#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১৬
ধ্রুব ভাবনার প্রহর কাটিয়ে বিছানায় বসে। হাতে থাকা খামটা খুলেই ওর চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে যায়!
দেখে সেখানে এক হাজার টাকার বেশকিছু নোট, সাথে একটা চিরকুট। ধ্রুব বুঝতে পারে না এগুলো কিসের টাকা। ও চিরকুটটা খুলে দেখে সেখানে লেখা,
“মিস্টার ইফতেখার হাসান। এটা গতমাসের রুম ভাড়া। আপনার পাওনা পরিশোধ করলাম। রাগারাগি করে লাভ হবে না, এগুলো আমি ফেরত নেবো না। এখন ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তে বসবো। ডিস্টার্ব করবেন না। কেমন? আর একটা কথা, জরিনার মতে আপনি আসলে বেশ সুদর্শন একজন পুরুষ। কিন্তু আমার মতে আপনি আপনার বাজে অভ্যেস বাদ দিতে পারলে সত্যিকারের সুর্দশন পুরুষে পরিণত হবেন।”
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। ওর মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। টাকা পেয়ে রাগবে নাকি অদ্রির থেকে ছোট প্রশংসা শুনে আনন্দিত হবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তখনি শায়লা ঘরে ঢুকলেন। তার চোখমুখ দ্বিধাগ্রস্ত। পেছনে জরিনা, ওর হাতে ঝাড়ু। মা’কে দেখে ধ্রুব’র ধ্যান কাটলো। জিজ্ঞেস করল,
— কখন ফিরলে?
— ফিরলাম একটু আগেই। কি করছো? অফিসে কাজের চাপ বেশি নাকি?
— হ্যাঁ, ইদানীং বেশিই। তবে ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেলে একটা ভালো ব্রেক পাবো।
শায়লা ছেলের পাশে বসলেন। ধ্রুব’র সাথে এখন বেশ স্বাভাবিক আচরণ করেন। শায়লা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ধ্রুব হাসলো। মায়ের এই আচরণ তার চেনা। ওকে কোনো বিষয়ে রাজি করতে হলে তিনি ধ্রুব’র মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এটা তার অভ্যেস। বিয়েতে রাজি করানোর সময়ও শায়লা ঠিক এভাবেই ধ্রুব’কে কনভিন্স করেছিলো। ও জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবে?
শায়লা ইতস্তত করে বললেন,
— তেমন কিছু না….
এরপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠলো,
— মেজো ভাই ফোন করেছিলো।
— কেন?
শায়লা হাসান মনে মনে কথাগুলো সাজালেন। কিভাবে ছেলেকে রাজি করানো যায় ভাবলেন। ধ্রুব গ্রামে যেতে চায় না। শুনলেই রাগ দেখায়। কিন্তু কি আর করার! মা তো চাইছেন নাতির বউ দেখতে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— আম্মার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। তাই ওরা আবিদার বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাছাড়া অদ্রিকেও তো আম্মা দেখেনি, ওনি নাতির বউ দেখতে বায়না করেছেন। বড় ভাই তো এখনো বেশ রেগে আছে এখনো কেন অদ্রিকে নিয়ে আমরা গ্রামে যাইনি। সামনের মাসে গ্রামে যাবো। আগেই জানিয়ে রাখলাম তোমাকে। গল্পটা আজকাল নানা জায়গায় কার্টেসী ছাড়া কপি হচ্ছে, এর মূল লেখনীতে আছে ইসরাত জাহান ফারিয়া।
ধ্রুব বিরক্তিবোধ করলো। ওর গ্রাম তেমন ভালো লাগে না। সেখানের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে ওর সমস্যা হয়। ওর বড় মামা আইয়ুব আলী একদম গ্রাম আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষ। রাগীও বটে। বাড়ির কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে তাহলে তার ভাত খাওয়া বন্ধ। গ্রাম ছেড়ে শহরের পরিবেশে নাকি তার দম বন্ধ হয়ে আসে। ধ্রুব’র বিয়ের পর যখন আত্মীয়রা অদ্রিকে দেখতে এসেছিলো তখনো তিনি আসেন নি। তার এক কথা, বৌমাকে গ্রামে যেতে হবে।
সারাক্ষণ বাড়ির সবাই তার ধমকির ভয়ে থাকে। এছাড়া বাড়িভর্তি একগাদা কাজিনের হুল্লোড়ের ভেতর ধ্রুব খুবই বিরক্তিবোধ করে। এসব নানা কারণে ধ্রুব নিজে থেকে কখনো গ্রামে যেতে চায় না। কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে ও প্রতিবার যেতে বাধ্য হয়। তাছাড়া নানুকে সে খুবই ভালোবাসে। নানুর শরীর খারাপ শুনে সে গ্রামে যেতে অনিচ্ছাবশত রাজি হয়। জরিনা এসেছিলো ঘর ঝাড়ু দিতে। মা-ছেলের কথোপকথন শুনে সে হেসে শায়লাকে বলে,
— কি গো খালাম্মা নানি যে কইয়া দিসে শ্রীঘ্রই আপনের নাতিনাতনি দেখতে চায়, হেইডাও কন ভাইজানরে!
জরিনার মুখে এ কথা শুনেই ধ্রুব বিস্মিত হলো। শায়লা জরিনাকে চোখ রাঙলেন। ধ্রুব’কে অপ্রস্তুত হতে দেখে জরিনাকে ধমকে বললেন,
— কাজ শেষ তোর? এত কথা বলিস কেন! আমরা কখন নাতি-নাতনির মুখ দেখবো আল্লাহ ভালো জানেন। আম্মা চাইলেই তো আর হবে না।
বলতে বলতে শায়লা জরিনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ধ্রুব মায়ের মুখে এ কথা শুনে বিস্মিত বোধ করলো। তার নানু বয়সের ভারে এখন এমন অনেক কথাই বলেন। কিন্তু মা কেন এমন একটা কথা বললো? সে-ও কি তার নাতিনাতনি দেখতে চায় নাকি? ধ্রুব হতাশ হয়ে দু-হাত মেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এটা তখনই সম্ভব যখন অদ্রি রাজি হবে। কিন্তু ও তো এমন ত্যাড়া একটা মেয়ে, যে এখনো নিজের ঘরে নিজেই ভাড়া দেয়। ধ্রুব হেডবোর্ডে ঘুষি দিলো, খুব আফসোস হলো কেন সেদিন রুম শেয়ার করার ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলো। প্রথম থেকে সবকিছু ঠিক থাকলে মা-বাবাকে দাদা-দাদি হওয়ার মতো আনন্দের খবরটা এতদিনে দিয়েই দিতো! তারপর বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা খামের ভেতরের টাকাগুলোর দিকে নজর পড়তেই ধ্রুব ভাবতে লাগলো এখন ওর ঠিক কি করা উচিৎ? ও তো আর কাপুরষ নয় যে বউয়ের টাকা ছুঁবে। আর জেদি অদ্রিও তো ফেরত নেবে না। উল্টে কথা শোনাবে! ধ্রুব অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলো এই টাকা দিয়ে সে অদ্রিকে কিছু একটা গিফট করে দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। এর দু’দিন পর ধ্রুব নিজে পছন্দ করে একটি ব্র্যান্ডেড ঘড়ি কিনে আনলো। মা’কে দিয়ে সেদিনের মতোই অদ্রির কাছে পাঠালো। অদ্রি বারবার জেদ করছিলো এরকম দামী একটি ঘড়ি নেবে না বলে। কিন্তু শায়লার কথার জালে জড়িয়ে ও সেটা নিতে বাধ্য হয়। এদিকে ধ্রুব মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। অদ্রির টাকা ওর কাছেই থাকলো! ও কি ভেবেছে ওর নিজেরই আত্মসম্মান আছে আর ধ্রুব’র নেই? হুহ! অদ্রি চলে ডালে ডালে আর ধ্রুব পাতায় পাতায়!
এরমধ্যেই আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। সকালে নিয়মমাফিক অদ্রি কোচিংয়ে গেলো। রাহাতের কিছু শিট অনেকদিন ওর কাছে ছিলো। কোচিং শেষে বেরুনোর সময় অদ্রি রাহাতকে ডাক দিয়ে বলল,
— রাহাত, এদিকে একটু আসবে?
রাহাত অদ্রির ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালো। ও লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
— বলো!
অদ্রি ব্যাগ থেকে নোটসগুলো বের করে ফেরত দিতে দিতে বলল,
— থ্যাংকস। বাট নোটগুলো এত খাম-খেয়ালিভাবে ফেরত দিলাম এজন্য স্যরি।
রাহাত নোটসগুলো হাত বাড়িয়ে নিলো। অদ্রির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
— দিস ইজ নট ফেয়ার। বন্ধুত্বের মাঝে নো স্যরি।
অদ্রি হেসে বলল,
— তাই তো!
— পড়া কতদূর?
— অনেককিছুই বাকি রয়ে গেছে। তোমার কি অবস্থা?
রাহাত উত্তরে বলল,
— অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছি, বাকিটা আল্লাহ ভরসা। দেখা যাক কি হয়!
এভাবেই ওদের মধ্যে নানা বিষয়ে কথা হতে লাগলো। রাহাত আর অদ্রিকে কথা বলতে দেখে নীরা এগিয়ে এলো৷ সে-ও ততদিনে অদ্রির বেশ কাছের বান্ধবী হয়ে ওঠেছিলো। সম্পর্কটা ‘তুমি’ থেকে ‘তুইতে’ নেমে এসেছে। ও এসেই হাসতে হাসতে বলে ওঠলো,
— কি? দু’জনে কি নিয়ে গুজুরগুজুর করিস? তা-ও আবার আমাকে ছাড়া?
রাহাত মজা করে বলল,
— আমাদের সিক্রেট? তোকে কেন বলবো?
নীরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
— সিক্রেট? আমাকে কেন বলবি না? কি চলছে দু’জনের ভেতর? দু’জনে মিলে প্রেম-ট্রেম করছিস মনে হচ্ছে! ঠিক কি-না হুম?
রাহাত অপ্রস্তুত হলো। অদ্রি হতভম্ব হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বলল,
— ছেলে-মেয়ে একসাথে কথা বললেই ‘প্রেম করে’ তকমা দেওয়াটা কি খুব জরুরি? আমি ওকে নোটস ফেরত দিচ্ছিলাম।
নীরা ধীর গলায় বলল,
— আমি তো মজা করছি….
অদ্রি জোর গলায় বলল,
— এ ধরনের মজা আমার ভালো লাগে না।
রাহাত অদ্রিকে লক্ষ্য করছিলো। এবার ও বলল,
— সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেন? ফ্রেন্ডদের মধ্যে এধরণের কথাবার্তা মজা করে একটুআধটু বলে …
অদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নীরার হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,
— আমার ওসব শুনে অভ্যেস নেই তাই হয়তো রিয়েক্ট করে ফেলেছি। স্যরি।
নীরা হেসে ব্যাপারটা ওড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ইট’স ওকে দোস্ত।
তখনি ওকে নিতে যতীন চলে এলো। অদ্রি ওদেরকে বলল,
— আসছি।
নীরা হাত নেড়ে বলল,
— সাবধানে যা। টেক্সট করলে রিপ্লাই করিস।
— ওকে!
রাহাত এতক্ষণ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। অদ্রির ব্যবহার ওকে খুব ভাবাচ্ছে। নীরা যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে কথাটা বললো তখন ওর রিয়েকশনটা লক্ষ্য করেছে রাহাত। কেমন যেন অদ্রি ব্যাপারটা মানতে পারছিলো না৷ সেটা লজ্জাবোধের জন্য নয়। রাহাতের আচমকা মনে হলো ওর জন্য অদ্রির মনে সামান্যতম অনুভূতিও নেই। তবুও সে নিজের মনকে বোঝালো, অদ্রির মন সে জিতে নেবেই। আরো একটু সময় নিয়ে সে পরশের প্ল্যানমাফিক ট্রাই করে দেখবে। দুজনের প্রেম না হোক, অন্তত ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গী হিসেবে অদ্রিকে পেলেই চলবে তার!
যতীন আস্তেধীরে ড্রাইভ করছে। প্রকৃতি মনমরা। রুক্ষ দুপুরে রোদের তাপ নির্লিপ্ত। আকাশ কেমন কালচে হয়ে আছে। একসাথে দলবেঁধে ওড়ে যাচ্ছে সাদা বকের দল। বৃষ্টি আসার আগ মুহূর্ত! ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে ওঠছে অদ্রি। ও মনে করার চেষ্টা করলো এখন কোন সিজন চলছে, বর্ষা নাকি! অদ্রির মন খুব বিষণ্ণ হয়ে আছে। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখায় মগ্ন হতে পারছে না অন্যদিনের মতো। তখন নীরা কেন বললো ওরকম একটা কথা? রাহাতের সাথে ওকে দেখে কি এমন মনে হয়? তাহলে অদ্রি আর ওর সাথে মিশবে না। নীরা হয়তো মজা করেই বলেছে, কিন্তু অদ্রি তো কোনোদিনই রাহাতকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি। ইভেন ভাবতে চায়ও না। ওর মনে পড়ে, নীরা এর আগেও প্রায়ই রাহাতকে নিয়ে এ ধরনের কিছু ইঙ্গিত করেছে। তখন অদ্রি বুঝতে পারে নি। অদ্রি অস্বস্তি পরিস্থিতি পড়ে যায়। পৃথিবী জানে না, কিন্তু অদ্রির মন জানে কতটা হৃদয় দিয়ে সে একটি মানুষকে আজকাল চায়। সে ছাড়া অন্য কাউকে অদ্রি তার মনের আশেপাশেও আনার চিন্তাও করতে পারে না। অদ্রি জানে এটা মোটেও সহজ কাজ নয়। তবে কখন যে মানুষটার প্রতি ওর ভেতর মায়া, প্রেম, দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা জেগে ওঠেছে সেটা ও নিজেও জানে না। মানুষটা ওর চোখের আড়াল হলেই ওর জন্য অদ্রির মন কেঁপে ওঠে, পুরো পৃথিবীর বিনিময়েও অদ্রি ওকে হারিয়ে ফেলতে চায় না। আচ্ছা এটা কি ভালোবাসা? যেটা ত্যাগমিশ্রিত স্বার্থপর এক জিনিস!
কিন্তু অদ্রির যখন ওর মা-বাবা’র কথা মনে পড়ে তখন
ওর পুরো পৃথিবীটাই কালচে আঁধারে ঢেকে যায়। ও আজ-ও মেনে নিতে পারে না বাবার করা বিট্রে। তখন ওর মনে হয় ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই। সবাই শুধু অভিনয় করে বেড়ায় জীবনভর। অদ্রির ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। ওর মনের ভেতর একটা ইদানীং ক্ষুদ্র একটা দ্বিধা ঢুকে আছে। এডমিশনের আর কিছুদিন বাকি, এরপর ও কি করবে? ধ্রুব’কে তো বলেই দিয়েছে সে এখান থেকে চলে যাবে। কিন্তু এরপরে কি হবে সেটা তো এখনো ভাবা হয়নি! অদ্রি গালে হাত দিয়ে ভাবে, আচ্ছা ধ্রুব কি ওকে যেতে দেবে? আটকাবে না? সারাক্ষণ গম্ভীর এবং কঠিন কথা বলা মেয়েটা মা মারা যাওয়ার পর এতদিন অবধি যা করেনি, গাড়ির ভেতরে বসে তা-ই করে ফেললো। অদ্রি দু’হাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো।
[ কেমন হচ্ছে জানাবেন তো।]
চলবে…