#লাজুকপাতা
#পর্ব-৫
রান্নাঘরের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের লিস্ট বানানোর দায়িত্বটাও আমি পেয়ে গেলাম। বাজার করেন শ্বশুর বাবা। উনি আমার সাথে কথা কম বলেন তবে আমার প্রতি তার স্নেহ, আন্তরিকতা টুকু আমি টের পাই। উনি আমাকে জরী কিংবা বউমা বলে ডাকেন না। মিষ্টি করে মা ডাকেন।
এই বাড়িতে সকালের নাস্তায় এখন আর প্রতিদিন ভাত হয় না। একদিন পাতলা খিচুড়ি, একদিন পরোটা, একদিন ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর অন্যান্য দিনগুলোতে রুটি করা হয়। খাবারের এই নিয়মে সবাই ই খুশি। জামিল ভাই একদিন রুটি খেতে খেতে বললেন,
“থ্যাংক ইউ জরী। একঘেয়ে খাবার খেতে খেতে মুখ পঁচে গেলেও কিছু বলতে পারি না। কামাই রোজগার নেই তো।”
আম্মা খানিকটা অসন্তুষ্ট হলেন বোধহয়। একদিন বললেন,
“এইগুলারে তো তুমি চেন না, একেকটা রাক্ষস বানাইতেছ।”
আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। আম্মা বিরক্ত গলায় বললেন,
“হাইসো না। আমি হাসার মতো কিছু বলিনাই। ”
পরী আপা একদিন আসলেন দুলাভাই কে নিয়ে। ফল, মিষ্টির দোকান টা উঠিয়ে আনতে বাকী রেখেছিলেন। পরী আপার আদর যত্নের কমতি রাখলো না। এই যে ছোট ছোট যে ব্যাপার গুলো এগুলোর জন্যই এই বাড়ির মানুষজনকে আমার এতো ভালো লাগছে।
আমার মনে আছে একবার বড় আপার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আমি, নিরু আপা আর অরু। বড় আপা পোলাও মাংসের আয়োজন করেছিলেন। খাবার সময় যখন মাংস তুলে দিচ্ছিলেন তখন আপার শাশুড়ী হায় হায় করে উঠলেন। বললেন,
“আরে, করো কি? ভালো মাংসের পিস গুলান তোমার স্বামী, ভাসুরের জন্য রাখো। ”
লজ্জায় অপমানে আমি আর কখনো ওই বাড়ি যাই নি। আসার সময় নিরু আপা বলছিল, খবিশ বুড়ি আমার পাল্লায় পড়লে বুঝতো। বড় আপা ভালো মানুষ বলে সহ্য করছে।
***
আমি পড়াশোনা করব এই ব্যাপারটায় বাড়ির কেউ তেমন আপত্তি করলো না। তবে আম্মার কপাল কুঁচকানো দেখে বুঝলাম যে উনি বোধহয় খুশি নন। বাবা বললেন,
“পড়তে চায় পড়ুক না। এখন কী আর সেই আগের যুগ আছে! এখন মেয়েরাও বিয়ের পর পড়তেছে। ”
নাবিদ আমাকে কোচিংএ ভর্তি করাতে চাইলো। আমি রাজি হলাম না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কোচিং এর শিট গুলো কালেক্ট করে পড়তে শুরু করলাম। একা একাই পড়ছিলাম। নাবিদ অবশ্য বলেছিল একজন টিচার দেখবে কি না। আমি তাও রাজি হলাম না।
আমার পড়াশোনার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে চাচাজান আর মা ফোন করলেন। বোঝালেন, পড়াশোনার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো সংসার। সংসারে মন দেয়া উচিত। একসঙ্গে সব পাওয়া যায় না। পড়াশোনার চক্করে আমার সংসার টা ভেসে যেতে পারে।
আমি এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলাম। পরী আপা ভীষণ খুশি হলেন। সেই সঙ্গে শুরু হলো আরেক উৎপাত। আপা ভোরবেলা মিসড কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারেন। বাধ্য হয়ে আমাকেও উঠে পড়তে বসতে হয়।
***
নাবিদের সাথে আমার দূরত্ব কমে গেল আস্তে আস্তে। আমাকে অবশ্য পরী আপা আর মা যখনই জিজ্ঞেস করেন সব ঠিক আছে কি না, আমি উত্তর দেই হ্যাঁ সব ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই ঠিক ছিলো না। নাবিদ দূরে দূরে থাকতো বলে আমিও দূরে থাকতাম। সূক্ষ্ম অহম বোধ আমার মধ্যেও ছিলো। ডানাকাটা পরী না হলেও সবাই আমাকে সুন্দর ই বলতো। আমার বড় মামার মেয়ে ফাইজা আপুর বিয়ের সময় ভাইয়ার এক কাজিন বলেছিল, এই জরী দিব্যা ভারতী কে চেন? তুমি দেখতে অনেক টা ওনার মতো।
তবুও নাবিদের দূরে থাকার কারণ হিসেবে ধরে নিলাম যে ওর হয়তো আগে কেউ ছিলো। কিন্তু আমার জটিলা ননদের কাছ থেকে সেরকম কোনো খবর পেলাম না। বলল, আরে না ভাবী। ছোট্ট ভাই অমনই ম্যুডি টাইপ। বড় ভাইয়ের মতো না।
এক ঝিমধরা শীতের সকালে টের পেলাম নাবিদ আমাকে ওর কম্বল দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ঘুম ভাঙার পর নড়েচড়ে সরে আসতে গেলেই নাবিদ বলল,
“তোমার কম্বলে ঠান্ডা মানছিল না। ঠকঠক করে কাঁপছিলে। ”
আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,
“হু। ”
“এখনো কাঁপছ কিন্তু! ”
নাবিদ আরও একটু কাছে এলো। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল আমার গালের সঙ্গে ঘষলো৷ অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল সমস্ত শরীরে। নাবিদ আরও একটু ঘনিষ্ঠ হলো, প্রথমে নাকের পাশে চুমু খেল, তারপর গালে ও কপালে। আবেশে আমি চোখ বন্ধ করলাম। নাবিদ ফিসফিস করে বলল,
“তুমি এতো দূরে দূরে থাকো কেন? আমি কী অন্য শিবিরের মানুষ! আগ বাড়িয়ে একটু কাছে আসা যায় না!”
আমি বললাম,
“তুমি বা কবে কাছে ডাকলে! তাছাড়া তুমি তো কম্বলও শেয়ার করতে পারো না। ”
নাবিদ হাসলো। বলল,
“ওহ এই ব্যাপার! শীত তো প্রায় চলেই যাচ্ছে। এখন কাছে আসবে তো?”
“ডাকলে আসব। ”
“আর না ডাকলে আসবে না?”
নাবিদ আমার জবাবের অপেক্ষা করলো না। আমিও ভালোবাসা টুকু উপভোগ করতে লাগলাম।
***
বিয়ে নিয়ে আমার রাজ্যের ভয় ছিলো। অচেনা, অজানা মানুষগুলো কেমন হবে! বিছানায় হাত বাড়ালেই যাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় সে না জানি কেমন হবে! সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ ছিলো না। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর নাম পুতুল। পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল কলেজে পড়ার সময়ে। এইচ এসসি পরীক্ষা দিতে পারলো না কারণ বাচ্চা পেটে এসেছিল। পুতুলের সঙ্গে শেষবার যখন দেখা হলো ভীষণ আক্ষেপ করে বলল,
“বিয়ে মানে হলো জীবন টা শেষ হয়ে যাওয়া জরী। নিজের জন্য তখন আর কিছু করা যায় না। ”
আমার কাছে বিয়ে মানে জীবন শেষ হওয়া মনে হয় নি। বিয়ের আগে কতশত পরিকল্পনা করেছিলাম, দূরে কোথাও পালিয়ে যাব। পড়াশোনা করে, চাকরি বাকরি করে ফিরে আসব।
এসব পরিকল্পনা আসলে ভাবনার জগৎ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমি আসলে কিছুই পারতাম না।
নাবিদের সঙ্গে দূরত্ব কমে যাবার পর দারুণ একটা বন্ধুত্বও জমে উঠেছে। আমরা দুজন দুজনের খেয়াল রাখি। আমার প্রতি আম্মার অভিযোগ নেই বলে বাড়ির সকলের কাছে লক্ষিমন্ত বউ। নাবিদও বলে,
“তুমি আসলেই লক্ষি জরী। ”
আমি লাজুক হাসি। নাবিদ আমাকে প্রশ্ন করে,
“তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?”
“হু। তোমাকে বাসলাম যে। ”
নাবিদ হাসে। বলে,
“এখন আর বাসো না?”
“কিজানি!”
“তুমি ভালো হেয়ালি করে কথা বলতে পারো। দেখে বোঝা যায় না?”
“দেখে কী বোঝা যায়?”
“ভীতুর ডিম, লজ্জাবতী। ”
“আমি শুধু তোমার সঙ্গেই এমন হেয়ালি করি। আর কারোর সঙ্গে করিনি। ”
নাবিদ খানিকটা শাসিয়ে বলে,
“আর কারোর সঙ্গে করার কথা ভাববেও না। ”
“যদি ভাবি?”
“খুন হয়ে যাবে তাহলে। ”
আমি শব্দ করে হাসি৷ আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও হাসে।
চলবে…
#লাজুকপাতা
#পর্ব-৬
আমি ভর্তি হবার সুযোগ পেলাম তিতুমীর কলেজে। সাবজেক্ট প্রানীবিদ্যা। ইউনিভার্সিটির ভর্তি যুদ্ধে ছিটকে গেলাম প্রথম দফাতেই। শেষ ভরসা ছিলো জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি। নাবিদ সেখানে পড়াতে চাইলো না। বলল,
“বাসা থেকে এতো দূরে গিয়ে ক্লাস করতে পারবে না তুমি জরী। আর ওখানে একা থাকার তো প্রশ্নই আসে না। তুমি বরং কাছের কলেজেই পড়৷ ”
আমি মেনে নিলাম। নাবিদ ভুল কিছু বলে নি। তাছাড়া অত দূরের পথ জার্নি করা আমার পক্ষেও সম্ভব না।
আম্মা আমার পড়াশোনা মেনে নিতে পারলেন না। কিন্তু নাবিদের মুখের উপরও কিছু বলতে পারছেন না। তিনি আড়েঠাড়ে আমাকে বেশ কয়েকবার বোঝালেন যে পড়াশোনা করে আসলে লাভ কিছু নেই। শেষ অবধি রান্নাঘর ই মেয়েদের আসল জায়গা।
আমি এসব কিছুতে মাথা ঘামাই না। বাপের বাড়িতে থাকাকালীন সময় থেকেই একটা ভালো গুন আমি রপ্ত করেছিলাম। লোকের কথায় মাথা ঘামিয়ে নিজের সময় নষ্ট করব না।
মনি সারাদিন বসেই থাকে। বিকেল হলে সেজেগুজে বেরোয় পাড়ার সমবয়সী কিছু মেয়েদের সাথে। ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে। প্রায়ই মেজাজ খারাপ থাকে। পঞ্চাশ, একশ টাকা নাবিদের কাছে চেয়ে নেয় হাত খরচের জন্য। মুক্তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পড়ে পড়ে কয়েকটা দিন ঘুমালো। তারপর নেমে পড়লো সেলাই মেশিন নিয়ে। সেলাই মেশিন টা আমার মামাশ্বশুরের বাসা থেকে আনা। পুরোনো জিনিস। কলকব্জা প্রায় নষ্ট। সেটাকে পয়সা খরচ করে সারিয়ে জামা কাপড় বানায়। প্রথমে বানালো টাপুর টুপুর এর জন্য জামা। সেই জামা ওদের গায়ে বড় হয়৷ হাতা খুলে পড়ে। আমার সাথে সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো। গল্পটল্প করতে গেলে হাসিমুখে কথা বলে।
আমার অবশ্য গল্প করার সময় নেই। সকালে উঠেই রান্নাঘরে দৌড়াতে হয়। নাবিদের খাবার গুছিয়ে, সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে টাপুর টুপুর কে নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। বাচ্চাদুটো সামনের কেজি স্কুলেই পড়ে। জামিল ভাই মেয়ে দুটোর দিকে ফিরেও তাকান না। এদিকে ওদের মা’ও মেয়েদের খোঁজ খবর নেয় না। মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে নিজেদের মতো। দাদী, ফুপুর আদরের পরিবর্তে থাপ্পড় খেয়ে বড় হচ্ছে।
এই বাড়িতে টুম্পা ভাবীর সম্পর্কে কেউই ভালো কথা বলে নি। আম্মাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন,
“এমন বিষে ভরা মেয়ে মানুষ আমি জম্মেও দেখিনি। তার গুনকীর্তন তোমার শুনে লাভ নাই। ”
মুক্তা কে জিজ্ঞেস করার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,
“তোমার মতোই সুন্দর ভাবী। একটু অন্যরকম সুন্দর। বড়ভাই’র সঙ্গে মানায় না। মোটকথা আমাদের পরিবারে মানায় না। ”
মুক্তার এই গুণ আমাকে চমৎকৃত করেছে। টুম্পা ভাবী ভালো কী মন্দ সে আমি জানিনা। তবে এই যে দোষ টুকু সরাসরি না বলা এটা আমার বেশ লেগেছে।
নাবিদ অবশ্য ভাবীর ব্যাপারে অন্য কথা বলেছে,
“শোনো জরী, দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ। ভাবীর অনেক দোষ ছিলো। হয়তো মায়েরও দোষ ছিলো। তবুও মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। শ্বশুর বাড়িতে চটাং চটাং কথা বলতে হয় না। ”
আমি অনেক কিছুই বুঝি না। এতসব সাংসারিক জটিলতার সম্মুখীন এখনো অবধি হয় নি সম্ভবত আমার সহজাত চুপচাপ স্বভাবের কারণে। তবুও একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর চলতে থাকে। সেই প্রশ্নটা আমি নাবিদ কে করতে পারি না। মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়ার দায়ভার কী শুধু মেয়েদেরই!
***
এই বাড়িতে আমার অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিলো না। তবুও পাচ্ছি তার কারণ বোধহয় টুম্পা ভাবী৷ আম্মাকে একদিন পাশের ঘরে বসে তার দু:সম্পর্কের বোন বলেছিল,
“এই বউয়ের সঙ্গে দজ্জালপানা কম দেখাইস। আগেরবারের কথা মনে আছে! ছি: ছি: ভদ্রঘরের মহিলারা জেল হাজতে থাকে!”
এই একটি কথাতেই আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। অজান্তেই সেই মানুষটির জন্য দোয়া চলে আসে। যাকে আমি কোনোদিন দেখিও নি। আমার টাপুর টুপুর এর মা, যেখানে থাকুক ভালো থাকুক।
চলবে…