–“ আমার পিরিয়ড চলছে অভ্র ”– এই কথা বলে আজ পরাপর দুই রাত নিজেকে অভ্রর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি আমি। যদিও আমরা এখন স্বামী স্ত্রী তারপরও এরকম করার কারণ হলো কেউ একজন বলেছিল আমার ফুলশয্যার রাতে আমার স্বামীর মৃত্যু হবে।
ফুলশয্যার রাতেই আমার স্বামীর মৃত্যু হবে এই কথাটা নাকি কোনো একজন বলেছিল আমার মাকে। সেই কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরেও পরিবার থেকে কখনোই আমার বিয়ে নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিলনা পরিবারের।
অবশ্য এই কথা আমাকে আর কেউ না বললেও আমার দাদী বলেছিল আমায়। সেই থেকে আমিও বিয়ের চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার কারণে একজনের মৃত্যু হবে এটা কোনদিনই আমি চাইনি। ভেবেছি আজীবন নাহয় কুমারী হয়ে কাটাবো। সবার থেকে একটু ভিন্ন জীবনযাপন হবে আমার। সবাই স্বামীর সংসার করার স্বপ্ন দেখে সেটা সত্যি করে। আমি নাহয় স্বপ্নই দেখে যাবো।
ঐসব ঘর সংসারের আশা বাদ দিয়ে যখন স্বপ্নহীন দিন পার করছি তখন একদিন হঠাৎ করে জীবনে আসে অভ্র তারপর পাল্টে যায় পুরো গল্পটা।
সেই সন্ধ্যায় বড়ো খালার বাড়িতে বিয়ের আনন্দে পুরো ধুমধাম। বড়ো খালার বড়ো মেয়ে মানে আমার খালতো বোন নুপুরের বিয়ে।
সন্ধ্যায় বরযাত্রী আসতেই গেট ধরে বরযাত্রীদের একেবারে নাজেহাল করে ছাড়লাম আমরা সব ভাইবোন মিলে। সেইসময়ও অভ্র উপস্থিত ছিল কিন্তু বিশেষ ভাবে চোখে পড়ার মতো কিছু ছিলনা তখন।
সন্ধ্যার পরে সবাই মিলে হৈহল্লা আনন্দে মেতে আছে, কখনো গান, কখনও নাচ, আবার বরপক্ষের লোকদের সাথে ধাঁধা খেলা।
সব বোনেরাই শাড়ী পরে আছে শুধু আমার পরনে সেলোয়ার কামিজ। এবার বোনেরা মিলে বায়না করলো আমারও শাড়ী পরে আসতে হবে।
ব্যাস আমি চলে এলাম শাড়ী পরতে, ওদিক রং খেলা শুরু হয়ে গেল।
বড়ো খালাদের ঘরের পেছনের বারান্দায় একটা পর্দার মতো টানানো। সেই পর্দার এপাশে দাড়িয়ে আমি পাজামা খুলে ছায়া পরে ব্লাউজটা কেবল পরবো এমন সময় অভ্র দৌড়ে এসে বারান্দায় উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পর্দায় এপাশে চলে এসে আমাকে এ অবস্থায় দেখে একদম থ মেরে গেল। আমিও এতটাই চমকে গেলাম যে এই মুহূর্তে কি করবো সেই হিতাহিত জ্ঞানটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছি। আমার খোলা বুক। দুই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে থ মেরে আমি তাকিয়ে আছি অভ্রর দিকে, আর অভ্রও তাকিয়ে আছে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে।
কয়েক সেকেন্ড পরে সম্বিৎ ফিরে পেতেই আমি চিৎকার করার জন্য মুখ খুলতেই অভ্র বিদ্যুৎ গতিতে এসে এক হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো।
এবার আমি আরও বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। এই ছেলে আবার অন্য কোনো মতলব নিয়ে আসেনি তো। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে। মনে মনে ভাবলাম এতটা ভয় পেলে চলবেনা এই মুহূর্তে, তাহলে ছেলেটা আরও সুযোগ পেয়ে যাবে।
দিলাম অভ্রর হাতের তালুতে কামড় বসিয়ে। মা গো বলে অভ্র হাতটা সরিয়ে নিয়ে আবার অন্য হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে বললো– বিশ্বাস করেন আমি এখানে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি জানতামওনা আপনি এখানে আছেন এবং আমি চিনিওনা আপনাকে। বাইরে ওরা রং মাখিয়ে দেবার জন্য ধাওয়া করছিল তাই ওদের হাত থেকে বাচতেই এই বারান্দায় উঠে দরজা বন্ধ করে লুকানোর চেষ্টা। কিন্তু এখানে এসে এরকম বিপদে পড়ে যাবো জানলে ওদের ইচ্ছে পূর্ণ হতে দিতাম তবু এখানে আসতাম না।
অভ্রর কথা শুনে মনে হয়েছিল একটুও মিথ্যা বলছে না। আর বাইরের পরিস্থিতিটাও এমন।
অভ্র আবার বললো– আমি বর পক্ষের লোক, বর আমার বন্ধু। আপনি চিৎকার করলে লোকজন যেমনটা ভাববে ঘটনা যে তার উল্টো সেটা তো কেবল আপনি আর আমি জানি। তারা ভুল বুঝে বিয়েটা ভেঙে দেবে, আর আমার লোকজনের সামনে মুখ দেখানোর আর কোনো উপায় থাকবেনা। প্লিজ আপনি চিৎকার করবেননা দয়া করে।
আমি এক হাত দিয়ে টেনে আমার মুখের ওপর থেকে অভ্রর হাত সরিয়ে বললাম– কিন্তু আমার যে সর্বনাশ হয়ে গেল এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে হুম?
অভ্র আমতা আমতা করে বললো– আপনি যে শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে মেনে নেবো।
আমি বললাম– আপাতত ঘুরে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকুন, আমি শাড়ীটা পরে নেই তারপর দেখি কি শাস্তি দেয়া যায়।
অভ্র ঘুরে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো, আমি জলদি করে শাড়িটা পরে নুপুরের রুমে গিয়ে ওর লিপস্টিক এনে অভ্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম– আপনার শাস্তি হলো এই লিপস্টিপ ঠোঁটে মেখে বিয়ে বাড়ির সমস্ত লোকজনের সামনে ঘুরতে হবে।
অভ্র অবাক হয়ে হা করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বলতে গিয়েও আবার থেমে গেল।
অভ্রর অবস্থা দেখে আমার হাসি আটকে রাখা দায়। হাসতে হাসতে আমি শেষ। বেচারা ফান্দে পড়েছে আজ।
আমি বললাম– কি ব্যাপার মিস্টার হ্যান্ডসাম, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখবেন নাকি গায়ে কলঙ্কের কালি। একবার সবার কাছে বলে দিলেই কিন্তু খেল খতম।
অভ্র কোনকিছু আর না বলে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
সবার সামনে অভ্র হাটাহাটি করছে, কেউ কেউ অভ্রর ঠোঁটে লিপস্টিক দেখে ভাবছে ছেলেটা পাগল হয়ে গেল নাকি! কেউ আবার হো হো করে হেসে দিচ্ছে। কেউ আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর আমার তো হাসতে হাসতে অবস্থা কাহিল।
নুপুরের বরকে গিয়ে বললাম– দুলাভাই আপনার বন্ধু ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে ঘুরছে আপনাকেও একটু দিয়ে দেবো নাকি? বন্ধু বলে কথা।
দুলাভাই অবাক হয়ে উঠে গিয়ে অভ্রকে ডেকে বললো– কিরে আমার বিয়ে হয়ে গেল তোর আগে সেই দুঃখে তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
দুলাভাইয়ের কথা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম সবাই।
অভ্র লজ্জা পেয়ে বললো– ইয়ে মানে ভেসলিন ভেবে অন্ধকারে লিপস্টিক মেখে ফেলছি মনে হয়।
আমি বললাম– ব্যপার কি বেয়াই, লিপস্টিক নিয়েও ঘোরেন নাকি আজকাল? এ-তো পুরাই বিয়ে পাগল ছেলে রে।
আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
লজ্জায় বেচারার ফর্সা মুখটা একেবারে লাল হয়ে আছে।
যা-ই হোক সবশেষে নুপুরকে নিয়ে চলে গেল বরপক্ষ। কিছু অভ্রর প্রতি ভালোলাগার ছোট্ট একটা চারাগাছ জন্ম নিলো আমার হৃদয়ে।
আমাকে আর বাড়িতে যেতে দিলনা খালামনি।
তিনদিন পরে আমরা গেলাম নুপুরকে আনতে।
এবারও সাথে আসলো ভাইয়া ও তার দুই বোন এবং অভ্র। অভ্র ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড এবং দুজন দুজনের এতটাই কাছের যে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারেনা বলা যায়।
বিকেলে সবাই মিলে অনেক ঘোরাঘুরি এবং মজামাস্তি করা হলো।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পরে খালামনি বললো সবাইকে লেবুর শরবত করে দিতে। সবার জন্য ঠিকঠাক করলেও একটা গ্লাসে আলাদা ভাবে বোম্বাই মরিচ গুলে সেটা তুলে দিলাম অভ্রর হাতে।
সবাই শরবত খেতে শুরু করলো, অভ্রর গ্লাসে অভ্র চুমুক দিতেই কেমন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল।
দুলাভাই অভ্রকে বললো– কি হলো খা, ও কিন্তু দারুণ শরবত বানায়। আহ অসাধারণ।
আমি মুখ চেপে হেসে মনে মনে বললাম– কি দারুণ শরবত যে বানিয়েছি সেটা অভ্র টের পাচ্ছে দুলাভাই।
আমাকে হাসতে দেখে জেদের বেশে অভ্র এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে ফেললো। আমি অবাক! এরকম করবে ভাবতেই পারিনি।
অভ্রর মুখটা লাল হয়ে গেছে, ভাব দেখে মনে হচ্ছে কান দিয়ে এক্ষুণি ধোঁয়া বের হবে। চোখে জল টলমল করছে।
নুপুর অভ্রর চোখে জল দেখে বললো– কি ব্যাপার ভাইয়া চোখে জল কেন? শরবত কি খুব বাজে ছিল?
অভ্র বললো– আরে না না, তেমন কিছু না, আফসোস হচ্ছে তাই।
দুলাভাই বললো– শরবত খেয়ে আবার আফসোস কিসের?
অভ্র বললো– আফসোস হচ্ছে তুই বিয়েটা আরও আগে কেন করলিনা, আগে করলে শরবতের স্বাদটা আরও আগে থেকে পেতাম।
তারপর অভ্র উঠে সেই যে হাওয়া হয়ে গেল, ফিরলো অনেক পরে।
নুপুর কিন্তু বুঝতে পেরেছিল বিষয়টি এবং এই নিয়ে পরে নুপুর এবং দুলাভাই হাসাহাসি করলেও আমার খারাপ লাগছিল এটা ভেবে যে অভ্রর সাথে এমন করাটা ঠিক হয়নি।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমার ঘুম আসছিল না। চাঁদের মায়াবী স্নিগ্ধ আলোয় ভাসছিল চারপাশ। ভাবলাম ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখি।
ছাদে এসে এক কর্ণারে দাড়িয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে আছি আনমনে। এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কারো এগিয়ে আসার শব্দ পেয়ে ঘুরে দাড়ালাম। অভ্র এগিয়ে আসছে।
আমি বললাম– এতরাতে আপনি, ঘুমাননি এখনও?
আমার সামনে দাড়িয়ে অভ্র বললো– অত ঝাল খেলে ঘুমও পালায় বিয়াইন। ঝাল তো কমাতে হবে আগে।
আমি বললাম– মধু খেয়ে নিন, কমে যাবে।
অভ্র হঠাৎ করে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো– পৃথিবীর স্রেষ্ঠ মুধু নাকি এটাই, তাই খেয়ে নিলাম। এবার যদি ঝাল কমে।
আমি থ মেরে দাড়িয়ে আছি, চোখের পলকে এটা কি ঘটে গেল।
অভ্র মুচকি হেসে বললো– কি চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলেন তো? মনে রাখতে হবে ওস্তাদের মার শেষ রাতে।
আমার কিছু বলার আর শক্তি নেই যেন, ছাদে বসে পড়লাম।
অভ্র চলে যেতে যেতে বললো– চাঁদের নিজের আবার চাঁদ দেখার কি দরকার, নিচে এসে শুয়ে পড়ো।
এভাবেই আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যাই ধীরে ধীরে। একসময় পরিস্থিতি এমন হয় যে দুই পরিবারে জানাজানি হয়ে যায় এবং তারা মানে না।
কিন্তু আমরা দুজন দুজনের ভালোবাসায় এতটাই জড়িয়ে গেছি যে কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবোনা।
অবশেষে আমরা পালিয়ে এসে বিয়ে করে ফেলি।
বাসর রাতে পিরিয়ডের কথা বলে অভ্রকে দূরে সরিয়ে রেখেছি আজ সাতদিন। কিন্তু অভ্র তো এতটাও বোকা নয় যে এসব বিষয়ে ওর মোটেও জ্ঞান নেই।
আজ অভ্র কাছে আসতে চাওয়া মাত্র আঁতকে উঠলাম, তাহলে কি এই রাতটাই অভ্রর জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে…
চলবে…
গল্পঃ ভয় ( ১ম পর্ব )
লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।