বিয়ে পর্ব ২১

0
198

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ২১

ধ্রুব এবার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলো। গাড়ির চাবিটা রাদিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— তোরা যা। আমি ওর সাথে আসছি।
ফ্লোরা শুকনো গলায় বলে ওঠলো,
— তাহলে আমি?
ধ্রুব বলল,
— গাড়িতে করে যাবে।
অদ্রি ফ্লোরার হাত ধরে শক্ত গলায় বলল,
— আমরা তিনজন একসাথে যাবো, আপনি গাড়িতে আন্টিদের নিয়ে আসুন।
ধ্রুব এবার রেগে গেলো,
— তুমি আমার সাথেই যাবে।
অদ্রি গো ধরে বলল,
— যাবো না আপনার সাথে।
ধ্রুব এবার অদ্রির হাত চেপে ধরলো, শক্তভাবে। তারপর দৃঢ় স্বরে বলল,
— আমি যখন একবার বলেছি তখন এটাই হবে।
আর তাছাড়া আমার সাথে না যাওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না!
বলে অদ্রির হাত নিজের মুঠোতেই ধরে রাখলো। অন্যহাত ওর নিজের প্যান্টের পকেটে। গাড়ির ভেতরে বসে বাকিরা কৌতূহল নিয়ে দেখছে দু’জনকে। ধ্রুব শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— নো টেনশন, ও আমার সাথে যাচ্ছে।
ছেলের কথা শুনে শায়লা নিঃশব্দে ওদের দেখলেন। এবার আর বিন্দুমাত্র আপত্তি জানালেন না। ওদেরকে তিনি একা ছেড়ে দিলেন। দিনদিন দু’জনের সম্পর্কটা কেমন হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য আগেও যে স্বাভাবিক ছিলো তা নয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ধ্রুব যে অদ্রিকে চোখে হারায় তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছেন, অদ্রির দিকটাই তিনি বুঝে ওঠতে পারেন না! আবার মা মরা বলে মেয়েটাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করতেও তার দ্বিধা হয়! ধ্রুব রাদিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— সাবধানে ড্রাইভ করিস।

এরপর ওদের গাড়িটা চলে যেতেই ধ্রুব অদ্রির হাত
ধরে নিয়ে এগিয়ে চললো সামনে। আশেপাশে খালি রিকশা খুব কম। ধ্রুব একটা রিকশা ডেকে অদ্রিকে নিয়ে ওঠে পড়লো। আর ওর কান্ড দেখে অদ্রি এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো। এবার নিজের বিরক্তি উগড়ে দিলো,
— হাত ছাড়ুন আমার।
ধ্রুব একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে এরপর হাত
ছেড়ে দিলো। অদ্রি নিচু গলায় বলল,
— পেয়েছেনটা কি আপনি? বাইরের মানুষের সামনে
যা খুশি তাই করবেন?
ধ্রুব তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
— কি করেছি আমি?
অদ্রি কটমট করে বলল,
— জানেন না কি করেছেন?
ধ্রুব রুক্ষ স্বরে বলল,
— জানি। তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি
আমার অপরাধ।
অদ্রি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— আপনি রাদিফ ভাইয়া, ফ্লোরার সামনে এভাবে
কেন ব্যবহার করেছেন? ওদের খারাপ লাগতে পারে, আপনি সেটা ভাবছেন না?
ধ্রুব’র রাগ তীব্র হলো আরও। ওর গলার স্বর আটকে আসছে। চোখমুখ জ্বলছে প্রচন্ড। ও বলল,
— তোমার এজন্য খারাপ লাগছে? এজন্য?
অদ্রি মাথা নাড়লো,
— হ্যাঁ।
ধ্রুব এবার জিজ্ঞেস করলো,
— আমার জন্য লাগছে না?
অদ্রি এবার ওর মুখের দিকে তাকালো। বলল,
— আপনার জন্য কেন লাগবে? কি হয়েছে আপনার?
ধ্রুব তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
— আমার ওয়াইফ আমার খারাপ লাগা চিন্তা না করে অন্য একটা পুরুষের জন্য কনসার্ন দেখাচ্ছে এটা তোমার যুক্তিতে কতোটা ঠিক? ভেবে বলো আমাকে।
অদ্রি প্রায় সাথে সাথেই বলল,
— আমি ওনার জন্য কনসার্ন না।

ওদের কথোপকথনের একপর্যায়ে ওরা পৌঁছে গেলো মলে। ধ্রুব রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিলো। ধ্রুব অদ্রিকে রেখে আগে আগেই হেঁটে গেলো। অদ্রি শুধু ওকে অনুসরণ করলো। ওরা এস্কেলেটরে করে ওপরে চলে এলো। ওখানে এসে শায়লাদের খুঁজে পেলো। এরপর সবাই শপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। শায়লা বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করছে। আর ক’টা দিন পর গ্রামে বেড়াতে যাবে তাই সবার জন্য টুকটাক উপহার নিয়ে নিলো। ফ্লোরা নিজের ইচ্ছেমতো শপিং করলো। অদ্রি সবকিছু কিনলো শায়লার পছন্দে। ধ্রুব রাদিফকে নিয়ে কফিশপে গেলো। অর্ডার কনফার্ম করে ওয়েট করছিলো৷ একটু পর ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেলো ওদের। রাদিফ অনেক গল্প বলছিলো ওকে। ধ্রুব শুধু ফোন চাপছিলো। ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না। শপিং শেষে ওরা ডিনার করতে পাশের বড় একটা রেস্টুরেন্টে গেলো। অদ্রি ধ্রুব’র পাশে বসলো না। বিপরীত দিকের চেয়ারে ফ্লোরার সাথে বসলো। ধ্রুব চুপচাপ লক্ষ্য করছিলো সমস্ত ব্যাপার। ওর খাওয়া হলো না ভালোভাবে। বাড়িতে ফিরতে ওদের প্রায় অনেক রাত হয়ে গেলো।
প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় যে যার মতো শুয়ে পড়লো।
সেদিন ওদের দু’জনের মধ্যে আর কোনো কথাবার্তা হলো না।

এরমধ্যে কিছুদিন কেটে গেলো। অদ্রি এতদিন কোচিং আর পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলো। পরীক্ষা প্রায় এগিয়ে আসায় কোচিংয়ের কোর্স প্রায় শেষ। এখন বাসায় বসেই সবাই নিজেদের প্রস্ততি নিচ্ছে। রাহাত, পরশ, নীরা, অদ্রি সবাই নিজেরা মিলে একদিন ব্যুফে খেতে গেলো। কারণ এরপর সরাসরি আর সবার দেখা না-ও হতে পারে। তবে ফোনে সবার যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু রাহাত বেশ মনক্ষুন্ন৷ এখন আর অদ্রির সাথে প্রতিদিন দেখা হবে না বলে। পরশ ওকে পরামর্শ দিলো অদ্রির ভাইয়ের কাছে ফোন করে তার পছন্দের ব্যাপারটা শ্রীঘ্রই জানিয়ে দিতে।

সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে ফ্লোরা, রাদিফের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো অদ্রি। ধ্রুব অফিস থেকে ফিরে দেখলো ওদের। ওকে দেখে শায়লা কফি বানিয়ে অদ্রির হাত দিয়ে পাঠালো। ব্যাপারটা দেখে ফ্লোরা টিজ করতে লাগলো। অদ্রি প্রচন্ড লজ্জা পেলো। রাদিফও মজা নিতে লাগলে অদ্রি হেসে ফেললো। এই দৃশ্য দেখে ধ্রুব কফি না খেয়েই নিজের ঘরে চলে এলো। রাতের খাওয়া শেষ করে অদ্রি এসে দেখলো ঘরের আলো নিভানো। বাইরের মস্ত চাঁদে আলোকিত পার্থিব। ধ্রুবকে সে ঘরে দেখতে পেলো না। ব্যলকনির দরজা আধখোলা, সেখান থেকে ধোঁয়া ওড়ছে। অদ্রি সন্দেহ নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দরজা ঠেলতেই দেখলো ধ্রুব রকিং চেয়ারে বসে আছে। ওর চোখ বন্ধ। হাতে সিগারেট। সেখান থেকে ধোঁয়া ওড়ে বাতাসে মিলে যাচ্ছে। ধ্রুব সিগারেট টানছে! দৃশ্যটা দেখে অদ্রির বুক কেঁপে ওঠলো। ও ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ধ্রুব’র দিকে।
মানুষটার সাথে আজকাল তেমন কথা বলা হয় না।
ধ্রুব আর আগের মতো নেই। আগের মতো ওকে খোঁচা
দেয় না, বেঁফাস কথাও বলে না। অদ্রি মনে মনে আগের সেই ধ্রুবকে মিস করে। কিন্তু মুখে স্বীকার করে না।
কারোর অস্তিত্ব টের পেয়েও ধ্রুব চোখ না খুলেই ধীর গলায় বলল,
— কে?
অদ্রি ছোট্ট করে বলল,
— আমি।
অদ্রির কন্ঠস্বর শুনে ধ্রুব চুপ থাকলো। এবার অদ্রি অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— সিগারেটটা ফেলুন।
ধ্রুব শুনলো না ওর কথা। আজ আর নিজেকে সামলালোও না। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো অদ্রির দিকে। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেঁচকা এক টানে নিজের উরুর ওপর বসিয়ে দিলো অদ্রিকে। তারপর পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে নিজের মুখ রাখলো। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
— ফেলবো না। কি করবে তুমি?
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো অদ্রি। ও কাশতে কাশতে বলল,
— হচ্ছেটা কি? ছাড়ুন আমাকে…
— ছাড়বো না। কি করবে তুমি?
অদ্রি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু ধ্রুব আরো শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলো। অদ্রি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
— আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো আসবো না।
ধ্রুব জোরালো গলায় বলল,
— আসতেই হবে।
অদ্রির সর্বাঙ্গে ভয়, জড়তা, অস্বস্তি এসে ভর করে। ওর নখ বসে গেছে ধ্রুবর হাতে। ধ্রুব আরও বলল,
— প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত, এমনকি এক্ষুনি করা ঘটনাটার জন্যও ক্ষমা চাইছি অদ্রি। আমি তখন ভুল ছিলাম, তোমাকে অনেক খারাপ কথা বলেছি, হার্ট করেছি যেগুলো করা আমার উচিৎ ছিলো না। আজ থেকে এ ঘরের সমস্ত কিছু তোমার, এমনিক আমিটাও।
অদ্রি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
— দান করছেন?
ধ্রুব বলল,
— উহু! তোমার অধিকার দিচ্ছি।
অদ্রি শুকনো গলায় বলল,
— আমি তো চাইনি।
ধ্রুব অদ্রির অপ্রস্তুত হওয়াটা বুঝতে পারে। ও শীতল গলায় বলে,
— চাইতে হয় না অদ্রি। যখন থেকে তুমি আমার হয়ে গেছো, তখন থেকে আমিসহ আমার সমস্ত কিছু তোমার হয়ে গেছে।
অদ্রি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাবো এখান থেকে।
ধ্রুব রেগে গেল,
— বেরিয়ে কোথায় যাবে? রাদিফের সাথে গল্প করতে? কেন বুঝো না অদ্রি আমি নিতে পারি না, আমার কষ্ট হয় তোমাকে অন্য কারোর সাথে দেখলে।
অদ্রি কম্পিত কন্ঠে বলল,
— আমি কেন যাব ওনার সাথে গল্প করতে? আর আপনি এগুলো কেন বলছেন?
ধ্রুব অদ্রির চোখে চোখ রাখে। অদ্রি সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। ও চোখ সরিয়ে নেয়। ধ্রুব কাঁপা কন্ঠে বলে,
— কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার বিয়ে করা স্ত্রী। তুমি আমার অধিকার।
অদ্রি ধ্রুব’র হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিলো। ধ্রুব ওকে আগের থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— তোমাকে ছাড়া আমার আজকাল নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় অদ্রি। তুমি রাদিফের সাথে আর কখনোই গল্প করবে না। আমি তোমার অবজ্ঞা, অবহেলা মেনে নিতে পারি, কিন্তু অন্য কারোর সাথে তোমাকে আমি নিতে পারি না।
বলতে বলতে ধ্রুব অদ্রির ঘাড়ে মুখ ডুবালো। অদ্রি কেঁপে ওঠলো। নিজেকে ছাড়িয়ে হুট করে
ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
ধ্রুব অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যেন! ডেস্পারেট হয়ে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। অদ্রি পিঠে প্রচন্ড ব্যথা পেলো, চোখ ছলছল করে ওঠলো। ধ্রুব রাগী কন্ঠে বলল,
— সবসময় তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমি নিজের করা সমস্ত ভুল স্বীকার করে নিলাম এরপরেও তুমি আগের মতো ব্যবহার করবে আমি সেটা মেনে নেবো না কিছুতেই।
অদ্রির চোখে এবার সত্যিই জল চলে এলো। ধ্রুব কি বুঝতে পারছে না ওর লাগছে? এদিকে ধ্রুব বলতেই থাকলো,
— এডমিশনের পরে যদি আমার থেকে দূরে যেতে চাও তাহলে কখনোই ভালো হবে না।
অদ্রির হৃদযন্ত্র গতিশীল। মুহূর্তে মেরুদণ্ড বরাবর তীক্ষ্ণ শীতল স্রোত নেমে যায়। ও এবার শক্ত গলায় বলল,
— আপনি আমাকে কেমন ভালোবাসেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এতদিন তো আমার সাথে ভালো করে কথাও বলেন না। আর এখন আমার যে লাগছে সেটাও তো আপনি বুঝতে পারছেন না।
ধ্রুব ওর কপালে কপাল ঠেকালো। এরপর আচমকা চোখমুখে অসংখ্য চুমু দিতে দিতে বলল,
— আমার ব্যথা এরচেয়ে ভয়ংকর।
অদ্রি এবার জোরে ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলো। ধ্রুব নিজের মধ্যে ফিরে এলো, ও হাঁপাচ্ছে। অদ্রি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— আপনি ভালোবাসতে জানেন না। খুব স্বার্থপর…

[ দুঃখিত। পরের পর্ব বড় করে দেবার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here