#মুক্তির_স্বাদ
লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
#পর্বঃ৫
দিন গিয়ে কয়েক মাসে পরিণত হয়েছে, শিখার বাচ্চা হওয়ার সময়টা ঘনিয়ে আসছে। অপরিপক্ক বয়সে গর্ভধারণ করার ফলে শরীরের নানা রোগে ভুগছে মেয়েটা, ভরা পেট নিয়ে চলাফেরা করাই দায় হয়ে আসছে আজকাল। চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসছে তার, হাত-পা ফুলে গিয়েছে।
সেদিন হসপিটাল থেকে ডক্টর দেখিয়ে আসার পর ডক্টর শিখাকে সম্পূর্ণ বেট রেস্ট দিয়েছিলো। কিন্তু, হায়! সেই বেট রেস্ট কি তার কপালে ছিলো? একদমই না! অসুস্থ শরীরটা নিয়েও করতে হয়েছে সংসারের হা’ড়’ভা’ঙা খাটুনি। কেউ কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, মেয়েটার জীবন মরণের সময়টায়ও তার অর্ধাঙ্গিন সেই দায়িত্বহীন পুরুষ হয়েই রয়ে গেলো। তবুও শিখা ছিলো নির্বাক! তার যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, যাওয়ার মতো নিদিষ্ট কোনো আশ্রয় নেই। শত কষ্টের পরও ছোট্ট সোনামণির আগমনের প্রহর গুনছে একজন নবীন মা। শত ব্যথার মাঝে এইটুকু তার প্রশান্তি!
মেঘলা আছন্ন একটি দিন। সকাল থেকে মৃদু হাওয়া, টিপ-টিপ বৃষ্টি। ভালো লাগার মতো একটি সন্ধ্যা। বিছনার এক কোণে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে আযান, তারই পাশে সুয়ে আশপাশ করছে শিখা। মাএই নামাজ পড়ে একটু বিছনায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো সে, কিন্তু শরীরে এতটুকু শান্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। অদ্ভুত এক অশান্তিতে আনচান করছে মন! সুয়ে, বসে কোথাও কিঞ্চিৎ স্বঃস্তি নেই যেন। বাচ্চাটা পেটে কি’ক মার”ছে, পেট ধরে ব্যথা ককিয়ে উঠে মেয়েটা।
শিখার এতো নড়াচড়ার কারণে ঘুমে ব্যঘাত ঘটছে আযানের। পরমুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার হঠাৎ কিঞ্চিৎ দমকে আযান বলে উঠলো,
“কি হয়েছে তোমার শিখা, পাশে বসে এতো নড়াচড়া করছো কেন? দেখলেতো মাএই একটু দু-চোখ এক করলাম, এরিমধ্যে তোমার অশান্তি শুরু হয়ে গেলো। সমস্যা কি তোমার, এতটুকু শান্তি দিচ্ছো না কেন আমায়?”
শিখা আযানের ডান হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে অসহায় কণ্ঠে শুধালো,
“দেখুন না!বাবু এখানে বারবার কি’ক মারছে, আমার একদম কলিজায় লাগছে! দশ-টা মাস সহ্য করে আসছি আমি এরকম হাজারটা অসহ্য য’ন্ত্র’ণা, আর আপনি এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলেন। পাশে অসুস্থ বউ থাকলে এতটুকু’তো অশান্তি হবেই। সবসময় এরকম দমকিয়েই আসলেন আপনি, কখনো বুঝতে চেষ্টা করেননি আমাকে। একদিন শত অভিযোগ নিয়ে নিখোঁজ হবো, সেদিন ঠিকই খুঁজবেন।”
আযান নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
“হয়েছে ঢঙ করো না, আমি টায়ার্ড শিখা। আজকে প্রচুর খাটুনি গিয়েছে শরীরে, আমাকে ঘুমাতে দেও বিরক্ত করো না।”
অন্য পাশে মুখ করে পুনরায় সুয়ে পড়লো আযান। অসুস্থ বউটার এসব কথা নিছক ঢঙ লাগছে তার কাছে। হতাশ হলো শিখা! তপ্ত এক শ্বাস ছেড়ে বললো,
“লোকে বলে, পুরুষ মানুষ নারীর ছোঁয়া পাইলে এমনিতেই বদলে যায়।
সেখানে আমি মেয়ে আপনার নামে আমার আস্তো জীবনটা উৎসর্গ কইরা দিলাম, তাও আপনার একটুখানি ভালোবাসা আমার ভাগ্যে জুটলো না। আপনি বড্ড পাষাণ,পা’ষা’ণ পুরুষ!”
কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিলো না আযান! শিখা জবাবের অপেক্ষাও করলো না। স্বামীর ঘুমের ডিসটার্ব হচ্ছে ভেবে, ভরা পেটটা নিয়ে পা টিপে টিপে পাশের রুমে চলে গেলো শিখা।
রুমে পা রাখতে না রাখতেই নিচ থেকে ভেসে আসলো রেহেনা বেগমের বাজখাঁই কণ্ঠ,
“বউমা! সন্ধ্যা হলো সেই কখন, আমার চা টা কি পাবো না নাকি? তুমি জানো না সন্ধ্যায় চা না হলে আমার চলে না। এখনো রুমে ঘাপটি মে’রে বসে, কি করছো তুমি? রাতের রান্নাটাও এখনে করোনি, আজকাল কাজের ফাঁকি দেওয়াটা কি তোমার স্বভাব হয়ে গিয়েছে? জমিদারী ভাব ছেড়ে, দ্রুত নিচে এসো।”
শিখা আর বসতে পারলো না, অচল শরীরটা টানতে টানতে রান্না ঘরে যেতেই হলো। দাঁড়াতে পাড়ছে না, নড়তেও পারছে না মেয়েটা। খুব করে কান্না আসছে তার, অসহায় লাগছে নিজেকে। অথচ শ্বাশুড়ি তার আয়েশ করে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে।
পরমুহূর্তে পেটে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে বললো শিখা,
“মা, আমার শরীরটা আজকাল ভীষণ অসুস্থ লাগছে। এই কয়দিন সবকিছু একটু মানিয়ে নেও মা, আর চলছে না দেহটা।”
রেহেনা বেগম টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে কপাল কুঁচকালো। শিখাকে আগাগোড়া একবার পরখ করে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আজ কালের মেয়েদের যত আগলা শরীর হয়েছে বাপু! আমাদের বুঝি বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি,হয়েছে নিশ্চয়ই!”
“এভাবে বলো না মা, কেউ ইচ্ছে করে অসুস্থ হয় না। ”
“রাখো তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছা। জানো, সে-কালে আমরা বাচ্চা ডেলিভারি করেও সংসারের সব কাজ একা করেছি, কতগুলো বাচ্চা-কাচ্চা সামলিয়েছি।
কই আমরা তো এতো কাজ-চোর ছিলাম না। যাও গিয়ে রান্নাটা সেরে ফেলো, এই সময়ে কাজ-কর্ম শরীরের জন্য ভালো।”
রেহেনা বেগম পুনরায় আবারো সিরিয়াল দেখায় মনোযোগ দিলো৷ শিখা অবাক চোখে দেখলো কেবল শ্বাশুড়িকে। লোকে বলে, শ্বাশুড়ি কখনো মা হয়না। আসলেই তাই, হারে হারে প্রমাণ পাচ্ছে মেয়েটা। সে-বার যখন তার অসুস্থ ননদ আসছিলো, এই মায়েরই কত না সতর্ক আর নীতিবাক্য শুনেছে শিখা। তার মেয়েকে দিয়ে একটা কাজ করানো যাবে না,এতে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লাগাতারে এই অকর্মা, কাজ চোর মেয়েটাই সেবা যত্নের কোনো কমতি রাখেনি। এমনকি মায়ের দায়িত্বের কাজ গুলোও করতে হয়েছে তাকে। আজ যখন শিখা ভীষণ অসুস্থ, নিজেকে সাহায্য করার মতো একটা কাকপক্ষী ও মিলছে না এ বাড়িতে। বাপের বাড়ি থেকে বাবা পোয়াতি মেয়ে’কে নিতে আসছে কয়েকবার , সে বাড়িতেও যেতে দেয়নি তারা। কড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছে রেহেনা বেগম, পুনরায় যেন নিতে না আসে তার বউকে।
সব ছিলো নিজেদের স্বার্থে, সবার প্রয়োজন মিটানোর মেশিনটা চলে গেলে তাদের আবার কাজ করতে হতো না!
এসব ভাবতেই মেয়েটার চোখে ভীড় করছে কান্নারা, অনবরত গড়িয়ে পড়ছে কিছু বুক ফা’টা বো’বা কান্না!
শিখাকে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহেনা বেগম তেঁতো কণ্ঠে পুনরায় শুধালো,
“এভাবে বেয়াক্কালের মতো দাঁড়িয়ে কি দেখছো বউমা? আমাকে কি নতুন দেখছো, নাকি আমার চেহারা বেড়েছে? যাও রান্না করো, রাত অনেক হয়েছে। আর হ্যা, শোনো? আমার জন্য একটু শিং মাছের ঝোল করিও।”
শিখা নড়েচড়ে উঠলো। নিজের ভাবনায় থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে আঁচলে চোখ মুছে মৃদু হেসে শুধালো,
“তোমরা আমার কাছে নিত্য নতুন মা। তোমাদের যত দেখি ততই আগ্রহ পাই। ভাগ্য করে তোমাদের বাড়িতে এসেছি, নয়তো কতকিছু থেকে বঞ্চিত হতাম, কত কিছু জানা হতো না।”
পরমুহূর্তেই আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জায়গা ত্যাগ করলো শিখা। রেহেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটার যাওয়ার পানে। কি বলে গেলো মেয়েটা? সব তার মাথার উপর দিয়েই গেলো। অকারণেই মুখ বাঁকালো উনি, সময় নষ্ট না করে আবারো ধ্যান দিলো টিভির দিকে।
.
.
রাত প্রায় নয়টার দিকে ঘুম ভাঙে আযানের। আড়মোড় ভেঙে উঠে বসলো, অকারণেই আশেপাশে তাকিয়ে শিখাকে একবার খুঁজলো বোধহয়। মেয়েটা রুমে নেই।কই গেলো? পাশেই তো ছিলো এতক্ষণ। পরমুহূর্তে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো আযান।
শরীরটা মেজমেজ করছে। এখন এক কাপ গরমগরম কফি চায় তার শরীর। মায়ের রুমে একবার যেতে যেতে চাইলো আশেপাশে, এখানেও দেখছে না শিখাকে। এবার একটু উঁচু কণ্ঠেই আযান বলে উঠলো,
“শিখা, কোথায় তুমি? আমার জন্য একটা কফি নিয়ে এসো।”
এভাবে বারকয়েক ডেকেও সাড়াশব্দ নেই মেয়েটার। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে গেলো তার, মেয়েটাকে সময় মতো পাওয়া যায় না কখনো। কেয়ারলেস মেয়ে একটা! বড়সড় পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে উঁকি দিলো আযান। মুহুর্তেই শরীর শিউরে উঠলো তার শরীর, ফ্লোরে র’ক্তে’র স্রোত বইছে।
এরিমধ্যে জুবুথুবু অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শিখা।
আযান দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। শিখার গা ছুঁয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“এই মেয়ে? এই কি হয়েছে তোমার? এমনটা কখন হলো, উঠো শিখা। এতো র’ক্ত কিসের!”
কোনো হুঁশ নেই মেয়েটার,শরীরটা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালালো আযান। কিন্তু, এবারো ব্যর্থ সে।
ভয় পেলো আযান, বেঁচে আছো তো মেয়েটা! পরমুহূর্তে উচ্চ স্বরে মা’কে ডাকলো। শিখাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে সুয়ে দিলো। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রেহেনা বেগম। উনি শিখাকে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে রে? ”
আযান বসা থেকে দাঁড়িয়ে চিন্তিতো কণ্ঠে বললো,
“বলতে পারছি না মা। রান্না ঘরে রক্তে মাখো-মাখো অবস্থায় ফ্লোরে পেলাম। অবস্থা খুব শোচনীয়! ওকে এক্ষুণি হসপিটালে নিতে হবে মা।”
রেহেনা বেগম ছেলেকে দমক দিয়ে চুপ থাকতে বললো। কিছু হলেই হসপিটাল, ডক্টর! এতোকিছুর কি দরকার? এতটুকুতো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখো গিয়ে না জানি, ভাং ধরে এমন করছে। শুধু শুধু টাকা খরচ।
চলবে……
(সবাই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন,তাহলে প্রতিদিন দিবো।)