#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৩৫
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে আবিদের ফোনে একটা কল আসে। সবার অগোচরে আবিদের মুখে সুক্ষ্ম হাসির দেখা যায়। সে ফোন রিসিভ করতেই কিছু কথোপকথন চলে অজ্ঞাত লোকটির সঙ্গে। আবিদকে পরক্ষণে তাচ্ছিল্যতার সঙ্গে বলতে শোনা যায়,
‘বন্দি করে রাখো, আমি এইদিকটা সামলে ফ্রি হয়ে চলে আসবো। তারপর ওর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।’
অপরদিকে সম্মতি দেয়। আবিদ ফোনটা রেখে সামনে তাকাতেই দেখে দর্শিনী প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ দর্শিনীকে দেখে আবিদ একটু ঘাবড়ে যায়। পরক্ষণে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। দর্শিনী আবিদের কথোপকথন পুরাটা না শুনলেও শেষের কথাটা শুনেছে। সে অবাক হয়ে আবিদকে জিগ্যেস করে,
‘কার ব্যাবস্থা নেওয়ার কথা বললেন?’
আবিদ ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘোষে নেয়। দর্শিনী তার শেষের কথাটা শুনেছে। সে সবটা জানতে পারলে, হয়তো পরিবারের কথা ভেবে আসফিকে মুক্ত করে দিতে বলবে। কিন্তু আবিদের মাঝে এতো দয়া নেই। ভুল করলে শাস্তি পেতেই হবে নাহলে সেম ভুলটাই বারবার করবে সবাই। এইটাই আবিদের ধরাবাঁধা নিয়ম। ভাই বলে অন্যায় করে পার পাবেনা আসফি। আবিদের কাছে দর্শিনী অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই আসফির শাস্তি অনিবার্য ছিল। তবুও আসফির ভাগ্য ভালো ব্যাস্ততার জন্য আবিদ তাকে এতোদিন কিছু বলেনি। আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘এমনি কাজের ক্ষেত্রে কথা বলেছিলাম। তুমি, এইখানে কী করছো? ডিনার করবেনা? সবাই ডিনার করছে তুমিও করে নেও।’
‘আসলে একটা কথা বলতে চাইছিলাম!’
‘কী কথা?’
‘বাবা-মা চলে যাবে, আমি কী তাদের সঙ্গে যাবো? কালকেই আবার ফিরে আসবো।’
‘একদম নাহ!’
‘কেনো?’
‘বাড়িতে ফুপি আছে। তুমি চলে গেলে উনি কী ভাববেন। আর আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, অসম্ভব। তুমি ছাড়া আমার রাতে ঘুম আসেনা। হাঁসফাঁস লাগে নিজের। অস্থিরতা বেড়ে যায় আমার। আজ আর নয় আমি ফ্রি হলে নিয়ে যাবো, তোমাকে।’
‘কিন্তু!’
‘কোন কিন্তু নয় দর্শিনী! এখন তো বাড়িতে প্রজ্জ্বলিনী নেই। তোমার বোন তার শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে, ভূলে গেছো? বাসায় গিয়ে বোনকে না পেয়ে মন খারাপ হবে। এইজন্য বেটার হবে প্রজ্জ্বলিনী যখন থাকবে, তোমাকে নিজে রেখে আসবো আমি।’
দর্শিনীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে কতো আশা করেছিল বাবা মার সঙ্গে যাবে তাই। কিন্তু আবিদ তাকে যেতেই দিচ্ছে না। তাছাড়া আবিদ ঠিকই বলেছে। তার বোন সেখানে নেই। মুহতাসিম ভিলায় গেলে তার মধ্যে হুট করে একাকীত্ব ভর করবে। তাছাড়া আবিদকে সে প্রচন্ড মিস করবে। আবিদের শরীরের মাতাল করা পুরুষালী স্মেলটা মিস করবে। আবিদের শত চুম্বন, আদর সব মনে পড়বে। এক কথায় তার তখন একা থাকতে দম বন্ধ লাগবে। আবিদ তাকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া ঘুমোতে পারেনা। দর্শিনী প্রতিনিয়ত আবিদের বাজে অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে আবিদ তাকে একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে চায়না। তাই বাব-মার কাছে কিছুদিন পরে গেলেই হবে। আপাতত আবিদের বাহুডোরে থাকুক কিছুদিন। সে মৃদু হেসে আবিদকে সম্মতি দেয়। আবিদ খুশি হয়ে আলতো হাতে দর্শিনীর চিবুক উচু করে সুন্দর মুখটা দেখে নেয়। তারপর আশেপাশের লোকজনকে লক্ষ্য করে, সবার অগোচরে নির্দিষ্ট দূরুত্বে থেকে শুকনো চুমু দেওয়ার ভঙ্গিমা করে।
.
প্রচন্ড অসস্থি আর বিষণ্ন মনে সবার সঙ্গে ডিনার করেছেন আশরাফ সাহেব। কিছুদিন আগে পরিস্থিতি আলাদা ছিল তখন সানন্দে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তিনি যখন থেকে জানতে পেরেছেন শবনম চৌধুরী এইবাড়ির আদরের ছোটকন্যা; তখন থেকে উনার মাঝে নিদারুণ বিষণ্নতা জেঁকে ধরেছে। দুজনের মাঝে অতীতের স্মৃতি গুলো আবছা হয়ে ভাসছে। ভার্সিটিতে অবস্থান রত সময় আশরাফ সাহেব ছিলেন শবনম চৌধুরীর সিনিয়র ভাই। সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাক্তিত্বের, তুখোড় মেধাবী, রাজনীতির অঙ্গনে ছিল পরিচিত মুখয়ব। শুধু রাজনীতি অঙ্গনে নয় সবার মাঝেই পরিচিত ছিল আশরাফ মুহতাসিম। শবনম চৌধুরী ছিল তৎকালীন সময়ে ভার্সিটির সেরা সুন্দরীদের একজন।তিনি বরাবর নিজের সম্পর্কে বেশি প্রকাশ করতে চাইতেন না। এমনিতেই সুদর্শনা আবার সুন্দর ব্যাক্তিত্বের জন্য ছেলেদের আকর্ষণ, কৌতূহল ছিল তার প্রতি। শুধু ব্যাতিক্রমী ছিলেন আশরাফ মুহতাসিম নামের গম্ভীর পুরুষটি। শবনম চৌধুরী ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ ছিলনা। শবনম চৌধুরীর কাছে এই বিষয়টি অসাধারন লাগে। তিনি আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে পরিচিত হোন একটা দূর্ঘটনার মাধ্যমে। সেই অনেক লম্বা কাহিনী! শবনম চৌধুরীর উপর হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে সিনিয়র কয়েকজন মেয়ে তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন সময়টাতে ভার্সিটির শাসনব্যবস্থা তেমন ভালো ছিলনা। আশরাফ মুহতাসিম সেইদিন তাকে বাঁচিয়েছিল। তারপর থেকে শবনম চৌধুরী কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে থাকে। একটা সময় আশরাফ সাহেবের প্রেমে পড়ে যান তিনি। কিন্তু বিষয়টি গোপন রেখেছিল প্রেমিক পুরুষটির কাছে। আশরাফ মুহতাসিম তারপর থেকে তাকে ভালো বন্ধুর মতো ট্রিট করতো। একটা সময় শবনম চৌধুরী ভালোবাসা প্রকাশ করেন কিন্তু আশরাফ সাহেব তাকে রিজেক্ট করেন। তবে শবনম চৌধুরীর প্রতি কোনো অনুভূতি ছিলনা এমন নয়। তিনি মূলত ভালোবাসায় জড়াতে চাইতেন না নিজেকে। জমিদার পরিবারের ছেলে হওয়ার দরুণ তাছাড়া রাজনীতি করার জন্য শত্রুদের অভাব ছিলনা তার। সেইজন্য তিনি কাউকে নিজের দূর্বলতা বানাতে চাননি। তাছাড়া দর্শিনীর দাদু আহমেদ মুহতাসিম সারাজীবন কঠোর মনের ব্যাক্তি ছিলেন। ছেলের প্রেমের বিষয় জানলে তিনি হয়তো সহ্য করতে পারতেন না। এতোসব ভেবেই শবনম চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আশরাফ মুহতাসিম। এতে শবনম চৌধুরী প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছিল। পছন্দের পুরুষের থেকে প্রত্যাখান পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সবকিছু থেকে। শুরু করেছিল নিজের প্রতি মারাত্মক রকম অবহেলা। এভাবে দিন বাড়তে থাকে। তিনি আশরাফ সাহেবর সামনে যায়নি। এদিকে আশরাফ মুহতাসিম তাকে প্রচন্ড মিস করতে থাকে। সবশেষে তিনি দেখা করতে প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে শবনম চৌধুরী শেষবার দেখা করতে রাজি হয়েছিল। কোন এক বৃষ্টিভেজা দিনে শবনম চৌধুরীকে দেখে আশরাফ সাহেবের হৃদয় ধ্বক করে উঠেছিল। কারণ, শবনম চৌধুরীকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছিলো সেইসময়। চোখের নিচে হালকা কালো দাগ পড়ে গেছিলো তার। প্রচন্ড অগোছালো লাগছিল সেরা সুন্দরী উপাধি পাওয়া মেয়েটিকে। আশরাফ মুহতাসিম তাকে জিগ্যেস করেছিল,
‘শবনম, ঠিক আছো তুমি? তোমাকে অস্বাভাবিক লাগছে।’
শবনম চৌধুরী সেইদিন তীর্যক হেসে বলেছিল,
‘যেমন রেখেছো, তেমন-ই তো থাকবো।’
আশরাফ মুহতাসিম শবনম চৌধুরীর কথা বুঝতে পারে, উনার খারাপ লাগছিল সেইসময় তবে কিছু করার ছিলনা। ততদিনে হৃদয়ের কুঠিরে শবনম চৌধুরী ঠিকই পৌঁছে গেছিল। তারা শেষবার দেখা করবে বলেছিল কিন্তু আশরাফ মুহতাসিম পারেনি শবনম চৌধুরীকে গ্রহণ না করে। তবে শবনম চৌধুরী প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিল আশরাফ সাহেব সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছিল। পরবর্তীতে প্রেমিকা হিসাবে গ্রহণ করেন তাকে। ইউনিভার্সিটিতে সেইসময় সবাই জেনে গেছিলো শবনম চৌধুরী আর আশরাফ মুহতাসিমের প্রেমের কথা। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল তবে ভালো মুহূর্ত খুব স্বল্প সময়ের জন্য ছিল তাদের মাঝে। কারণ খবরটা দ্রুত আহমেদ সাহেবের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলে ডেকে নেন। তারা যেহেতু জমিদার ছিল শত্রুর অভাব ছিলোনা। বাবার কসম রক্ষার্থে এছাড়াও গ্রামের মানুষের স্বার্থে, শত্রু পরিবারের মেয়ে প্রিয়মা বেগমকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছিল তার। এই বিয়ের মাধ্যমেই শত্রুতার অবসান ঘটে। তবুও আশরাফ সাহেব, প্রিয়মা বেগমকে মেনে নিতে পারেননি। এদিকে বাতাসের বেগে আশরাফ মুহতাসিমের বিয়ের খবর সবার কাছে পৌঁছে যায়। বন্ধুমহলের মাধ্যমে শবনম চৌধুরীর কাছেও খবরটি পৌঁছে যায়। তিনি মারাত্মক আঘাত পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেইসময় ছোটখাটো স্ট্রোক করে বসেন। হোস্টেলের বান্ধবীরা তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দেয়। অনেক খোঁজখবর আর চেষ্টার পরে শবনম চৌধুরীর পরিবারকে জানানো হয়। পরবর্তীতে শবনম চৌধুরীর পরিবার তাকে নিয়ে চলে যায়। তখন থেকে জীবন্ত পাথরের ন্যায় হয়ে গেছেন তিনি। একজীবনে তিনি সব পেলেও, নিজের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থেকে গেলেন আজীবন। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি চেয়েছিল প্রেমিক পুরুষকে। সেইজন্য ধনী ফ্যামেলীর মেয়ে হয়েও সাধারণদের মতো চলাচল করতো। বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে একগাদা মেয়েদের সঙ্গে থাকতো। সবকিছুর একটাই কারণ ছিল; আশরাফ মুহতাসিম সাধারণদের পছন্দ করতেন বলে। সেই ব্যাক্তি যখন তাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিল প্রচন্ড দুঃখ পেয়েছিল তিনি। দুঃখের পরে যখন একটু সুখের মুখ দেখল আশরাফ সাহেবকে পেয়ে সেই সুখটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভাগ্যকে অপ্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ স্থান হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুখী হতে পারেননি। ঠিক এমন সময় অনুসা বেগম এসে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার। সেইদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন শবনম চৌধুরী। বাধ্য হয়ে সবটা জানিয়েছিল অনুসা বেগমকে। অনুসা বেগম শবনম চৌধুরীর সিচুয়েশন বুঝতে পারছিলেন। এটাও উপলব্দি করেছিলেন এখানে থাকলে বোন সমতূল্য ননদ কখনো শান্তি পাবেনা। কখনো ভুলতে পারবে না পাষাণ প্রেমিক পুরুষকে। পরবর্তীতে ননদকে তিনি আমেরিকা যাওয়ার পরামর্শ দেন। শবনম চৌধুরী বিষণ্ন মনে একবুক পরিমাণ হতাশা, তীব্রকষ্ট, কাউকে না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে আমেরিকা চলে যায় ঠিকই। তবে পেছনে ফেলে যান শুভাকাঙ্ক্ষীদের। তাছাড়া কলিজার একাংশ আবিদকে ফেলে তিনি শান্তি পাননি ভীনদেশে। তবে মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে।
অপরদিকে আশরাফ মুহতাসিম বিয়েটা মানতেন না তখন। বাবার বিরুদ্ধে তিনি হোস্টেলে গিয়েছিলেন। তিনি সবার কাছে জানতে পারেন শবনম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এখানে। তারপর তার পরিবার তাকে নিয়ে গেছে। এইটা শোনার পর আশরাফ সাহেবের বুক মুষরে উঠেছিল। বারবার খোঁজ করেছিল কিন্তু শবনম চৌধুরীর কোনো খোঁজ পাননি তিনি। সবকিছুর একটাই কারণ, শবনম চৌধুরী সবার কাছে ঠিকানা গোপন রেখেছিলেন। আশরাফ মুহতাসিম তখন নিজেকে বড্ড অপরাধী ভাবতে থাকেন। প্রেমিকাকে হারিয়ে অবশেষে বাবার কাছে ফিরে যান। সংসারজীবনে প্রিয়মা বেগম প্রচন্ড ধৈর্য্যশীল ছিলেন। বাবা চাচাদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মানবী। প্রথম প্রথম আশরাফ মুহতাসিমের কাছ থেকে তিনি ভয়ংকর অবহেলা পেয়েছেন। কিন্তু কখনো অভিযোগ করেননি। স্বামীর তীক্ষ্ম সত্যিটা জানতে পেরেছিলেন প্রিয়মা বেগম। অথচ বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারতেন তৎকালীন সময়ে স্বামী ভার্সিটি পড়ুয়া টগবগে যুবক ছিল। কোন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয় ছিলনা। তবে তিনি সময় দিয়েছিলেন স্বামীকে সবটা ভুলে যেতে। দীর্ঘ দেড়বছর ধরে তাদের মাঝে সবকিছু অস্বাভাবিক ছিল। প্রিয়মা বেগম যখন শ্বশুর-শাশুড়ির ইচ্ছায় কনসিভ করেন তখন থেকে আশরাফ মুহতাসিম চেন্জ হতে শুরু করেন। অবশেষে পেয়েছিলেন তিনি স্বামীর ভালোবাসা। কিন্তু স্বামীর জীবনে প্রথম নারী হতে পারেননি। এইটা নিয়ে তিনি আফসোস করতেন। অথচ আশরাফ মুহতাসিম ছিলেন শবনম চৌধুরীর জন্য পুরোটাই আফসোস। তিনি আশরাফ সাহেবের প্রথম ভালোবাসার স্বীকৃতি ছাড়া কিছুই পাননি। শতচেষ্টা করেও পারেননি ভালোবাসাকে আপন করতে।
.
শবনম চৌধুরী নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তার ভিতরে প্রলয় চলছে অথচ কতটা স্বাভাবিক তিনি। আশরাফ সাহেবের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছেন না। হয়তো তিনি নিজের লিমিটেশন বুঝে গেছেন। নিজেকে সেইভাবে গ্রহণ করতে শিখে ফেলেছেন। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তিনি। কিন্তু আশরাফ সাহেব এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে দমাতে পারছেন না। অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করছেন শবনম চৌধুরীর সঙ্গে তার আলাদা করে কথা বলা প্রয়োজন। সত্যিই অতীব প্রয়োজন। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, কিন্তু আশরাফ সাহেবের বিষণ্ণ হৃদয় কাঁদতে চাইছে। ইতিমধ্যে শবনম চৌধুরী সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু জেনে গেছেন। উনার বড্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে। শবনম চৌধুরীর এমন জীবন গ্রহণ করার জন্য তিনিই দায়ী। এসব ভেবেই তার সবচেয়ে খারাপ লাগছে। আসলে সব অপরাধের ক্ষমা হয়না। শবনম চৌধুরীর কাছে তাকে মাফ চাইতে হবে একবার। নাহলে তিনি নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবে না। তিনি সেইদিন বাবার বিরুদ্ধে চেয়েও কিছু করতে পারেননি ঠিকই। তবে শবনম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয়ই কোন উপায় বের করে ফেলতেন। সেইদিন কিছু ঠিক হয়নি, আশরাফ সাহেব বড্ড দেরী করে ফেলেছিল। তার কারণে-ই শবনম চৌধুরী আজও কষ্ট পাচ্ছেন। তিনি নিজেও এতোবছর যাবৎ মানসিক দ্বন্দ্বে ছিলেন। হঠাৎ আশরাফ সাহেবের মনটা বড্ড ছটফট করছে স্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কেনো এমন করছো, শবনম? নিজেকে গুছিয়ে নেও নাহলে সারাজীবন আমি কষ্ট পাবো। তোমার প্রাক্তনকে মাফ করে দিও, শবনম। সে তোমার জন্য কিছুই করতে পারেনি। আমি তোমার জন্য অযোগ্য ছিলাম।’
অনুষ্ঠান শেষে সবাই বিদায় নেয়। আশরাফ মুহতাসিম আর প্রিয়মা বেগমকে গাড়ি পযর্ন্ত পৌঁছে দিতে শাহরিয়ার চৌধুরী, অনুসা বেগম দুজনে এগিয়ে আসে। তারা সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। তবে তথাকথিত আশরাফ সাহেবের মনটা তখনও ভালো ছিলনা। প্রিয়মা বেগমের কাছেও কারণটা স্পষ্ট ছিল। আশরাফ সাহেব তাকে সবটা জানিয়েছিলেন। তবে শবনম চৌধুরীকে দেখে তিনি নিশ্চিত হোন স্বামীর প্রাক্তন তিনি। দুজনকে বারবার লক্ষ্য করেছেন তিনি; অতঃপর শিয়র হয়েছেন। অথচ কাউকে বুঝতে না দিয়ে তিনি দিব্যি ছিলেন। বলাবাহুল্য তিনিও কষ্ট পাচ্ছিলেন সেটা বিন্দুমাত্র কাউকে বুঝতে দেননি। তবে তিনি স্বামীকে বিব্রত পরিস্থিতিতে দেখতে চাননা। কারণ তিনিই দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে অনিচ্ছুকভাবে আগমন করেছিল। প্রিয়মা বেগম সবটা আগে জানলে এমনটা কখনো হতে দিতেন না। সবটাই নিয়তি ছিল।
এদিকে সবাই চলে গেলে শবনম চৌধুরী অদ্ভুত বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দর্শিনী ফুপিআম্মুর মাঝে আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে। ফুপিআম্মু অসুস্থ বোধ করছেন ভেবে দর্শিনী এগিয়ে যায়। তবে শবনম চৌধুরী হাত দেখিয়ে মানা করেন। তারপর নিজের রুমে ফিরে যান। সবার মাঝে ভালো থাকার অভিনয় করতে করতে বড্ড ক্লান্ত তিনি। এজন্যই এখন নিজেকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতে চান। দর্শিনী দেখল ফুপির মাঝে আগের মতো ভালোবাসা ময় দৃষ্টি ছিলোনা। হয়তো তিনি অসুস্থ বলে দর্শিনী বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই নিলো।
.
আদিবা, নিহালকে আজ তিনদিন ধরে ম্যাসেজ পাঠিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিহাল এখনো সিন করেনি। বিষয়টি নিয়ে প্রচন্ড ব্যাথিত হয় আদিবা। একমুহূর্তের জন্য ডাক্তার মানুষটিকে পাষাণ উপাধি দিতে ভুলল না।তার ছোট্ট মাথায় একটা বিষয় ঢুকছেনা আসলে নিহালের সমস্যাটা কোথায়? তাকে কেনো এতো ইগনোর করে? ছোট্ট একটা রিপ্লাই দিতে কী কষ্ট লাগে? তার অবচেতন মন বারবার আশা করে রিপ্লাই পাওয়ার কিন্তু আসেনা। আদিবা হতাশ হয় তবে আশা ছাড়েনা। সমস্যা নেই আদিবা রিপ্লাই পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছে। আবিদ জরুরি কাজের উছিলায় বাসা থেকে বের হয়ে যায়। হয়তো আজ রাত করে বাড়িতে আসবে। দর্শিনীর যেহেতু নিচে কোনো প্রয়োজন নেই তাই নিজের রুমে চলে যায়।
.
অন্ধকার ফাঁকা একটা রুম। বিনদুমাত্র আলোর উপস্থিতি নেই সেই রুমে। আসফিকে আবিদের লোকজন অচেতন অবস্থায় তুলে এনেছে। বর্তমানে আসফি অর্ধজ্ঞান অবস্থায় চেয়ারে বাঁধা। আবিদ একটুপরে উপস্থিত হবে তার চিরচেনা সিক্রেট রুমে। যেখানে আগেরবার আহানাফকে তুলে আনা হয়েছিল। এবার আসফি, আবিদের নিজের ভাই। কিন্তু আসফির বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। আসফি অতিরিক্ত করেছে সেটাও ভাইয়ের কলিজার সঙ্গে। এই দুঃসাহসের জন্যই আবিদ তাকে শাস্তি দিবে আজ।
#চলবে