আমার ভালোবাসার মানুষের আজ বিয়ে হতে যাচ্ছে, আমারই চাচাতো বোন শায়লার সঙ্গে। বিয়ে হতে যাচ্ছে কী, বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন শুধু রীতিনীতি মোতাবেক শায়লাকে অভ্র ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে সমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আর কী! রাতের বেলা ছোট্ট করে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আর গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানোর জন্য যাবতীয় কেনাকাটা গুলোর দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার উপর! মজার না ব্যাপারটা? এরকম মুহূর্ত কারো জীবনে এসেছে কী-না আমি জানি না, নাকি আমিই প্রথম যে হাসি মুখে বড় চাচীর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা চেয়ে নিয়েছি ফুল টুল কেনাকাটার জন্য! অভ্র ভাই বাসায় এসে সেই যে ঘরে গিয়ে ঢুকেছেন, আর বের হননি। হলেই তো আমার মুখোমুখি হতে হবে তাকে! তখন তো প্রশ্ন তুলতে পারি, এই অধমের কী এমন দোষ ছিল- যার জন্য অভ্র ভাইয়ের স্ত্রী’র জায়গাটা আমি নিতে পারলাম না! কোন গুণে শায়লা আজ হাস্যমুখ করে প্রজাপতির ন্যায় উড়ু উড়ু করছে? কী ক্ষতি হতো যদি আমার নামের শেষে অভ্র ভাইয়ের নামটা জুড়ে যেতো?
বাক্যগুলো ডায়েরির পাতায় তুলতে তুলতে বাম হাত দিয়ে চোখের জলগুলো মুছে নিলো পড়ন্ত। বাড়িতে মোটামুটি রমরমা ভাব চলে এসেছে ইতিমধ্যেই। একমাত্র বড় চাচীই মুখ গোমড়া করে গায়ে হলুদের আয়োজন করছেন। তিনি চেয়েছিলেন ছোটোখাটো আয়োজনের মাধ্যমে শায়লাকে ছেলের বউ হিসেবে ঘরে তুলে নিতে। শায়লাকে এমনিতেও পছন্দ করেন না তিনি, শায়লার উড়নচণ্ডী স্বভাবই এরজন্য অনেকাংশে দায়ী। মেয়েটা রূপে,গুণে থাকলেও মেজাজটা চটা চটা ধরনের। আর ভীষণ জেদি, এই জেদের বশবর্তী হয়েই তো পড়ন্ত’র থেকে তার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিলো একপ্রকার!
ঘটনা হচ্ছে, গতকাল সন্ধ্যের আগে আগে অভ্র ভাইয়ার রুমে আসে শায়লা। অভ্র তখন অলস ভঙ্গিতে শুয়ে ছিল। শায়লা এসে ক্ষণকাল সময় চোখ দিয়ে অভ্রের হাত-পা চেটে নিলো। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে ডাকল,
-“অভ্র ভাইয়া!”
অভ্র কপাল কুঁচকে তাকাতেই সে বলল,
-“আমার সাথে একটু যাবে।”
-“কই?” প্রশ্ন করে অভ্র। মেয়েটার মতিগতি তার ভালো ঠেকে না। শায়লা যে তার উপর হাত-পা পিছলে পড়েছে, সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারে অভ্র। কিন্তু তার মনের মনি কোঠায় যে পড়ন্ত’র নাম লেখা। তার মন,শরীর,চিন্তাচেতনায় পড়ন্তেরই আনাগোনা। সেখানে অন্য কাউকে ভাবতেও পারে না অভ্র।
শায়লা বলল,
-“আমার বান্ধবীর আজ জন্মদিন। আমি একাই যেতাম। কিন্তু ওদের বাড়িটা একে তো অনেক দূরে, তার উপর সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তাই মা বলল,কাউকে নিয়ে যেতে।”
-“পাপন কে ধর গিয়ে… আমি পারব না। আমার শরীর ভালো না।” বলে বালিশে মুখ গুঁজলো অভ্র।
-“আহা! একটু গেলে কী এমন হবে বলো তো? আর বেশিক্ষণ থাকব না। যাব, উপহার দিয়ে চলে আসব। পাক্কা প্রমিস। পাপন ছোটো মানুষ, রাস্তাঘাটে একটা সমস্যায় পড়লে ও কী করবে? আর তুমি আমাদের সবার বড় ভাই। তুমি আমাদের দায়িত্ব নেবে না তো কে নেবে?”
অগত্যা অভ্রকে উঠতে হলো। হাতমুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে কালো রঙের শার্টটা গায়ে চাপাচ্ছিল, তখনি চপল পায়ে পড়ন্ত এসে ঘরে ঢুকলো।
-“শুনলাম, তুমি নাকি বাইরে যাচ্ছো?” খানিকটা অভিমানী শোনালো পড়ন্তের কণ্ঠটা।
অভ্র নির্ভার হাসলো,
-“হ্যাঁ, ওই শায়লাকে নিয়ে আর কী।”
-“শায়লা আপা যে তোমার উপর ফল করেছে, সে খবর টের পেয়েছো?”
-“তাতে কী? আমি কী তোকে ছাড়া কারো কথা ভাবতে পেরেছি নাকি পারব?”
-“ভেবে দেখোই না একবার, মেরে আধা লুলা করে ফেলবো।”
পড়ন্ত ঠোঁট বাকালো। অভ্র এগিয়ে এসে তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
-“পাজি কোথাকার! এ’বাড়ির সবাই আমাকে যমের মতোন ভয় পায়, আর তুই কী-না আমাকে লুলা বানাতে এসেছিস?”
-“সবাই আর আমি এক হলাম বুঝি?” ভার ভার শোনালো পড়ন্তের গলা।
অভ্র মুচকি হেসে পড়ন্তের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বলে,
-“না, আপনি তো আমার রাণী, আর রাণীর জন্যে শুধু লুলা কেন, জানটাও দিয়ে দিতে পারব। এবার আমি যাই মহারাণী মা?”
পড়ন্ত হাসতে চায় না, তবুও হাসিরা তার ঠোঁটে দখল করে।
-“যান, দ্রুত আসবেন। আমি অপেক্ষা করব।”
পড়ন্ত’র সেই অপেক্ষা আর যেন ফুরোয় না। রাত পার হয়ে গভীর হয়, অথচ শায়লা, অভ্র কারো কোনো খোঁজ মেলে না। দু’জনের ফোনই বন্ধ। যতটা চিন্তিত বাড়ির সকলে,তার চাইতেও বেশি চিন্তিত পড়ন্ত নিজে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক ছটফটানি! অভ্রের জন্য যতটা না দুশ্চিন্তা, শায়লা সঙ্গে থাকায় তার চাইতেও বেশি উৎকণ্ঠা! মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগের একটি কথা, পড়ন্তের কপাল সই করে উড়ু চুমু ছুঁড়েছিল অভ্র। পড়ন্ত হাসতে হাসতে বাহিরে বের হচ্ছিল, তখনি শায়লার সামনে পড়ে গেল। শায়লা জানালা দিয়ে দেখেছিল ব্যাপারটা। সেদিনই শায়লা জানতে পেরেছিল, অভ্র আর পড়ন্তের মন দেওয়া নেওয়া অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। শায়লা দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল,
-“দ্যাখ পড়ু, আমরা সবাই চাচাতো ভাই-বোন, সবাই কাজিন। তাই কারো সাথে কারো সম্পর্ক খারাপ হোক, এটা আমি চাই না। তুই তো জানিস, আমার মা বড় চাচার সাথে ঠিক করে রেখেছেন, অভ্র ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা। আমিও তাকে অনেক পছন্দ করি। মাঝদিয়ে তুই এসে ঝামেলা পাঁকাস না। আমি কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে অভ্র ভাইকে জিতে নেবোই নেবো…”
অভ্র তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। তমিজ উদ্দিনের পর মেঝ ভাই খোকন উদ্দিনের বড় মেয়ে শায়লা, ছোট মেয়ে নিতু। এরপর ছোট ভাই মিথুন উদ্দিনের বড় মেয়ে পড়ন্ত আর ছোট ছেলে পাপন। সবাই এতকাল যাবত একই সঙ্গে পৈতৃক ভিটাতেই থাকছেন। বলতে গেলে তারা একান্নবর্তী পরিবার। সেই সাথে আছেন দাদী মেহেরজান। ছোট বেলা থেকে সকলে একত্রে বড় হয়েছে। অভ্র আর পড়ন্তের বয়সের পার্থক্য টা সত্যি চোখে পড়ার মতো। তবুও কথায় আছে না, ভালোবাসা কোনোকিছু বিবেচনা করে হয় না? কার জন্য কখন কীভাবে মনের গোপন কুঠুরিতে এসে বংশবিস্তার করতে শুরু করে, তা কেউ জানে না?
পরদিন সকালে অভ্র আর শায়লা বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে আসলো। শায়লা তো মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না শুরু করে দিলো আসার পর থেকেই। তবে সেটা তার সুখের কান্না, দুঃখের নয়। আর অভ্র লজ্জায় ঘরের খিল আঁটে। ঘটনা জানা যায় শায়লার মুখে। বান্ধবীর বাসা থেকে ফেরার পথে বৃষ্টির মুখে পড়ে যাওয়ায় রাস্তার পাশেই পরিত্যক্ত একটা ছাউনির নিচে নিজেদের আড়াল করে দু’জনে। বেশকিছু সময় সেখানে থাকার পরেও বৃষ্টি কমছে না দেখে দু’জনেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। কোনো রিকশা, বাহন কিছুই পাচ্ছিল না তারা৷ এমন সময়ে স্থানীয় কয়েকজন বখাটের দল সেখানে এসে উপস্থিত হলে তাদের নিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য শুরু করে। অভ্র জানায়, শায়লা তার চাচাতো বোন। কিন্তু সবাই উল্টো বিদ্রুপ করে হেসে উঠে বিশ্বাসের বদলে। অভ্র ফোন করে বাসায় জানাতে চাইলে তারা দু’জনের ফোনই কেড়ে নেয়। তারপর একপ্রকার বগল দাবা করে ওই এলাকার চেয়ারম্যানের নিকট যায়। সেখানে গিয়ে অভ্র আশ্চর্যের আতিশয্যে পৌঁছায় যখন শোনে, চেয়ারম্যানকে বখাটের দলেরা বলছে, ওদের দু’জনকে নাকি ঝোপের আড়ালে বাজে কাজ করতে দেখে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। শায়লা তো শুনেই কেঁদে ফেলে। অভ্র’র তখন মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। চেয়ারম্যান যখন শুনলো, এরা অন্য এলাকার ছেলে-মেয়ে, তখন সে নিজেও পেয়ে বসল। অভ্র’র থেকে মোটা অংকের টাকা দাবী করে, বিনিময়ে অভ্র বলে বাসায় জানাতে ওদের পরিস্থিতিটা। তারা তখন বাসায় জানায় তো নাই-ই উল্টো দুটোকে ধরে বেধে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। অভ্র যখন কবুল বলছিল, তার গলায় সবটুকু শ্বাস গিয়ে আঁটকে ছিল। অপরদিকে শায়লা বেশ গদগদ হয়েই কবুল বলে। সে তো একদিক থেকে খুশিই হয়েছে অভ্রকে নিজের করে পেয়ে।
সবটা শোনার পর বাড়িতে মোটামুটি একটা বিধ্বস্ত অবস্থা হয়ে গেল। সবাই নীরব স্নায়ুযুদ্ধে ভেঙে পড়লেন। শেষে দাদীই উপায় বাতলে দিলেন, যা হওয়ার হয়েছে। আল্লাহ পাক এদের কপালে এভাবেই বিয়ে লিখে রেখেছিলেন। আর দুটোই বাড়ির ছেলেমেয়ে। তাই আর দেড়ি না করে পারিবারিক ভাবে বিয়ে সম্পন্ন করা উচিত। সেই রেশ ধরেই আজ তাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হবে, যদিও তা একদম ছোটোমোটো করে।
পড়ন্তের মা নাসরিন ঘরে এসে ঢুকলেন। পড়ন্ত হুড়মুড় করে ডায়েরি ভাঁজ করল। নাসরিন সেদিকে লক্ষ করলেন না, বরং চেঁচালেন,
-“কীরে, তুই বসে আছিস ক্যান? ওদিকে কত কাজ। আয়, হাত লাগা আমার সঙ্গে।”
পড়ন্ত শক্ত কণ্ঠে বলল,
-“আমি পারব না মা। আমাকে ফুল আনতে হবে।”
-“ও! ফুলের দায়িত্ব তোকে দিছে নাকি? আচ্ছা যা তাহলে, দেড়ি করিস না। এমনিতেই কত কাজ! সময় কই? শোন, বেছে বেছে আনবি। সুন্দর দেখে.. মরা, শুকনো, চ্যাপ্টা লেগে আছে এমন ফুল আনবি না বুঝছিস?”
পড়ন্ত চোখের জল সামলে উঠে দাঁড়াল। পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরোতে বেরোতে শুনল, নাসরিন বলছেন,
-“শত হোক, এই বাড়ির প্রথম বিয়ে বলে কথা!”
পড়ন্ত বাইরে এসেই আগে চোখের জল মুছলো। অবাধ্য অশ্রুগুলো কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
★
শায়লা গুনগুন করে গান গাইছে। দশটা বাজছে ঘড়িতে। শিখা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকতেই শায়লা উঠে দাঁড়াল।
-“মা, আমি যাব না?”
-“কই?”
-“শপিংয়ে!”
-“না, না, বউয়ের জিনিসপত্র ছেলের বাড়ি থেকে কিনবে। তুই যাবি কেন আবার?”
-“আরে আজব! আমরা আমরাই তো!”
-“তবুও…এখন আর ওরা তোর চাচা-চাচী সম্পর্কে নেই। এখন থেকে তারা শ্বশুর শাশুড়ি, আমার বেয়াই-বেয়াইন। বুঝছিস? নিয়মকানুন তো মানতেই হবে। তুই এখানে আয়, বস। তোর সাথে আমার কথা আছে।”
শিখা মেয়ের হাত ধরে বিছানায় বসলেন।
-“কী বলবে মা?”
-“হ্যাঁ রে শায়লা, তুই খুশি তো? দ্যাখ, বিয়েটা যেভাবে হয়েছে, হয়েছে। তাই বলে ছাড়াছাড়ি তো করিয়ে দিতে পারি না বল? তোর বাবা অবশ্য বলেছিল একবার, যা হয়েছে দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাও। দু’জনকে তালাক করিয়ে দাও।”
শায়লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল,
-“না, না! ভুলেও এইধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যেও না তোমরা। বিয়ে যেভাবেই হোক, আমি মন থেকে মেনে নিয়েছি। আর…”
শায়লা মুখ নামালো লজ্জায়,শিখা তাড়া কণ্ঠে বললেন,
-“আর কী?”
-“আর হলো গিয়ে… আমি তো অভ্র ভাইকে আগে থেকেই পছন্দ করতাম।”
শিখা শায়লার পিঠে মৃদু চাপড় দিলেন।
-“ভাই কীসের? এখন থেকে নাম ধরে ডাকবি। আর আমি জানি তুই ওকে আগে থাকতেই পছন্দ করতিস। এই জন্যে আমিও তো তোকে অভ্রের হাতেই দিতে চাইছিলাম। যাক, যেভাবেই হোক,আমার দোয়া কবুল হলো।”
-“হুঁ..”
শায়লা মুখ নামিয়ে রাখলো। তার মনের বাগানে হরেক প্রজাপতির ভীড় লেগেছে। তারা সব লাগাম হারা ভাবে উড়ছে।
★
দুটোর দিকে ঘেমেনেয়ে বাড়ি ফিরলো পড়ন্ত। সঙ্গে নিতুও গিয়েছিল। দুপুরে খাওয়ার জন্য পড়ন্তকে ডাকা হলে,ও গেল না। একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে ছাদে চলে গেল স্টেজ সাজানোর জন্য। সঙ্গে পাপন আর নিতুকে নিলো। নিতু জিজ্ঞেস করল,
-“আপু, কীভাবে ডেকোরেট করবে? এনি আইডিয়া?”
-“আরেহ,কাঠবেলির মালা গুলো ঝুলিয়ে দাও পেছনে, আর গোলাপ গুলো তোড়ার মতো সাজিয়ে লাগিয়ে দাও চারিদিকে। শর্টকাটে সুন্দর সাজ!” বলে ঠোঁট গোল করে শিষ দিয়ে উঠল পাপন।
হঠাৎ পড়ন্ত বলে উঠল,
-“উঁহু… আমি সাজাব আমার মনের মতো করে। সিংগেল গোলাপ গুলো পেছনে টেপ দিয়ে মেরে দে নিতু। বাঁকা বাঁকা করে… আর জারবেরা দিয়ে চারপাশ ভরে উঠবে। কাঠবেলি থাকবে পিলার গুলোতে, জড়িয়ে জড়িয়ে… চারিদিক যেন ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে!”
-“এটাও সুন্দর হবে!” বলে পাপন আর নিতু হাত লাগালো কাজে। পড়ন্ত খানিকক্ষণ থম ধরে রইল। তার হাত জোড়া যেন অসাড় হয়ে আছে। কোনো শক্তি নেই! বুকের ভেতর এলোমেলো ঝড়, কষ্টের পরিমাপটা কী দিয়ে করবে! তারা যেহেতু একবাড়িতেই থাকে, তাই পড়ন্ত একদিন বলেছিল অভ্রকে, ওদের বিয়ের সময় হলুদের স্টেজ ও নিজে সাজাবে। শত হোক, নিজের বিয়ে বলে কথা। আর বিয়ে মানুষের কয়টা হয়? অভ্রকে নিজের করে পেলে আর কোনোকিছুই লাগতো না পড়ন্তের এমনিতেও। এখন সেসব দুঃস্বপ্ন! যার ঘোর কেটে বাস্তবে পদার্পণ করেছে সে। তবুও এতদিনের ভালোবাসা! এতগুলো স্মৃতি! সব এক নিমিষেই ভুলে যাওয়া যায় কী? লম্বা করে শ্বাস টানলো পড়ন্ত। তার ধীরস্থির ভাবে কাজ করতে লাগল।
আটটারও আরও কিছু বেশি বাজে ঘড়িতে। শায়লাকে পার্লার থেকে একটি মেয়ে এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। তার গায়ে কুসুম রংয়ের শাড়ি, তবে কুসুমের চেয়ে হলুদ রংটিই বেশি ফুঁটে আছে। কানে, হাতে, গলায়, মাথায়, কাঁচা গোলাপের গয়না! এত অল্প সময়ে এতকিছু কীভাবে যোগাড় করে ফেলল, কে জানে! পড়ন্ত শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। তার পাশ কাটিয়ে শায়লাকে স্টেজে উঠিয়ে বসানো হলো। শায়লা স্টেজে বসেই পড়ন্তের দিকে একটা চোখা হাসি ছুঁড়ে দিল, যার অর্থ, আমি তো অভ্রকে জিতে নিলাম। কী করবি এবার তুই?
পড়ন্ত আনমনেই হাসল! কী করবে সে? কিছুই না… অভ্রের দাবী সে ছেড়ে দিয়েছে। অনার্সটা শেষ হলেই সে দেশ ছাড়তে চাইবে,যেকোনো মূল্যে… এক বাসায় অভ্রের স্ত্রী শায়লাকে মেনে নিয়ে থাকা সম্ভব না। যতটুকু ঝলসে গেছে ভেতরটা যাক, সেই ঝলসানো উত্তাপের উপর বারবার আগুনের আঁচ আসুক, পড়ন্ত সেটা চায় না।
সবাই-ই মোটামুটি সেজেছে। শাড়ি পড়েছে। পড়ন্তই কিছু পড়েনি। সে কাজের দোহাই দিয়ে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বড় চাচী ডেকে বললেন,
-“পড়ন্ত মা… শায়লার সাথে সাথে থাকিস তো।”
পড়ন্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
-“আমার আরও কাজ আছে কাকী। আমি পারব না… নিতুকে বলো।”
বলেই সরে গেল পড়ন্ত নইলে কাকী জোড়াজুড়ি করতেন। কাঠবেলির একটা মালা একটু ঝুলে ঝুলে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে খুলে পড়তে পারে। সুতা দিয়ে ঠিকঠাক করছিল পড়ন্ত সেটা। তখনি শুনলো, সবাই মিলে বরকে নিয়ে আসছে। একই পরিবারের লোক যেহেতু, তাই শায়লার পাশেই অভ্রকে বসানো হবে। শুধু মাঝখানে পাতলা ফিনফিনে পর্দা তুলে দিবে হলুদ ছোঁয়ানোর সময়। পড়ন্তের দম বন্ধ হয়ে গেল। ঢোক গিলে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সে। শায়লার দিকে তাকাল, শায়লা লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে মাথা নত করে আছে। বুকটা কামড় মেরে উঠল পড়ন্তের। ওই জায়গায় তো তার থাকার কথা ছিল! সেখানে শায়লা কেন! কীসের জন্য! সব লণ্ডভণ্ড করে দেবে সে। হবে না, কিচ্ছু হবে না। বন্ধ করো, গান বন্ধ করো…!
দু’হাতে কান চেপে ধরল পড়ন্ত। তার বুক হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। আশেপাশের শব্দ ছাপিয়ে তার কানের মধ্যে ঝিনঝিন ধরনের একটা সূক্ষ্ণ সাউন্ড হচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল সে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মাটিতে ধপ করে শুয়ে পড়ল পড়ন্ত।
(চলবে)
গল্প- #অন্তর্দহন
পর্ব- ০১
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি