নির্মোচন পর্ব ৩১

0
587

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_৩১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

– “গতকাল রাতে নিশ্চয়ই উপুড় হয়ে ঘুমিয়েছেন? মেবি আজকের মতোই পিঠ খোলা রেখে। এখন এখানে আসুন। আমি বিছানার মতো নরম নই। কিন্তু হোপ দ্যাট আমার বুকে ঘুমুতে পারবেন। আসুন।”

স্তব্ধ, বিমূঢ়, হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সামান্য একটু ঢোক গিলল নাবিলা হক। সহসা মুখে শব্দ জুটল না। মনে হচ্ছে দিনে দুপুরে অকাল স্বপ্ন দেখছে যা এতটুকু সত্য বা বাস্তব নয়! অকল্পনীয় ভাবনায় থরো থরো চিন্তাগুলো যেন টাস টাস তুড়ির মতোই উড়িয়ে দিয়ে সোজাসাপ্টা এমন প্রস্তাব রেখেছে সাঈদ। নির্ভীক মুখটা আরো দু কাঠি প্রস্তর চিত্ত বানিয়ে ফিহার দিকে শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করে উঠল,

– ইন্সটিক্ট সাড়া না দিলে অ্যাভোয়েড করতে পারেন। আপনাকে জোর করা হচ্ছে না। শুধু আখেরিবারের মতো জিজ্ঞেস করব, আপনি কী আমার কাছে ঘুমাবেন, নাকি না?

দীঘল কালো চোখজুড়ে রাজ্যের বিভ্রান্তি এসে ভর করল ফিহার। সত্যিই ও ভাবেনি প্রথম রাতেই এতোখানি সহজবোধ আচরণ পাবে তার কাছটুকু থেকে। স্কুল থেকে কলেজে উঠার পর বান্ধবী ও সিনিয়র সহপাঠী আপুদের অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু আড্ডা আলোচনায় যেসকল অজানা বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটু একটু দুকানে শুনেছিল, সেরকম কোনো ভয়াবহ জটিল দৃশ্যপট এখনো তাঁর ঠাঁট আদর্শপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মাঝে প্রকটরূপে ধরা পড়েনি। ওর এখনো মনে আছে, কলেজের রাষ্টবিজ্ঞানে পড়া স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের এক আপু বাথরুমের এককোণে দাঁড়িয়ে রসালো ফোনালাপের একপর্যায়ে ওপ্রান্তের পুরুষটি কীরকম অসংলগ্ন কথাবার্তা উচ্চারণ করছিল! ঝিঁ ঝিঁ করে উঠা মাথাটা তৎক্ষণাৎ নীচু করে চট করে তাঁর ব্যাপক কাছাকাছি চলে যায় ও। দুহাত বাড়িয়ে পলক ঝাপটাতেই কালো টিশার্টে আব্রু মেদহীন পুরুষ্টু শক্ত বুকটার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিহা। দেহের তাপে তাপ মিলিয়ে, স্পর্শের কাছে স্পর্শ জড়িয়ে, মুঠোর মাঝে কালো টিশার্টের কাপড়টুকু মুচড়ে ধরে গভীর দমে টেনে নেয় সাঈদের নিবিড়, একান্ত, শান্ত সম্মোহন করা বুকের উষ্ণতাটুকু। সাঈদ স্কিলড্ ইন্সটিক্ট দ্বারা অনুমান করতে পারে ওর মনে বিস্ফোরণ ঘটানো কোনো এক বৈরি ঘটনার রোমন্থন। সে পেশল বাহুদুটো দৃঢ়বদ্ধ করে কোমল মাথায় ঠোঁট স্পর্শ করে আদর করল। পেলব নরম গালটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুধোল,

– কী হয়েছে? ওরকম করে ঝাঁপিয়ে পরার মতো সেন্সেটিভ কিছু তো আপনার সাথে ঘটেনি। সমস্যাটা কোন জায়গায়? কিছু কী বলতে যেয়েও লুকাচ্ছেন?

চাঁপাকলির মতো নরম আঙুলগুলো সুঠাম বুকের টিশার্ট খামচানো কাপড়টুকু ঢিলে করে একটু। তবু মুঠো আলগা করল না। মুখ তুলে ঘুম ঘুম চোখের দৃষ্টিদুটো সাঈদের অন্তর্ভেদী ধারালো চোখে স্থির করে বলল,

– থ্যাংকিউ। আপনার জায়গায় অন্য কোনো ব্যক্তি হলে এতোক্ষণে কীরকম একটা জটিল ব্যাপার হতো, সেটা ভেবেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে।

– এতে থ্যাংকিউর আমি কিছুই দেখছি না। নিজেও প্রোবাব্যালি ব্যালকনি এরিয়ায় কিছুটা ইরর‍্যালিভেন্ট আচরণ দেখিয়েছি। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। মাথায় স্ট্রিক্টলি নোটেড রাখা উচিত ছিল আপনি এখনো ফিট নন। যেটা এখন চিন্তা করে ভয় পেলেন আর যাকে এখন খুশি মনে থ্যাংকিউ দিচ্ছেন এ দুটো ব্যক্তির মাঝে তফাত নেই। সমান দোষী।

মুখের ওপর এভাবে নিজের দোষ স্বীকারের অবস্থাটুকু দেখে কেন জানি ফিহার হাসি পাচ্ছে। রুক্ষু রুক্ষু মুখে যেভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করেছে তাতে ওই অনার্স পড়ুয়া আপুর সুশীলভাষী বয়ফ্রেন্ড বোধহয় প্রেমের ডিগ্রি থেকে রুচিই হারাবে। নাকমুখ কুঁচকে বলবে, “ভাই, বিয়ের পরও আপনি বউকে চুমু খেতে দোষ খুঁজে পাচ্ছেন, সেখানে আমি প্রেমিকার সাথে রুমডেট করেও দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি ভাই আউলিয়া লেভেলের মানুষ!” এমন অদ্ভুত অলীক দৃশ্যপটটা মনে মনে চিন্তা করতেই ফিহা চোখ সয়ানো অন্ধকারে মৃদু হাসি ছেড়ে বলল,

– এখন তো চিন্তা হচ্ছে আপনি আমার কলেজ, কলেজের সার্কেলের সাথে কী করে মিশবেন। ওরা হয়ত আপনাকে দেখে ভয়েই এক মাইল দূরে গিয়ে পালাবে। স্বাভাবিক হোন। কিছু জিনিস রুলস রেগুলেশনের আওতায় যুক্ত করে জীবনটাকে জটিল বানাবেন না। শুভ রাত্রি।

হৃদয় প্রফুল্ল করা সুন্দর হাসিটি উপহার দিয়ে আবারও নিজের বরাদ্দকৃত জায়গাটুকুতে মুখ গুঁজল ও। অনুভব করল, পিঠের উপর থেকে ঝুরঝুরে রেশম চুলগুলো বাঁপাশে সরিয়ে চেইন উন্মুক্ত জায়গাটুকুতে হাত রেখেছে সে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কোনো আর্দ্র মলম আঙুলের ডগায় মাখিয়ে শুশ্রূষা করছে পরম যত্ন ছুঁয়ে। নিস্তব্ধ, ঘোর অন্ধকার রুম। জানালায় পর্দা টাঙিয়ে বারান্দার দরজাটুকু স্রেফ আধখোলা রাখা। লাভ হয়নি। চাঁদের উজ্জ্বল মুখে কালো কুচকুচে মেঘের ঘোমটা পড়ায় রূপোলি আলোর পরিমাণ অনেক কম। বুকের উপর ছুঁয়ে যাওয়া প্রতিটি তপ্ত নিঃশ্বাসের হলকা জানান দিচ্ছে পরমাপ্রিয় স্ত্রীর প্রসন্ন বিভোর ঘুম। নিশ্চিন্তের মাঝে বিশ্রম্ভ সঙ্গিণীর নির্ভার সাহচর্যে সাঈদও ক্লান্তির বিভ্রমে বুঁদ হয়ে আসে। কখন যে মনের আকাশ থেকে কীভাবে, কীরকম অদ্ভুত উপায়ে সবটুকু দ্বিধা ধূসরিত মেঘ দুজনের মানস কোণ থেকে কেটে যায়, মুছে যায়, তা আর জানা সম্ভব হল না।

.

রাতের প্রথম প্রহরের পথ ধরে ঘনিয়ে আসে মধ্যরাতের আয়োজন। নিশিরাতের ভয়ার্ত নীরবতা চারপাশে। জাগতিক কিছু কু ডাক, ঝিঁঝি ডাক, অদ্ভুত কিছু ডাকের মধ্য দিয়ে হাজির হয় শেষ রাতের ফজর আযান। সমস্ত শহর ঘোর নিদ্রায় অসার হয়ে থাকলেও দীর্ঘদিনের কঠোর অভ্যাসের দরুন আপনা থেকেই ঘুমটা ভেঙে যায়। এখনো টুটে গেছে গভীর ঘুমের সুতো। দেয়ালে সাঁটানো রেডিয়াম ধাতুর আলো জ্বলজ্বল করা ঘড়িতে স্পষ্ট দেখাচ্ছে ভোর সোয়া চারটা। গা ঝাড়া দেওয়া বুক ফুলানো গভীর দম নিতেই হঠাৎ বুকের উপরে ঘুমুনো ঘুমন্ত প্রাণটার দিকে নজর পড়ল। ছোট্ট শিশুর মতো হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে টিশার্টের কাপড়টুকু। যেন এক্ষুণি ওকে ঘুমাবস্থায় ফেলে চলে যাবে সাঈদ। ঠিক এমনটাই ছোট্টবেলায় মায়ের বুকে মুখ লুকোনো অবস্থায় ছোট্ট ছোট্ট মুঠিতে আঁচল খামচে রাখতো সে। সেসময় শৈশব তুল্য মন ভাবতো, মুঠোর ভেতরে মায়ের আঁচল খামচে ধরলে মা আর একা ফেলে চলে যেতে পারবে না। পাশে থাকবে। সঙ্গে ঘুমুবে। এভাবেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। অথচ নিষ্ঠুর সত্যি এটাই যে, মিলিটারী ফ্যামিলি সিন্ড্রোম এর দরুন বেশিদিন সেই সময়গুলো অনুভব করার সৌভাগ্য জুটেনি। সাঈদ ওর ছোট্ট মুঠোর উপরে পরম প্রশ্রয়ী হাতটা রেখে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগল,

– নাবিলা, উঠুন। আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? চোখ খুলুন এক্ষুণি। উঠতে বলেছি আপনাকে। উঠুন, ফাস্ট।

প্রগাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ফিহা মৃদু ঝাঁকুনি, অবিরাম ডাকাডাকি শুনে চোখ মেলে চাইল। আধো আধো চাহনিতে চারপাশের অবস্থা দেখে বিরক্ত হল কিছুটা। মাথা উচুঁ করে চরম অপ্রসন্ন হয়ে বলল,

– এখন কয়টা বাজে? সকাল হয়েছে? এখনো তো বাইরে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি!

– জ্বী, ঠিকই দেখছেন। এখন উঠে যান।

– এই চারটার সময় উঠব কেন? কাঁচা ঘুম ভেঙে. . না, আমি ঘুমাব। আপনি যান। আমি উঠব না।

আবারও ঘুমের ছোবলে চোখ বন্ধ করে নিলে সাঈদের বজ্রআটুনির ধাক্কায় কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে চোখ মেলে চাইল ফিহা। অসহায় ভঙ্গিতে নিভু নিভু চোখে বলল,

– কী চান আবার?

– আপনাকেই চাচ্ছি। ঘুম ঝেড়ে উঠে পড়ুন। বাইরে যাব।

– জনাব, বাইরে কঠিন অন্ধকার। এখনো এই অন্ধকারে কাকপক্ষিও জেগে উঠেনি। আমি সেখানে মানুষ। ঘুমাতে দিন না!

– আমি কী ঘুম ভাঙাতে কিছু সাহায্য করব নাবিলা? যদি করি, ঘুম আর ঘোর দুটোই মনে করুন, হাওয়া হয়ে যাবে। উঠে যান। এখনো সময় আছে বলছি। দেরি করলে পস্তাতে পস্তাতে ঘুম থেকে উঠবেন।

ঠাণ্ডা হুমকি শুনে চোখ ভরা ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাবিলা হক। কী মহা মসিবতে ও পড়ল! এই সোয়া চারটার সময় কোন পাপের শাস্তি দিতে উঠানো হচ্ছে? এতো নিষ্ঠুর তো নিজের মা-ও হয় না! এই সময় কী কোনো মানুষ উঠে? একটা কাকও তো কা কা করার জন্য উঠেনি! চোখ কচলাতে কচলাতে মুখ ভার করা অবস্থা নিয়ে সাঈদের সাহায্যে প্রাতঃকালীন কাজটুকু সমাপন করল। দুই মিনিট বিছানাতেও বসে রইল। কেন বসে রইল তা অবশ্য সেসময় বোঝা যায়নি। শীতালু স্পর্শের কাছে দুহাত বুকের কাছে আড়াআড়ি বেঁধে মৃদু কাঁপনে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকল। দাঁত কিড়মিড় করা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে প্রশ্ন,

– আপনি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ওখানে কী করছেন? বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিন প্লিজ। প্রচুর ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে।

কোনো সাড়াশব্দ এলো না বারান্দার ওখান থেকে। সাঈদ যে কিছু একটা যত্ন সহকারে করছে সেটা কান সজাগ রাখলে শোনা যায়। ঠিক গুণে গুণে মিনিট পাঁচেক পর সাঈদ বারান্দা থেকে রুমে ঢুকলে ফিহাকে তুলে নেয় বুকে। পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে ঠিক বাঁদিকে কয়েক পা এগুতেই নরম কার্পেটে মোড়া জায়গাটুকুতে নামিয়ে দিল ওকে। ঠাণ্ডা ফ্লোরে সদ্য বিছানো আরামদায়ক কার্পেট, কার্পেটের উপর সাদা পশমী নরম কম্বল, কম্বলের ওখানে ছোট্ট একটা কুশনও রেখে দেওয়া। সাঈদ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সাবধানে ওর পা-টা কুশনে বসিয়ে আপন কোলের মাঝে জড়িয়ে নেয় ফিহাকে। চারিদিক থেকে কম্বলে মুড়িয়ে চেপে ধরে নিজের সুদেহী বুকটার ভেতর। গভীর ওম, গভীর উষ্ণতা, গভীরভাবে জড়িয়ে নেওয়া পরশ। নিঃশ্বাসে মাদকতার উচ্ছ্বাস টের পায় ফিহা। বুকে অনুরণন তুলে দেওয়া হৃদপিণ্ডের ধুক ধুকে শব্দ আরক্ত করে দেয় কানদুটো, চোখের চাহনি। কালো চাদর ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে ভোরের ফরসা আলো। পূব আকাশে উঁকি দিয়ে হাজির হয় পৃথিবীর সৌর পিণ্ড। কী ভয়ংকর সেই অপরূপ সৌন্দর্য! কী বিচিত্র সেই সূর্য উঠার দৃশ্যপট! সাঈদ ওর মুখটা পিছু ঘুরিয়ে পূর্বদিকের সবচাইতে সুন্দর নীরব দৃশ্যটুকুতে নিবিষ্ট করে বলল,

– আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এভাবেই একদিন আপনার সঙ্গে ভোর হওয়া দেখব। সূর্যোদয়ের দৃশ্যটুকু আপনার সাথে উপভোগ করব। একটা সূর্য কীভাবে নতুন দিনের জানান দিতে হাজির হয়েছে দেখুন। আপনিও আমার জীবনে এই সূর্যের মতো সুন্দর। লাগাম ছাড়া, বর্ণনাহীন, অনেক বেশিই গুরুত্বপূর্ণ।

শান্ত সম্মোহন সমুদ্রের মতো বড়ো গভীর তাঁর কথা বলার ভঙ্গি, তাঁর ব্যবহার করা প্রতিটি বাক্যের শব্দ বিশেষণ। “লাগাম ছাড়া সুন্দর।” কারো সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা, সরল প্রশংসা বোঝাতে “লাগাম ছাড়া সুন্দর” কথাটি ব্যবহৃত হয়? ফিহা ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলে। দূর আসমানে সূর্য উদয়ের রূপ মোহনিয়া দেখতে দেখতে প্রফুল্ল চিত্তে হাসি দেয়। তাঁর চোখ, তাঁর মুখ, তাঁর সমস্ত সুন্দর ব্যাপারের মতো তাঁর কথা বলার ধরনটাও যে ভোরের মতো শুদ্ধ, প্রান্ঞ্জল, অপূর্ব! ইশ! সাঈদের বুকে ছোট্ট শরীরটুকু এলিয়ে ভোরের অপার সৌন্দর্যে নিষ্পলক হয় ফিহা। ফুরফুরে হাসিতে বলে উঠে,

– এরকম সুন্দর একটা ভোর প্রতিদিন উপভোগ করতে পারলে মন্দ হয় না। ইচ্ছে করছে শুধু তাকিয়েই থাকি . . তাকিয়েই থাকি . . চোখ স্থির হয়ে যাক।

রিনরিনে কণ্ঠের আবেগ উচ্ছ্বসিত অনুভূতিটা বড্ড স্পর্শ করে সাঈদের অন্দর কোণে। ছুঁয়ে যাওয়া কোনো হিমেল বাতাসে মন নরম হলে বড্ড ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হাতটা রেখে দেয় ফিহার চেইন উন্মুক্ত পিঠে। হঠাৎ শীতল পরশে দুলে উঠে বুকের মধ্যে থাকা ফিহার সমস্ত কায়া। প্রাণপণ উন্মত্ত হয় মন। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বুকের মধ্যে ডানগাল ছুঁয়ে দ্রুত কম্বলে ঢেকে নেয় লাল মুখ। মুখ ফুটে বলতেও পারে না, “আপনার স্পর্শ আমার চামড়া ভেদ করে ছুঁয়ে যাচ্ছে জনাব সাঈদ। আপনার উপস্থিতি আমার চারপাশের অবস্থা, নিঃশ্বাসের প্রখরতা অতি ভয়ংকর পর্যায়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। থামুন।” সত্যিই বোধহয় থেমে যাওয়া কোনো রেড সিগন্যালের মতো বিপজ্জনক হাতটা থেমে ক্ষতর অবস্থা পরোখ করল। গতরাতের ফোলা ভাবটুকু আর নেই। শেষ। চামড়া শুকিয়ে এসেছে। শেষপর্যন্ত চেইনটা টেনে দিতে দিতে ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে উঠল সাঈদ,

– ঠিক সাড়ে সাতটায় রুম থেকে বের হবেন। তার আগে কেউ ডাকাডাকি করলে সেটা অন্য হিসাব। সন্ধ্যার দিকে দুনিয়ার তাবৎ ব্যস্ততা থাকলেও আমার সঙ্গে এক্স-রে দেখানোর জন্য বের হচ্ছেন। আমার যেন গলা ফাটিয়ে ডাকতে না হয়। মিষ্টি কিছু বানাতে বললে বানাবেন না। আমি ওসব খাই না। সব বুঝা গেল?

কম্বলের হাতটা শিথিল করে নির্মল চোখদুটি আস্তে আস্তে নিজের বাঁকানটার কাছে থামাল ফিহা। জলদ্গম্ভীর মুখটির দিকে তাকাল নির্নিমেষ। পবিত্র ভোরের রং মাখা আলোতে তাঁর মুখটা দেখাচ্ছে বড্ড গৌরদীপ্ত, সুপুরুষ। লক্ষভেদী চোখদুটো চেয়ে আছে সৌরজ্জ্বল তীক্ষ্ম চাহনি ছুঁড়ে। ফিহা নিজের পেছনে পৃথিবী উজ্জ্বল করা সূর্যের আলোয় সাঈদের চিরগম্ভীর মুখটি দুহাতের বলয়ে টেনে নেয় কাছে। কপাল বরাবর অংশটুকু সিক্ত ওষ্ঠে চেপে দেয় বহু . . বহুক্ষণ ধরে। সাঈদ চোখ বুজে নেওয়া নিঃশব্দের মাঝে আজও নিরঙ্কুশ ভূমিকায় নীরব।

.

আফসানার শত বারণেও কথা শোনেনি। ডাইনিং টেবিলে বসে বসে নিষিদ্ধ কাজটাই সবার আগে করছে ফিহা। মিষ্টি খাবারটাই বেছে নিয়েছে নিজের হাতে। সুফিয়া খানম মাছির মতো বারবার ঘুরঘুর করলেও ফিহা চোখ রাঙানো দৃষ্টি ছুঁড়ে বেশ বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

– আপনি আমাকে শান্তিমতো কাজটা করতে দিবেন সুফি খালা? কে খাবে, না খাবে ওসব নিয়ে এখুনি চিন্তা করতে হবে কেন? আমি তো এসব অন্য কারো জন্য বানাচ্ছি না। বলুন তো খালু, কাজু বরফি আপনি খাবেন না বলুন? আমি আপনার অনুমতি নিয়ে এটা বানাচ্ছি না?

খবরের কাগজে বুঁদ হয়ে থাকা সেনাবাহিনীর কর্ণেল কর্মকর্তা সোয়াদ জাকির হঠাৎ চমকে উঠে ফিহার দিকে তাকিয়ে বলল,

– কী? হ্যাঁ . . আমিই ওকে পায়েস রাঁধতে বলেছি। আমি পায়েস খাব। আমার কোনো ডায়াবেটিসের সমস্যা নেই। নাবিলা মা, ঘন করে জ্বাল দেওয়া দুধে পায়েসটা রাঁধো তো।

বেআক্কল দৃষ্টিতে হতভম্ব সুফিয়া একবার মেজর খ্যাত কর্ণেল সোয়াদের দিকে তাকান, আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফিহার চোর চোর মুখটার দিকে তাকান। মাঝখান থেকে আহাম্মক বনে যাওয়ায় ফিহা শ্বশুরের দোষ ঢেকে দিয়ে বলল,

– হ্যাঁ হ্যাঁ, খালু . . মানে আব্বু, থুক্কু ধুর . . মানে বাবা, আপনার জন্য পায়েসই রাঁধব। কিন্তু এটা হচ্ছে নতুন আইটেম। আপনার তো ডায়াবেটিস নেই, তাই এটা আপনার জন্য বিশেষ করে বানাচ্ছি। কাজুবাদাম আপনার পছন্দ না?

হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠ সচকিত চিৎকারে জানান দিয়ে উঠল,

– পছন্দ মানে? জব্বর পছন্দ। তুমি কাজু দিয়ে কী করছ ওগুলো? কিছু বানাচ্ছ নাকি? দেখে তো খুব ইন্ট্রেস্টিং লাগছে। বলা যাবে নামটা?

খোলা সদর দরজা দিয়ে হাস্যবদনে প্রবেশ করেছে ইফতিখার ফাহাদ ও লাবিব খন্দকার। তাদের পিছু পিছু গাড়ি পার্ক করে চাবির রিংটা পকেটে পুড়ে ঢুকছে ইয়ামিন আদিব এবং সঙ্গে আরেকটি স্বল্প অদেখা যুবা পুরুষ। সকলের পড়নে সাদাসিধে শার্ট প্যান্ট। তবু তাদের পোশাক-আশাক বলে দিচ্ছে আচারনিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের সুন্দর ছাপ। লাবিব ভ্রুঁ নাচাতে নাচাতে ফিহার পাশে এসে জগ থেকে একগ্লাস ঢেলে শুধাল,

– হা° রাম জা° দা টা কই ছোটু? জানো কিছু? সকাল থেকে হা°রাম জা° দা টা ফোন রিসিভ করছে না। আজকে মনে করো এখানে একটা সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। খুঁজে খুঁজে সবগুলো ফকিরকে তুলে আনলাম। ওদের একটু গলা ভেজানোর ব্যবস্থা করে দাও। আই মিন, কফি।

লাবিব অবশ্য খেয়াল করেনি অদূরে সোফায় বসে মুখ আড়াল করে কেউ একজন খবরের কাগজ পড়ছে। এতো চমৎকার করে মুখ খারাপ করার ব্যাপারটা শুনে আগ্রহ বোধ করেন সোয়াদ। খসমস শব্দে কাগজের পর্দাটা মুখ থেকে সরিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে লাবিবের মূর্তিটা দেখতে পেলেন। বেচারা সবে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে যাচ্ছিল, কিন্তু সোয়াদের বদরাগী চেহারা দেখে চরম ভড়কে গিয়ে মুখ ছিঁটকে পানিটা ফ্লোরে ফেলে দিল। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, আ.. আ . .আঙ্কেল আপনি!

– হ্যাঁ আমি। কোনো সমস্যা হয়েছে? ওভাবে মুখ ফসকে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো পানি ফেলছ কেন? বসো। একটা চেয়ার টেনে বসে বসে খাও। আর তোমরা . .

কথাটা বলেই বাকি তিনজনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সোয়াদ। হাতের কাগজটা পরিপাটি রূপে ভাঁজ করে বাকিদের উদ্দেশ্যে নিরুত্তাপ স্বরে বললেন,

– তোমরাও বসো। খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বন্ধুর কাবিনে তোমাদের উপস্থিতি না দেখে অবাকই হলাম। এতো কাছের বন্ধু তোমাদের। অ্যাকাডেমি জীবন থেকে গলায় গলায় ভাব। সেখানে কাল তোমরা কেউই উপস্থিত হতে পারলে না। বিষয়টা হতাশাজনক। বসো। আমি বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি। দুপুরে না খেয়ে কেউ যাবে না।

গমগম গম্ভীরতায় কথাগুলো উচ্চারণ করে কোমর হাতদুটো পিছমোড়া বেঁধে বেরিয়ে গেলেন সোয়াদ। পেছন থেকে চারজনই কেমন ভীতশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে সোফায় যেয়ে বসল। সোয়াদকে তারা বন্ধুর বাবা ভাবার চাইতে আর্মির একজন মহা বদরাগী কর্ণেল হিসেবেই চিনে। একসময় যার লাঠির চুমুতে পিঠের ছাল-চামড়া, পশ্চাৎ দেশের মাংস পর্যন্ত খুলে যাওয়ার অবস্থা হতো। ফোঁস করে সবকটা দম ছাড়তেই পুরোনো দিনের অভিজ্ঞতাগুলো বুক মথিত করে সামলে নেয়। হাসি উদ্ভাসিত মুখে ফিহার পায়ের দিকে নজর পরতেই ভ্রুঁ কুঁচকে উঠে নতুন মুখের। নাম তার রাফায়েত ইমাম সাব্বির। পাঁচবন্ধুর মাঝে সবচাইতে দূরদর্শি প্রখর আখ্যা পেয়ে এখনো প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ। সাব্বির প্রশ্ন মাখানো দৃষ্টি তুলে ফিহার দিকে আপাতত প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

– তোমার পায়ে কী হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন?

ফিহা টেবিলের উপর ছড়িয়ে নেওয়া কাজু বরফির মিষ্টান্নটা বড়ো বড়ো থালায় হালুয়ার মতো বিছিয়ে বিছিয়ে বলল,

– সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছিলাম। ওটার জন্য পায়ে একটু সমস্যা হয়েছে। চিন্তার তেমন কিছু নেই। ভয়াবহ কোনো ফ্র‍্যাকচার হয়নি আসলে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাজু বরফির আইটেমটা নিপুণ হাতে সাজিয়ে সকলের সাথে খোশগল্প করতে থাকে ফিহা। যদিও মাথার ভেতরে তীব্র সাইরেনে জানান দিচ্ছে, এভাবে ওকে প্রেশার নিয়ে কাজ করতে দেখলে কুরুক্ষেত্র বোধহয় বাঁধিয়ে ছাড়বে। ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করছে যেন কাজ শেষ হওয়ার পরেই ওই লোক হাজির হোক! আফসানা রাতের জন্য ঘরোয়াভাবে একটু ভালো-মন্দ খাওয়ার উদ্দেশ্য বার্বুচিদের নিয়ে বাড়ির বাইরে সব ফিটফাট করছে। এমনিতেই তার জননী মনে দুঃখ, একমাত্র পুত্রের বিয়েতে কোনোপ্রকার মানুষ নেমতন্ন করতে পারবেন না। কী ভারী লজ্জার কথা! অন্যদিকে সুফিয়া খানম এক সের চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে বারবার রান্নাঘর থেকে ফিহার দিকে তাকাচ্ছেন। যদি দরজা দিয়ে তার সাঈদ বাবা এখুনি ঢুকে আর দেখতে পায় এই চিত্র, তাহলে আজকে পাকনামো করার বর্ণমালা ভালোমতো ফিহাকে বুঝিয়ে দিবে। গাড়ি নিয়ে বেরুনোর পূর্বেও অক্ষরে অক্ষরে বলেছে চুপচাপ রুমে শুয়ে বিশ্রাম নিতে। সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এক্স-রে রিপোর্ট চেক করাবে। ওই জায়গায় ফিহার এমন গা ছাড়া ভাব দেখে সুফিয়া ছোট্ট বাটন ফোনটা ডায়ালে চেপে কানে ধরল,

– হুঁ, হ্যালো। তুমার সুফি খালা কইতাছি বাবা। তুমি আইবা কহন কও তো। . . না না, কিচ্ছুই হয়নাই। কী হইব? আমি থাকতে কোনো পক্ষি আইয়াও ডানা ঝাপটাইতে পারতো না। . . হ বাবা. . হাচা কইছি। তুমার মায় কইলাম কষ্ট পাইছে। সক্কাল সক্কাল হের লগে খাওন দাওন রান্ধনের ব্যাপার লইয়া চেতাচেতি দেখাইছো ক্যা? কুনো প্রয়োজন আছে এইসবের? হের কাম হেয় বুঝুক গা। তুমি ওইসবের মইধ্যে নাকমুখ ঢুকাইয়ো না। আইচ্ছা দেখমু নে ওরে। হ, ঘরে ঘুমায়া আছে। চিন্তা কইরো না। আইচ্ছা তয় রাহি।

কলটা কেটে পিছু ফিরতেই হঠাৎ চমকে উঠে বুকে থুথু দিলেন সুফিয়া খানম। ভূতের মতো কখন যে আফসানা ঠিক সুফিয়ার পিছটাতেই এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝে উঠতে পারেননি সুফিয়া। ঠোঁটে মুখে অপ্রস্তুত হাসি ফুটিয়ে কিছুটা ঠেলেঠুলে বলে উঠলেন,

– কিছু কী কইবেননি আফা? আপনার মুখ অমন কুঁচকায়া রইছে ক্যা?

আফসানা বুকের উপর হাত ভাঁজ করে চোখের চাহনি নিষ্পলক করে তাকালেন। গলাটা পেশাদার নারীর মতো স্বর দীপ্ত করে বলে উঠেন,

– আমাকে সাঈদের গ্যারেজের চাবিটা দাও সুফিয়া। আমি জানি, ও শুধুমাত্র তোমার কাছেই ওর গ্যারেজের চাবিটা দিয়ে যায়। আমি গ্যারেজটা খুলে দেখতে চাই। চাবি দাও!

কথা শুনে মুখটা নিমিষের ভেতর বিবর্ণ হয়ে যায় সুফিয়ার। কাগজের মতো সাদা, ফ্যাকাশে, বড্ড বেশি পাণ্ডুর দেখায়। গ্যারেজের চাবি তিনি মরে গেলেও আফসানার হাতে দিবেন না! সাঈদ নিজের বিশ্বাসের জায়গা থেকে ওই একটিমাত্র দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে দিয়েছে। চাবিটা কী করে তুলে দিবেন বড়ো আপার কাছে? কী করে মুখের উপর বানোয়াট মিথ্যেটা বলবেন তিনি? মাথা কাজ করছে না . .

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here