গল্পঃ #ভয় ( ৫ম পর্ব )
আমাকে কোলে তুলে নিয়ে অভ্র ঘরের বাইরে পা রাখতেই ফস করে কালো কি একটা দৌড়ে গেল। অভ্র ব্যালেন্স হারিয়ে আমাকে নিয়ে প্রায় পড়ে যেতে যেতে ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেল।
বাইরে চাঁদের আলোয় আলোকিত তবুও দ্রুত বেগে দৌড়ে যাবার কারণে সেটা কি ছিল বোঝা যায়নি।
অভ্র এবার আমাকে নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য দুই পা সামনে এগোতেই থমকে দাড়ালো। অভ্র যেটা দেখছে আমিও তাই দেখছি। রজনীগন্ধার ঝোপের ভেতর থেকে দুটো জ্বলজ্বলে জ্বলন্ত চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোতের ধারা বয়ে গেল।
অভ্র আমাকে ধীরে ধীরে কোল থেকে নামিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফ্লাশলাইট জ্বেলে রজনীগন্ধার ঝোপের দিকে আলো ফেলে একটা ঢিল ছুড়ে মারতেই দেখলাম একটা কালো বিড়াল বিশ্রী সুরে মিঁয়াও ডেকে দৌড়ে পালালো।
অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো– বুঝলে এবার, বনের বাঘের চেয়ে মনের বাঘে খায় বেশি। ভয়ের কারণ বিশ্লেষন না করে ভয় পাওয়া বোকামি।
আমরা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছি পুকুরের দিকে। রক্তজবার বাগানটা অতিক্রম করে যাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে রক্তজবার বাগানে জোরেসোরে দোল দিয়ে যেতেই আচানক রক্তজবার বাগানে আলোকিত হয়ে উঠলো জোনাকি পোকার আলোয়।
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি রক্তজবার ঝোপের দিকে, সব কিছুই স্বাভাবিক আবার অস্বাভাবিক। তারচে বেশি অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে ডালে ডালে পাতায় পাতায় জোনাকিরা বসে ছন্দে ছন্দে যে আলো জ্বালছে।
আমি পুরোপুরি বিমোহিত হয়ে অপলক তাকিয়ে উপভোগ করছি রাতের প্রকৃতির এই আজব আয়োজন।
হঠাৎ দেখলাম একটা রক্তজবা ফুল বোটা থেকে খসে টুপ করে মাটিতে পড়লো। বাতাসে আবার ফুলটা গড়াগড়ি খেতে খেতে আমার প্রায় সামনে চলে এসেছে।
আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো ফুলটা তুলে খোঁপায় গোঁজার। দুই পা এগিয়ে ঝুকে পড়ে ফুলটা তুলবো এমন সময় অভ্র পেছন থেকে আমাকে টেনে তুলে বললো– কি করছো ওতে ধুলো মেখে গেছে তো।
আবার একটা দমকা হাওয়ায় ফুলটা দূরে কোথাও উড়ে গেল।
মাথার ওপরে রূপালী চাঁদ, চাঁদের স্নিগ্ধ আলো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে পৃথিবীতে আর খোলা আকাশের নিচে প্রিয়তমার হাতে হাত রেখে সে আলো গায়ে মেখে আমি যেন এখন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করছি।
ধীরে ধীরে আমরা শানবাঁধানো ঘাটে এসে বসলাম। পুকুরের জল চাঁদের আলো মেখে চিকচিক করছে। বাতাসে দোল দিয়ে যে মৃদু ঢেউ তুলছে সেই ঢেউয়ে পুকুরের পদ্মফুল যেন হেলেদুলে নাচছে।
আমি অভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বললাম– একটা কবিতা শোনাবে?
অভ্র মিষ্টি হেসে আমার কপালে চুমু খেয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কবিতা শুরু করলো–
আমি তোমার হাতে হাত রেখে হেটে যেতে চাই দূর হতে বহুদূরে, বলতে গেলে সেখানে, যেখানে জীবনের সীমারেখা টানা আছে। যদি জীবন সীমারেখা টেনে দেয় তবে বিধাতার কাছে ওপারের জনমেও তোমাকেই চেয়ে নেবো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নামুক, অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো নিস্তব্ধ পৃথিবী জানুক আমি তোমার হাত ধরে হেটে চলেছি গন্তব্যহীন পথে। তেপান্তরের মাঠ পেড়িয়ে ঘন গভীর বন পেড়িয়ে যেতে যেতে হোক রাত গভীর। আমরা ক্ষানিকটা জিরিয়ে নেবো ঝোপের পাশের কোনো দূর্বাঘাসের চাদরের ওপর বসে, অন্ধকারে জোনাকিপোকার আলোর মিছিলে হারাবো দুজন। আমাদের এ যাত্রার সাক্ষী হবে জোনাক পোকা, সাক্ষী হবে ঝোপের ভেতর থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া রাতজাগা পাখিরা। সাক্ষী হবে রাতের আধার আর সেই পথ, যে পথে হেটে এসেছি এবং হেটে যাবো বহুদূর।
চলতে চলতে যদি ক্লান্তি এসে তোমার পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায় ভেবনা এই বুঝি চলার শেষ। কোলে তুলে নিয়ে আবারও শুরু হবে পথচলা। ফেলে যাবো বলে কাছে আসিনি, ফেলে যাবো বলে ভালোবাসিনি। মানুষটা যখন অস্তিত্বে মিসে যায় তখন তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। তুমি আমার সেই অস্তিত্বে মিসে যাওয়া ভালোবাসা, আমার প্রেম। জীবনের পরেও যদি নতুন কোনো জীবন পাই, সেই জীবনেও আমি তোমাকেই চাই।
কবিতা শেষে অভ্র চুপ করে আছে, আর আমি এখনও সেই কবিতার ঘোরের মধ্যেে ঘুরপাক খাচ্ছি। একটা মানুষ এতটাও ভালোবাসতে পারে?
আনন্দে আমার চোখে জল টলমল করে উঠলো, ক্ষনিকের এই জীবনটা অভ্রকে পেয়ে পরিপূর্ণ আমার। এরকম কাউকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের বিষয়। এবং প্রতিক্ষণ নিজেকে বড়ো ভাগ্যবতী মনে হয় আমার।
অভ্র আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল দেখে অবাক হয়ে দুই হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো– কবিতা শুনিয়ে যদি মুখের হাসির বদলে চোখের জল দেখতে হয়, তাহলে আমি আর কোনদিন কবিতা শোনাবোনা বাবা।
আমি হেসেফেলে অভ্রর নাক টিপে দিয়ে বললাম– এটা আনন্দের হাদারাম, আনন্দে চোখে জল এসেছে।
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো– জল খালে ফেলে ঠোঁটে হাসি ফোটাও, তোমার মায়াবী হাসি আমার প্রাণকে আরও সতেজ করে তোলে প্রতিটি মুহূর্ত।
পুকুরের ঠিক ওপারে পাড় ঘেঁষে কয়েকটা পদ্মফুল। অভ্র উঠে দাড়িয়ে বললো– একটা পদ্মফুল তুলে আনি তোমার খোঁপায় গুঁজে দেবো।
কথা শেষে অভ্র এগিয়ে গেল।
হঠাৎ করে দমকা হাওয়া এসে আমাকে ছুয়ে যেতেই শরীর একটা ঝাঁকুনি খেয়ে শরীরের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠলো।
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি বারবার অভ্রকে বলতে চেয়েও পারিনি কারণ যদি ভুল বুঝে দূরে সরে যায়। আমি অভ্রকে হারিয়ে বাঁচতে পারবোনা।
এই সমস্যার কারণেই আজ পর্যন্ত অভ্রকে একান্তে কাছে আসতে দেইনি। তবে আমি যে চুপচাপ আছি তা-ও নয়।
ছোটবেলায় সেই হুজুর বলেছিল আমার ফুলসজ্জার রাত হবে আমার স্বামীর জীবনের শেষ রাত। তার মানে অশুভ শক্তি আমার স্বামীকে মেরে ফেলবে। যদি তাই হয় তবে হুজুর আমাকে যে তাবিজ দিয়েছিল সেই তাবিজের কারণে অশুভ শক্তি আমাকে স্পর্শ করতে না পারলে অভ্রকেও ওরকম একটা তাবিজ দিলেই হয়। তাহলে তো অশুভ শক্তি অভ্ররও কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। এ-সব ভেবেই মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে ইতিমধ্যে আলাপ করেছি এবং মা বলেছে আগামীকাল সেই হুজুরকে নিয়ে আসবে আমাদের এখানে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘরের জানালার পর্দায় চোখ পড়তেই ভয়ে আমার শরীর অবশ হয়ে গেল যেন। জানালার পর্দায় ঘরের ভেতর থেকে পড়া একটা জীবন্ত ছায়া দেখে মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর কেউ হাঁটাচলা করছে। কিন্তু আমি আর অভ্র ছাড়া তো এ বাড়িতে তৃতীয় কেউ নেই!
ঝপাৎ করে পানিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম পদ্মফুল তুলতে গিয়ে অভ্র পানিতে পড়ে গেছে।
দৌড়ে গিয়ে অভ্রকে টেনে তুলে বললাম– এসব পাগলামি কে করতে বলেছে তোমায়, চলো ঘরে চলো।
অভ্র মিষ্টি হেসে একটা পদ্মফুল আমার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে বললো– কিছু পাগলামি স্মৃতি থাকতে হয় জীবনে, যেগুলো মৃত্যুর আগপর্যন্ত জীবন্ত থেকে যায় মস্তিষ্কে।
ঘরে এসে অভ্রর পোশাক চেঞ্জ করা হলে আমরা শুয়ে পড়লাম।
রাত গভীর।
অভ্র বললো আমার ঠান্ডা লাগছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমায়। আমি অভ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
ধীরে ধীরে আমার শরীরে অভ্রর স্পর্শে কেমন একটা অনুভূতির আগমন ঘটছে। নিশ্চই অভ্র ইচ্ছে করে এরকম করছে।
আমি অভ্রকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললাম– এই যে মিস্টার হাবভাব তো সুবিধার মনে হচ্ছেনা।
অভ্র হেসেফেলে– হাবভাব অসুবিধারও কিছু নয় মিস, আমরা স্বামী স্ত্রী– বলে এক টানে আমাকে বুকে নিয়ে আমি কিছু বলার আগেই আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডোবালো। এই প্রথম, এমন স্পর্শে আমি কেমন থমকে গেলাম। অভ্রর এই আদর ফিরিয়ে দেবার কোনো উপায় নেই আমার কাছে। আমার দেহ মন অভ্রর স্পর্শ ও আদরে বশিভূত হয়ে অন্যরকম এক সুখের অনুভবে মেতে উঠলো।
আজ আর ফেরাতে পারিনি অভ্রকে।
স্বামী স্ত্রীর এই একান্ত সময় পার হবার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি আমি, শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অভ্রর ভয়ংকর চিৎকারে…
চলবে…
লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া