#পথের_কাঁটা(৪)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
বাইরে থেকে হট্টগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জয়ীর মা কলপাড়ে পা পিছলে পড়ে গেছেন। তাঁর চিৎকারের দমকে বাড়ির সবাই এবং আশেপাশে যারা ছিল তাঁরা দৌঁড়ে এগিয়ে আসে। পা মচকে গেছে। সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যায়। জামশেদ রহমান ত্রয়ীকে বললেন,’জয়ীর ঘর ভেতর থেকে লাগানো। স্কুল থেকে এসেছে বোধ হয়। ওকে ডেকে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।’
ত্রয়ী মায়ের পাশ থেকে উঠে জয়ীর ঘরের কাছে যায়। দরজায় বেশ কয়েকবার করাঘাত করেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। ত্রয়ী এবার চুপ হয়ে যায়। ভেতর থেকে কেমন যেন একটা শব্দ আসছে। পূর্বের তুলনায় এবার আরও জোড়ে জোড়ে করাঘাত শুরু করে ত্রয়ী। ফলাফল শূন্য। আশঙ্কা জাগে মনে। দৌঁড়ে ঘরের পেছনের জানালার কাছে চলে যায়। ধাক্কা দিতেই ভেজিয়ে রাখা জানালাটা খুলে যায়। জয়ী ফ্যানের সাথে ঝুলছে। পা ছুড়াছুঁড়ি করছে। ত্রয়ী এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। হাত-পা কাঁপছে সমানে। প্রথমে একটা ফাঁকা চিৎকার দেয় এবার গগনবিদারী চিৎকার করে জামশেদ রহমানকে ডাকেন।
ত্রয়ীর এমন চিৎকার শুনে জামশেদ রহমানসহ আরও কয়েকজন এগিয়ে আসেন। উঠানে এসে শুনতে পায় ত্রয়ী চিৎকার করে কাঁদছে। শব্দ অনুসন্ধান করে ঘরের পেছনে এসে দেখতে পায়, ত্রয়ী জানালায় থাকা বাঁশের গ্রিলগুলো খোলার চেষ্টা করছে। উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছে ত্রয়ী।
‘কী হয়েছে মা? এমন করছিস কেন?’ বলতে বলতে জামশেদ রহমান ত্রয়ীর কাছে এগিয়ে যায়। দৃষ্টি আপনা-আপনি জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। ত্রয়ীর মুখ ফুঁটে কিছু বলা লাগে না। এবার তিনি নিজেও চিৎকার শুরু করেন। সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার বলেন,’দরজা ভাঙো। তাড়াতাড়ি সবাই দরজা ভাঙো।’
কয়েকজন শক্তিসামর্থ্য তরুণেরা দরজায় ধাক্কায়। ভেতরে ছিটকিনি ধাক্কার দমকে ঢিলে হয়ে খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জামশেদ রহমান হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকেন। জয়ীর দু’পা নিজের কাঁধের ওপর রাখেন। ইতিপূর্বে জামশেদ রহমানকে কেউ কখনও কাঁদতে দেখেনি। আজ সে বাচ্চাদের মতন কাঁদছেন। বাকিরা তাড়াতাড়ি করে ফ্যানের থেকে ওড়নাটা খুলে ফেলল। জয়ী বার দুয়েক কাশতে আরম্ভ করে এবং শরীরটা নিস্তেজ হয়ে বাবার কোলে ঢোলে পড়ে। ত্রয়ী জয়ীর পার্লস চেক করে। নাকের কাছে হাত রাখে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তারপর সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
.
হাসপাতালের বিছানায় নির্বাক অন্তঃসারশূন্য হয়ে শুয়ে আছে জয়ী। কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলছে না। মরতে গিয়েও সে মরতে পারল না। নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে। মৃত্যও কি তাকে ঘৃণা করে? যদি না-ই করত তবে সে কেন মরতে পারল না? এ জীবনের মূল্য যে একদম নেই! একদম না।
গুটি গুটিয়ে পায়ে ত্রয়ী ভেতরে এসে জয়ীর পাশে বসে। জয়ী একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয়। ত্রয়ীর কষ্ট হয়। ফোনটা জয়ীর পাশে বেডে রেখে জয়ীর হাত ধরে আকুতি করে বলে,’আপু! আপুরে! তুই এখনও আমার ওপর রাগ করে আছিস? তুই কেন এই কাজটা করতে গিয়েছিলি?’
জয়ী আস্তে কিন্তু দারাজ গলায় বলল,’ত্রয়ী! রাগ যদি তোর একার ওপর হতো তবে সেটা মিটিয়েই নিতাম। আমি পারছিলাম না নিজের সাথে যুদ্ধ করে ভালো থাকতে।’
ত্রয়ীর ফোন বেজে ওঠে তখন। ফোনের স্ক্রিনে লেখা ‘অঙ্কন ভাই’। জয়ী এবং ত্রয়ী দুজনেই ফোনের দিকে তাকায়। ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে জয়ী বাঁকাভাবে ত্রয়ীর দিকে তাকায়। ত্রয়ী ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে অঙ্কন জিজ্ঞেস করে,’জয়ী এখন কেমন আছে?’
‘ভালো।’ ত্রয়ীর ছোটো উত্তর।
‘আমি আসতে চাচ্ছি। কিন্তু জয়ী কি ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেবে? আমায় দেখলে উল্টো রিয়াকশন হবে না?’
‘আপনার আসার কোনো প্রয়োজন নেই।’
কথা বলতে বলতে ত্রয়ী বাইরে যায়। বলল,’আপু কোনো রিয়াক্ট না করলেও আপনার আসার প্রয়োজন নেই। যা হয়েছে, এতে আপনার দোষ নেই কোথাও। কোনোভাবে নিজেকে দোষারোপ করারও প্রয়োজন নেই। ভাগ্যে হয়তো এমন কিছুই লেখা ছিল।’
‘আমি জানি ত্রয়ী, মুখে যত কিছুই বলো না কেন মনে মনে আমার ওপর রেগে আছো। আসলে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কোনোকিছু না ভেবেই বলে দিয়েছিলাম আমি তোমায় ভালো…’
সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই ত্রয়ী বাঁধা দিয়ে বলল,’অঙ্কন ভাই! যা হওয়ার হয়েছে। অতীত ঘেঁটে লাভ নেই। তবে একটা কথা বলি। আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েই বলছি, আমায় ভুলে যান। আপনার ভালোবাসা শুধু যদি ‘আমি’ কেন্দ্রিক হয় তবে সেই ভালোবাসা কোনোদিনও পূর্ণতা পাবে না।’
‘আমার অপরাধ?’
‘কোনো অপরাধ নেই। আপুকে যেমন আপনি কখনও ঐ নজরে দেখেননি, আমিও আপনাকে কখনো সেই নজরে দেখিনি। দয়া করে এটা ভাববেন না, আমি আপুর হয়ে রিভেঞ্জ নিচ্ছি। আমি শুধু সত্যটাই বলছি। তবে এ কথা সত্য, এই ঘটনা না ঘটে, ডাক্তার হওয়ার পর যদি বাবা বলত আপনায় বিয়ে করতে তাহলে হয়তো আমি বিনাবাক্যেই রাজি হতাম। কারণ ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ব্যতীত আমার জীবনে কোনো স্বপ্নপুরুষ ছিল না। তবে আমি দুঃখিত, এখন আমি নিরুপায়।’
‘ত্রয়ী!’
‘ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’
অঙ্কনকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না ত্রয়ী। লাইন কেটে দিল। জয়ীর কাছে ফিরে গেল আবার। এবার জয়ী নিজ থেকেই কথা বলল। জিজ্ঞেস করল,’অঙ্কনের সাথে তোর সম্পর্ক ছিল, আমায় বলিসনি কেন?’
‘আমার তাঁর সাথে কেন, কোনো ছেলের সাথেই সম্পর্ক ছিল না, নেই।’
‘মিথ্যা বলিস না। আমার জন্য ভালোবাসা বিসর্জনও দিস না।’
‘আমি এত মহান নই আপু। যদি ভালোইবাসতাম তবে অঙ্কন ভাইয়ের সাথে বাবা তোমার বিয়ে দিতে চায়, এটা মেনে নিতাম না।’
‘তাহলে বলতে চাচ্ছিস সম্পর্ক ছিল না?’
‘না।’
জয়ী আর কিছু বলল না। ত্রয়ীও না।
পরেরদিন জয়ীকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখন শোনা যাচ্ছে আরেক নতুন কাহিনী। চায়ের দোকানে গ্রামের লোক একত্রিত হলেই শোনা যায় কথাগুলো। এই বাড়ির মহিলা ঐ বাড়িতে গিয়ে গল্প করছে। সব কথা জয়ী আর ত্রয়ীকে ঘিরে। সবার কথার ধরন, জামশেদ ভাই কত ভালো মানুষ। তাঁর মাইয়া এমন কাম কেমনে করে? আচ্ছা বিয়া না হইছে নাই। এইজন্য ছোটো বইনের ভালোবাসার মানুষরে পাওনের লেইগা ফাঁসি দিতে হইব? কী ফাঁসি দিল? মরলও তো না!
শেষের কথাগুলো সকৌতুকেই বলে মানুষজন। তাদের বিষাক্ত কথার কবল থেকে বাদ পড়ে না ত্রয়ীও। তাঁর চরিত্র তুলেও বলে, মাইয়া মানুষ বানাইব ডাক্তার! ডাক্তারি পড়তে তো যায় নাই গেছে ফষ্টিনষ্টি করতে। দেখো গা বিয়াশাদী কতগুলা শহরে করছে। দুই মাইয়া লইয়া কত গর্ব করত ছেড়ির মায়ে। এহন কই গেল ঐ গর্ব? দিল না চুনকালি মাইখা?
এসব কথাবার্তাই এক মুখ থেকে আরেক মুখে যায়। একজনের বুলি আরেকজন আরও একটু মশলা মিশিয়ে অন্যজনকে শোনায়। সব কথাই জয়ী, ত্রয়ী এমনকি জামশেদ রহমানের কানেও আসে। জামশেদ রহমান বাজারে চায়ের দোকানেও যান না এখন। না, সম্মুখে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু ঐযে লোকে বাঁকা চোখে তাকায়, আড়ালে কথা বলে। এসব সহ্য করা বড়ো কষ্টের। একদিন, দু’দিন, তিনদিন সহ্য করলেও এরপর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সুযোগ পেলে কেউই কথা শোনাতে ছাড়ছে না। যারা কোনোদিন মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারেনি, তারাও এখন বাড়ি বয়ে এসে কথা শুনিয়ে যায়। বাদ যায় না আত্মীয়-স্বজনরাও। তাঁদেরকেও গ্রামবাসীদের নানানরকম কথা শুনতে হয়। যার ঝাল এসে তাঁরা জামশেদ রহমান এবং মায়ের ওপর উঠায়। জামশেদ রহমান আর সহ্য করতে পারলেন না। হার্টঅ্যাটাক করে বসলেন একদিন। কাকে আপনারা পথের কাঁটা বলবেন? জয়ীকে? ত্রয়ীকে? নাকি এই সমাজের বিষাক্ত মানুষরূপী কীটগুলোকে?
চলবে…