#প্রেম_পুকুর
[৯]
লেখনীতে মারিয়া মুনতারিন
একটি সুন্দর সন্ধ্যা শিমু বেলকোনিতে দাড়িয়ে আছে।সাফোয়ান আজকে বাসায়ই আছে। সাফোয়ান ড্রয়িংরুমে থাকায় শিমু রুম থেকে বের হচ্ছেনা।
সাফোয়ানের সামনে গেলে নিজের মধ্যে এক রকম জড়তা অনুভুত হয় ওর কেন এই জড়তা সেটা শিমু জানেনা।
সাফোয়ানের চোখে গভীর প্রণয় দেখলে মনে হয় সব কিছু ভুলে যেতে। কিন্তু তার যুবতী মন সাফোয়ানের জন্য তিব্র অভিমান পুষে রেখেছে।তার ইচ্ছে করে সাফোয়ানের বুকে মাথা রেখে সেই সব রাতের কথা জানাতে যেই রাত গুলোতে সে নির্ঘুম কাটিয়েছে।
জানাতে ইচ্ছে হয় মানুষের কথার দ্বারা কত অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে।
কিন্তু অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের হওয়ার জন্য ও এগুলো কিছুই বলতে পারেনা।
অতিরিক্ত অভিমানে দু’চোখ ভেঙে জল পরতে শুরু করলো ।
একপর্যায় মেঝেতে পা ভেঙে বসে পরল শিমু।
_________
সাফোয়ান আজকে পরিপূর্ণ ভাবে নিজেকে ধাতস্তু করে নিয়েছে।
শিমু তার কাছে এসেছে গোটা একমাস হয়ে গেল কিন্তু তাদের সম্পর্কের বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি।
সে নিজের দিক থেকে সম্পূর্ন চেষ্টা করছে কিন্তু শিমু এখনো নির্বিকার।
সে আর শিমুর অবহেলা সইতে পারছেনা। অনেক তো হলো অনুভুতির লুকোচুরি আর সে কোন লুকোচুরি খেলতে চায়না।
সে চায় এবার নিজের প্রেয়সী কে আপন করে পেতে ।
নিজের সাথে বোঝাপড়া করে সাফোয়ান সোঝা শিমুর ঘরের দিকে চলে যায়।
কিন্তু গিয়ে দেখলো শিমু রুমে নেই।
বেলকোনির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই এক কান্নারতা রমণীর দিকে দৃষ্টি আটকে গেল।যে রমণী হাটুতে মুখ গুঁজে গুন গুনিয়ে কান্না করছে। যার দীর্ঘ কালো কেশ পিঠ জুড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
সাফোয়ান হাটু ভেঙে শিমুর কাছ ঘেষে বসল।
এই রমণী কান্না করাতে এতোটাই বিভোর যে তার সামনে যে কেউ বসে আছে সে সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই।
সাফোয়ানের ভীষণ ইচ্ছো করল রমণীকে নিজের বুকে আগলে নিতে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,ওগো রমণী তোমার এত দুঃখ কিসের।
ওর মধ্য হঠাত কোথা থেকে যেন একরাশ অধিকার বোধ তৈরি হলো।হাত বাড়িয়ে আগলে নিলো নিজের প্রেয়সীকে।
শিমু পুরুষালী হাতের ছোঁয়া পেয়ে একটু ভড়কালো থমকালো স্তব্ধ হয়ে গেল।
নিজের লুকোনো কান্না কারো সামনে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সাফোয়ানের বুক থেকে মাথা তুলতে চাইলো।
কিন্তু সাফোয়ান তুলতে দিলোনা জোড় করেই মাথা নিজের বুকে চেপে রাখল।
শিমু স্পষ্ট শুনতে পেল সাফোয়ানে বুকের অস্বাভাবিক ধুকপুকানি।
দীর্ঘ সময় কেটে গেল নিরাবতার মধ্য।
নিরাবতা ভেঙে সাফোয়ান বলে উঠল,”শিমু আমরা কি পারিনা আমাদের মাঝের এই যোজন যোজন দুরত্বের ইতি টানতে।আমরা কি পারিনা আমাদের একটা সুখের সংসার সাজাতে।”
শিমুর কাছে সাফোয়ানের কণ্ঠ ভীষণ কাতর শোনালো, কি সহজ আবদার।
ইতিমধ্যে সাফোয়ানের হাতের বাধন আলগা হয়ে গেছে।
শিমু সাফোয়ানের বুক থেকে মাথা তুলে সাফোয়ানের চোখের দিকে তাকায়।
সাফোয়ান লক্ষ করল শিমুর চোখ অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে। কান্না করার ফলে নাকের ডগাও ফুলে লাল হয়ে গেছে।
শিমুর অভিমানে পরিপূর্ণ অক্ষিকোটরে জল থৈ থৈ করছে।
সাফোয়ান শিমুর নিরাবতা দেখে আবার প্রশ্ন করল।
” বলুননা আমরা পারিনা অতীত ভুলে গিয়ে আবার সবটা নতুন করে সাজাতে”।
হঠাতই অভিমানী মেয়েটা একরাশ অভীমান নিয়ে বলতে শুরু করল,”কোনটাকে ভুলে যেতে বলছেন সাফোয়ান আপনি?
বাসর রাতে স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়াকে নাকি প্রতিনিয়ত আমার অপমানিত হওয়াকে।
নাকি নিজের সম্মান বিকিয়ে দিয়ে একটা মেয়ের শশুর বাড়িতে পড়ে থাকাকে।
নাকি দিনের পর দিন আপনার দাদীর কটু কথাকে শোনাকে।
আপনার যখন এতটাই আমাকে অপছন্দ তবে কেন বিয়ে করেছিলেন আমায়?
প্রতিনিয়ত আপনার আত্মীয়রা প্রতিবেশিরা আমাকে ঠাট্টাতামাসা করতো। আম্মা আড়াল করতো কিন্তু আমি টের পেয়েই যেতাম।”
শিমু কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে শুরু করল।
“আপনি কি কখোনো চিন্তা করেছেন বিয়ের রাতে একটা মেয়ে কতোটা আশা সপ্ন বুকের মাঝে পুষে রাখে।
কিন্তু সেদিন, সেদিন আপনি এলেননা। আমি পুরো রাত আপনার জন্য বসে ছিলাম।
সকাল বেলা আপনার দাদী এসে বলল আমি নাকি অপ*য়া কল*ঙ্কিনী তাই তার নাতি আমাকে ফেলে চলে গেছে।
আপনান দাদী প্রতিনিয়ত আপনার চলে যাওয়ার জন্য আমাকে দ্বায়ী করতো।বিয়ের পড়ে বাবা কত বার আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু আমি বাবাকে মিথ্যে বলেছি।নিজের কষ্টগুলোকে আড়াল করে আমি বাবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেছি।”
শিমু এবার অসহায়ের মতো সাফোয়ানে দিকে তাকিয়ে বলল,”আচ্ছা আমি কি এতটাই অপ*য়া।
আমি যেটাই ধরতে যাই সেটাই কেন দুঃখ হয়ে যায় বলতে পারেন।
আমিও তো আপনার জন্য এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলাম।
কিন্তু আপনার প্রত্যাখ্যান পেয়ে সেগুলো কেমন ফিকে হয়ে গেছে।
আমি ও চাই সব ঠিক করে নিতে। কিন্তু আমার ভয় হয় যদি আপনি আবারো আমাকে ছেড়ে চলে যান।
আমি জানি আমি কোন অবুঝ কিশোরী নই কিন্তু আপনাকে আঁকড়ে বাচঁতে চাই আমি আপনাকে ভালোবেসে বৃদ্ধ হতে চাই।
কিন্তু পুরোনে কথাগুলো মনে পড়লে আমার বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠে।
মনের মাঝে তিব্র অশান্তি হয়।
আমি এই সব কিছুর থেকে নিস্তার পেতে চাই সাফোয়ান।
আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই।”
মোম যেমন আগুনের স্পর্শ পেয়ে গলে যায় শিমু তেমন সাফোয়ানের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নিজের বুকের মাঝে রাখা সকল কষ্ঠ প্রকাশ করে দিচ্ছে।
আজ নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে শিমুর।নিজের সব অভিযোগ প্রকাশ করতে পেরে মনে শান্তি লাগছে ওর। খুব কাদঁতে ইচ্ছে করছে।
সাফোয়ান শিমুকে আবার বুকের মাঝে আগলে নিলো।
শিমু আবারে কাদঁতে শুরু করল।এই কান্না যেন দীর্ঘ কালের অভিমানের পাহাড় ধসে পড়ার কান্না।
সাফোয়ান শিমুর সমস্ত অভিযোগ মন দিয়ে শুনছে।নিজের করা ভুলের জন্য সে সত্যি ভীষণ অনুতপ্ত। নিজের রাগ জেদ কে প্রাধান্য না দিলে হয়তে আজকে মেয়েটার এই পাহাড় সমান অভীমান দেখতে হতো না।
তাদের ভালোবাসাময় একটা সংসার হতো এতদিন।
সাফোয়ান শিমুর মাথা তুলে নিজের দিকে ঘোরালে।শিমু কাদঁতে কাদঁতে অবস্তা খারাপ করে ফেলেছে নিজের।
সাফোয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,”আমি আপনার সাথে অনেক অনেক অন্যায় করেছি আমি জানি। আমি সেগুলোকে শুধরে নিতে চাই। আমার এই ভুল গুলো শুধরে নেবার জন্য আমি আপনার থেকে একটা সুযোগ চাই দয়া করে আমাকে ফেরাবেননা।”
সাফোয়ান আবার কাতর স্বরে বলল,”আমি গ্রামে বিয়ে করার জন্য মোটেই রাজি ছিলাম না।
কিন্তু মায়ের কথায় এক প্রকার বাধ্য হই মায়ের কথা রাখতে। মা আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে থাকে। আবার আমার বন্ধুরাও আমাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাসা করতে শুরু করে।
এদিকে মা বাবার চাপ অন্য দিকে বন্ধুদের ঠাট্টা সব মিলিয়ে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। মায়ের কথা রাখতে আপনাকে বিয়ে করলাম ঠিকই কিন্তু আপনাকে মেনে নিতে আমার ভীষণ কষ্ঠ হচ্ছিল। আপনি জানলে অবাক হবেন আমি আপনাকে বিয়ের আগে একবারের জন্য দেখিওনি।
কবুল বলার পড়েই আমি বিয়ের আসর ছেড়ে চলে এসেছিলাম।আপনার বাবা আমাকে আটকাতে গেলে আমি তাকে বলেছিলাম আমার জরুরী কাজ পড়ে গেছে।
আপনার বাবা সেটা বিশ্বাসও করে নিয়েছিলো হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিলেন আমাকে ।মা ওই দিকটা সামলে নিয়েছিলো সেদিন তাই কোন ঝামেলা হয়নি।
নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম মা আমাকে জোড় করে বিয়ে করিয়েছি কিন্তু আমি চাইলে সংসার নাও করতে পারি।
নিজের জেদ কে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলাম।ঢাকায় এসেই মাকে বলেছিলাম আমি আপনার সাথে সংসার করতে চাইনা।
সেই দিনের পর থেকে টানা দুই মাস আমার সাথে মায়ের কোন যোগাযোগ ছিলনা।এর মাঝেই আয়ান এলো আমার বাসায় হুট করে। ওকে দেখে আমি অবাকই হই। ও আমাকে আমার ভুল গুলো সম্পর্কে অবগত করে। ইতিপূর্বে আপনার কথা মনে পড়লেও আমি আমার জেদ কেই প্রাধান্য দিয়েছি।
আয়ান যখন আপনার সাথে আমার করা অন্যায় গুলোর সম্পর্কে ধারনা দিলো তখন আমি বুঝতে পারলাম নিজের জেদের বসে আমি আমার স্ত্রীকে কতটা কষ্ঠ দিয়েছি। ধীরে ধীরে আমার চিন্তা ধারা বদলালো আপনার প্রতি আমার অনুভুতি কাজ করতে শুরু করল।
আয়ানকে নিজের মনের কথা গুলো বললাম।আয়ান আমাকে আশ্বস্ত করল সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি ও নিজের করা ভুল গুলোর জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে মড়িয়া হয়ে উঠলাম।
আয়ানের সাথে গেলাম বাড়িতে যে সম্পর্কে বাড়ির কেউ কিছুই জানতোনা।
যাবার পরেরদিনই বাবা আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে অনেক বকা ঝকা করলেন। বাবাকে কোনরকমে আয়ান সামলে নিলো, বাবাও শান্ত হলেন আমি তার পর থেকে নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করছি নিজের ভুল শুধরে নেবার।
আপনি কি আমাকে এখনো ক্ষমা করবেন না শিমু। আমি সত্যি চাই আপনার সাথে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কাটাতে।
আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি শিমু ।”
সাফোয়ান এবার আরো অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল,”আমিতো ভুল করেছি আমি জানি। সেই জন্য আমি ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। আমি আর এই অপরাধবোধ নিয়ে বাচঁতে চাইনা।আপনি দয়া করে আমাকে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিন।”
চলবে,,,