাকে দেখতে হয়েছে আমার। আর কী বলছ তোমার জ্বর আমি জানি না? জ্বর আসলে তো তোমার জ্ঞানই থাকে না৷ রাতে যখন আমি রুমে এসে তোমার গালে চুমু দিতে গিয়েছি কপালে থাকা ছোটো চুল সরাতে গিয়ে দেখি তোমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর। আমি রাত দুইটা পর্যন্ত জলপট্টি দিয়েছি, ভেজা কাপড় দিয়ে যতটুকু পেরেছি শরীর মুছে দিয়েছি যেন তাপমাত্রা কমে যায়। সকাল সকাল বের হয়ে ওষুধও নিয়ে এসেছি৷ তুমি আমার সাথে কথা বলছিলে না জন্য আমারও অভিমান হয়েছিল। ওষুধের পলিতে চিরকুট লিখে রেখেছিলাম সেটাও দেখছি দেখোনি৷ ”
আশরাফ কথা শেষ করে খাটের নিচে থেকে একটা বাটি বের করে সুরাইয়াকে দেখায়। দরজার পিছনে থাকা সাদা কাপড়টাও ইশারায় দেখায় সুরাইয়াকে।
আশরাফ বাটিটা আবার নামিয়ে রেখে বলে,” নারীর ভালোবাসা অল্পতেই চোখে পড়ে কিন্তু পুরুষ লুকিয়ে ভালোবাসতে পছন্দ করে। তুমি কখনো একটা কথা মাথায়ও এনো না যে আমি তোমার জন্য নেই। আমার জীবনে মা আর তুমি দুজনই দুদিক দিয়ে জরুরি৷ তোমাকে ভালোবেসে রাগ দেখাতে পারব, বকতে পারব, অভিমান করতে পারব কিন্তু মায়ের সাথে এগুলো করে ওঠা সম্ভব না। আমি আসলেই দুঃখিত সুরাইয়া। আমি তোমাকে নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে চিন্তিত হয়তো ছিলাম না।”
আশরাফ বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যেতে পা বাড়ালে সুরাইয়া বলে ওঠে, ” শুনুন।”
আসরাফের পা থেমে যায়। পিছনে ফিরে বলে,” হুম।”
” কাল অন্তত আমার জন্য সন্ধ্যায় সময় রাখুন। অনেকদিন বের হওয়া হয় না।”
” ঠিক আছে।”
” শুনুন।”
” বলো।”
” স্যরি।”
” ভালোবাসি বলতে শিখো।”
_____
হৃদিতা আর ইশিতা ভার্সিটিতে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ আগে। সাহিল, ফাউজিয়া আর অনয়ের আসার কথা অনেক আগেই কিন্তু তারা এখনো এসে পৌঁছায়নি।
হৃদিতা ক্যাম্পাসে এসে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে ফাউজিয়াকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইশিতা।
কল রিসিভ হতেই হৃদিতা বলে উঠল,” কী রে কই তোরা? সোয়ামি-বউ ঘর থেকে বেরোসনি? এদিক আসবি না নাকি? তোরা দেরি করে আসবি সেটা বললেই হতো তাহলে আমি আর ইশুও দেরি করে আসতাম। ”
ফোনের ওপাশ থেকে ফাউজিয়া বলে ওঠে,” গেইটে দ্যাখ একটু। ”
হৃদিতা সাথে সাথে তাকিয়ে দেখে ফাউজিয়া আসছে, একা আসছে। সাথে সাহিল নেই। ফাউজিয়া হেটে সোজা হৃদিতা আর ইশিতার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ইশিতা তাৎক্ষণিক বলে ওঠে,” কী লাগতেছে ভাই! সাহিল কি এমনি এমনি বউয়ের আঁচলের নিচ থেকে বের হয় না নাকি? ঘরে এরকম মারকাটারি ফিগারের সুন্দরী বউ থাকলে কি অন্যদিকে নজর যায় নাকি? ”
ইশিতার কথায় লজ্জা পেয়ে যায় ফাউজিয়া। হৃদিতা এদিক ওদিক দেখে বলে,” তোর বর কই? বউকে একা ছাড়ল কেন আজ?”
ফাউজিয়া ক্যাম্পাসের বাহিরে ইশারা করে দেখিয়ে বলল, ” খাবার কিনতে গেছে। শুকনো মুখে অনুষ্ঠান দেখব নাকি? ”
ইশিতা কাউকে ফোন করতে করতে বলে,” এই অনয়ের বাচ্চা কই ক’ তো? এই বা*লডারে দেখলাম না সময়মতো আসতে। কোথাও হয়তো দাঁড়ায় দাঁড়ায় সিগারেট ফুঁকছে। বান্দর একটা।”
ফাউজিয়া ইশিতার ফোনটা নিয়ে অনয়কে দেওয়া কলটা কেটে দিয়ে বলে,” অনয়, সাহিলের সাথেই আসছে। চল আমরা ভেতরে যাই।”
” আগে বলবি তো..”
হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” মিস করতেছিলা অনয়বাবুরে?”
লজ্জায় নুইয়ে যায় ইশিতা। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,” চলতো। ওই বা*লডারে কেডায় মিস করবে? একটা চাকরিও ঠিকঠাক করছে না। তুই মেয়ে হয়ে পেয়ে গেলি আর ও! ”
” আমি কীভাবে পেয়েছি সেটা তো জানিসই।”
ফাউজিয়া পাশে থেকে বলে ওঠে,” তোকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয় হৃদি।”
____
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে রাতের রান্না চড়াবে কখন তুমি? বাড়িত যে এতগুলান মানুষ রইছে সেইদিকে দেখি কোনো খেয়ালই নাই তোমার, সুরাইয়া!”
ময়না বেগমের কথায় বিছানা থেকে উঠে বসে সুরাইয়া। গম্ভীরমুখে বলে,” লতার মা রান্নার ব্যবস্থা করতেছে। আজ থেকে সে-ই রান্না করবে।”
ময়না বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কপাল সটান ছড়িয়ে বললেন,” কাজের লোকের হাতের রান্না খাওয়া লাগবে এখন? এমন দিন চলে আসলো যে বাড়ির মানুষ রান্না না করে কাজের লোককে দিয়ে রান্না করাবে?”
” হ্যাঁ আসলোই তো। আপনারাও তো বাড়ির মানুষকে বাড়ির মানুষের মতো না রেখে কাজের মানুষের মতোই রাখতে চান। কাজের মানুষ, কাজের মানুষের মতো থাকলে সমস্যা কোথায়?”
” তোমারে কাজের মানুষের মতোন রাখা হয়?”
” হয় না বলছেন? সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত কে কামলা খাটে কন তো?”
” বাড়ির বউরা বাড়িতে কাজ করবেই, তোমারও করতে হবে।”
” বাড়ির বউ আর কাজের মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাছাড়া আপনার মেয়েরে দিয়ে দিন-রাত এতো কাজ করাতে পারতেন, মা?”
ময়না বেগম যেন আ*গুনে জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” আমার মেয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য বেড়াতে এসে কাম করবে?”
” শ্বশুরবাড়িতে নিজেদের সাথে শ্বাশুড়ির রান্না করা লাগবে জন্য বাসাভাড়া নিছে। ভাবছি আপনার ছেলেকেও বলব হয় নতুন বাসা নিবে নয়তো আমি এ সংসার করব না। ”
” সাহস বেড়ে গেছে তোমার।”
” মেয়ের কথা ভাবলে আমার কথা কেন ভাববেন না? ছেলের বউ বলে? মেয়ের শাশুড়ি মেয়ের সাথে একদিন খারাপ ব্যবহার করেছিল বলে বাসা নিয়ে দিলেন আর আপনি যে প্রতিদিন অত্যা*চার করেন খারাপ ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে? আপনি যদি বাড়ির বউয়ের মতো আমার সাথে ট্রিট না করেন তবে আমি আমার অধিকার বুঝে নিতে বাধ্য হব।”
ময়না বেগম রাগে গটগট করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
_____
অনুষ্ঠানের মাঝে ঘোষণা করা হলো বিশেষ অতিথি চলে এসেছে। এক্ষণি এখানে অবস্থান করবেন। হৃদিতা বোতলের ক্যাপ খুলে কিছুটা পানি খেয়ে অনয়কে বলে ওঠে,” এটাই সেই নেতা?”
অনয় মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,” হ্যাঁ। এটাই। ভাই দেখতে যেরকম আ*গুন, ব্যবহারেও সেরকম আ*গুন। কেউ তার কথার বিরুদ্ধে গেলেই জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে ছাড়খা*ড় করে দেয়। ”
” পুরুষ মানুষের এমন না হলে দাম নাই। দেখতে কেমন? ইশিতার সাথে মানাবে?”
ইশিতা হৃদিতাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,” আমার সাথে মানাতে হবে কেন? তুই নিজের জন্য রেজিস্ট্রি করে নে। আমার লাগবে না।”
হৃদিতা ইশিতাকে ইশারায় চুপ করতে বলে ফাউজিয়া আর সাহিলকে দেখায়। ফাউজিয়া আর সাহিল একপাশে বসে অনুষ্ঠান দেখছে আর কথা বলছে।
অনয় হেসে বলে,” কে বলেছে বন্ধুদের মধ্যে বিয়ে করলে বিয়ে টিকে না? বন্ধুরাই তো বন্ধুকে ভালোমতো চিনে। সাহিল আর ফাউজিয়াকে দেখ, পরিবার থেকে দুজনকে ইন্টারের পরপরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে আজ এতগুলো বছরেও ওদের ভালোবাসা কমেনি। ”
হৃদিতা অনয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” তোরাও বিয়েটা করে নে। কোনো না কোনো রাস্তা বেরিয়ে যাবে।”
অনয় মুখ গম্ভীর করে ওঠে, ” ওর পরিবার আমাকে মানবে না, হৃদি।”
তাদের কথার মাঝেই চারপাশে জোরেসোরে হৈ হৈ আওয়াজ শোনা যায়। বাহিরে থেকে সেটা গেইট পর্যন্ত এসেছে। কয়েকজনের সাথে ফুলের মালা গলায় ভেতরে প্রবেশ করে আবরার ফাইয়াজ। দুই পাশে খয়েরী শাড়ি পরিহিত মেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছড়াচ্ছে। চোখের সানগ্লাসটা খুকে পকেটে রেখে হাত মিলিয়ে সোজা মঞ্চে গিয়ে বসে। দুপাশে আরও কয়েকজন সম্মানিত অতিথি এবং শিক্ষকগণ বসে আছেন।
হৃদিতা প্রথমদিকের সাড়িতে বসায় আবরারকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সাহিলের পাশে থেকে ফাউজিয়া ইশিতাকে ডেকে বলে,” ইশু, লোকটা কী জোশ দেখতে রে!”
ইশিতা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,” আরেকটা বিয়ে করবি? নাজায়েজ কামকাজ!”
” দেখতে ভালো হইলেই ক্যান বিয়ে করে নেওয়া লাগবে? আমার আছে।”
” তাইলে চুপ থাক।”
” মেজাজ গরম নাকি?”
” তোর কথায় হচ্ছে।”
” চাল হাট..” বলেই ফাউজিয়া সামনের দিকে তাকায়।
একদল মেয়ের নৃত্য পরিবেশনের পরই আবরার ফাইয়াজকে ডাকা হয় তার মূল্যবান বক্তব্যের জন্য। আবরার নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই সামনে বসে, দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-মেয়ে চিৎকার করে উঠে তালি দিতে থাকে। মেয়েদের গলার স্বর বেশিই কানে আসে সবার। আবরার অবিবাহিত সুদর্শন যুবক বলে একটু বেশিই পরিচিত সবার কাছে। মাইক্রোফোনের কাছে এসে দাঁড়ায় সে।
ভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা বিষয়ক কথা বলতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পার হতেই সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে সে।
এবার গানের পালা। প্রথমেই অনার্স প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী এসে গান গাইতে শুরু করে। চারপাশটা গানের সুরে মেলাচ্ছে কেউ বা বান্ধবীর সাথেই হাতে হাত ধরে নৃত্য করছে আবার কেউ গানের সাথে নিজে গলা মিলিয়ে ধীরে ধীরে হাতে তালি দিয়ে তাল মেলাচ্ছে।
কিচ্ছুক্ষণ বাদের মাইক্রোফোনে গানের জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী হৃদিকা শেখকে ডাকা হয় সাথে তার পড়াশোনা, ব্যবহারের প্রশংসা চলতে থাকে। হৃদিতার ডাক পড়তেই অনয়ের হাতে থাকা গিটারটা হৃদিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,” অল দ্যি বেস্ট, দোস্ত।”
সাহিল, ফাউজিয়া, ইশিতা সবাই অনয়ের মতো বেস্ট অব লাক জানিয়ে দেয়। সামনে থেকে হৃদিতাকে উঠতে দেখে আশেপাশের শিক্ষার্থীরা তালি দিয়ে ওঠে। সবুজ রঙা শাড়ি, চুল কাধে এসে পড়েছে, ঠোঁটে গাঢ় ম্যাট লিপস্টিক যেন পুরো মুখের শ্রী বাড়িয়ে দিয়েছে। সব নারীকে সুন্দর দেখাতে কোমর বা হাটু পর্যন্ত কেশ থাকা যে জরুরী কোনো বিষয় নয় তা হৃদিতাকে দেখেই অবলোকন করা যায়।
হৃদিতা এগিয়ে যেতে যেতে দেখলো দুটো চোখ যে চোখে মেয়েরা ডুবে যেতে রাজি সে দুটো চোখ ঘুরেফিরে তার দিকে এসে থামছে।
হৃদিতা মুচকি হেসে মনে মনে বলে,” আপনি এবার ম*রেছেন আবরার ফাইয়াজ। ডুবে ডুবে জল খেয়ে ম*রবেন।”
#চলবে……