#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৭)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
রাতের আঁধারে নিস্তব্ধ শনশন বাতাস। মৃদ্যু কেঁপে উঠছে প্রিয়তার কায়া। দুলছে গলায় পেঁচিয়ে রাখা কালো ওড়না। ছোট ছোট চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে অযত্নে। এই সমাজের অযাচিত কিছু ঘটনার রোষানলে পিষে গিয়েছে প্রিয়তা। কোনোভাবেই বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। আর না সম্ভব একেবারে এসবে ঢুকে পরা। প্রিয়তা একটা সাদামাটা, সহজসরল জীবন চেয়েছিল। যেজন্য পরিবার ছেড়ে চলে এসেছিল এই অনিশ্চয়তার জীবনে। কিন্তু এই জীবনটা এখন অত সহজ নয়। ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর ভয় তাড়া করছে প্রিয়তাকে। ভাইকে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। ঘর থেকে বের হবার আগে বারবার ভাবতে হচ্ছে। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিছ নোংরা মুখ সামনে চলে আসায় অপরাধীরা হিংস্র হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর তাণ্ডব করতে চাইছে। আর এই অপরাধীরা কোনো সাধারণ ছোটখাটো ব্যক্তিবর্গ নয়। এদেরকে দেশের মানুষ সম্মান করে, বিশ্বাস করে। এদের কথায় চলে এলাকা। শত শত চ্যালা এদের হাতের নাগালে চলে। জনগন কি করবে? পুলিশের এত দায় কিসের? প্রাণ হারানোর ভয় তো সবার আছে।
খলিল নামের লোকটি একজন ডাক্তার। শহরে তার একটা মাঝারি আকারের ফার্মেসি আছে। সকলে লোকটাকে খুব ভালো বলেই জানে। বিশ্বস্ত ডাক্তার হিসেবে মানে। কিন্তু এই খলিল তার ডাক্তারি পেশার অগোচরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তুলে এনে ভিক্ষে করিয়ে টাকা ইনকাম করে। যেসকল বাচ্চাদের খুঁত নেই, সেসব বাচ্চাদের বিভিন্ন ঔষধ দিয়ে অসুস্থ বানিয়ে রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়। ভিক্ষা করার কৌশল বের করে দেয়, হাত-পা কেটে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়। খলিলের কথামতো সবাইকে রোজ নির্দিষ্ট একটা টাকা এনে ধরিয়ে দিতে হয় খলিলকে। নইলে পেতে হয় শাস্তি।
প্রিয়তা ছুটে চলেছে নিস্তব্ধ, কোলাহলমুক্ত পাকা রাস্তায়। বাতাসে গা কাঁপছে। ভয়ঙ্কর লাগছে সবকিছু। আরহামের ঘুম ছাড়ছে না। বোনের ঘাড়ে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। প্রিয়তা প্রহরের কল পাওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে আরহামকে টেনে তুলেছে। আরহামের গায়ে কোনোরকমে জ্যাকেট পরিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। জ্যাকেটের চেইন লাগানোর মতো সময় নেয়নি প্রিয়তা। নিজেও শাল কিংবা জ্যাকেট পরে আসেনি। নিজের কথা ভাবে না প্রিয়তা। ভাইক নিয়েই সকল ভয় তার। আরহামের কিছু হলে প্রিয়তা নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা আরহামকে প্রিয়তা ভালোবাসে। ওকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও থাকতে পারবে না সে। নিষ্পাপ এই ছেলেটার তো কোনো দোষই নেই। তবে কেন আরহামকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে? আঘাত পাওয়ার আশঙ্কায় থাকতে হবে? প্রিয়তার ভয় বাড়ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেউ একজন পিছন থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তায় একটা অটো ও নেই। রাত একটা বাজে কেই বা যানবাহন নিয়ে বসে থাকবে? এতটা পথ কি করে যাবে প্রিয়তা? আরহামকে নিয়ে যেতে পারবে তো? নাকি তার আগেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পরতে হবে।
_______
গোলাগুলির এক মুহূর্তে থেমে গেল শত্রুপক্ষ। শান্ত হলো পরিবেশ। আরো এক জিপ ভরে পুলিশ এসেছে। খলিলের লোকজনের চেয়ে এখন পুলিশের লোক সংখ্যা বেশি। শুধু গুলিতেই নয় একের পর এক থাপ্পড়,ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে প্রহর আর ইহান। একটা লোককেউ ছাছে না। রক্তাক্ত হচ্ছে স্থানটা। শব্দে ভরে উঠেছে আবার। দুই পক্ষই আক্রমণের শিকার।
প্রহর চোখের ইশারায় ইহানকে ডাকল। দুজন মিলে সাবধানতার সাথে বন্দুক নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। বাড়িতে আগে থেকেই কিছু পুলিশ অফিসার রয়েছে। অতর্কিত হামলায় অপ্রস্তুত হয়েছে খলিলের লোকজন। অস্ত্র হাতে নেওয়ার সময় পায়নি। যারা বুঝে গিয়ে অস্ত্র উঠিয়েছিল তাদের কৌশলে ধরা হয়েছে। গুলি ছুঁড়েছে পুলিশরাও। বাড়িতে ঢুকে কোথাও কাউকে পেল না প্রহর বা ইহান। খুঁজল আরেকটু। ছাদে এসে রেলিংয়ের কাছে এসে একজনকে দেখল তারা। খলিল পালানোর চেষ্টা করছে। পেছনের গেট পেরিয়ে বাইরে এসেছে মাত্র মাত্র। প্রহর উচ্চ স্বরে নিচের সবাইকে ডাকল। বললো,
” খলিল পালাচ্ছে। ওকে ধরো। পালাতে যেন না পারে।
তানিয়া বাড়ির নিচের বারান্দার দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। বাড়ির সদর দরজা আটকানো। কেউ যেন পালাতে না পারে এজন্য আগেই এটায় লক করে রেখেছে প্রহর। খলিল লোকটা লাফিয়ে গেটের পাশের দেয়াল পার হতে চাইল। এক পা উঠিয়ে পার হতে গেলেই। তানিয়া দৌড়ে খলিলের কাছে গেল। ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল খলিলের শার্টের কলারের অংশ। নামিয়ে নিল দেয়াল থেকে। কষে থাপ্পড় মারল খলিলের গালে। হাতাহাতি হলো খলিলের সাথে। তানিয়াকে সরাতে চাইল খলিল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তানিয়াকে ধাক্কা মারল খলিল। তানিয়া পরে গেল নিচে। অতঃপর উচ্চস্বরে ডাকলো সবাইকে। প্রহর তখন বাড়িটির ভিতরের এক ঘরে থাকা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বের করছে। ইহান ছাদ থেকে ছুটে এলো দ্রুত গতিতে। ততক্ষণে খলিল দেয়াল পেরিয়েছে। বাইরে থাকা কয়েকজন পুলিশকে ফোন দিল ইহান। কানে থাকা হেডফোনে চাপ লাগাল আঙ্গুল দ্বারা। অপর প্রান্তের পুলিশকে বললো,
” খলিল মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ওর পেছনে যাও। আজ ওকে ধরতেই হবে। প্ল্যান ডিশমিশ হতে দেওয়া যাবে না।
তানিয়ার হাতে কাঁচের টুকরো ঢুকে গেছে। বাড়িটির আশেপাশে অসংখ্য কাঁচের টুকরো। মদের বোতলের একটা ভোটকা গন্ধ ভেসে আছে। ব্র্যান্ডের বোতল গুলোকে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে রেখেছে আশপাশে। বোঝা গেল এই খলিল নামক ডাক্তার মদ্যপান করে প্রচুর। চ্যালাদের নিয়ে বাইরে বসে আড্ডা দেয়। ইহান তানিয়ার পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে গেল তানিয়ার কাছে। চিন্তিত হলো সে। হাত থেকে ধীরেসুস্থে কাচ বের করছে তানিয়া। মাঝে মাঝে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলছে। রক্ত গড়াচ্ছে হাতে। হাতের তালু মাখামাখি হয়েছে রক্তে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট না থাকলে অগণিত গুলি বিধতো বুকে। কাচ বিঁধে যাওয়ার উপর দিয়ে সবটা গিয়েছে ভেবে মনে মনে খুশিই হলো তানিয়া। উঠে দাঁড়াল কষ্ট করে। হাঁটু বোধহয় ছিলে গিয়েছে। একটু ব্যথা করছে সেখানে। জ্বলছে খানিক।
ইহান পর্যবেক্ষণ করলো। তানিয়াকে ধরে উঠাল। তানিয়ার হাত মুঠোয় ধরে দায়িত্ব নিয়ে কাচের টুকরো বের করল খুব যত্ন নিয়ে। চোখে পানি জমল তানিয়ার। মুখ দ্বারা শব্দ করলো না কোনো। তাকিয়ে রইল রক্তাক্ত হাতের দিকে। জ্বলে যাওয়া স্থানে ফু দিল। ইহান পকেটে থাকা নিজের রুমাল পেঁচিয়ে দিল তানিয়ার হাতে। বললো,
” মিশন তো কমপ্লিট। ফার্মেসিতে চলো। ব্যান্ডেজ করতে হবে। আল্লাহ্ জানে তুমি এত আহত হও কিভাবে।
” আমি নিজেও জানি না। সব হামলা আমার সাথেই হয়। আচ্ছা প্রহর স্যার কোথায়? ড. খলিল ধরা পরেছে?
” প্রহর ভিতরের ছেলেমেয়ে গুলোকে বের করছে। ধরা পরেছে খলিল। বেশিদূর যেতে পারেনি। জানতাম পালানোর চেষ্টা করবে। রাস্তার এদিক ওদিক, অলিতে গলিতে পুলিশ ফোর্স রাখা হয়েছে আগে থেকেই। চিন্তা নেই। এইবার জাফরকেউ ধরতে পারবো।
তানিয়া হাসল। মিষ্টি হাসি। জ্যাকেট টা খুলে ফেলল। এতক্ষণের হানাহানিতে ভিষণ গরম লাগছে। বন্দুক থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। বন্দুকটা ইহানের হাতে দিয়ে সে বললো,
” আমাকে তো নিয়ে আসতে চাইলেন না। দেখেছেন এসে কত ভালো হলো? কতকিছু দেখতে পারলাম। গুলি করার সুযোগ পেলাম। এত রিস্কি একটা মিশন আমার সামনে হলো। ইটস ইন্টারেস্টিং।
” হাতটা তো কেটেছিঁড়ে ফেললে। ক্ষতি হয়নি কে বললো? এর থেকে বেশি কিছুও হতে পারতো।
হাসল তানিয়া। মনোমুগ্ধকর হাসি তার। গোল চশমার আড়ালে থাকা চোখগুলোও হাসল। ইহান সহ্য করতে পারল না তানিয়ার হাসি। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল সে। অপর পাশে ফিরে বড় বড় দম নিল। ওষ্ঠদ্বয় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। নিস্তব্ধ এই শহরে প্রিয় নারীর অমায়িক হাসি তোলপাড় শুরু করে দিল ইহানের হৃদয়ে। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইহান। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হলো। শ্বাস নিতেও কষ্ট হলো খানিক। এই হাসিটা আর কিছুদিনই দেখতে পাবে সে। এরপর সব সৌন্দর্য ফিকে পরে যাবে। দেখতে পাবে না শখের নারীকে। বিড়বিড় করে ইহান বলে উঠল,
” এ শহরের সকল সৌন্দর্য তোমাতে নিবদ্ধ তানু। তুমি আমার পছন্দের চাঁদ । তোমাকে দেখা যায়, অনুভব করা যায়। শুধু ছোয়া যায় না, একান্ত নিজের বলে দাবি করা যায় না।
_______
রাত দুটো বেজে আঠারো মিনিট। প্রায় শতাধিক ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে এ বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ টিম। প্রায় সব বাচ্চাদের হাত-পা অচল, কয়েকজন কথা বলতে পারে না। মাত্র কিছুজন সুস্থ সবল ছেলেমেয়ে পাওয়া গেল। প্রহরের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশের জিপ এলো চারটা। সেখানে গাদাগাদি করে রাখা হলো বাচ্চাদের। এতক্ষণে প্রিয়তার কথা মনে পড়ল প্রহরের। জিপে থাকা ল্যাপটপে প্রিয়তার লোকেশন ট্র্যাক করল। প্রিয়তার লোকেশন ভেসে উঠল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ম্যাপের মতো আঁকাবাঁকা দাগ ভেসে উঠল। প্রহর হাসল। প্রিয়তা মোটেও অত বোকা নয়। মনে করে ঘড়িটা হাতে পরে বেরিয়েছে মেয়েটা। বিপদ হলে প্রহর যেন প্রিয়তাকে খুঁজতে পারে সেজন্য ঘড়িটা সাথে সাথে রেখেছে প্রিয়তা। প্রহর জায়গাটা চিনে নিল। অতঃপর কল করল প্রিয়তাকে। রিং হবার সাথে সাথেই ফোন তুলল প্রিয়তা। কণ্ঠে মেয়েটার ভয়, উৎকণ্ঠা। যন্ত্রণার পাহাড়। প্রহর কিছু বলার আগেই প্রিয়তা বলে উঠল,
” আপনি কোথায়? আমি থানায় পৌঁছাতে পারিনি। রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। আরো আধঘন্টার পথ বাকি। আমার ভয় করছে। আরহামের কিছু হবে না তো? হঠাৎ আমাদের বের হতে বলেছেন কেন? কোনো বিপদ হবে না তো?
প্রহর বললো,
‘ রিল্যাক্স প্রিয়তা। আমরা খলিলকে অ্যাটাক করছি। সব বাচ্চাদের উদ্ধার করেছি। এট্যাকের সময় খলিল জাফরকে ফোন করতে পারে, এই ভয়টা ছিল আমার। জাফর আপনাদের ক্ষতি করে আমাদের মিশন ক্যানসেল করে দিতে পারে বলে মনে হয়েছে। ইনফ্যাক্ট এখনো আমি ডাউট করছি আপনাদের ক্ষতি করতে পারে। বাকিটা আমি পরে বলবো। আপনার লোকেশন দেখতে পাচ্ছি। আমরা আসছি। আপনি ততক্ষণ নিজেদের সেইভ রাখুন।
আরহামের ঘুমন্ত শরীরের ভর এলিয়ে দিয়েছে প্রিয়তার শরীরে। এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তার পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছে প্রিয়তা। শ্বাস আটকে আসছে। প্রিয়তা জানে আরহাম কোনোমতেই এখন হাঁটতে পারবে না। এতক্ষণ ছেলেটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুর্বল লাগছে প্রিয়তার। পানি পিপাসা পেয়েছে। হুট করে ঘুম ভাঙায় মাথা ব্যথাও করছে। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। এই প্রথম এত রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে প্রিয়তা। আশেপাশে কেউ নেই তার। মনে হচ্ছে এই বুঝি সাদা পোশাকে বেরিয়ে এলো কোনো আত্মা। আঁকড়ে ধরল প্রিয়তার কাঁধ। কিংবা চতুষ্পদ জন্তু আক্রমন করে বসল। ভয়ে গা গুলিয়ে আসছে প্রিয়তার। আঁধারে ভয়ঙ্কর লাগছে পুরো শহর। এক হাতে ফোনের আলো জ্বেলে আরেক হাতে আরহামকে জড়িয়ে রেখেছে সে। হাতেও ব্যথা হচ্ছে ভালো মতো। প্রিয়তা হুট করে কেঁদে দিল যন্ত্রণায়। আর সইতে পারছে না সে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। নিদারুণ ব্যথায় কুকিয়ে উঠছে বারবার। নিজেকে নিজেই আঘাত করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বসে পরতে ইচ্ছে করছে মাঝরাস্তায়। এই ব্যথা কে বুঝবে? কে জানতে চাইবে? তাদের বিপদ হবে না তো?
খলিলকে একটা জিপে উঠানো হলো ফোর্স সহ। জিপের ড্রাইভিং সিটে বসল প্রহর। প্রিয়তার জন্য পাশে জায়গা রাখল। মাঝরাস্তায় মেয়েটাকে তুলে নিবে জিপে। ইহান আর তানিয়া যখন জিপে উঠতে গেল তখন জিপে কোনো জায়গা নেই। এত রাতে অন্য গাড়ি পাওয়া সম্ভব না। ইহান একজন পুলিশকে ফোন দিয়ে তার বাইক আনতে বললো। আধঘন্টার মাঝেই বাইক আসল। প্রহর জিপ স্টার্ট দিল। ইহান আর তানিয়া বসল বাইকে। ছুটে চলল নিজের মতো। জিপ শীঘ্রই পৌছাল প্রিয়তার লোকেশনে। জিপের আলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখে পরল প্রিয়তার। হাত দিয়ে চোখ মুছে নিল সন্তর্পণে। জিপের কাছে এসে দাঁড়াল। প্রহর উঠতে বললো গাড়িতে। বসতে দিল তার পাশে। প্রিয়তা সাবধানে আরহামকে নিয়ে উঠে বসল। সিটে গা এলিয়ে দিল সে। মনে জমা এত এত প্রশ্ন আর করা হলো না প্রিয়তার। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভর করল। ঘুমে চোখ বুজে আসল। ঘুমু ঘুমু চোখে এক পলক প্লহরের দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে গেল প্রিয়তা। মেয়েটার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনো গেল শুধু। প্রহর প্রশান্তিতে শ্বাস ফেলল। এতক্ষণ প্রিয়তাকে নিয়ে ভয়ে ছিল সে। কোনোভাবে জলিল যদি প্রহরের এই অ্যাটাকের কথা জাফরকে জানাতো, তাহলে প্রিয়তা বা আরহামের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে সবটা ডিশমিশ করে দিত জাফর। এতকিছু হয়নি ভেবে চিন্তা কমল প্রহরের। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। আরহামের গাল টেনে দিয়ে পাতলা চুলে হাত বুলিয়ে দিল। প্রিয়তার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিল।
___________
প্রিয়তার যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির কাটায় নয়টা বেজে ঊনত্রিশ মিনিট। চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। গরম গরম ভাব আসছে। নিজের অবস্থান দেখে নিল প্রিয়তা। প্রহরের ডেস্কের চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে সে। গায়ে একটা মোটাসোটা শাল। আরহাম কোলে নেই। চারপাশে শোরগোলের আওয়াজ। প্রিয়তার ঘুম ঘুম ভাব কাটল। একটু এপাশ ওপাশ করে উঠে পরল নিঃশব্দে। চারপাশে ভালোমত চোখ বুলাল। সেসময় ঘরটায় প্রবেশ করল প্রহর। গায়ে সাদা রঙের শার্ট। চুল গুলো ভেজা। ফর্মাল ড্রেসআপে আকর্ষণীয় লাগছে ছেলেটাকে। প্রিয়তাকে উঠতে দেখে মুচকি হাসল প্রহর। ডেস্ক থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
“গুড মর্নিং প্রিয়তা। ঘুম ভালো হয়নি তাইনা?এখানে তো বিছানা নেই।
প্রিয়তা হাই তুলল। হাত দিয়ে চুলগুলোকে আঁচড়ে নিল। অলস ভঙ্গিতে বললো,
” গুড বলে আমার জীবনে কিছু নেই। আজকের সকালটা কোনোভাবেই গুড নয়। এতটা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে আমার শরীর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।
” এটুকু না করলে আরহাম বা আপনার ক্ষতি হতে পারতো। এত বড় রিস্ক নিতে আমি পারতাম না।
” আপনি শুধু আমায় নিয়ে ভাবছেন কেন? আপনার মা আর বোনকেও তো জাফর এট্যাক করতে পারে।
” মা ফুপির বাসায় গিয়েছে গতকাল মাঝরাতে। নিধি এখন হোস্টেলে। ওদের আমি আগেই সরিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ আক্রমণ করেছি বলে সবাইকে সরিয়ে নেওয়াটা নজরে রাখেনি জাফর। ওর তো অন্য প্ল্যান ছিল। আপনাকে তো কোথাও পাঠাতে পারি না। পাঠালেও আপনি যাবেন না। তাই আমার কাছেই রাখছি।
” কতদিন রাখবেন এভাবে? আমাকে নিয়ে আমি ভয় পাই না। আরহামকে নিয়েই সব চিন্তা আমার। আচ্ছা আরহাম কোথায়?
” তানিয়ার ডেস্কে। খেলছে বোধহয়। আমি বাড়ি থেকে গোসল করে খেয়ে এলাম। আপনার আর আরহামের খাবারটা তানিয়ার ডেস্কে রেখে এসেছি। আরহাম আর আপনি খেয়ে নিবেন এখন। আর ব্যথার ট্যাবলেট ও রেখেছি।
” আপনি কি আমাকে সারাজীবন আপনিই বলবেন?
” কেন? আপনি সারাজীবন থাকবেন নাকি?
” না মানে আপনি আমাকে আপনি সম্বোধন করলে আমার নিজেকে আপনার চেয়ে বড় বলে মনে হয়। তাই আর কি।
” আচ্ছা এটা পরে ভেবে দেখবো। আপনি এখন খেয়ে নিন। আজকে আপনাকে থানায় থাকতে হবে। জাফরকে ধরতে পারলেই মা আর নিধি ফিরবে। আপনিও বাড়ি যাবেন।
” আচ্ছা।
______________
থানায় আটকে রাখা হয়েছে খলিলকে। সব বাচ্চাদের বয়ান নেয়া হয়েছে। কিছু বাচ্চার বাবা-মায়ের সাক্ষী নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে থানার সামনে প্রেসের লোক জড়ো হয়েছে। সকলের মনে অনেক প্রশ্ন। সবকিছুর উত্তর দিচ্ছে ইহান। তথ্যসমূহ তুলে ধরছে মিডিয়ার কাছে। প্রহর জেলের ভিতরে ঢুকল শান্ত ভঙ্গিতে। প্রহরের মুখে হাসি। জেলে থাকা চেয়ারটা টেনে বসল সে। লাঠি দিয়ে আঘাত করলো মেঝেতে। ভয়ে কেঁপে উঠল খলিল। ধরে আনার পর ইহান নামক পুলিশ কয়েক ঘা দিয়েছে তাকে। হাতে পায়ে দাগ পরে গিয়েছে। ব্যথা হচ্ছে অনেক। প্রহর শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
” জাফর তো আপনার বন্ধু? শুনেছি খারাপ মানুষরা নাকি ভালো বন্ধু হতে পারে না। জাফরের অনেক তথ্য আপনার কাছে আছে। আবার জাফরের কাছে আপনার সব তথ্য আছে। সব তথ্য আমাকে দিবেন নাকি আরো কয়েক ঘা খাবেন?
” আমি কিছু বলবো না। একটু পরেই ছেড়ে দিবি আমাকে।
“আমি ছারলেও মিডিয়া ছাড়বে না। সব ছেলেমেয়েদের বয়ান মিডিয়ায় দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেটের সর্বত্র স্থানে আপনার কুকর্ম ফাঁস হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে বের হলেই জনগন আপনাকে ইট ছুড়ে মারবে। আর বাকি রইল ক্ষমতার কথা? এইবার সব গুছিয়ে রেখেছি আমি। উপরমহলে আপনাদের বিরুদ্ধে ফাইট করেছি। দাবি জানিয়েছি নিজের।এইবার আপনি যদি জাফরের তথ্য আমাদের দেন তো আপনার শাস্তি কম হবে। তবুও যদি না বলেন আপনার মেয়ের হাত-পা কেটে ভিক্ষে করাবো। যেমনটা আপনি অন্যের সন্তানদের দিয়ে করাতেন। কি ভালো লাগবে?
রেগে গেল ডক্টর খলিল। ক্ষেপে উঠল। বললো,
” আমার মেয়ের ক্ষতি করলে তোকে মেরে পুঁতে রাখবো।
” অন্যের ছেলেমেয়েকে দিয়ে যখন ভিক্ষে করাতেন তখন তাদের বাবা-মায়ের ও এমন রাগ হতো। নিজের মেয়ে বলে খুব মায়া তাইনা? আপনি একটা নোংরা মানুষ। রেগে বললো প্রহর নিজেও।
দমে গেল খলিল। “নিজে বাঁচলে বাপের নাম” কথাটি উচ্চারণ করল। সময় নিয়ে সব তথ্য তুলে ধরল মিডিয়ার সামনে। বেরিয়ে এলো জাফরের কুকর্ম। মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। ভাইরাল হলো কথাগুলো। জনগন থানায় এসে হামলা চালাল। প্রেসের লোক জনগনের সামনে মাইক্রোফন রাখলেই সকলে তাদের মনের ক্ষোভ ঝেরে প্রকাশ করল মিডিয়ায়। পুলিশকে আদেশ করা হলো জাফরকে ধরে আনার জন্য। প্রহর, ইহান আর তানিয়া হাসল। আনন্দে আত্মহারা হলো সকলে। প্রিয়তাও খুশি হলো। বেরিয়ে এলো থানা থেকে। এবার বাড়ি ফেরা দরকার।
_________
ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। রাতের আবহাওয়া ভালো লাগছে তার। হাতে প্রিয়তার দুধ চা। এই ঠান্ডায় চা খেতে ভিষণ ভালো লাগছে প্রিয়তার। চুমুকে চুমুকে বিষাদ কেটে যাচ্ছে। প্রকৃতিকে আজ খুব সুন্দর লাগছে প্রিয়তার। চাঁদ টাকে আকর্ষণীয় লাগছে। নিজেকে কেমন স্বাধীন মনে হচ্ছে আজ। আগামীকাল নিজের বাড়িতে যাবে প্রিয়তা। তার জীবন যেমনই কাটুক না কেন, আরহামের জীবনটা সুন্দর, উৎফুল্ল করে তোলা প্রয়োজন। বাবার সম্পত্তির অংশ পাওয়া আরহামের অধিকার। সেই অধিকার থেকে ছেলেটা বঞ্চিত হবে কেন? সামনে আরহামের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি না থাকলে এ দুনিয়ায় কারো দাম নেই। আরহাম বেরঙের জীবন যাপন করুক তা প্রিয়তা চায় না। দমে গেলে তো তার চলবে না। লড়তে হবে আরহামের জন্য।
প্রিয়তা চায়ে চুমুক দিল। ছাদে প্রবেশ করলেন মিসেস নাবিলা। একটু আগেই ফিরেছেন তিনি। একদিনের অভিযানে তেমন মন ভরেনি উনার। ছেলের এমন সুন্দর মুহুর্তে মা না থাকলে কি চলে? তাইতো চলে এসেছেন। প্রিয়তাকে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। প্রিয়তা নাবিলার উপস্থিতি বুঝল। একটু হাসল সে। মিসেস নাবিলা জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছো প্রিয়তা? আরহাম কেমন আছে?
” আলহামদুলিল্লাহ্ আন্টি। আমরা ভালো আছি। আপনি ফিরলেন কখন?
” এইতো একটু আগেই। জানো কাল প্রহরের বাবা আসবে ইনল্যান্ড থেকে। প্রহর খুব খুশি।
” ও আচ্ছা।
” তোমাকে একটা কথা বলতে চাই প্রিয়তা। খুব জরুরী কথা। এখন এই কথাটা না বললেই নয়।
প্রিয়তা শুনতে মনোযোগী হলো। আগ্রহ প্রকাশ করলো। মিসেস নাবিলা দমে গেলেন। মুখ মলিন হলো উনার। চুপ করে গেলেন। প্রিয়তা স্থির হয়ে রইল। কি এমন বলতে চায় উনি? এমন মলিন কেন কেন আন্টির মুখ? কথাটা শুনে প্রিয়তা কষ্ট পাবে না তো? ভয় হলো প্রিয়তার।
চলবে?