গল্পঃ #ভয় ( ৮ম বা শেষ পর্ব )
হঠাৎ অনুভব করলাম শীতল সাপের মতো কিছু একটা আমার পাজামার ভেতর দিয়ে পায়ে পেচিয়ে বুকের দিকে উঠে আসছে।
ভয়ে শঙ্কায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। প্রতিটি মুহূর্ত এখন গভীর ভাবে উপলব্ধি হচ্ছে।
শীতল সাপের মতো সেই জিনিসটা এবার কোমর হয়ে বুকের মাঝবরাবর এসে থামলো।
বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়িপেটা করছে দমাদম, মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড এক্ষুনি ফেটে যাবে।
পিনপতন নীরবতা চারপাশে, আমার নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে।
সাপের মতো সেই জিনিসটা এবার চোখের পলকে মানুষের আকৃতি ধারণ করলো, কিন্তু চেহারা তার বিভৎস রকমের ও ভয়ঙ্কর। রুমে অন্ধকার বলে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও যেটুকু বোঝা যাচ্ছে ওটুকুই অনেক। ভয়ে অভ্যস্ত নয় নয় এমন কেউ হলে হয়তো এতক্ষণে হার্ট-অ্যাটার্ক করে মারা যেত।
অশুভ শক্তি এমন ভাবে আমার ওপর হামলে পড়েছে যে তার শক্তির কাছে আমার শক্তি হাতির সামনে পিপড়ার মতো।
আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে যেন। অশুভ শক্তি আমার পরনের কাপড় টেনে খুলে ফেলায় মগ্ন। হঠাৎ করে অভ্রর মুখটা ভেসে উঠলো চোখে। এ যাত্রায় হেরে গেলে আর হবেনা জীবনের বাকিটা পথ অভ্রর হাতে হাত রেখে চলা, হবেনা না বলা কথাগুলো আর বলা। কত স্বপ্ন রয়ে গেছে বাকী। ভাবতে ভাবতে চোখে জল এসে গেল। আর মনোবল ফিরে পেলাম যেন আবার।
অশুভ শক্তির সাথে ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে একসময় খাটের বামপাশে চলে এলাম। এখানেই খাটের পাশে আছে সেই পাত্রে পবিত্র পানি আর পানিতে ভেজানো ছোট চাকুটা।
সুযোগ বুঝে হাত বাড়িয়ে চাকুটা তুলতে যাবো এমন সময় অশুভশক্তি আমাকে শুন্যে তুলে যেন খাটের ওপর আছাড় মারলো। ঘাড়ে হাতে অনেক যায়গায় অশুভ শক্তির আক্রমণে জখম হয়ে রক্ত ঝরছে।
আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছি বিছানায়। অশুভশক্তি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটু পরেই আবার দৃশ্যমান হয়ে আমাকে লক্ষ্য করে ঝাপ দিতেই আমি গড়িয়ে খাটের পাশে পড়ে চাকুটা হাতে নিলাম অমনি অশুভ শক্তি আবার আমার ওপর হামলে পড়তেই বিদ্যুৎ গতিতে চাকুটা ঢুকিয়ে দিলাম অশুভ শক্তির শরীরে।
সাথে সাথে ভয়ংকর একটা চিৎকার দিয়ে অশুভ শক্তি কালো ধোঁয়ার কুন্ডলিতে পরিনত হয়ে রুমের চারপাশে চক্কর মেরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। হুজুর হয়তো ঘরের চারপাশ দোয়া কালাম পড়ে বন্ধ করে রেখেছে যেন পালাতে না পারে।
পালাবার পথ বন্ধ দেখে হয়তো অশুভশক্তি আরও ক্ষেপে গেছে। ধোঁয়ার কুন্ডলি আবার সেই ভয়ংকর রূপ ধরে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে ঠিক এমন সময় অভ্র দরজা খুলে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে তাবিজটা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে।
অশুভশক্তি এবার চারপাশে চক্কর কাটছে আর ভয়ংকর গর্জন করছে।
একটা মুখবন্ধ মাটির হাড়ি নিয়ে হুজুর রুমে ঢুকে হাড়ির ঢাকনা খুলে দোয়া কালাম পড়ে ধুল মাটির মতো কিছু রুমে ছিটিয়ে দিতেই গর্জন করতে করতে অশুভশক্তি ধোঁয়ায় পরিনত হয়ে হুজুরের হাতের মাটির হাড়ির ভেতর ঢুকতেই হুজুর ঢাকনা লাগিয়ে হাড়ির মুখটা বন্ধ করে আরও কিসব দোয়া পড়ে হাড়িতে ফু দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো– তোমাদের শত্রু এবার চিরতরে বন্দী, তোমরা আজ থেকে ভয় মুক্ত। এই দুষ্ট জ্বীনের ব্যবস্থা আমি করছি।
হুজুরের কথা শেষ হতেই আমি এতক্ষণের ধকলে ক্লান্ত বলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
সকালে চোখ খুলে দেখি সবাই ব্যাগ গোছগাছ করে রেডি। আব্বা আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে, বরিশাল পিরোজপুরে গ্রামের বাড়ি।
গাড়িতে বসে অভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বললাম– তোমাকে তো ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলাম, তুমি টের পেলে কীভাবে রাতে?
অভ্র মুচকি হেসে বললো– মানুষটা যদি মনের হয় তখন তার বিপদে মন নিজেই ঘুমটুম তাড়িয়ে মনের মানুষ বিপদে আছে জানিয়ে দেয়।
বললাম– ভয় লাগেনি তোমার?
অভ্র মিষ্টি হেসে বললো– ভয় একটাই হয়, তোমাকে যেন কভু না হারাই।
আমরা গল্প করতে করতে বাড়ি এসে পৌছালাম।
এরপর অভ্রর প্রাইমারী স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি হয়ে যায়। গ্রামেই আমরা বসবাস শুরু করি।
প্রায় দুবছর কেটে যায়। আমাদের ছোট্ট সোনা মেয়ে পরিটার বয়স এখন আট মাস। সুখী সংসার আমাদের।
মেয়েটা বারবার দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে অস্পষ্ট ভাবে এমন করে হাসে কথা বলে যেন ওর সামনে কেউ দাড়িয়ে আছে বা শূন্যে ভাসছে জানালার ওপাশে।
আমি কোলে তুলে জানালার কাছ থেকে সরে এসে মনে মনে ভাবি– সেই আগের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ছাঁপ এখনও মনে রয়ে গেছে বলেই হয়তো একটু অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই ভয় হয়।
ভয়কে জয় করে আমাদের জীবন এখন ভয়হীন সুখের। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন হাসি আনন্দে সারাক্ষণ। ভয় নেই বলেও সুপ্ত অবস্থায় মনের কোণে ঘাপটি মেরে রয়ে গেছে কিন্তু অজানা অস্পষ্ট ভয়।
মনকে বোঝাতে বোঝাতে একসময় সে ঠিকই বুঝবে চিরতরে শেষ সেই ভয়।
সমাপ্ত।
লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।