#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৫|
ধবধবে সাদা রঙে ঘেরা একটি আলিশান বাড়ি। চারপাশের ভূমি গাঢ় সবুজ, কৃত্রিম ঘাসে সজ্জিত। গাড়ির ভেতর থেকে এ পর্যন্ত দেখে ধীরেসুস্থে নেমে দাঁড়াল সৌধ। সুহাসকে ইশারা করল চটজলদি বেরুতে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে সুহাসের। উত্তেজনায় তলপেট মুচড়ে, মুচড়ে ওঠছে। চোখ, মুখের অবস্থা নাজেহাল। কণ্ঠনালি ক্ষণে ক্ষণে নীরস হচ্ছে। হৃৎস্পন্দন চলছে বিদ্যুৎ গতিতে। সৌধর ইশারা পেয়ে ধাতস্থ হলো। সচেতন ভাবে এক ঢোক গিলে নেমে দাঁড়াল গাড়ি থেকে। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ঝকঝকে, চকচকে আকর্ষণীয় বাড়িটায়। নিমেষে বুকের ভেতর হুহু করে ওঠল। আচমকা একটি হাত চলে গেল বুকের বা’পাশে। কী ভয়ানক ভাবে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা! নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না সুহাস। অদৃশ্য কোনো এক সুতোয় যেন বাঁধা পড়ল তার সমস্ত সত্তা। সৌধকে রেখেই কোনোদিকে না তাকিয়ে তরান্বিত হয়ে এগিয়ে গেল।
সৌধ বুঝতে পারল ওর অনুভূতি। তাই কিছু না বলে নিজেও ছুটে গেল। যেতে যেতে বাড়ির চারপাশটায় নজর বুলালো সুক্ষ্ম ভাবে। সম্মুখের একপাশ জুড়ে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম পশুপাখির মূর্তি, নাম জানা এবং না জানা অনেক ফুল গাছের সমাহার। আরেক পাশে পাশাপাশি দু’টো দোলনা, রাজকীয় একটি ডিভান আর সুইমিং পুল। এ বাড়ির মালিক ভীষণ রুচিশীল। বাড়ির সম্মুখে ছোটোখাটো, স্বচ্ছ, সুন্দর, আকর্ষণীয় পার্ক দেখে বাড়ির সদস্যদের প্রতি মনে মনে ইতিবাচক ধারণা করল সৌধ। ওরা দু’জন যখন সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপবে ভাবল ঠিক সেই মুহুর্তেই দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো, ধবধবে ফরসা দেহের বলিষ্ঠ এক পুরুষ। সৌধ, সুহাস দু’জনই থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল। সম্মুখের পুরুষ লোকটি চোখে মুখে দীপ্তি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সুহাসের দিকে। বলল,
‘ হ্যালো, আই এম আব্রাম হক অ্যালেন। নামী’স বেস্ট উইশার। ‘
স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বাড়াল সুহাস। অ্যালেন হাত মিলিয়ে সৌধর দিকেও হাত বাড়াল। সুহাস পলকহীন অ্যালেনকে দেখতে লাগল। ঢোক গিলল নীরস গলাটা ভেজাতে। ওর হৃৎস্পন্দন এবার থমকে আছে। কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মস্তিষ্ক। কুর্ণিশ শেষে ওদের দু’জনকে ভেতরে নিয়ে গেল অ্যালেন৷ সৌধ সুহাসের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতা দিল। নিচু স্বরে বলল,
‘ ভেড়ার মতো মুখ করে না থেকে মানুষের মতো থাক। নিজের বউ বাচ্চার কাছে আসছিস। আব্রাম হক অ্যালেনের না। ‘
সৌধর এহেন কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস। শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে ওঠল৷ নিমেষে উথাল-পাতাল শুরু হলো বুকে। নামী কোথায়? তার সন্তান কোথায়?
ওরা ভেতরে প্রবেশ করলে ড্রয়িংরুমে দু’জন ভদ্রমহিলা আর একটি ছোটো বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেল। ভদ্রমহিলাদের মধ্যে যার বয়স কম সে হুইলচেয়ারে বসা। অ্যালেন তাদের দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল,
‘ আমার মা আর স্ত্রী উইরা। ‘
অ্যালেনের চেহেরায় বাঙালির চিহ্ন বলতে ওই চোখ দু’টোই। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, চুল গুলোও ব্রাউন কালার। তাই বাংলা বলাতে বিস্মিত হয়েছিল সৌধ, সুহাস। সেই বিস্ময় কাটিয়েছে অ্যালেন নিজেই৷ সগর্বে জানিয়েছে তার শরীরে বাঙালির রক্ত বইছে। অ্যালেনের বয়সটা ঠিক আঁচ করতে পারছিল না ওরা দু’জন৷ কিন্তু স্ত্রীর পরিচয় পেয়ে বুঝতে পারল ভদ্রলোক তাদের থেকে ঢের সিনিয়র। স্বস্তি পেল সুহাস। অ্যালেন বিবাহিত। হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল ছেলেটা। এরপর অ্যালেন অ্যারিনের সঙ্গে পরিচয় করানোর পূর্বেই গুটিগুটি পায়ে অ্যারিন সামনে এসে দাঁড়ায়। দু-হাত কোমরে রেখে পিটপিট করে তাকিয়ে সৌধ, সুহাসকে দেখে নিয়ে অ্যালেনকে প্রশ্ন করে,
‘ পাপা, হুইচ ওয়ান ইজ সহৃদ’স ফাদার? ‘
সৌধর চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। ভাবল, সুহাসের ছেলের নাম তাহলে সুহৃদ? চমৎকার! সুহাস স্তম্ভিত! সুহৃদ? তাদের ছেলের নাম সুহৃদ রেখেছে নামী? মেয়ের প্রশ্নে অ্যালেন স্মিত হাসে প্রথমে সৌধ, সুহাসকে বলে,
‘ আমার একমাত্র মেয়ে অ্যারিন হক। ‘
এরপর অ্যারিনকে ইংরেজিতে বলে,
‘ তুমি দু’জনকে দেখে চিহ্নিত করো তো পাপা কোনটা সুহৃদের পাপা? ‘
ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল অ্যারিন৷ দু’জন আংকেলই ভীষণ স্মার্ট। সুহৃদও স্মার্ট বেবি। তাহলে সে বুঝবে কী করে কোনটা ওর পাপা? অ্যারিন চিন্তায় মশগুল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে সৌধ, সুহাসকে। অ্যালেন ওদের বসতে বলল। সৌধ বসলেও সুহাস বসল না। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
‘ নামী? ‘
সুহাসের অস্থিরতা আর চোখ দু’টো দেখে অ্যারিন হঠাৎ চ্যাঁচিয়ে ওঠল৷ হাত তালি দিতে দিতে বলল,
‘ সুহৃদ’স ফাদার! ‘
অ্যালেন মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ টিপ্পু মাসিকে বলো, সুহৃদকে নিয়ে আসতে। ‘
সুহাসের বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল। অ্যালেনের মা চলে গেল, গৃহকর্মীদের অতিথি আপ্যায়নে তাড়া দিতে। সুহাসের অবস্থা তখন বিধ্বস্ত প্রায়। সৌধ টের পেল অত্যাধিক উত্তেজিত হওয়ার ফলে ওর নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। তীব্র শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ এক পর্যায়ে শরীরে জড়ানো শীতের পোশাকটা খুলে ফেলল সুহাস৷ বন্ধুর অবস্থা দেখে সৌধ আর চুপ থাকতে পারল না। অ্যালেনকে জিজ্ঞেস করল,
‘ মিস্টার অ্যালেন, নামী কোথায়? ‘
সৌধর এ প্রশ্নে অ্যালেনের মুখে হাসি বিলীন হয়ে গেল। অচঞ্চল পায়ে এসে বসল সৌধর পাশে। সুহাসের দিকে এক পলক তাকিয়ে মৃদু গলায় সৌধকে বলল,
‘ অনেক বুঝিয়েছি। সে কিছুতেই মিস্টার সুহাসের সামনে আসতে রাজি হলো না৷ তার বক্তব্য আপনারা যতদিন এখানে থাকবেন ততদিন মিস্টার সুহাস তার সন্তানের সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করার সুযোগ পাবে। বাকি সব ফয়সালা দীর্ঘ কিছু মাস পর বাংলাদেশে গিয়ে করবে৷ ‘
আকস্মিক যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল সুহাসের। সৌধ হতবাক! এ কেমন ছেলেমানুষী? অ্যালেন সুহাসের কাঁধে হাত রাখল। বিনয়ের সুরে বলল,
‘ মিস্টার সুহাস, হতাশ হবেন না৷ আপনার স্ত্রীর অভিমান ভীষণ প্রকট। দুর্ধর্ষ জেদ। নিঃসন্দেহে ভেতরে ভেতরে আপনার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা লালন করে সে। কিন্তু অদৃশ্য এক রাগ, জেদ আর তীব্র অভিমানের বেষ্টনে তা প্রকাশ করতে পারছে না৷’
অ্যালেনের স্বান্তনা বাণী কাজে দিল না। স্থির নেত্রে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুহাস৷ বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। অস্থির চিত্তে বলল,
‘ নামী কোথায় মিস্টার অ্যালেন? আমি নামীর কাছে যাব। ওকে বলুন আমি এসেছি, ওর সুহাস এসেছে। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি৷ স্টিল নাও স্বীকারও করছি৷ হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব। তবু প্লিজ ওকে আমার সামনে আসতে বলুন। আমি আর নিতে পারছি না, পারছি না নিতে৷ ‘
মন, মস্তিষ্ক জুড়ে তীব্র এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বদ্ধ উন্মাদের মতো এক শব্দ, এক বাক্য বারবার উচ্চারণ করতে লাগল সুহাস। অ্যালেন আশ্চর্য হয়ে গেল সুহাসের অস্থিরতা দেখে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন যুবক কতটা ছেলেমানুষ হতে পারে স্বচক্ষে দেখে নিল সে। শুধু তাই নয়। নামীর মতো শক্ত ধাঁচের মেয়ের জীবনে এমন সরল, উন্মাদ প্রেমিকের সরূপ দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ তার বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়৷ সুহাস ঠিক তাই হয়েছে। যতটুকু বুঝেছে নামীও এই ছেলেকে ভালোবাসে। তবে কেন এই দূরত্ব? দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে, মেয়ের এই ছেলেমানুষি কি শোভা পায়? সম্পর্ক, ভালোবাসা, সন্তানের চেয়েও কি অভিমান, জেদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সহসা একটি কথা মনে পড়ে গেল অ্যালেনের। নামী সব সময় বলে, তার কাছে জীবনের চেয়েও সম্মান বড়ো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অ্যালেন৷ স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের পানে। সৌধ ওকে সামলানোর চেষ্টা করেও সামলাতে পারল না৷ শেষে বাধ্য হয়ে যে নাম্বার থেকে নামী তাকে ফোন করেছিল সেই নাম্বারে কল করতে উদ্যত হলো। দু’জন গৃহকর্মী হালকা নাস্তা নিয়ে এসেছে। ত্বরিত সেগুলো টেবিলে রেখে চলে গেল তারা৷ এরপরই বেবি রকারে সুহৃদকে নিয়ে হাজির হলো টিপ্পু মাসি আর অ্যারিন। ফলশ্রুতিতে সৌধর আর নামীকে কল করা হলো না৷
টিপ্পু মাসি ফিরে গেল। নামীর অবর্তমানে সুহৃদের দেখভাল সেই করে। ভেতর ঘর থেকে অ্যারিনকে শিখিয়ে দিয়েছে নামী৷ সুহাসকে জানাতে সুহৃদের পুরো নাম। তাই অ্যারিন ইংরেজিতে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
‘ সুহাস আংকেল, আপনার ছেলে – নুহাস খন্দকার সুহৃদ। ‘
সহসা সকল উত্তেজনা মিলিয়ে গেল সুহাসের। বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, একটি ছোট্ট, কোমল নিষ্পাপ শিশু। যার শুভ্র দেহের, কোমল মুখটায় চোখ পড়া মাত্র সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল৷ ছোট্ট গোলগাল মুখটার টকটকে ঠোঁট, লম্বা নাক, ধূসর বর্ণের ছোট্ট ছোট্ট দু’টি চোখ আর মাথা ভর্তি হালকা ব্রাউন কালার চুল দেখে হৃদয় জুড়ে অনুভব করল শীতল শিহরণ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার সৌধর দিকে চোখ ফিরাল। টলমল হয়ে ওঠল দৃষ্টি। চোয়ালদ্বয় কাঁপছে। মিলিয়ে যাওয়া উত্তেজনা পুনরায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে সামলাতে না পেরে ডান হাতটা ওঠিয়ে মুখে সামনে নিয়ে একবার কামড়ে ধরল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সৌধকে বলল,
‘ আমার ছেলে! ‘
একটু থেমে ফের বলল,
‘ আমার সন্তান আমাকে চেনে সৌধ। সেদিন লেকের পাড়ে পাপা ডেকেছিল ওই তো! কী কপাল আমার প্রথম দর্শনে ছেলেকে চিনতে পারিনি, ছুঁতে পারিনি। ছেলে কিন্তু ঠিক বাবাকে চিনতে পেরেছে। ‘
চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেল সৌধর। বিস্ময়ে শিহরণ জাগল শরীর জুড়ে। হতভম্ব হয়ে গেল অ্যালেনও। পুরো বিষয়টা বুঝে ফেলল সৌধ। আচমকা সুহাসকে জাপ্টে ধরে স্বাভাবিক করতে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ! পৃথিবীতে কোইন্সিডেন্স শব্দটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি সুহাস৷ নিজেকে সামলা। ভাতিজা আমাদের মাশাআল্লাহ। যেমন দেখতে তেমনি ট্যালেন্ট। নজর না লাগুক৷ ‘
বন্ধুর বুকে বুক মিলিয়ে পিঠে শক্ত করে চাপড় দিতে দিতে ফের বলল,
‘ দেখ কীভাবে তাকিয়ে আছে। কাছে যা ব্রো, কাছে যা বুকে আগলে নে। এই বাচ্চাই তোকে আর নামীকে এক করবে দেখে নিস৷ তুই জাস্ট মাথাটা ঠান্ডা রেখে সব সামলে যা। ‘
নিজেকে সামলালো সুহাস। ধাতস্থ হয়ে চোখের পানি মুছে তাকাল সুহৃদের দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সুহৃদ। সুহাস, সৌধ ওর দিকে তাকাতেই এক পাশে মাথা কাত করে হাসল। সৌধর মুখটা হা হয়ে গেল বাচ্চার কাণ্ড দেখে। আর সুহাস ছেলের স্বাগতম পেয়ে আবেগে টইটুম্বুর। চোখ, নাক লাল হয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল তার। বুকে ধুকপুক নিয়ে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিমায় মৃদু পায়ে গিয়ে ছেলের সামনে এক হাঁটু গেঁড়ে বসল। কম্পিত দু’টো হাত বাড়িয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বন্ধ করল চোখ দু’টি। ভারিক্কি শ্বাসের পাশাপাশি অবিরাম অশ্রু ঝড়ল চোখ বেয়ে। সুহৃদ নিশ্চুপ। আপন, আপন উষ্ণ বুকে মিলিয়ে রইল। সুহাস চোখ বন্ধ রেখেই একের পর এক চুমু খেল ওর সারা গায়ে। পিতা পুত্রে এহেন মিলন দৃশ্যে উপস্থিত সকলের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। না চাইতেও সৌধর চোখ দু’টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। সে ন্যায়, অন্যায়, ভুলচুকের ঊর্ধ্বে গিয়ে দীর্ঘ মাস ব্যাপি বন্ধুর করুণ দশা গুলো স্মরণ করে আজকের এই মুহুর্তে আবেগি না হয়ে থাকতে পারল না।
ড্রয়িং রুমের উত্তর কর্ণারে থাইগ্লাসের দেয়াল। দেয়ালের ওপারে ছোট্ট একটি রুম। অ্যারিনের খেলার ঘর এটি। যে ঘরের ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে ভেতর দেখা সম্ভব না। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছে নামী৷ আড়ালে থেকে সবটা অবলোকন করতে করতে কখন যে তার হৃৎস্পন্দন থমকে গেছে টেরই পায়নি। চোখ গলেও বেড়িয়েছে নোনা পানির ধারা…।
.
.
খুবই অল্প সময়ে সুহাসের সঙ্গে সুহৃদের সখ্যতা গড়ে ওঠল। ঘন্টা দুয়েক আগে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। সৌধ সম্মানার্থে একটু মুখে তুললেও সুহাস ছেলেতে মগ্ন। কখনো বুকে আগলে, কখনো বা কাঁধে তুলে ড্রয়িংরুম জুড়ে পায়চারি করছে সুহাস। একবার সোফায় বসে আদরে, আহ্লাদে গল্প করছে তো আরেকবার চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলছে বাচ্চাকে। টিপ্পু মাসি এরই মধ্যে দু’বার সুহৃদের খাবার নিয়ে এসেছে। আনাড়ি হাতে সুহাসই খাইয়ে দিয়েছে ছেলেকে। সৌধ ভিডিয়ো কলে সোহান আংকেল আর সিমরানকে সেসব কাণ্ড দেখিয়েছে। ওদেশে বাবা, মেয়ে মিলে কান্না, হাসিতে লুটোপুটি। সামনে ফোন ধরলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সুহৃদ। সোহান খন্দকার দাদুভাই দাদুভাই করে চ্যাঁচায়৷ চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে তার৷ সুহৃদ হাসে। সোহান খন্দকারের গলা যত বাড়ে সুহৃদের হাসি বিস্তৃত হয়৷ খিলখিল করে হাসে ছেলেটা। সিমরান মুখে হাত চেপে অবাক হয়। মনে পড়ে আম্মুকে। সুহৃদের হাসি, চোখ দু’টো ঠিক তার মায়ের মতো। হবে নাইবা কেন? তাদের পরিবারের ছেলে সুহৃদ। আহ্লাদে গদগদ হয় মেয়েটা। টলমল চোখে সৌধর পানে তাকায়৷ আফসোস করে, কেন তাকে নিয়ে গেল না? কেন সে সুহৃদকে ছুঁতে পারছে না? চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলতে পারছে না ওর গুলুমুলু গালটা? সৌধ স্মিত হাসে৷ সুহৃদের গাল টেনে আদর করে দেয়৷ যেন ভাতিজাকে নয় তার ফুপুমনির গালটাই টেনে আদর করে দিল। আড়াল থেকে সবটাই দেখে যায় নামী। সবকিছুর ভীড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করে সুহাসকে। ছেলেতে বিভোর থাকলেও ওর দৃষ্টি ক্ষণে ক্ষণে অচঞ্চল হয়ে পড়ছে। অস্থির চিত্তে খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধুই তাকে৷ এত আনন্দ, হাসিখুশির ভীড়ে সুহাসের ভেতরকার তীব্র বিষাদসিন্ধু দেখতে পেল সে। শরীরটা কেমন ভেঙে পড়েছে। আগের মতো সুস্বাস্থ্য নেই৷ সর্বাঙ্গ জুড়েই বিষণ্নতার ছাপ৷ বহু বছর আগের সেই হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা মনে পড়ল নামীর। কিন্তু ওই বয়সে ওই ছেলেটার হ্যাংলা, পাতলা রূপ মানানসই লাগলেও আজ এ বয়সে এসে একদম মানাচ্ছে না। মানুষের অভাবের চেয়ে বড়ো অভাব পৃথিবীতে আছে কী? নেই। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণার চেয়েও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা কী হতে পারে? নিজের ভুল কর্ম দ্বারা এ পৃথিবীতে অনেকেই মানুষ হারায়। ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। নিঃসঙ্গতা এক ভয়ানক ব্যাধি৷ এই ব্যাধিতে যে আক্রান্ত হয় সেই জানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কী কঠিন! প্রিয় মানুষ ছাড়া জীবন কী দুর্বিষহ। রুদ্ধশ্বাস ফেলে নামী৷ সহসা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ডুকরে ওঠে।
বাংলাদেশে সময় যখন দু’টো ছুঁই ছুঁই। সুইজারল্যান্ডে তখন দশটা। আজ বাবার বুকেই ঘুমিয়ে গেছে সুহৃদ। যদিও দীর্ঘ সময় মাকে না পেয়ে ছটফট করছিল। কিছুক্ষণ গুনগুনিয়ে কেঁদেছেও। সুহাস কতবার অনুরোধ করেছে অ্যালেনের কাছে। একবার নামীকে আসতে বলুন। আসেনি। ছেলের ছটফট দেখে এরপর ওকে সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পিতৃ সত্তার জাদুবলে সামলে নিয়েছে সন্তানকে। এভাবেই এক সময় ঘুমিয়ে গিয়েছে সুহৃদ। সৌধও শশুর আর বউকে বিদায় দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। যদিও তারা নামীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু সৌধ নামীর সিদ্ধান্ত চেপে গিয়ে কৌশলে তাদের দমিয়ে রেখেছে। সুহৃদ ঘুমালেও ওকে ছাড়ল না সুহাস৷ এদিকে রাতের খাবার আয়োজন চলছে। হঠাৎ সৌধ বুদ্ধি করে অ্যালেনকে বলল,
‘ সুহৃদ তো ঘুমিয়ে গেছে। ওকে বেডরুমে নেয়া উচিত। ‘
এরপরই টুপ্পি মাসি এলো। হাত বাড়াল সুহৃদকে নিতে। রেগে গেল সুহাস৷ সুহৃদকে বুকে আগলে ধরে বলল,
‘ আমি দিব না৷ কোন ঘরে নিয়ে যাব ওকে তাই বলুন।’
টুপ্পি মাসি দৃঢ় দৃষ্টিতে অ্যালেনের দিকে তাকাল। অ্যালেন ইশারায় নিয়ে যেতে অনুমতি দিলে টুপ্পি মাসি আগে গেল। আর সুহাস গেল পিছন পিছন। নামীর ঘরেই নিয়ে গেল সুহাসকে। কিন্তু ও ঘরে নামী নেই৷ সুহাস হতাশ হলো এতে। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই বেবি বেবি ঘ্রাণ আর নামী নামী ঘ্রাণ মিলেমিশে তার নাকে ধাক্কা খেলো যেন। চারপাশে যা কিছু দেখল সবটাই ভীষণ আপন আপন মনে হলো। টুপ্পি মাসি সুহৃদের বিছানা ইশারা করলে সুহাস গিয়ে ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ল। এক হাত সুহৃদের বুকের ওপর হালকা করে রেখে কপালে এঁটে দিল স্নেহময় পরশ। নিষ্পাপ মুখটা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা সুহাস।
সুহাস ভেতর ঘরে চলে গেলে সৌধ বুদ্ধি করে অ্যালেনকে প্রশ্ন করল,
‘ নামী ওর ঘরে নেই রাইট? ‘
অ্যালেন মাথা নাড়ল। সৌধ মৃদু হেসে বলল,
‘ একটি সাহায্য চাই করবেন? ‘
‘ আমি ভীষণ সাহায্যপ্রিয় মানুষ। বলুন? ‘
‘ নামীকে গিয়ে বলবেন আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই? সুহাসের সঙ্গে দেখা না দিক সম্ভব হলে দশ মিনিটের জন্য আমার সঙ্গে একাকী যেন দেখা দেয়। জোর করছি না জাস্ট প্রস্তাব রাখছি। বাকিটা সম্পূর্ণ নামীর ইচ্ছে। ‘
হাসল অ্যালেন। বুঝল এই ছেলেটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। এরপর চলে গেল নামীর কাছে৷ নামীকে গিয়ে সৌধর প্রস্তাবটি রাখলে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল নামী। বলল,
‘ এ ঘরেই আসতে বলুন উনাকে। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।