#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৩
রাহাত দুরুদুরু মন নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে স্বাভাবিক গলায় বলল,
— কেমন আছো?
অদ্রি শক্ত গলায় সরাসরি বলল,
— ভালো। আচ্ছা, এতদিন যাকে ফোন দিয়ে নিজের ফিলিংসের কথা জানিয়েছো তুমি কি জানো সে আমার কে হয়?
রাহাত শুকনো গলায় বলল,
— তোমার ভাই।
— ডাফার, হি ইজ মাই হাজব্যান্ড….
রাহাতের মনে হলো ওর কানে কেউ বি’ষ ঢেলে দিয়েছে! কি শুনলো এটা? ভুল শুনলো নাকি? এক লাফে ও বিছানায় ওঠে বসলো। ল্যাম্পশেডটা জ্বালাতেই ঘরে মৃদু হলদে আলোয় ভেসে গেলো। রাহাত নিজের গালে থাপ্পড় দিয়ে শিওর হয়ে নিলো যেটা শুনছে সেটা সত্যি নাকি মিথ্যে। কি হচ্ছে এটা তার সাথে? ওর গলা দিয়ে কোনো বাক্যব্যয় হতে চাইলো না। বহুকষ্টে হাসার চেষ্টা করে বলল,
— ত তুমি মজা করছো আমার সাথে?
অদ্রির গলা জোরালো শোনালো,
— তোমার সাথে আমার মজার সম্পর্ক?
রাহাত দমলো না। দৃঢ় স্বরে বলল,
— আমি বিশ্বাস করি না। তোমার হয়তো আমাকে পছন্দ না সেজন্য সরাসরি বলতে পারছো না বা তোমার ফ্যামিলির চাপে তুমি আমাকে মিথ্যে বলছো। বাট
আমি সত্যিই তোমাকে চাই…
অদ্রি শুনলো ওর কথাগুলো। ওর খানিকটা বিরক্ত লাগছে। একটা মেয়ে বিবাহিত সেটা জানার পরেও রাহাত বলছে অদ্রি ওর সাথে মজা করছে? রাহাতের মতো ইন্টিলিজেন্ট ছেলের থেকে এধরণের কোনো কথা ও এক্সপেক্ট করেনি। অদ্রি যথেষ্ট শক্তভাবে বলল,
— দ্যাটস ইওর প্রবলেম…
রাহাত নিজের অনুভূতি লুকাতে পারলো না। ব্যাকুল গলায় বলে ওঠলো,
— আমার তোমাকে ছাড়া সব শূন্য শূন্য লাগে অদ্রি।
আমি তোমার প্রতি লয়্যাল, সেজন্যই আমি সবার আগে তোমার ফ্যামিলিকে মানাতে চেয়েছি…
রাহাতের কথাগুলো শুনে অদ্রি হতাশ হলো। ও কি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না অদ্রি বিবাহিত? ও নিজের মনে কিছু কথা গুছিয়ে নিলো। বলল,
— কিন্তু আমি তোমার প্রতি কিছু অনুভব করি না রাহাত। তুমি জাস্ট আমার ভালো বন্ধু, তাই তোমার উচিৎ সম্পর্কটাকে রেস্পেক্ট করা। আই হোপ তুমি সেটা করবে। নয়তো আমাদের ফ্রেন্ডশিপ এখানেই স্থগিত!
অদ্রি এটুকু বলে ফোন কেটে দিলো। নয়তো রাহাত নাছোড়বান্দা হয়ে হয়তো আরও অনেক কিছু বলবে। ওকে এত সুযোগ দেওয়া মোটেও ঠিক হবে না।
ধ্রুব একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিলো এতক্ষণ। রাহাতের কথাগুলো শুনে ওর ইচ্ছে করছিলো
ফোনের ভেতরেই তার টুঁটি চেপে ধরতে। কিন্তু সে নিজের ভাবনা চিন্তাকে সংযত করলো। এমনিতেই রাগে, অদ্রিকে ভুল বুঝে জঘন্য একটা অন্যায় সে করেছে যার কোনো ক্ষমা হয় না। সে চায় না আর কোনো ভুল করতে যাতে করে অদ্রি ওকে আরও বেশি ঘৃণা করুক। তবে ওর মনটা বেশ হালকা লাগছে, বুকের ভেতর চেপে বসা যন্ত্রণাটা ধীরেধীরে কমছে।
অদ্রি ফোন রেখে অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। ধ্রুবকে কিছুই বললো না। দূরে গিয়ে বসে রইলো। থালার মতো চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে। ও এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না রাহাত ওকে পছন্দ করতো এবং এইসব সে করেছে। আর ওর কথায় প্রভাবিত হয়ে কাল ধ্রুব ওর সাথে এসব করেছ! অদ্রির মাথায় এসব হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মাথা কাজ করছে না। সোজা হয়ে বসে দম নিলো। শীতল বাতাসে ওর চুলগুলো ওড়াওড়ি করছে। অদ্রি চুলগুলো হাতখোঁপা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো। ধ্রুব এগিয়ে এসে বলল,
— আমি করে দিই?
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলল,
— আগে কয়টা মেয়ের চুল বেঁধেছেন?
ধ্রুব প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে গেলো। অদ্রি কি ওকে সন্দেহ করছে? ও তো আগে কখনোই কোনো মেয়ের চুল বাঁধেনি! সেজন্য দৃঢ় স্বরে বলল,
— কারোর নয়…
অদ্রি ঠোঁট উল্টালো,
— বিশ্বাস হলো না। যে যে কাজ করে থাকে, সে-ই অন্যকে সন্দেহ করে আর নিজের মতো ভাবে। আপনি ঠিক সেরকম…
অদ্রি চলে গেলো ছাদ থেকে। ধ্রুব একা দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো। ও কি করে অদ্রির রাগ ভাঙাবে সেটা বুঝতে পারছে না। এমনিতেই অদ্রি একটু ত্যাড়া, তার ওপর ধ্রুব আহাম্মকের মতো কাজ করেছে। সে তো নিজেকেই ক্ষমা করতে পারছে না, তাহলে অদ্রি কীভাবে করবে? ধ্রুব চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন লাগালো রাদিফের কাছে, এই প্রথম ওর মনে হচ্ছে মেয়েদের রাগ ভাঙানোর ট্রিকস জানার জন্য হলেও ওর আগে একটা প্রেম করা উচিৎ ছিল!
এদিকে রাহাতের মাথা কাজ করছে না। সত্যিই কি ও এতদিন অদ্রির বরকে ফোন করে নিজের ফিলিংস শেয়ার করতো? সব বলতো? নাকি নিছকই রাহাতকে রিফিউজ করার জন্য অদ্রি এই ট্রিকস ব্যবহার করেছে? হয়তো ওর পরিবারের চাপে পড়ে! রাহাত ঢকঢক করে গ্লাসের সবটা পানি খেলো।
কিন্তু লোকটা যদি সত্যিই অদ্রির পার্টনার হয় তাহলে মারাত্মক বিশ্রি একটা ব্যপারে হবে। অদ্রি মিথ্যে বলে না। তাহলে নিশ্চয় ও রাহাতের সাথে মিথ্যে বলেনি। দোটানায় ভুগতে থাকা রাহাত হতাশ হয়ে ফোন লাগালো পরশকে। দু’বার রিং হবার পর সে ধরলো। ধরেই উচ্চস্বরে হেসে বলল,
— কি খবর মাম্মা? এই টাইমে ফোন কেন?
রাহাতের সারা গা বিরক্তিতে ছেয়ে গেলো। মুখ গোঁজ করে ধমকে বলল,
— একদম হাসবি না। কোথায় আছিস?
পরশ চিন্তিত গলায় বলল,
— কালু মামার দোকানে। কেন? কি হইছে মাম্মা?
রাহাত নিজের দু-চোখ বন্ধ করলো। ওর বুকের ভেতর
অদ্ভুত চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। কোনোমতে বলল,
— সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে গেলো রে…
পরশ বলল,
— মানে কি? এত ভনিতা না করে সোজাসুজি বল তো ঘটনা কি?
রাহাত লম্বা দম নিলো৷ করুণ গলায় বলল,
— একটু আগে অদ্রির ফোন এসেছিলো। জানালো যাকে এতদিন ফোন দিয়ে নিজের ভালোবাসার কথা
বলেছিলাম সে নাকি ওর ভাই নয়, ওর হাজব্যান্ড। অদ্রি বিবাহিত পরশ…
পরশ বসা ছিলো। ও সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
— একি বলিস রে? অদ্রির বিয়ে হইয়া গেসে? কখন, কেমনে দোস্ত?
রাহাত রেগে গেলো। অদ্রি কি ওর সাথে গল্প করার জন্য ফোন দিয়েছে নাকি যে বসে বসে নিজের বিয়ের গল্প শোনাবে ওকে? রাহাত প্রচন্ড জোরে ধমকে ওঠলো,
— তোর কি মনে হচ্ছে অদ্রি গল্প করার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছে যে তার বিয়ের ডিটেইলস বলবে? কিন্তু
আমি এখন কি করবো তুই বল, কারণ সবকিছু তোর প্ল্যান ছিলো! অদ্রি এখন আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ রাখতে চাইছে না। আগেই যদি অদ্রির সাথে কথা বলে নিতাম তাহলে হয়তো এত ফ্যাসাদে পড়তাম না। শেষ পর্যন্ত একটা বিবাহিত মেয়েকে…ছিঃ
পরশের মুখ শুকিয়ে গেলো। সে কি জানতো নাকি অদ্রি বিবাহিত? কই কোনোদিনও তো বিবাহিত মেয়েদের মতো আচরণ করতে দেখেনি। সবসময় এত স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, কথাবার্তা বলেছে যে ওরা কেউ কিছু ধরতেই পারেনি? এরপর হঠাৎ ওর মনে পড়লো নীরা হয়তো কিছু জানলেও জানতে পারে। কেননা মেয়েরা নিজেদের বান্ধবীর সাথে এসব বিষয়ে আলোচনা করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নীরার কথা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় পরশ রাহাতকে বলল,
— আচ্ছা মানছি আমি ভুল। তুই নীরারে ফোন দিয়া জিগা, অই শালি কইলো না কেন অদ্রির জামাই আছে? ও নিশ্চয়ই জানতো। তাছাড়া ও তো এটাও জানে তুই অদ্রিরে পছন্দ করোস। এরপরেও কইলো না হারামিটা, শালি…
রাহাত ফোন দিয়ে নীরার সাথে কথা বললো। কিন্তু নীরাও অদ্রি বিবাহিত শুনে আকাশ থেকে পড়লো। সবার মতো ভীষণ অবাক হলো। রাহাত ফোন কেটে রেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। টং দোকানে গিয়ে দেখলো পরশ বসে চা খাচ্ছে। রাহাত গিয়েই ওকে পেছন থেকে ধরলো। পাশের মাঠটাতে নিয়ে কিছু উত্তম-মধ্যম দিলো। রেগে বলতে লাগলো,
— শালা, নীরা কিচ্ছু জানে না। আমার হৃদয় টুকরো হয়ে গেছে আর তুই বসে চা খাচ্ছিস? এই তুই ওর ব্যাপারে ভালোমতো খোঁজ করেছিলি? সত্যি করে বল…
পরশ মার খেয়ে মুখ গোঁজ করে বলল,
— এত খোঁজ নেবার কি আছে? ওর মতো মাইয়ারে দেইখা কার মনে হইবো ওর জামাই আছে? আর ওই লোকের সাথেও তো অদ্রির চেহারার কত মিল আছে!
রাহাত এবার ইট তুললো পথের ধার থেকে। বলল,
— তোর চোখের ছানি পড়েছে, তুই এক্ষুনি আমার সাথে চোখের ডাক্তারের কাছে চল। নয়তো আজ মেরেই ফেলবো!
পরশ বুঝতে পারলো রাহাত খুব রেগে গেছে। ও দৌড়ে গিয়ে রাহাতকে ধরলো। ধস্তাধস্তির পর হাত থেকে
ইটটা ফেলে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো। দু’জনেই হাঁপাচ্ছে। পরশ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
— বাদ দে ভাই। অন্য মেয়ে খুঁইজা দিমু। আর রাগ করিস না…
রাহাতের গলা অন্যরকম। পরশের কথা শুনে বলল,
— আমার কাউকেই আর লাগবে না। যাকে চাইলাম তাকে যখন পেলাম না তখন কাউকেই আর লাগবে না আমার…
রাহাতের মনের অবস্থা ভালো নেই বুঝতে পারলো পরশ। ওর নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। একটা বিবাহিত মেয়ের পেছনে লাগা কতটা নিকৃষ্ট কাজ সেটা আন্দাজ করেই ঘৃণা আসছে দু’জনেরই। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। চারপাশে তার আলো ঠিকরে পড়ছে। কোটি কোটি তারায় ছেয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পরশ হঠাৎ বলল,
— সিগারেট খাবি?
রাহাত ভ্রু কুঁচকাল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— আমি ফুর্তির মুডে নেই। আর তুই জানিস, আমি এসব কখনো ছুঁইও নি। বুঝতে পারছিনা তুই আমার দুর্দশা দেখে কতটুকু কষ্ট পেয়েছিস যে এরকম অফার করছিস।
পরশ মুখ গোঁজ করে বলল,
— মাম্মা রাগ করস কেন? আমিও জীবনে সিগারেট ছুঁইনাই। শুনছি বেশি কষ্ট পাইলে নাকি এইডা কাজে দেয় তাই আরকি…
রাহাত ওকে অবাক করে বলল,
— নিয়ে আয়, ট্রাই করি..
পরশ শোয়া থেকে ওঠে পড়লো। একরাশ বিস্ময় নিয়ে দৌড়ে টং দোকানে ছুঁটে গেলো। দুটো সিগারেট নিয়ে এসে তারাভর্তি আকাশের নিচে খোলা মাঠে শুয়ে দুই বন্ধু ধোঁয়া ওড়াতে লাগলো। আগে প্র্যাকটিস না থাকার দরুণ আনাড়ি ভাবে সিগারেট টানতে গিয়ে দু’জনেরই বেহাল দশা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে অদ্রির মুখটা মনে করে রাহাত। পরক্ষণেই নিজের কর্মকান্ড মনে পড়তেই খুব রাগ হয়। রাহাত ঠিক করে অদ্রি ওর না হোক, তবুও ভালো থাকুক। দূর আকাশের তারার মতোই সারাজীবন অদ্রিকে সে ভালোবেসে যাবে, তার প্রথম ভালোবাসা। সে কখনোই ভুলতে পারবে না…
________
পারফিউমের মিষ্টি সুবাসে মাঝরাতে হঠাৎ অদ্রির ঘুমটা ভেঙে গেলো। নড়াচড়া করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো। ও চোখ খোলার চেষ্টা করলো। তবে অন্ধকারে কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না৷ একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলো ধ্রুব’র বিছানায়। অদ্রি ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলো। ও তো রোকেয়ার ঘরে শুয়েছিলো তাহলে এঘরে কীভাবে এসেছে? কিছুই ওর মাথায় ঢুকলো না….
[ ইচ্ছে করে দেরি করি নি, লিখতে বসার সময় পেয়েছিলাম একটু আগে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে…..