#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৪ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
নিয়াজ শেখ নিজেকে আবারো আয়নায় দেখে নিলেন। আধঘন্টা ধরে আয়নায় নিজেকে দেখে যাচ্ছেন তিনি। নিজেকে আজকাল কেমন তরুণ যুবক মনে হচ্ছে উনার। হৃদয়ে ঢেউ খেলছে। যদিও বয়স উনার একচল্লিশ ছুঁই ছুই। চুলগুলোকে চিরুনি দ্বারা আচরে নিয়ে চাপ দাড়িতে হাত বুলালেন নিয়াজ। তানিয়া ঘড়ি পড়তে পড়তে ঘরে এসে বাবার দিকে তাকাল এক নজর। মুচকি হাসল সে। নিয়াজ সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়েছেন। পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তানিয়া এগিয়ে এলো আয়নার সামনে। বাবার সম্মুখে এসে বললো,
” বাব্বাহ্! ভালোই তো রেডি হয়েছো। ইউ আর লুকিং সো হ্যান্ডসাম বাবা।
নিয়াজ বিব্রত হলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,
” কি যে বলো না তুমি তানি। এখন কি আর সেই সৌন্দর্যের বয়স আছে?
” কেন থাকবে না? তুমি এখনো কিন্তু সুন্দর। সৌন্দর্যের আবার বয়স কিসের?
” আচ্ছা এসব না করলে হতো না? এই বয়সে এসে?
তানিয়া রেগে গেল। বাবার বাহু ধরে টেনে বাইরে এনে ফ্ল্যাট লক করে দিল। আজ নিয়াজ শেখ তাসলিমা খাতুনের সাথে দেখা করতে যাবেন। নির্দিষ্ট একটা রেস্টুরেন্টে বসে আলাপ আলোচনা করবেন দুজন। তানিয়ার খুশি খুশি লাগছে। পিতার জীবনে নতুন মানুষের আগমনে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে তানিয়ার মন। তানিয়া জানে নিয়াজ খুব নার্ভাস। সেজন্য বাবার সাথে নিজেও যাচ্ছে পাত্রী দেখছে। এই বিষয়টা কেমন নতুন নতুন লাগছে। এরকমটা আগে বুঝি হয়েছে কখনো?
____________
একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টের মাঝের চেয়ারে বসেছেন নিয়াজ আর তাসলিমা। তাসলিমা খাতুনের পরণে মসলিন শাড়ি। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। ঠোঁটে মেরিলের চিহ্ন। তাসলিমা খাতুনের হাবভাবে জড়তা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই পুরো রেস্টুরেন্টটা পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তানিয়া ওয়াশরুমের কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছে। তাসলিমার বুঝতে বাকি নেই তানিয়া তাদের দুজনকে আলাদা কথা বলার সময় দিচ্ছে।
তসলিমা খাতুন দু কাপ চা অর্ডার করলেন। নিয়াজ বোকা হাসলেন। সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন তাসলিমা খাতুন নিজেও। বললেন,
” আপনি বোধহয় অসস্তি বোধ করছেন।
নিয়াজ ভড়কালেন। এই বয়সে এসে পাত্রী দেখা আবার বিয়ে করা সবটাই যেন কাল্পনিক মনে হচ্ছে। সাধারণত এইসব টিভি সিরিয়ালেই দেখা যায়। বাস্তবেও যে এমনটা ঘটে সে ঘটনা দূর্লভ। নিয়াজের মনে হচ্ছে তিনি পাত্র দেখতে আসেননি। তাকেই পাত্রী দেখতে এসেছে। একটু হেসে তিনি বললেন,
” বুঝতেই পারছেন এই বয়সে এসে বিয়ে বিষয়টা বেমানান। আমার মেয়েটার বয়স বাড়লেও কি হবে? বাচ্চামিতে সবসময় এগিয়ে। কি পাগলামী করে বেড়াচ্ছে।
” আপনার মেয়েকে কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। চা য়ে চুমুক দিয়ে কথাটা বললেন তাসলিমা। পুনরায় বললেন,
” আপনি বিয়ে করেননি তানিয়ার জন্যই। তাইনা?
” তা বলতে পারেন। সৎ মা ওর সাথে কেমন আচরণ করবে এই ভেবে আর এগোতে পারিনি।
” এখন কেন মনে হলো বিয়ে করা দরকার?
” কারণ আমি উপযুক্ত পাত্রী পেয়েছি। যিনি আমার মেয়েকে নিজের মেয়েই ভাববেন।
” এত কনফিডেন্ট?
” আমার মেয়ে কিন্তু পুলিশে কর্মরত। ও কিন্তু আপনার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই আমাকে জানিয়েছে। আপনার ব্যক্তিত্বে আমার মেয়েটা মুগ্ধ হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি আপনাকে নিয়ে আমার মেয়ের কখনো কোনো অভিযোগ করতে ইচ্ছে হবে না। আপনি কি চান বলুন। আপনি রাজি না হলে এখনই উঠবো আমি। আমার মেয়েটা আপনাকে ভালোমতো চিনে বলে ভদ্রতাসূচক এখানে বাধ্য হয়ে বসে থাকবেন এমনটা কিন্তু করা যাবে না। সোজাসুজি বলবেন।
তাসলিমা হাসলেন। আরো এক কাপ চা অর্ডার করলেন। মুচকি হেসে বললেন,
“বসুন।
____________
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। টিউশন থেকে ফিরে চুলায় ভাত আর ডাল বসিয়েছে প্রিয়তা। শীত ভালোই ঝেঁকে বসেছে। জ্বরের কারণে আরো বেশি শীত লাগছে প্রিয়তার। হু হু করে কাঁপছে কায়া। হুট করে ঊদিত হওয়া শীতল বাতাসে হু হু করে শিহরণ জাগাচ্ছে দেহে। হাতে হাতে ঘর্ষণ দিয়ে হাত গরম করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে আগুনের কাছে হাত রেখে সেই হাত গালে চেপে ধরছে।
ডাল আর ভাত হলে প্রিয়তা ঘরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। একটু আগেই আরহাম ঘরে ছিল। এখন কোথায় গেল? মাথায় ওড়না চেপে শালটাকে আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নিল প্রিয়যা। নভেম্বরের এই শীতের মাসে সন্ধ্যে হবার পরে আরহাম কোথায় যাবে? চিন্তা হলো প্রিয়তার। বেলকনিতে গিয়ে আশপাশে চোখ বুলাতেই মাঠে আলোর ঝলকানি দেখল প্রিয়তা। মাঠের ঠিক মাঝে অনেকগুলো শক্তপোক্ত পুরুষের দেখতে পেল। লম্বাটে, ফর্সা কয়েকজন মেয়েকেও দেখল প্রিয়তা। মাঠের মাঝে দু দিকে দুটো বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে। বাঁশের উপরের শেষ অংশে কতকগুলি বাল্প লাগানো হয়েছে। পুরো মাঠটা সেই বাল্পের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। ব্যাডমিন্টন খেলছে সকলে। হাতে খেলার সামগ্রী। আরহাম পাশেই তানিয়ার কোলে বসে আছে। তানিয়া ব্যাডমিন্টন হাতে নিয়ে আরহামকে এটা ওটা দেখাচ্ছে। কারো গায়েই শীতের বস্ত্র নেই। মোটা শাল আর সোয়েটার ঘাসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে সবার কথার।
প্রিয়তা নিচে নেমে এলো। রান্না হয়েছে, আরহামের খাওয়া প্রয়োজন এখন। সন্ধ্যের সময় বাইরে না থাকাই উচিত বলে মনে করে প্রিয়তা। প্রিয়তা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসে ডাকল আরহামকে। এত মানুষ এখানে উপস্থিত বলে উচ্চস্বরে ডাকল না। আর প্রিয়তার এমন শান্ত কণ্ঠ কানে পৌঁছাল না আরহামের। বাধ্য হয়ে মাঠে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। ইহান আর প্রহর তখনো খেলছে। একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে কক টাকে। নেটের উপর দিয়ে বারংবার উড়ছে কক টা।
প্রিয়তা তানিয়ার কাছে এসে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছেন আপু?
তানিয়া হাসল প্রিয়তাকে দেখে। ব্যাডমিন্টন হাত থেকে নামিয়ে বলল,
” ভালো আছি। তোমার কি খবর?
” এই তো চলছে।
প্রিয়তা আরহামের হাত ধরে তানিয়ার কোল থেকে উঠাল। বললো,
” ঘরে চলো। এখানে সবাই বড় বড় মানুষ। তুমি এখানে কি করছো?
আরহাম সবার দিকে তাকাল। অতঃপর হাসিহাসি কণ্ঠে বললো,
” প্রহর ভাইয়া আমাকে এনেছে। জানো আমি খেলতে পারি এখন। ইহান ভাইয়া আর প্রহর ভাইয়া আমাকে শিখিয়েছে।
” রান্না করেছি। খেয়ে আবার আসবে। এখন চলো।
প্রহর খেলা থামাল। প্রিয়তার পানে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। বললো,
” এখানে খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আপনি আসুন না আমাদের সাথে, ভালো লাগবে।
” আপনাদের কাজটাজ নেই? এই ভরসন্ধ্যায় খেলছেন? শীত কেমন পড়েছে দেখেছেন? সর্দি, জ্বরে ভুগবেন।
এতক্ষণ ধরে প্রিয়তার অঙ্গভঙ্গি, কথা বলার ধরণ সবটাই পর্যবেক্ষণ করেছে পুলিশ ফোর্সের অন্যতম সদস্য সোহেল। প্রিয়তাকে ওর ভালো লাগতো প্রথম থেকেই। কখনো শত্রুপক্ষের লোক বলে মনে হয়নি। তবে প্রহর স্যারের কথামতো মেয়েটার খোঁজ খবর সবটাই বের করেছে সোহেল। মুচকি হেসে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ছেলেটা এগিয়ে এলো সামনে। বললো,
” পুলিশ বলে কি আমরা মানুষ নই প্রিয়তা? বিনোদন তো আমাদের ও দরকার নাকি?
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। সামনের মানুষটা যথেষ্ট সুন্দর এবং সাবলীল। প্রিয়তা প্রশ্ন করলো। বললো,
” আপনি আমার নাম জানেন?
” জানবো না? এক সময় আপনাকে ভিলেইন ভেবেছি। সমস্ত খবরাখবর কালেক্ট করেছি। আপনাকে না চিনলে হবে?
হাসল প্রিয়তা। বিষয়টা সত্যিই মজার। একটা সময় তার পিছনে অনেক পুলিশ লেগে ছিল। অথচ প্রিয়তা সেসব ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। মুচকি হেসে সে বললো,
” এখনো ভিলেইন মনে হয়?
বাঁকা হাসল সোহেল। ভ্রু চুলকে মাথার পিছনের অংশ চুলকে দিল মুচকি হেসে। প্রিয়তা চলে এলো সেখান থেকে। আরহাম আর বাকিদের জন্য চিকেন ফ্রাই, নুডলস, স্যান্ডুইচ আনা হয়েছে। আরহাম প্রিয়তার সাথে খেতে চাইলেও প্রহর আরহামকে কোনোমতেই ছাড়বে না বলে দিল। পুলিশ ফোর্সের সকলে প্রিয়তাকে অনুরোধ করেছিল তাদের সাথে থাকার জন্য। প্রিয়তা থাকেনি,চলে এসেছে। রাতে আবার মাঠে উপস্থিত থাকায় ওখানকার অনেকগুলো মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছে প্রিয়তার। সকলের সাথে আড্ডা হয়েছে কিছুক্ষণ। প্রিয়তার শান্তি শান্তি লাগছে আরহামকে এমন খুশি থাকতে দেখে। ভাইকে ফিরে পেয়ে জ্বর হুট করেই নেমে গেছে প্রিয়তার। একটু সুস্থ বোধ করছে।
__________
ভোরে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে প্রিয়তার। অদ্ভুত বলা যায় না তবে সেই স্বপ্ন মানানসই ও নয়। আরহামকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল প্রিয়তা। দুদিন পর ভাইকে পেয়ে খুশিতে রাতে কেঁদেও ছিল আরহামের আড়ালে। ভোরে প্রিয়তার চোখে ভেসে উঠেছে এক বেমানান কল্পনা। প্রিয়তা স্বপ্নে দেখেছে পুলিশম্যান তাকে বাহুডোরে আটকে রেখেছে। প্রিয়তার কানে ফিসফিস করে কিছু বলছে। ওই কথাটুকু প্রিয়তার মনে পড়ছে না। এই হয়েছে প্রিয়তার এক জ্বালা। স্বপ্নে দেখা ঘটনা গুলোর পুরোটা মনে রাখতে পারে না প্রিয়তা, ভুলে যায়। বারংবার মনে করার চেষ্টা করলেও মনে করতে পারছে না পুলিশম্যান তাকে কি বলেছিল। সব হাবিজাবি এবড়োথেবড়ো ভাবে মনে পরল। এ স্বপ্নের কথা যদি প্রহর জানে? লজ্জায় মরে যাবে প্রিয়তা। বিব্রত হবে প্রহর। বন্ধুত্বের সম্পর্ক কোনোভাবেই প্রণয়ে পরিণত হতে পারে না। হতে দিবে না তারা।
প্রিয়তা এখনকার টিউশন বিকেলে। টিউশনির জীবনে দেখতে দেখতে এস মাস পেরিয়ে গেল প্রিয়তার। কখনো কি ভেবেছিল বেঁচে থাকার জন্য টিউশনি করতে হবে? আরিফ হোসাইন সবসময় প্রিয়তাকে বলতো ” আমার ছেলে মেয়ে হীরের মতো যত্নে থাকবে। কোনো কাজ করতে হবে না ওদের। প্রয়োজন পরলে প্রিয়তার বিয়ের সময় মেয়ের সাথে কাজের লোক পাঠিয়ে দিবো আমি। আমার মেয়ের কি কম আছে”?
প্রিয়তা ফিক করে হেসে দিল। প্রিয়তার কি আছে এখন? কিচ্ছু নেই। একজন আগলে রাখার মানুষ অবধি নেই, নিজস্ব ছাদ নেই। উপযুক্ত কর্মের ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু তিনটে টিউশন। তা টিকবে কি না এ নিয়ে ভয়ে থাকে প্রিয়তা। কোচিংয়ের সবাই তার কথা বুঝতে পারে কি না, পড়া বুঝতে পারে কি না, এ নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকে প্রিয়তা। অনিশ্চিত এই জীবনে নিশ্চয়তার আশায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে।
আরহাম ঘুম থেকে উঠল সকাল নটায়। প্রিয়তার তখন শাক রান্না শেষ। ভাত বসিয়েছে মাত্র। আরহামকে উঠতে দেখে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে হাত-মুখ ধুইয়ে দিল ছেলেটার। শার্ট -প্যান্ট পড়িয়ে, চুল আঁচড়ে ছোট একটি বল সহ মাঠে পাঠিয়ে দিল। দু মিনিট পর দরজার খটখট আওয়াজে অবাক হলো প্রিয়তা। আরহাম বেরিয়েছে মাত্র। এখনই ফিরে আসার ছেলে তো সে নয়। কিছু হলো নাকি? চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজা খুললো প্রিয়তা। দরজার ওপাশে থাকা লোকটাকে দেখে ভীতিগ্রস্থ হলো সে। চোখ বড় বড় হয়ে এলো। জাফর আলী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জল মুখে। লোকটার কোলেই আরহাম। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে জাফর আলী হাসল। বললো,
” ঘরে ঢুকতে দিবে না? এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো? ভয় পেও না। আমি কিন্তু তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
প্রিয়তা ভড়কাল। দ্রুত আরহামকে টেনে নিজের কোলে নিল। আশপাশে তাকিয়ে লোক খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কপালে ভাঁজ পড়ল প্রিয়তার। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল হৃদয়। ঢোক গিলে জিভ দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিল। খানিক বড় বড় শ্বাস ফেলে রুদ্ধশ্বাসে বললো,
” আপনি? আপনি এখানে কেন?
” সব কথা এখানেই বলবো? ঘরে ঢুকতে দাও।
” এখানেই বলুন। আমি কিন্তু মানুষ ডাকবো।
” আশ্চর্য মিস প্রিয়তা, তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন? লোক ডাকলে তোমার-ই ক্ষতি। আমার পায়ে কিন্তু গান আছে। যেকোনো মুহুর্তে তোমার ভাইকে শ্যুট করে দিতে পারি। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করো।
প্রিয়তা আঁকড়ে ধরলো আরহামকে। ভয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপল প্রিয়তার। ভাইকে হারানোর ভয় ফুটে উঠল চোখে মুখে। বারংবার শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। বললো,
” আমরা আপনার কি ক্ষতি করেছি?
” ক্ষতি করোনি বলেই এখনো বেঁচে আছো। ক্ষতি করলে কি বেঁচে থাকতে? আমি তোমাদের ক্ষতি করতে আসিনি। সো কুল।
প্রিয়তা ঘামতে লাগল। দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। শার্টের উপরের কোর্ট ঠিকঠাক করে হাসিমুখে ঘরে ঢুকল। ঘরটার আশপাশে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। আরহামকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। জাফর বললো,
” তোমার একটা সাহায্য দরকার আমার। যত টাকা চাইবে আমি দিতে পারবো।
” কি সাহায্য? কি বলছেন?
” পুলিশ অফিসার আজওয়াদ ইশতিয়াকের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? সত্যি করে বলবে। আমি যদি বুঝতে পারি তুমি মিথ্যে বলছো দ্যান ইউর ব্রাদার উইল বি ফিনিশ।
” উনি আমার বন্ধু। দ্যাটস ইট। এছাড়া আমাদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন।
” আসল কথায় আসি। ওই পুলিশ অফিসারের মান সম্মান একদম ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে। প্রেমের ফাঁদে ফেলতে হবে। এরপর অপবাদ দিয়ে পুলিশের পদবি কেড়ে নিতে হবে। ব্যস এটুকুই কাজ।
অবাক হলো প্রিয়তা। ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠল। ভয়ে থিতিয়ে গেল প্রিয়তা। এমন নোংরা কাজ করার কথা তো কল্পনায় ও ভাবতে পারে না প্রিয়তা। পুলিশম্যান অনেক ভাবে সাহায্য করেছে তাকে। সাহায্যের মর্যাদা এভাবে দিবে সে?
প্রিয়তা ভাইয়ের দিকে তাকাল। আরহাম ভয় পেয়েছে ভিষণ। বারংবার চোখের ঘন পাপড়ি এক করছে ছেলেটা। প্রিয়তা কি করবে ভেবে পেল না। এই মুহুর্তে জান বাঁচাতে হবে এটুকু মাথায় সেট করে নিল। বললো,
” উনার সাথে এমনটা করতে চাইছেন কেন? আর সেদিন আব্বুর বন্ধু সেজে আমার সাথে দেখা করলেন কেন? কথা বললেন কেন?
” আমার টার্গেট যে তুমি ছিলে। কথা বলে বুঝতে হবে না তোমার দ্বারা কাজটা হবে কি না?
” প্রহর স্যার ভেবেছিল আমি আপনার সাথে কোনোভাবে যুক্ত। যদিও সেই ভুল উনার ভেঙেছে। আপনার জন্য প্রথমে আমাকে অপরাধী ভাবা হয়েছিল।
” ওই পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করতে না পারলে আমার নাম জাফর না। আমার পেছনে লেগেছে না? ওর কোনো ধারণা আছে আমার সম্পর্কে? যেকোনো মুহুর্তে আমার লোক ওকে মেরে গুম করে দিতে পারে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। জনগন জানে প্রহরের আমার প্রতি রাগ আছে। আমার সব অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে ওই পুলিশ। ও মরলে সন্দেহ আমার দিকে আসবে। সব কটা পুলিশ ওর আন্ডারে রয়েছে। আঙ্গুল আমার দিকে দেবে সবাই। সব পুলিশকে মারা সম্ভব নাকি?
প্রিয়তা চুপ করে রইল। চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরল। বিষাদে ছেয়ে গেল হৃদয়। কণ্ঠ আটকে আসল। জড়তা ভর করলো কণ্ঠে। জাফর পুনরায় বললো,
” তুমি যদি কাজ টা না করো তোমার ভাই আর তোমাকে শেষ করতে দু সেকেন্ড সময় ও লাগবে না আমার। আর এই কথা ওই পুলিশের কানে গেলেও কিন্তু তোমার ভাই শেষ। ভাইকে ভালোবাসো তো? আহ্ কি মিষ্টি বাচ্চা।
প্রিয়তা ভয় পেল। মোলায়েম হাত দ্বারা আরহামকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জরে ঠেসে ধরলো আরহামকে। বললো,
” আমার ভাইয়ের কিছু করবেন না প্লিজ। ও নিষ্পাপ একটা ছেলে।
” তাহলে আমার কথা মেনে নাও।
প্রিয়তা মাথা নত করলো। এইভাবে এই কেসে সে ফেঁসে যাবে কখনো ভাবেনি সে। এত সহজ সরল একটা জীবনে এত জটিলতা কেন সৃষ্টি হলো? কেন এত ফাঁদে পড়তে হলো তাদের? প্রিয়তা তো এসব চায়নি। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছে সে। কোনরুপ ঝামেলায় কখনো জড়াতে চায়নি। কিন্তু এ বাড়িতে আসার পর একেক সময় একেক ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছে সে। এসব থেকে বের হবার উপায় কি? কি করলে মুক্তি মিলবে?
__________________
ডেস্কের তিন পাশের তিনটি চেয়ারে বসে আছে ইহান, প্রহর আর তানিয়া। তিনজনের পরণে ব্লু রঙের পুলিশের পোশাক। গোল্ডেন নেইমপ্লেটে মাঝারি অক্ষরে সকলের নাম লেখা। ডেস্কের মাঝে রয়েছে গোটাকয়েক ফাইল,কলমের ঝুড়ি, ক্যাপ আর কফির খালি কাপ। ফাইল ঘাটতে ঘাটতে ইহান প্রহরের উদ্দেশ্যে বললো,
” নিয়াজ আঙ্কেলের বিয়েতে যাবি না প্রহর? ছুটি নিতে হবে একসাথে। স্যার কি দিবে ছুটি?
” আঙ্কেলের বিয়ে কনফার্ম? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো প্রহর। তাকাল তানিয়ার দিকে।
তানিয়া ঠোঁট চেপে হাসল। বললো,
” মনে তো হচ্ছে তাই। গতকাল বাবার সাথে আন্টির দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। বাবাকে দেখে মনে হয়নি আন্টি নাকচ করেছেন।
” ছুটি নিলে একসাথেই নিতে হবে। তানিয়ার বাবার বিয়ে বলে কথা। বলে উঠল প্রহর।
ইহান বলে উঠলো,
” ছুটি তো আরো একবার নিতে হবে। সামনেই তো আবার তানিয়ার বিয়ে।
মুখ কুঁচকে ফেলল তানিয়া। বললো,
” এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে স্যার। বাবার বিয়ে ভাবছি শুধু। এটা নিয়ে আমি সত্যিই খুব এক্সাইটেড।
তিনজন গল্প করলো একটু। একজন এসিসট্যান্ট এসে সালাম জানাল তিনজনকে। বিনীত ভঙ্গিতে বললো,
” একজন বয়স্ক লোক এসেছে থানায়। আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। আসতে বলবো?
তানিয়া বললো,
” আসতে দাও এখানে।
এসিসট্যান্ট চলে গেল সালাম গিয়ে। তিনজন অপেক্ষায় রইল লোকটার জন্য। দু মিনিট বাদে একজন বয়স্ক লোক কেবিনে এলো। সালাম জানাল স্বাভাবিক ভাবেই। ইহান নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বসতে দিল লোকটাকে। প্রহর মার্জিত ভঙ্গিতে বললো,
” আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।
লোকটার চোখ চিকচিক করে উঠল। বললো,
” স্যার আমার পোলা হারাই গেছে। জিডি করতে আইছি স্যার।
ইহান জিজ্ঞেস করলো,
“কবে হারিয়ে গেছে?
” দুইদিন হইছে স্যার।
তানিয়া ভ্রু কুঁচকাল। চশমা ঠেলে বললো,
“ছেলে হারিয়েছে দুদিন। আপনি আজকে পুলিশের কাছে এসেছেন?
” কি করমু স্যার কন? পুলিশের কাছে আইলেই ট্যাকা দরকার। এদিক ওইদিক ছোটাছুটি করতে হয়। আমি আগে সবজায়গায় খুঁজছি পোলারে। তারপর আপনাগো কাছে আইছি।
প্রহর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” জিডি করতে টাকা লাগে না। আপনি আপনার ছেলের সমস্ত ডিটেইলস বলে যান। আমরা আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো কথা দিচ্ছি।
লোকটা তার ছেলের সমস্ত তথ্য দিল। তা দ্রুত খাতায় তুলে নিল তানিয়া। ছেলেটার নাম সাকিব। বয়স এগারো। স্কুল থেকে আর বাসায় ফিরেনি ছেলেটি। ছেলেটির বাবা-মা দুদিন ধরে খুঁজেছে ছেলেটাকে। নতুন কেস পেয়ে ভালো লাগলেও ঝামেলা ঝামেলা লাগল। না জানি কেসটাতে কত পরিশ্রম দিতে হবে,কত সময় লাগবে কে জানে?
________________
জামাকাপড় তুলতে গিয়ে প্রহরের সাথে দেখা হলো প্রিয়তার। মনে পরে গেল জাফর আলীর সব কথা। প্রিয়তা কথা বলতে চাইল না প্রহরের সাথে। দ্বিধায় পুড়ছে সে। কোনদিকে যাবে ভেবে পাচ্ছে না। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। নির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না প্রিয়তা। এ যে ভিষণ যন্ত্রণার।
প্রিয়তাকে আলাপ শুরু করতে হলো না। প্রহর নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছেন প্রিয়তা।
” এইতো চলছে। আপনি কেমন আছেন?
” ভালো আছি। আজ নতুন কেস এসেছে থানায়। ওটা নিয়েই একটু চিন্তায় আছি।
” আপনারা তিনজন মিলে অবশ্যই কেসটা সলভড করতে পারবেন।
” আমার ও তাই বিশ্বাস। আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
” হ্যাঁ করুন না।
” আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানি এরা কোথায়? তাদের কাছে যান নি কেন আপনারা?
প্রিয়তা হাসল। মনটা বিষিয়ে উঠল নিমিষে। সামনে থাকা মানুষটা প্রিয়তাকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। আর এই লোকটার জীবনেই বিপদ আনতে যাচ্ছে প্রিয়তা। কি বিশ্রী ব্যাপারস্যাপার। মলিন মুখে প্রিয়তা বললো,
” আমার দাদা-দাদি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ঊনিশশো একাত্তরের যুদ্ধতে উনারা মারা গিয়েছেন। আব্বু তখন খুবই ছোট ছিল। আব্বু মানুষ হয়েছে আব্বুর চাচার কাছে। আব্বু যখন চাকরিতে জয়েন করে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তখন আব্বুর সেই চাচা ইউ এস এ চলে যান। উনার সাথে আব্বুর যোগাযোগ হয় ফোন কলে। আর আম্মুর বাবা-মা অর্থাৎ আমার নানা-নানি থাকেন গ্রামে। আমার মামা একজন অসৎ মানুষ। প্রচন্ড লোভী লোকটা। আমার নানা-নানির সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে মামা। আমার নানা নানি নিজেরাই মামার অধীনে বাঁচেন। মামা-মামী খেতে দিলে খায় না দিলে নাই এমন। আম্মু মাস শেষে কিছু টাকা পাঠাতো নানুকে। আগে এখানে এনেও রাখতো মাসের পর মাস। কিন্তু আম্মুর পরকিয়ার কথা জানতে পেরে নানা-নানু আম্মুর মুখ দেখেন তিন বছর ধরে। আম্মুও অত দায় নেয় না এখন। মাস শেষে খুবই কম টাকা পাঠায় নানুকে। সেই টাকা দিয়ে গরু পালে নানু। নানার ঔষধপত্র কিনেন। নানুর কাছে গিয়ে আমি আর তাদের দায়িত্ব বাড়াতে চাই না। মামা ও এটা পছন্দ করবে না। তাই এখানেই আছি। সত্যি বলতে আমাদের আপন বলতে কেউ নেই যার কাছে আমরা আশ্রয় খুঁজতে পারি। সবশেষে বলতে চাই এখানেই ভালো আছি। কারো নিয়ন্ত্রণে চলতে হচ্ছে না। কেউ আমাদের দেখে মুখ কালো করছে না।
” ওওও সো স্যাড।
” জি।
” আরহাম কোথায়?
‘ রেডি হচ্ছে।
” কোথাও যাচ্ছেন?
” হ্যাঁ শিশু পার্কে যাচ্ছি। আরহামের প্রিয় জায়গা। যাবেন আপনি?
” আপনারা যান আজ। আমি অন্যদিন যাবো। আমাকে একটু বের হতে হবে। টহল দিতে হবে।
প্রিয়তা নিচে নামল। বুক ভার হলো তার। প্রহরের সামনে বড় বিপদ। কিভাবে প্রিয়তা দুইদিক সামলাবে?
________________
চলবে?