বিয়ে পর্ব ৪২

0
183

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৪২

কতদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো কে জানে! হিসেব রাখেনি কখনো। শুধুমাত্র এই অদ্ভুত, চাপা স্বভাবের জেদি মেয়েটাকে খুব করে চেয়ে গেছে প্রতিটি দিন একটু একটু করে। অদ্রি ধ্রুবকে চুপ থাকতে দেখে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই দূরে সরে গিয়ে জিজ্ঞেস
করল,
— আপনি আমাকে বাবার সাথে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন? আমাকে কেন জানান নি?

ধ্রুব মনে মনে ভাবছিলো অদ্রি ওকে এই প্রশ্ন করবে। একটু অভিমানী, জেদী কিনা! ও মনে মনে দুঃখ পেলো। যেই না অদ্রি ওকে একটু ভালোবাসি বলেছে তখনই ওর ত্যাড়া সত্তাটা ফিরে এসেছে। এর কোনো প্রয়োজন ছিলো? ওকে যে আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে কে জানে! একসময় দু-মিনিট লেইট করে খাবার পেলে সারা বাড়ি মাথায় করতো যে ছেলে, সে এখন বউয়ের ভালোবাসা পেতে তার প্রতিনিয়ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েই চলেছে, যেন এর কোনো শেষ নেই! এদিকে অদ্রি ওর মুখপানে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চোখেমুখ শক্ত করে বলল,
— তোমার বাবা চেয়েছে তাই। বাবা-মেয়ের মধ্যে আমি বাঁধা দেওয়ার কে?
অদ্রি নির্নিমেষ চেয়ে থাকে ধ্রুব’র মুখপানে। বলে,
— আপনি জানেন না আমি এখন বাবার সাথে নেই?
কথা বলি না? সবটাই তো জানেন, এরপরেও…
ধ্রুব নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— আমি ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে যাইনি। আঙ্কেল মা’কে ফোন করে খুব জোর করেছেন তোমার সাথে কথা বলার জন্য। মা তো আর মুখের ওপর না বলতে পারেন না, তুমি না মানলেও বাবা হোন ওনি তোমার। আমিও বাধ্য ছেলে, স্বামীর মতো নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। নয়তো পরে হয়তো তুমিই এসব নিয়ে আমায় খোঁটা দিতে…
অদ্রির আরকিছুই বলার নেই। ধ্রুবকে সে কেন জিজ্ঞাসা করছে? ওর তো কোনো দোষ নেই!
অদ্রি পাশ ফিরে কম্বলে মুখ ঢেকে শুলো চুপচাপ। বুকের ভেতর কষ্টের দলা পাকিয়ে আসছে, কান্না গলায় আটকে আছে। যেকোনো সময় হয়তো গড়িয়ে পড়বে অশ্রুবিন্দু। কতদিন পরে বাবাকে দেখেছে সে! যেন বহুযুগ! চুলে পাক ধরেছে কি? খেয়াল করেনি তো ও! অদ্রির মনে পড়তে থাকে অতীতের স্মৃতি, তাদের হাসিখুশি দিনযাপন। যেখানে অদ্রি আর দশটা সবার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই হাসিখুশি দিনগুলো করুণ, চাপা কান্নায় কাটতে লাগলো ওর। নিজের জন্মদাতাকে “বাবা” বলে ডাকতে না পারার যন্ত্রণা ওকে তীব্র কষ্ট দেয়। একটা সময় একটু একটু করে দূরে সরে যাওয়া বাবাকে দেখলে সে অবাক হতো। এই কি সেই বাবা, যে মেয়ের অভিমান ভাঙাতো? রাতে ঘুমন্ত অদ্রির কপালে চুমু না খেলে হাসফাস করতো? বাইরে বেরুলে শক্ত করে হাত ধরে রাখতো। খারাপ সময়ে ভরসা দিতো? অদ্রি যেন জীবন্মৃত হয়ে গিয়েছিলো তখন। এর মধ্যে বাবার নতুন সংসার, নিজের মায়ের জায়গা দখল করা মহিলার ব্যবহার, বাবা প্রতিবাদ না করে সাথী বেগমের অনুসারে চলা, এসব দেখলে মনে হতো পৃথিবীতে সবকিছু অভিনয়, ভালোবাসা, বিশ্বাস সব নিছকই মেকি। এসবের অস্তিত্বই নেই।
মা মারা যাওয়ার পর বাবা কোনোদিন ওর মনের খবর রাখেনি৷ অদ্ভুত ভাবে অদ্রি তখন কারোর জন্য পিছুটান অনুভব করতো না। কিন্তু এখন করে, ধ্রুব’র জন্য! একান্তই তার নিজের মানুষটির জন্য! অদ্রি মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় তাকালো ধ্রুব’র দিকে,
— সরি।
ধ্রুব শুনে নড়েচড়ে বসলো। কুঁচকে থাকা কপালের চামড়া সোজা হলো। এরপর নির্বিকার ভঙ্গিতে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— খাবে চ….
অদ্রি ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ভার গলায়
বলল,
— খেতে ইচ্ছে করছে না।
ধ্রুব গম্ভীরমুখে বলে,
— কি খাবে সেটাই বলো। অজুহাত শুনতে চাইনি।
অদ্রি ম্লান গলায় বলল,
— আপনাকে!
ধ্রুব কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এরকম উত্তর সে আশা করেনি। বিবশ চোখে চাইলো সে অদ্রির আদর লেপ্টে থাকা মুখপানে। জানে সে, কথার পরিপ্রেক্ষিতে অদ্রি এমন বলেছে। কিন্তু প্রেমিক মন তো সবসময় ভালোবাসা খুঁজেই বেড়ায়। বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা তৃষ্ণার্ত সত্তাটা আচমকাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। ধ্রুব’র গলা শুকিয়ে আসে, ঘেমে ওঠে কপাল। চোখজোড়া জ্বলতে থাকে। কথা না বাড়িয়ে একটানে চাদর টেনে দূরত্ব বজায় রেখে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। অদ্রি বোকার মতো দেখলো ধ্রুবকে। এমন অদ্ভুত আচরণ করার মানে খুঁজে পেলো না। ও ওঠে বিছানায় বসলো। এরপর একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ধ্রুব’কে লক্ষ্য করে আবারও আদুরে বেড়ালের মতো ওর কাছে ঘেঁষলো। এদিকে চাদরের নিচে ধ্রুব শক্ত বরফের মতো জমে যাচ্ছিলো। ঝড় বয়ে চলা অনুভূতিতে বিক্ষত হতে শুরু করে ওর হৃদয়। অদ্রি বিরস গলায় জিজ্ঞেস করে,
— কি হলো আপনার? রাগ করেছেন? আমার সত্যিই ক্ষিধে নেই!
ধ্রুব উত্তর দেয় না। অদ্রি বিহ্বল হয়। সত্যিই রাগ করলো নাকি খেতে না চাওয়ায়? অদ্ভুত! ও ঠেলতে থাকে ধ্রুব’র পিঠ, না কোনো সাড়া দিচ্ছে না। খানিকটা বিরক্ত হয়েই অদ্রি এবার চাদর ধরে টানতে থাকে। ধ্রুবও টেনে ধরতেই অসাবধানতা বশত অদ্রি এসে পড়ে ওর ওপর। দু’জনেই থমকায়। ধ্রুব ওর চোখের গভীরে নিজেকে খুঁজে। অদ্রির গা থেকে ভেসে আসা সুবাসে বিমোহিত ধ্রুব’র চোখ আচমকা অঅনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে লেডিস শার্টের বোতাম ছাড়িয়ে চলে যায় গভীরে। নিঁখুত, সুন্দর, বিমোহিত এক দৃশ্য! আচমকা ওর হুঁশ ফেরে অদ্রির চুল মুখে পড়ায়। ও তৎক্ষনাৎ অদ্রিকে ছেড়ে দিয়ে প্রচন্ড জোরে ধমকে ওঠলো,
— দূরে যাও…
অদ্রি অবাক। চোখ ছলছল করতে থাকে। কিন্তু সামলালো নিজেকে। গ্রামের বাড়িতে ধ্রুব’র এমন আচরণ শেষবার লক্ষ্য করেছিলো। রাগ হলো ভীষণ। তবুও উৎকন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
— কি করেছি আমি? আপনি এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করছেন?
ধ্রুব ওঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। হৃদযন্ত্রটা এবার বুঝি বেরিয়েই এলো। ও উল্টো ঘুরএ অধৈর্য্য গলায় বলে,
— কিছু করো নি।
অদ্রির জেদ,
— আমার দিকে তাকান, মুখ ঘুরিয়ে কথা বলার মানে কি?
— কোনো মানে নেই।
অদ্রি মানতে নারাজ,
— উহু! আমি বোধহয় টের পাচ্ছি….
ধ্রুব’র চোখমুখ রক্তিম হয়ে এলো। নাহ, এভাবে হচ্ছে না। অনুভূতিগুলো ওর সাথে বেইমানি করছে। ও হার মানবে না, ভুল করবে না আর। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। অদ্রির অনুমতি ছাড়া ওকে ছোঁবে না। সেটা ভেবেই ওঠে বিছানার কিনারে বসলো ধ্রুব। কিন্তু অনিচ্ছায় অদ্রির চোখে চোখ পড়তেই কিছু সময় আগে ঘটে যাওয়া মুহূর্তটি ভেসে ওঠে। নড়বড়ে অনুভূতি আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতেই ধ্রুব কড়া গলায় বলে,
— এতো জ্বালাচ্ছো কেন আমায়? জ্বালিয়ে,পুড়িয়ে শেষ করতে পারলেই বুঝি শান্তি?
কথাটা নিজেকে বললো নাকি অদ্রিকে বোঝা গেলো না। কিন্তু এমন কিছু শুনে অদ্রির মনে জেঁকে বসলো অভিমান। ধীরপায়ে বিছানা থেকে নেমে চুপচাপ গিয়ে মেঝেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো। ভাবলো ও তো রাগারাগি করেনি বা এমন কিছুই করেনি। তাহলে কিসের জন্য ধ্রুব এমন করছে? শুধু খাবে না বলায়? ধ্রুব কি বুঝতে পারে না ওর কষ্ট হয় এভাবে কথা বললে? আজকাল কেন যে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে অদ্রি জানে না। ভালোবাসা মানেই অন্যের প্রতি নির্ভরতা। এতদিন তো ভালোই ছিলো সে, কারো জন্য এমন মন খারাপ হয়নি, কষ্ট পায়নি! অবাধ্য মনটা কিভাবে আর কখন যে ধ্রুবকে ভালোবেসে ফেললো টেরই পেলো না অদ্রি। আজ নিজে থেকেই প্রকাশ করেছে সে ধ্রুব’র কাছে। তার পরেও এরকম ব্যবহার ও প্রত্যাশা করেনি।
ধ্রুব হতাশ চোখে দেখে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। নিজেও বালিশ নিয়ে অদ্রির পাশে শুয়ে পড়তেই অদ্রি বলে,
— আমি আপনাকে কষ্টই দিই তাইনা?
ধ্রুব মলিন গলায় বলে,
— একদম না।
— তাহলে এখানে এসেছেন কেন?
— বিছানায় একা শোয়ার অভ্যাস হারিয়ে গেছে।
— তাই?
ধ্রুব মাথা নাড়ে,
— হ্যাঁ।
অদ্রি এবার রাগ ভুলে কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা, আন্টির থেকে শুনলাম বাবা আমাকে নিজের সাথে এবোর্ডে নিয়ে যেতে চান? আমি যদি চলে যাই তখন কিভাবে থাকবেন?
ধ্রুব’র চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শ্বশুর মশাই মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? আজ সুযোগ হয়নি, কিন্তু পরবর্তীতে যদি এ নিয়ে কোনো কথা তুলে তাহলে ধ্রুব তাকে ছাড়বে না। এতকষ্ট করে বউয়ের মনে জায়গা করেছে সে, শ্বশুরকে সে ভাগ নিতে দেবে না। মেয়ে বলে যখনতখন অধিকার দেখাতে এলে ধ্রুবও কথা শুনিয়ে দেবে। ও মোটেও কাপুরুষ নয়! বালিশ থেকে মাথা তুলে কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চেয়ে থেকে রাগী গলায় অদ্রিকে বলে,
— যেতে দিচ্ছে কে?
অদ্রি বলে,
— আহা, যদি চলে যাই। আপনি তো আটকাতে পারবেন না আমায়!
ধ্রুব রাগে ফেটে পড়ে। হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে,
— শুনো, যদিটদি বলে কিছু নেই। সেজন্য এসব যাওয়ার প্রশ্ন তো বহুদূর। বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে হলে আমাকে বলবে, আমার সাথে যাবে।
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলে,
— যদি বাবার সাথেই যাই?
ধ্রুব রেগে গেল,
— তেমন হলে তোমার বাবাসহ তোমাকে বাড়িতে বন্দী করে রাখবো।
অদ্রি হাসি আটকে বলল,
— কেন?
ধ্রুব থমথমে, গম্ভীর গলায় বলল,
— কারণ তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ।
কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যায়। দু’জনেই চুপচাপ। একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদ্রি বলে,
— আপনি আমার অক্সিজেন!

ধ্রুব কেমন করে যেন দেখলো ওকে!

.

.

[লিখতে লিখতে সময় খেয়াল ছিলো না। বড় পর্ব ছিলো, কিন্তু একেবারে পোস্ট করলে অনেকেই পড়তে পারবেন না। সেজন্য এতটুকু। যাইহোক, গত পর্বের কিছু অংশ চেঞ্জ করেছি। চাইলে চেক দিতে পারেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ও ধরিয়ে দিবেন। দুঃখিত।]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here