#মুক্তির_স্বাদ
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
#পর্বঃ২
সেদিন অপমানের পরও আজ সকালে বাবা আবারও এসেছে এই বাড়িতে, নিজের ভা’ঙা কুটিরে মেয়েসহ জামাইকে নিতে। আসলে মেয়ের বাবারা নির্লজ্জ, বেহায়া! বাবাদের মোটেও লজ্জা নেই। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে হাজারো অপমান-লাঞ্ছনা দিলেও বাবারা গায়ে মাখে না। শুধু মাএ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাবারা মুচকি হেসে উড়িয়ে দেয় সমস্ত বঞ্চনা।মনিরুলও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিয়ের পর এই প্রথম স্বামীর সাথে বাপের বাড়ি যাবে শিখা। আনন্দের শেষ নেই তার মনে। বাড়ি গিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিবে সে, মায়ের হাতে শাক দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবে। শ্বশুর বাড়িতে এই কয়দিনেই হাঁপিয়ে গিয়েছে কিশোরী কন্যা। নিজ বাড়ির নাম শুনেই ভিতর থেকে ভুলে গিয়েছে সব মন খারাপি। চঞ্চল কন্যা নিজেকে আজ ইচ্ছে মতো রাঙিয়েছে, বাহারি সাজসজ্জায়। আযান তাদের রুমে বসেই ফোন ঘাটছিলো। শিখা তার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে শুধালো, “আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?”
আযান পূর্ণ দৃষ্টি রাখে কিশোরী বউয়ের পানে। তার চোখ ঝ’ল’সে যাচ্ছে যেন! এতোদিনে এক সাথে থেকেও সেভাবে দেখা হয়নি মেয়েটাকে। মেয়েটাকে বলাই চলে, আগুন সুন্দরী! আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তাকে।
নীল রঙা শাড়ী পড়েছে শিখা, সাথে সিম্পল সোনার গহনা ফর্সা শরীরে চিকচিক করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে আযান। পরক্ষণে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে শিখার খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে মৃদু স্বরে শুধালো,
“শিখার থেকে তো আজ আগুন বের হচ্ছে। শিখার অনলে পু’ড়ে যাচ্ছে ই হতভাগা! একদম আগুন সুন্দরী লাগছে তোমায়!”
এই প্রথম স্বামীর থেকে নিজের প্রসংশা পেয়ে লজ্জা পেলো মেয়েটা। লাজুক হেসে বললো,
“আমি আগুনের শিখা হবো, আপনি আগলে নিন। এতো অবহেলা না করে, একটু ভালোবাসা দিন।”
আযান জবাব দিলো না। এমনটা নয় যে মেয়েটাকে তার অপছন্দ।পছন্দও, তবুও কোথাও যেন জড়তার রয়েছে! এই জড়তার জন্য নিজের ভিতরের কথা প্রকাশ করা হয় না। তান্মধ্যে, বাসায় পা রাখলেই মা বউয়ের নামে ছেলের মস্তিষ্কে বি’ষ ঢুকিয়ে দেয়। এজন্য আযান নিজের দুর্বলতা শক্ত খোলসে মুড়িয়ে রাখে। বাচ্চা মেয়ে আশকারা পেয়ে মাথায় উঠে যাবে। তাছাড়া মায়ের ভাষ্যমতে,
“বউ হচ্ছে শাসনের জিনিস! এদের বেশী আহ্লাদ করতে নেই। তাহলেই হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।”
মায়ের থেকে এই শিক্ষাই বড় হয়েছে ছেলেটা। যুবতী বউয়ের ছোঁয়া পেয়ে আজ অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও থেমে যায় আযান। নিজের ইচ্ছে গুলো গুটিয়ে নিলো ততক্ষণাৎ। শিখাকে ছেড়ে দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে নিচে এসো।”
কথা শেষে করে, বড়-বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মায়ের রুমে নক করে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“মা আসবো?”
রেহেনা বেগম খাটে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে পান চিবোচ্ছে। ছেলের কণ্ঠ শুনে এক গাল হেসে বললো, “আয় বাবা।”
“মা বলছিলাম কি, কিছু টাকার প্রয়োজন।” ইনিয়ে-বিনিয়ে মাথা নিচু করে বললো আযান।
হাজার হাজার টাকা নিজে ইনকাম করলেও মাতুব্বরি সব মায়ের। মাস শেষে বেতন পেয়ে মায়ের হাতেই তুলে দেয় সে। এমনকি হাত-খরচটাও মাঝে মাঝে মায়ের থেকে চেয়ে নিতে হয়। এই সংসার চলেই মায়ের কথায়।
ছেলের টাকা লাগবে শুনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয় রেহেনা বেগম। হেয়ালি পায়ে আলমারি থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট ছেলেকে ধরিয়ে দিলো। আযান টাকাটা নেড়েচেড়ে দেখে অনেকটা সাহস নিয়ে কিয়াৎ ক্ষণ পরে বললো,
“মা মাএ এক হাজার টাকা। ওই বাড়িতে তো প্রথমবারই যাচ্ছি আমি। এই বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম! তাছাড়া আমার তো এক্সটা একটা হাত খরচও রয়েছে।”
তেঁতে উঠলেন মা। ছেলের দিকে তাকিয়ে মুখ কিড়মিড় করে বললো,
“দুই দিননেই বউ মগজ ধুয়ে ফেলছে তোর আযান। আমার মুখে মুখে খুব তর্ক করা শিখেছিস? শ্বশুর বাড়ির জন্য দেখছি, দরদ উতলে পড়ছে আজকাল!”
আযান মিনমিন করে বললো, কি যে বলছো মা। আসলে….”
তাকে থামিয়ে দিয়ে মা বললো, “হয়েছে চুপ কর। এক হাজার টাকাই খুউব হয়ে যাবে তোর। যেই না তোর শ্বশুর বাড়ি! ভাঙা টিনের চালে, দু’কেজি সচতার মিষ্টি নিয়ে গেলেই লে’টা চুকে গেলো। খবরদার! এর চেয়ে বেশি কিছু নিসনে।”
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো শিখা। মূলত আযানকেই হাসি-হাসি মুখে ডাকতে আসছিলো সে। এসেই শ্বাশুড়ির এমন আচারণে তার এই উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অপমানে গা হিশহিশ উঠলো মেয়েটার। অথচ স্বামী তার নির্বাক! লোকটা এমন কেন? ন্যায়-অন্যায় কি তার চোখে পড়ে না? তার বাবা গরীব তাই বলে কি কথায় কথায় এভাবে অপমান করবে? শিখা এগিয়ে গেলো রুমে। তান্মধ্যে
আযান বিনাবাক্যে মাথা নত করে বেরিয়ে যেতে উদ্যতো হলো।
এমন সময় পিছন থেকে শিখা শ্বাশুড়ি’কে উদ্দেশ্য করে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“আপনার ছেলে আমাদের বাড়ি খালি হাতে গেলেও তার কোনো অমর্যাদা হবে না মা। আমার বাবা হতেই পারে রিক্সা চালক কিংবা গরীব। তবুও সে নতুন অতিথিদের কি করে খাতির-যত্ন করতে হয় সে বিষয় সচেতন।”
শিখার এহেন কথায় গা জ্বলে যাচ্ছে রেহনা বেগমের। মুখে ঝামটি মে’রে বললেন,
“এ্যা,নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার মেয়ে দেমাক কত! আযান দেখছিস, তোর বউ আমার মুখে মুখে তর্ক করছে।”
মায়ের ন্যাকা কথা শুনে আযান শিখার দিকে তাকিয়ে মৃদু চোখ রাঙিয়ে বললো,
“আমাদের মা-ছেলের মাঝে তোমাকে কথা বলতে কে বললো শিখা? নেক্সট টাইম এমনটা যেন না হয়, মাথায় রেখো।”
শিখা স্বামীর আচরণে অবাক হয়ে যায়। আচ্ছা এখানে তার দোষটা কোথায়? সে কি ভুল কিছু বলেছে? কই লোকটা প্রতিবাদ করবে , উল্টো তাকে ধমকাচ্ছে।
পরক্ষণেও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো মেয়েটা। বাবা নিচে বসা,আবার যদি বাবাকে অপমান করে তারা।
তান্মধ্যে, নিচ থেকে বাবা হাঁ’ক ছেড়ে বললেন,
“শিখা আম্মা,হলো তোদের? তাড়াতাড়ি কর মা।আমার ওদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
শিখা বিনাবাক্যে নিচে আসলো তার পিছনে পিছনে আযান। রেহনা বেগম পিছন থেকে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আজকের দিনটা থেকেই আগামীকাল বউকে নিয়ে চলে আসিস বাড়িতে। তোর সংসারের এতো কাজ-কাম আমি করতে পারবো না বাপ। এমনিতেই হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে।”
আযান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো।
.
.
কতদিন পরে মেয়ে-মেয়ের জামাইকে পেয়ে আনন্দের শেষ নেই শিখার মা-বাবার। এই প্রথমবার জামাই এসেছে বাড়িতে তার, আদর যত্নের কোনো কমতি নেই। বাবা ধারের টাকায় ব্যাগ ভর্তি বাজার করছে, মা খোয়ারের সব চেয়ে বড় মুরগীটা নিয়েছে রান্নার জন্য। শখা হরেক রকম নকশি পিঠা বানাচ্ছে।
কিন্তু জামাইটা একদিনের বেশি থাকলোই না। আফসোসে ম’রে যাচ্ছে শিখার মা। মন মতন কিছু করতেই পারলো না।
যথারীতি মায়ের কথা মোতাবেক পরদিন সকালে আযান শিখা’কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও শিখা আর কয়টা দিন থাকার বায়না ধরেছিলো। কিন্তু, কিন্তু আড়ালে স্বামীর র’ক্তি’ম চোখের কাছে চুপসে গেলো তার ইচ্ছে।
শিখার মনটা আজ ভীষণ খারাপ! কতদিন পর বাবার বাড়িতে এসেও ক’টা দিন থাকা হলো না তার। আপন-জনকে ছেড়ে আসার কষ্টে দু-চোখে অশ্রুকণা ভীড় করছে মেয়েটার। সেদিকে কিচ্ছুটি যায় আসে না কারো। অতিরিক্ত মা ঘেঁষা পুরুষের বউ সে, স্ত্রীর প্রতি লোকটা সবসময়ই উদাস!
আযান বাড়িতে পা রাখতেই রেহেনা বেগম জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন “শ্বশুর বাড়ি কোন বেলায় কি কি খাইয়েছে তাকে, তার ছেলের কোথাও কোনো অসম্মান হলো কিনা। আরো কত কি।”
তান্মধ্যে, শিখা শ্বাশুড়ির সামনে কয়েকটা বক্স ভর্তি খাবার রেখে বললেন, “এগুলো আমার মা তোমার জন্য পাঠিয়েছে মা।”
কথা শেষ করে শিখা কাজে লেগে পড়লো। তার আর বিশ্রাম নেই। একটা দিন ছিলো না, রান্না ঘরে হাঁড়ি পাতিল জমা হয়ে গিয়েছে, ঘরগুলো অপরিষ্কার। দুপুর হয়ে গিয়েছে প্রায়, এক্ষুনি আবার রান্না করতে হবে।
শিখা যেতেই রেহনা বেগম দ্রুত বক্স গুলো খুলে দেখতে লাগলেন। পোলাও, আস্তো মুরগীর রোস্ট, গরুর মাংস সহ আরো কয়েক রকমের বড় বড় মাছ রয়েছে বক্সে। যা দেখে জিভে জল চলে আসছে তার। ততক্ষণাৎ পেট ভরে খেয়ে ঢেঁকুর তুলে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলললো,
“খাবারের কি বিশ্রী স্বাদ! এগুলো না নিয়ে আসলেও তো হতো।”
শিখা কান এড়ালো না এ কথা। শ্বাশুড়ির কথা শুনে রান্না ঘরের বসে বিড়বিড় করে বললেন, “তোমাকে কলিজা ভুনা করে খাওয়ালেও তুমি বলবে লবনে কম হইছে।”
কেউ শুনলো না তার নিরব বাক্য। এরিমধ্যে আযান মুখ ফসকে বোকার মতো বলে উঠলো, “তাহলে তুমি এতো গুলো খেলে কেন মা? কম খেলেও তো হতো, আবার না জানি পেটে সমস্যা হয় তোমার।”
খেঁপে গেলেন রেহনা বেগম। ছেলের দিকে তাকিয়ে ন্যাকা কণ্ঠে বললো,
“এখন আমি এতো বেশি খাই যে তোর চোখে পড়ে গেছে আযান? তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে বলে, তুই আমাকে খাবারের খোঁটা দিচ্ছিস? বউ, নতুন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি পেয়ে মা এখন পর হয়ে গেলো তোর? আল্লাহ গো! এই দিন দেখার জন্যই কি বেঁচে আছি আমি।”
আযান এতক্ষণে ঠাহর করতে পারলেন, সরল মনে কি বলে ফেলছেন তিনি। ভাবতেই জিভে কামড় দিলো ছেলেটা। এখন মা কি তাকে আস্ত রাখবে? পেঁচাল করে মাথা খেয়ে দিবে আজ। তার থেকে এখান থেকে কে’টে পরাই শ্রেয়। ততক্ষণাৎ আযান অফিসের নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
চলবে……
(