#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪২ [প্রথমাংশ]
চৌধুরী ভিলাতে আজকের সকালটা অন্যরকম সুন্দর। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে সবাই মিলে বাগানে পিকনিক করবে। পিকনিকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব আজ সম্পূর্ণ ছেলেদের হাতে। ব্যাপারটা নিয়ে দর্শিনী খুব এক্সাইটেড! অনেক আগে প্রিয়দর্শিনী যখন দাদু বাড়িতে গিয়েছিল তখন এমন ফ্যামেলী পিকনিক দেখেছিল। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার আর সুযোগ হয়নি। প্রিয়দর্শিনী দাদুকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু দাদু বাড়িতে খুব কমই গেছে। তার দাদি বেঁচে থাকাকালীন তাদেরকে আশরাফ সাহেব তাদেরকে বাসায় নিয়ে আসতেন। এজন্যই তেমন প্রভাব পড়েনি দু’বোনের মধ্যে। তবে দর্শিনীর ইচ্ছে আছে আবিদকে নিয়ে তার দাদার বাড়িতে যাওয়ার। দর্শিনী প্রথমবার স্বামীর বাড়িতে এমন পিকনিক করবে। এজন্যই আনন্দটা দ্বিগুন মনে হচ্ছে তার।
সকালে আবিদ দর্শিনীকে জড়িয়ে শুয়ে ছিল। অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে দুজনের। মূলত দর্শিনীই তার ঘুমের বারোটা বাজিয়েছে। পরবর্তীতে আর ঘুমাইনি আবিদ। আজকে যেহেতু দর্শিনী প্রচন্ড খুশি! বউয়ের খুশির ঝলকানিতে ঈষদুষ্ণ হাসে আবিদ। হুট করেই দর্শিনীর গলায় মুখ গুঁজে মিষ্টি স্মেল নিতে থাকে। আবিদ এমন আচরণ মাঝে মধ্যেই করে; এটা নতুন নয় দর্শিনীর কাছে! কালকে রাতের কথা ভেবে দর্শিনী মৃদু লজ্জা পেয়ে আবিদকে ছেড়ে উঠে যেতে চায়। আবিদ একটু আপত্তি করে পরবর্তীতে দর্শিনীর লজ্জা পাওয়া দেখে ছেড়ে দেয়। তার ঠোঁটে এখনো মনোমুগ্ধকর হাসি। সচারচর তার হাসিটা সকলের অগোচরে থাকে, কিন্তু দর্শিনীর কাছে সবসময় দৃশ্যমান। আবিদের এমন সুক্ষ্ণ হাসিতে দর্শিনী লজ্জা পায়। সে আবিদের নজর এড়িয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়। অন্যদিকে আবিদও ফ্রেশ হয়ে গার্ডেন এড়িয়ায় চলে আসে। তার এখন জগিং করা প্রয়োজন। সুদর্শিনী বউয়ের জন্য তাকে আরো বেশি স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে হবে। এমনিতেই কাল রাতে দর্শিনী তাকে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বলে ফেলেছে। যদিও মজা করেছে বলেছে, তবুও কী দুঃসাহস! বত্রিশ বছর বয়সী এমন সুদর্শন স্বামীকে কেউ বুড়ো কীভাবে বলতে পারে? আবিদ জানেনা তবে কাল রাতেই দর্শিনীকে প্রমাণ করে দিয়েছে সে কতোটা স্টেবল, স্ট্রেন্থফুল। আবিদের ঠোঁটে সুক্ষ্ণ হাসির রেখা দেখা যায়।
.
সকালের মনোমুগ্ধকর পরিবেশটা আবিদের বরাবরই ভালো লাগে। টি-শার্ট টাউজার পরিহিত অবস্থায় জগিং শেষে প্রাণভরা সতেজ নিঃশ্বাস টেনে নিলো আবিদ। বাগানের এতো সব রঙিন ফুল ফলাদির মধ্যে যে কারো ভালো লাগবে স্বাভাবিক। আবিদ কিছুক্ষণ দৌঁড়াদৌঁড়ি করে লোহার একটা বেঞ্চে আরাম করে বসে। দর্শিনী তখন ট্রে’তে করে সকালের ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। আজকে দুজনেই শীতোষ্ণ সতেজ পরিবেশে বেঞ্চে বসে ব্রেকফাস্ট করবে। আগে সবসময় আবিদ ব্রেকফাস্ট এমন শান্তিময় পরিবেশে করতো। প্রকৃতির মাঝে স্বপ্নের প্রেয়সীনিকে, মানে দর্শিনীকে অনুভব করতে চাইতো। তাদের বাড়ির কাজের মহিলা বয়স্ক সুফিয়া বেগম এবং তার স্বামী ইমান আবদুল্লাহ দুজনেই চৌধুরী বাড়িতে অনেক আগে থেকে কাজ করে। ইমাম আবদুল্লাহকে আবিদ সম্মান করে চাচা বলতো। আবিদ যখন ব্যায়াম করার জন্য গার্ডেনে থাকতো তখন ইমান চাচাই তার জন্য প্রায় সময় ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসতো। আবিদ তখন নিরিবিলিতে ব্রেকফাস্ট করতো। অনেক সময় শাহরিয়ার চৌধুরী আবিদকে সঙ্গ দিতেন। মূলত তাদের জন্যই বাগানের দিকটায় টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দর্শিনী এসে আবিদের পাশে ট্রে’টা রেখে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে আবিদের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দেয়। আবিদ বেঞ্চে বসে থেকে দর্শিনীর কোমড় জড়িয়ে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে। পুরাই ফিল্মি স্টাইল! আসফি তখন নিজের রুমের ব্যালকনিতে ছিল। সবার ব্যালকনি থেকে গার্ডেন এড়িয়া সরাসরি চোখে পড়ার মতো ছিল। মূলত শাহরিয়ার চৌধুরী গার্ডেনের সৌন্দর্যটুকু অনুভব করার জন্য এভাবেই ডিজাইন করেছিলেন। আসফি ব্যালকনি থেকে দৃশ্যটা দেখে মলিন হাসলো। বুকের মধ্যে কোথাও একটা সুক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করলো। নাহ, এখানে থাকা ঠিক নয়। আসফি ততক্ষণাৎ রুমে চলে যায়।
আবিদকে জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয় দর্শিনী। দুজনে বেঞ্চে বসে নানান কথাবার্তা বলতে থাকে। ঠিক এমন সময়ে শবনম ফুফির আগমন ঘটে। মূলত বাগানটা তার হাতেই গড়া। এজন্য দেশে ফিরেই তিনি বাগান পরিদর্শন করেছিলেন। বাগানের এমন স্নিগ্ধ, সুন্দর, সতেজ রূপ দেখে তিনি বুঝে যায় আমেরিকা যাওয়ার পর সবাই ভালোই যত্ন নিয়েছে বাগানের। আবিদের মতো শবনম ফুপিরও নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করার অভ্যাস আছে। এজন্যই তিনি এখানে আসলেন। হঠাৎ-ই বেঞ্চের উপর আবিদ দর্শিনীকে বসে থাকতে দেখে তিনি বিব্রত হলেন। তাদের দেখার আগে ফিরে যাবেন বলে ঠিক করেন শবনম ফুপি। কিন্তু হঠাৎ-ই আবিদের নজরে পড়ে যান। আবিদ ফুপিআম্মুকে ডেকে ওঠে,
‘ফুপিআম্মু, চলে যাচ্ছো কেনো?’
শবনম ফুপি অনিচ্ছাকৃত থেমে যান। আবিদের ডাকে বিস্মাভূত হয়ে বললেন,
‘এমনিই! বাগান দেখতে এসেছিলাম। দেখা শেষ রুমে যাবো, আবিদ!’
আবিদ শবনম ফুপিকে ইশারায় তার কাছে আসতে বলে। দর্শিনী দু’জনকে স্পেস দিতে ব্রেকফাস্টের ট্রে’টা নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। শবনম ফুপি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায়। আবিদের পাশে না বসলে ছেলেটা থামবেনা। তাই বেঞ্চে আবিদের পাশে গিয়ে বসেন। আবিদ তখন বলে,
‘তোমাকে আগের মতো হাস্যজ্জ্বল দেখিনা, ফুপিআম্মু। আমার খুব খারাপ লাগে তোমাকে এভাবে দেখতে।’
‘কে বলল আমি আগের মতো হাস্যজ্জ্বল নই? আগের থেকে কম, তবে দেখো তোমার ফুপিআম্মুর জৌলুস কিন্তু এখনো কমেনি।’
শবনম চৌধুরী মেকি হেসে বললেন। আবিদ ফুপির দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। হঠাৎ-ই শবনম চৌধুরীর কাঁধে মাথা রেখে বলে,
‘একটা অমানুষের জন্য নিজের জীবন এভাবে শেষ করে দিচ্ছো? আমাদের ভালোবাসার কী কোন দাম নেই? কেনো ঐ লোকটা তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়? আমি যদি কখনো জানতে পারি লোকটি কে; তাহলে নিজ হাতে খু’ন করব। তোমার সঙ্গে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিবো। তুমি আমাকে লোকটির পরিচয় বলো। এই পৃথিবীতে অমানুষের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
‘আবিদ….!’
শবনম চৌধুরী সহসা আবিদের কথায় চমকে ওঠেন। এমন ভয়ংকর কথা আবিদের মুখে শুনে তিনি মৃদু ঢোক গিলে ফেলেন। অজান্তেই আবিদ নিজের শ্বশুরের প্রতি নিদারুণ ক্রো’ধ পুষে রেখেছে অথচ তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। শবনম চৌধুরী হয়তো আশরাফ সাহেবের প্রতি রেগে আছেন। হয়তো মৃদুমন্দ ঘৃ’ণা করেন। আশরাফ সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতা এখনো তার মনে আঁচড় কেঁ’টে রয়েছে। তাই বলে তিনি কখনো আশরাফ সাহেবের ক্ষ’তি চান না। এটাকেই হয়তো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে।
‘আমাদের ভুল কোথায় জানো, আবিদ? আমরা কখনো কারো দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখিনা। এজন্যই মানুষকে ভুল ভাবে জাজ করে ফেলি! আমি কোনকিছু মনে রাখিনি। আমার এই অবস্থার জন্য কেউ দায়ী নয়। তুমি অযথা ভুল ধারণা পুষে রেখেছো। তোমার এসব ভুলে যাওয়া উচিত! তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস প্রিয়দর্শিনী, ক্যারিয়ার! বাকি অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে যেওনা, আবিদ।
আবিদ ফুপিআম্মুর কঠিন কথায় দমে যায়। ফুপিআম্মুর অপছন্দ এমন কাজ সে করতে চায়না। আবিদ নিঃরস কন্ঠে বলে,
‘আমার কাছে তুমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ফুপিআম্মু। তুমি কী সারাজীবন এভাবেই থাকবে?’
‘এটাই তো আমার নিয়তি, আবিদ। এভাবেই বেশ ভালো আছি। লাইফে দ্বিতীয়বার এক্সপেক্টেশন রাখিনা আমি!’
আবিদ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে,
‘এটা কারো জীবন হতে পারেনা!’
‘মানিয়ে নিতে হয়, আবিদ! আমি তো মানিয়ে নিয়েছি।’
#চলবে
#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪২ [বর্ধিতাংশ]
বাগানে বিস্তর চাদর বিছিয়ে দর্শিনী সহিত সব মেয়েরা পেয়াজ রঁসুন সহ রান্নার যাবতীয় মসলা তৈরি করছে। অন্যদিকে আবিদ সহ বাড়ির সব পুরুষরা মাথায় গামছা বেঁধে রান্না করার জন্য প্রস্তুত। তাদেরকে গামছা বেঁধে স্টাইল করতে দেখে মেয়েরা একসঙ্গে কিছুক্ষণ হাসল। বাড়ির ছেলেরা মেয়েদের হাসতে দেখে বলে,
‘হেসে নেও, হেসে নেও! আজকে আমরা ছেলেরা পাকা রাধুঁনি হয়ে গেছি। যাকে বলে প্রফেশনাল সেফ! তোমাদের চেয়ে বেটার রান্না করবো। দেখবা যখন রান্না শেষ হবে তখন চেঁটেপুটে খাবা।’
মেয়েরা সারাবছর রান্না করে যদি এমন কথা শোনে রাগ হবার কথা স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু তারা কেউ রাগের বহিঃপ্রকাশ করল না। কারণ একটুপর ছেলেরা হাড়ে হাড়ে টের পাবে রান্না করা কতোটা কষ্টের কাজ। তখন বুঝতে পারবে মেয়েরা সারাবছর কতো কষ্ট করে। অথচ পুরুষরা একটু রান্নায় যেমন তেমন হলেই কতো কী শুনিয়ে দেয়। তারা মেয়েদের দিক থেকে কখনো চিন্তা করে দেখেনা। তবে আজ চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা উপলব্ধি করবে রান্না করতে রাধুঁনিদের কতো কষ্ট হয়। মেয়েরা ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘মসলাপাতি যা কিছু আছে সব আমরা করে দিচ্ছি। শুধু আগুন জ্বালিয়ে নাড়াচাড়া করার মধ্যে গর্ব করার কিছু নাই বুঝেছো?’
ছেলেদের মধ্যে তিনজন প্রতিবাদ করে উঠে,
‘আমরা তোমাদের বলিনি সাহায্য করতে! আমরা নিজেরাই সব করবো, দরকার নেই তোমাদের সাহায্যের।’
এইকথা শোনা মাত্র মেয়েরা তেঁতে ওঠে। অবশেষে শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন,
‘আজকে যেহেতু আমরা রান্না করবো বলেছি! শুরু থেকে সবটা আমরা করবো। অবশ্যই তোমাদের সাহায্য ছাড়া। কে কোথায় আছিস আমার আইফোনটা নিয়ে আয়! ইউটিউব দেখে আজ সব রান্না হবে।’
শাহরিয়ার সাহেবের কথায় সবাই মিলে একজোঁট হয়ে বিস্তর হাসিঠাট্টার রোল পড়ে যায়। ছেলেরা ইতিমধ্যে কাজে লেগে পড়েছে। দর্শিনী মুগ্ধ হয়ে মাথায় গামছা পরিহিত আবিদকে দেখে মিষ্টিমধুর হাসে। আবিদকে এভাবে দেখতে খারাপ লাগছেনা। দর্শিনীর তার সুদর্শন স্বামীকে সত্যিকারের রাধুঁনি মনে হচ্ছে। অকস্মাৎ দর্শিনী ভাবতে থাকে দ্যা গ্রেট ম্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর এমন লুক ছাত্রছাত্রীরা দেখলে নিশ্চয়ই হাসবে কী? এই আনন্দদায়ক পরিবেশে সুন্দর মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দী করা উচিত। ঠিক তখনই আদিবা আসে ক্যামেরা নিয়ে। দর্শিনী ভাবে এইতো আমার সুযোগ্য ননদিনী!
বাগানের যেখানে গাছপালা একটু কম সেখানে দুটো চুলা তৈরি করা হয়েছে। ইমান চাচা বাহির থেকে রান্নার জন্য পর্যাপ্ত কাঠখঁড়ি কিনে এনেছে। তাছাড়া রান্নার জন্য মাঝারি সাইজের কয়েকটা সসপ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শাহরিয়ার চৌধুরী চুলার উপর সসপ্যানের মধ্যে ফ্রেশ গরুর মাংস তেল, মসলা, পানি দিয়ে মাখিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। অন্যদিকে আবিদ আরহান পোলাও রান্নার চাউল ধুঁয়ে অন্য সসপ্যানে করে চুলাতে বসিয়ে দেয়। আজকের রান্নার আইটেম হচ্ছে গরুর মাংসের ঝোল, খাসির মাংসের ভূনা, পোলাও, বাসমতি চাউলের সাদা ভাত, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, মিষ্টান্ন দ্রব্যের মধ্যে দই, রসমালাই, কোক জাতীয় কমল ঠান্ডা পানি। ব্যাস!
ছেলেরা সবাই দ্রুত হাত চালিয়ে কাজ করতে থাকে। দুপুরের আগেই এতোসব রান্না শেষ করতে হবে তাদের। তারা সবাই জিদ দেখিয়ে ইউটিউবের সাহায্য নিচ্ছে। তাছাড়া বয়স্ক ইমান চাচা ছেলেদের মধ্যে একমাত্র পারদর্শী! তাই তিনি সবাইকে গাইড দিচ্ছেন। শাহরিয়ার চৌধুরী হঠাৎ-ই রান্না করতে করতে গুনগুন করে গাইতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে ছেলেরা সবাই একসঙ্গে গাইতে শুরু করে,
আমি শেষে ভজহরি মান্না
রামায়ন ভুলে গিয়ে। মহাভারত ভুলে গিয়ে
এখন আমি শুধু শিখেছি রান্না!
আমি শেষে ভজহরি মান্না।
মেয়েরা বাগানের যেখানে ছায়া রয়েছে সেখানে বসে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। তাছাড়া তাদের প্রধান লক্ষ্য ছেলেদের গতিবিধির উপর নজর দেওয়া। ছেলেরা যখনি কোনো কাজে ভুল করছে; মেয়েরা তখনি উচ্চঃশব্দে হেসে উঠেছে! অবশ্য ভালো হয়েছে ছেলেরা তৎক্ষণাৎ ভুল করা থেকে সাবধান হয়ে গেছে। তাছাড়া ছেলেদের বেসুরো গান শুনে সবাই আরো একবার উচ্চঃস্বরে হেসে উঠে।
দুপুরের দিকে ইমান চাচার সহযোগিতায় রান্না কম্পলিট হয়ে যায়। ইতিমধ্যে খাবারের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে সবখানে। ছেলেরা খুব সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করে। আজকে সবাই বাগানে বসে একসঙ্গে আহার করবে। ছেলেরা প্রত্যেকে ঘেমেনেয়ে একাকার। দেখে মনে হচ্ছে গোসল করে ফেলেছে। যেহেতু সবাই মাথায় গামছা পরিহিত ছিল। রান্না শেষে সবাই গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে থাকে। তখন দুপুরের আজান পড়ে গেছে। সবাই নামাজ পড়বে তারপর একসঙ্গে খেতে বসবে। তাই ছেলেরা দ্রুত গোসল করে নামাজে চলে যায়। মেয়েরাও কয়েকজন নামাজ পড়ে নেয়।
অবশেষে সবাই একসঙ্গে বাগানে খেতে বসে। ছেলেরা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে রান্না করা কতোটা কষ্টের কাজ। তারা সব কয়েকটি পদ অনেক কষ্টে শেষ করতে পেরেছে। সবাই বুঝে গেছে মেয়েদের সম্মান প্রাপ্য। তাই শাহরিয়ার চৌধুরী সহ বাকি সবাই আজ যত্ন করে বউদের খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছে। মেয়েদের খাবার বেড়ে দিয়ে তারা সবাই বসে পড়ে। রান্না খারাপ হয়নি প্রথম হিসাবে যথেষ্ট সুস্বাদু বলা যায়। সবাই তৃপ্তি করে খেতে থাকে। আদিবা সবকিছু ক্যামেরাতে ক্যাপচার করে নেয়। দর্শিনীর কাছে মনে হচ্ছে আজকের দিনটা অন্যতম আনন্দের দিন!
.
পাঁচমাস পরে,
সময় স্রোতের ন্যায় দ্রুত বহমান। দর্শিনীর বয়স উনিশ চলছে। এইতো কয়েকমাস আগেই সে ভার্সিটিতে জয়েন করেছে। সেখানে ইতিমধ্যে দিয়া, হৃদিতা, নাদিম, আহানাফ ছাড়া নিজের ডিপার্টমেন্টের মধ্যে কয়েকজন বান্ধুবী পেয়েছে। আবিদ তাকে গাড়িতে করে নিয়মিত ভার্সিটি পৌঁছে দেয়। আবার অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবিদ দর্শিনীর জীবন বর্ধিত হচ্ছে। তাদের ভালোবাসার পরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা দুজন দুজনের জন্য শুধু যত্নশীল নয় কর্তব্যপরায়ণ! দুজন দুজনকে অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারে।
তাছাড়া এই কয়েকমাসে চৌধুরী পরিবারের সবার সঙ্গে দর্শিনী এতোটা মিশে গেছে। দর্শিনীর কাছে এরা সবাই বাবা-মার পরে সবচেয়ে আপন। ঠিক তেমনভাবেই চৌধুরী পরিবারের সবাই দর্শিনীকে অনেক ভালোবাসে। শাহরিয়ার চৌধুরী অনুসা বেগম মনে করেন দর্শিনী তাদের সবার জন্য এমনকি এই বাড়ির জন্য ব্লেসিং। দর্শিনী এই বাড়িতে আসার পর তাদের বিজনেস আরো বেশি সফলতা পেয়েছে। তাছাড়া শাহরিয়ার চৌধুরী অনেকগুলো সুসংবাদ পেয়েছেন। এমনকি বিজনেসের পরিধি বেড়ে বাইরের দেশে পযর্ন্ত পৌঁছে গেছে। যেহেতু এতোসব কিছু দর্শিনী আসার পর হয়েছে। এজন্যই তাদের ধারণা দর্শিনী এই বাড়ির জন্য সৌভাগ্যের। অনুসা বেগম তাকে প্রায়ই বলেন আমাদের চাঁদের টুকরো লক্ষ্মী বউমা।
আদিবার পরীক্ষা শেষ অনেক আগেই। রেজাল্ট মাশআল্লাহ অনেক ভালো করেছে। এখন আদিবা ভার্সিটির পিপারেশন নিচ্ছে। তার লক্ষ্য দর্শিনীর মতো ঢাবিতে চান্স পাওয়া। তাছাড়া আদিবার সঙ্গে দর্শিনীর সখ্যতা ননদ ভাবিপু হিসাবে অনেক ভালো। তারা ননদ-ভাবি দুজনেই মাঝে মাঝে একসঙ্গে ঘুরতে যায়, শপিং করতে যায়! তবে একাকী নয় আবিদ তাদেরকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে পুস্পিতা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরে থেকে দর্শিনী, আদিবা সময় পেলেই তার সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। পুস্পিতার তখন একাকীত্ব বোঁধ হয়না।
আসফিও অনেক চেন্জ হয়ে গেছে। এখন সে কাজের মধ্যে ডুবে থাকে প্রায়ই। বাবার অনুরোধে আসফি আইটি কম্পানির জব ছেড়ে নিজেদের ফ্যামেলী বিজনেসে যোগ দিয়েছে। যেহেতু তাদের বিজনেস অনেক বড়। শাহরিয়ার চৌধুরী, আরহান সবটা সামলাতে হিমশিম খায়। এজন্যই আসফি সেখানে জয়েন করেছে। মাঝেমধ্যে আবিদ নিজেও ভাইদের সঙ্গে অফিসে যায়। সুপরিকল্পিতভাবে প্রজেক্ট তৈরিতে সহয়তা করে। তাছাড়া ভালোমন্দ পরামর্শ দেয়। অন্যদিকে সবার পরিবর্তনের মধ্যে শবনম চৌধুরী অন্যতম। তিনি এখন আর দর্শিনীকে এড়িয়ে যান না। দর্শিনীর সঙ্গে অনেকটাই ফ্রী হয়ে গেছেন বলতে গেলে। যেমনটা আগে ছিলেন যখন জানতেন না, দর্শিনী আশরাফ সাহেবের মেয়ে। তিনি এই কয়েকমাসে বুঝতে পেরেছেন দর্শিনী ভালো মেয়ে। শুধু ভালো নয় অনেক ভালো মেয়ে। একদম আবিদের জন্য সুযোগ্য। তাই দর্শিনীকে নিয়ে কোনো অভিযোগ রাখেন না। কিছুদিন পর তিনি আমেরিকা ফিরে যাওয়ার প্লান করেছেন। অবশ্য এই ব্যাপারে কেউ জানেনা সঠিকভাবে। জানলে হয়তো কেউ তাকে যেতে দিবে না। এজন্যই তিনি কাউকেই জানান নি। সবাইকে ধীরে সুস্থে জানিয়ে রাজি করাবেন এটাই পরিকল্পনা শবনম চৌধুরীর।
প্রজ্জ্বলিনীর এখন আটমাস চলছে। অনেকটা সিরিয়াস সময় বলতে গেলে। উজান তাকে একা সামলাতে পারেনা এজন্যই মুহতাসিম ভিলায় নিয়ে গেছে। মূলত উজান সেখান থেকেই অফিসের যাবতীয় সবকিছু দেখাশোনা করছে। অন্যদিকে প্রজ্জ্বলিনীকে পুরোটা সময় দিচ্ছে। তাছাড়া প্রিয়মা বেগমের কাছে প্রজ্জ্বলিনী অনেকটা নিরাপদ থাকে। বাবা-মাকে পেয়ে এখন প্রজ্জ্বলিনীর মন খারাপ কিংবা ভয় কোনটাই স্থায়ী হয়না। দর্শিনী ইতিমধ্যে অনেকবার তাকে দেখতে গেছে। দুইবোন অনেকদিন পর যখনই একসঙ্গে হয়েছে তারা একে অপরকে জড়িয়ে কান্না করেছে। তবে একটাই সমস্যা কোথাও গেলে দর্শিনীকে সেদিনই ফিরে আসতে হয়। নাহলে আবিদ অভিমান করে। আবিদ বলতে গেলে, তাকে ছাড়া থাকতে চায়না। এটা তার বদ অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আরহান আবিদকে বিষয়টা নিয়ে কতো পিন্চ করে কথা বলে। তাছাড়া হাসিঠাট্টা করে! আবিদ গায়ে তোলে না। কারণ সে সত্যিই দর্শিনীকে ছাড়া থাকতে পারেনা।
বিয়ের কয়েকমাস আগে আবিদের উপর একবার হামলা হয়েছিল। কেউ তাকে মা’রার জন্য চেষ্টা করেছিল। কোনমতে বেঁচে গেছে আবিদ। আবিদের বদলে তার একজন গার্ড গুরুতর আহত হয়েছিল। সেদিন সত্যিই আবিদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। কয়েকজন পুলিশ হামলাকারীকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে আবিদ পুলিশকে তদন্ত করতে মানা করে দেয়। এতে সবার আপত্তি ছিল ঠিকই। কিন্তু আবিদের মনে সম্ভবত অন্য পরিকল্পনা চলছিল। অ্যাটাক হওয়ার পর কোনো মতে বেঁচে গেছিলো আবিদ। সেইসময় আবিদকে সরকারী ভাবে একমাস ছুটি দেওয়া হয়েছিল। দর্শিনীর সেসময় কী কান্না! কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। তবে আবিদ তাকে বহুকষ্টে সামলে নেয়। একটু সুস্থ হওয়ার পরে ছুটি থাকাকালীন আবিদকে অন্যকাজে যেতে দেখা গেছে। দর্শিনী তখন আপত্তি করলেও কোনদিন শুনেছে! তো কোনদিন গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে চলে গেছে। সেই সময়টা দর্শিনীর কাছে দূর্বিষহ ছিল। আবিদকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে ভয় পেতো দর্শিনী। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো তখন। সবসময় আবিদকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো। এমনকি রাতে ভয় পেয়ে আবিদকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখত। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আবিদ তখন মৃদু হেসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতো দর্শিনীর মতো একজনকে জীবনে পাঠানোর জন্য।
পরবর্তীতে আবিদের ইচ্ছে অনুযায়ী হামলাকারীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়নি। সবার কাছে এটা অবাক করার মতো বিষয় ছিল। ওই ঘটনার একমাস পরেই আবিদ জেলা পর্যায় থেকে বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে জয়েন করে। সেদিন সেই খুশিতে শাহরিয়ার চৌধুরী বাড়িতে সেলিব্রেশন করেছিল। তারপরে সেদিন থেকে আজপর্যন্ত কোন সমস্যা দেখা যায়নি আবিদ দর্শিনীর জীবনে।
#চলবে
[ রান্নার সময় গানটা বিনোদনের জন্য ছিল। গল্পে অনেক সময় বানান ভুল হয়ে যায়, গ্রুপে গল্প পোস্ট করার পরে ঠিক করার কোনো উপায় থাকে না। সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ, আর রেসপন্স করবেন ]