#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__২৫
সময় স্রোতের ন্যায় বহমান। খুব দ্রুতগতিতে আবিদ দর্শিনীর বিয়ের দিন এগিয়ে এসেছে। আজকে তাদের গায়ে হলুদ আগামীকাল বিয়ে। মোটামুটি সব আত্মীয়স্বজনদের বিয়ের কার্ড দেওয়া হয়েছিল। সকাল থেকে দু’পরিবারেই আত্মীয়স্বজনদের আগমন। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর বিয়ে মানে বিশাল ব্যাপার স্যাপার। এই সাতদিন ধরে বিয়ের অনেক তোড়জোড় ছিল দু’পরিবারের। চৌধুরী ভিলাতো জাঁক জমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। এদিকে ব্যাতিক্রম নেই মুহতাসিম ভিলারও। আশরাফ মুহতাসিমের নির্দেশনায় মুহতাসিম ভিলা পরিপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। দর্শিনীর গায়ে হলুদ মুহতাসিম ভিলাতে হবে। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে সম্পূর্ণ করা হবে। এই তুখোড় আইডিয়াটা উজানের ছিল। কমিউনিটি সেন্টার এখান থেকে বেশি দূরে নয় তাই আশরাফ মুহতাসিম উজানকে সমর্থন করেন। তিনি নিজে সবকিছু ঠিকঠাক করে চৌধুরী পরিবাকে জানিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু বিয়ের দায়িত্ব উজানের উপর। তাই উজান কোনরকম ত্রুটি ছাড়া বিয়েটা সম্পূর্ণ করবে বলে আশরাফ মুহতাসিমকে আশ্বস্ত করে।
ইতিমধ্যে দর্শিনীর বন্ধুদের মধ্যে দিয়া, নাদিম, হৃদিতা, মিহিরিমা উপস্থিত হয়েছে মুহতাসিম ভিলায়। দর্শিনীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে তারা দারুণ মজা করবে বলে ঠিক করেছে। তাদের মধ্যে একমাত্র আহানাফই আসেনি। শেষে দর্শিনী আহানাফকে ফোন করে আসতে বলে। আহনাফ নিদারুণ কষ্ট বুকে চেপে রেখে জানায় সে বিয়ের দিন উপস্থিত হবে। পরবর্তীতে দর্শিনী আর তেমন কিছু বলেনি। আহানাফের সিদ্ধান্তকে দর্শিনী শ্রদ্ধার সঙ্গে মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু আহানাফের মনোঃকষ্ট তার কাছে অজানা অস্পষ্ট থেকে গেলো। আহানাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন সুইচ অফ করে দেয়। অবাস্তবিক কল্পনা করে আহানাফ বিষণ্নতায় ডুবে যায়।
এদিকে মুহতাসিম ভিলায় সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। প্রজ্জ্বলিনী নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত ছিল এইকয়েকদিন। সে কোনো প্রকার বাঁধা দেয়নি বিয়েতে। সেদিনের পর থেকে যথাসম্ভব নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। তাকে দেখে সহজে কেউ বুঝবে না, সে বোনের বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে উৎসুক। তবে আবিদের প্রতি রাগটা তার এখনো থেকে গেছে। যেমন, সুযোগ পেলেই কালনাগিনীর মতো ফোণা তুলে ছোবল দিতে ভুলবে না। প্রজ্জ্বলিনী প্রিয় বোনের শত্রু নয়। কিন্তু আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীকে থামানোর জন্য তাকে কতো কিছু করতে হবে।
.
সকাল দশটায় চৌধুরী ভিলায় আবিদের গায়ে হলুদ হওয়ার পরে,সেই হলুদ দর্শিনীকে লাগানোর জন্য আদিবা,পুস্পিতা, সঙ্গে আবিদের রিলেটিভদের মধ্যে দু’একজন বোন মুহতাসিম ভিলায় এসেছিল। তাদের উপস্থিতিতে দর্শিনীর গায়ে হলুদ হয়। সবাই মিলে আবিদকে ছোঁয়া হলুদ দর্শিনীর পুরো শরীরে লেপ্টে দেয়। অর্ধভেজা কাঁচা হলুদ শাড়ি পরিহিত, হলুদে ছোঁয়া দর্শিনীর বেশকিছু ছবি তুলে নেয় আদিবা। আদিবা মিষ্টি হেসে সব ছবি পাঠিয়ে দেয় আবিদকে। এদিকে নিজের রুমে শুয়ে আবিদ ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। তার গায়ে হলুদ আগেই সম্পূর্ণ হয়েছে। বাসা ভর্তি মেহমানদের সামনে অসস্থি হচ্ছিলো বলে আবিদ নিজের রুমেই আছে। হঠাৎ হোয়াটসএপে নোটিফিকেশন আসলে সে দ্রুত চেক করে। মূলত আবিদ নিজেই আদিবাকে দর্শিনীর হলুদ ছোঁয়া ছবি পাঠাতে বলেছিল। সে দর্শিনীকে অর্ধভেজা শাড়িতে, হলুদ ছোঁয়া আকর্ষণীয় রূপে দেখে মৃদু ঢোক গিলে ফেলে। দর্শিনীকে আজ প্রচুর আবেদনময়ী লাগছে। কাঁচা হলুদ শাড়িটা ভিজে যাওয়ার জন্য মেয়েলি অবয়ব হালকা ভাবে স্পষ্ট। হঠাৎ আবিদের রাগ হয় বিয়ে বাড়ি মানেই অসংখ্য ছেলেরা থাকবে স্বাভাবিক। এখন দর্শিনীকে যদি কোন ছেলে অর্ধভেজা শাড়িতে দেখে কী হবে তাহলে? হবু বর হিসাবে তার মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তাহলে অন্য ছেলেদের কী হবে ভেবে তার রাগ হয়। সে দ্রুত আদিবাকে ফোন দেয়। বেচারী আদিবা খাওয়া দাওয়া আনন্দ ছেড়ে ভাইয়ের ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই আবিদের নিটোল গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা যায়।
‘প্রিয়দর্শিনীকে বলে দেও, তার আশেপাশে কোন ছেলে যেন না থাকে। আমি চাইনা তাকে এভাবে কোনো ছেলে দেখুক।’ যথেষ্ট গম্ভীর ভাবে বলে আবিদ।
আদিবা ভাইয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। কথার মর্ম বোঁধগম্য হতেই মৃদু মেজাজ দেখিয়ে বলে,
‘আপুর গায়ে হলুদ তো হয়ে গেছে ভাইয়া। শুধু মেয়েরাই ছিল কোন ছেলে অ্যালাউ ছিলোনা। সবেমাত্র আপুকে গোসল করিয়ে রুমে পাঠানো হলো। বেকার বেকার অযথা চিন্তা করছো। রাখছি এখন সবাই খাওয়া দাওয়া করব।’ বলেই ফোনটা কেটে দেয় আদিবা।
আবিদ নির্বোধের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়। সত্যিই কী সে বেকার চিন্তা করছে? তার আদুরে বোন তাকে পাত্তা দিলোনা। এইযে দর্শিনীকে সবাই হলুদ ছুঁয়ে দিয়েছে। অথচ হবু বর হিসাবে হলুদ ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার তার সবচেয়ে বেশি রয়েছে। কিন্তু সেটাতো সম্ভব ছিলনা। সম্ভব হলে সে নিজ হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিতো তার সুদর্শিনীকে। তবে তার শরীরে ছোঁয়া হলুদই দর্শিনীকে লাগানো হয়েছে। এটা ভেবে মিষ্টি হাসে আবিদ।
এরমধ্যে আবিদ দর্শিনীকে অনেকবার ফোন দেয়। এদিকে দর্শিনী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়ায় ব্যাস্ত ছিল। তার ফোনে চার্জ ছিলো না বিধায় আবিদ বারবার ফোন বন্ধ পেলো। শেষে মেজাজ চওড়া করে বেচারী আদিবার থেকে খোঁজ খবর নিচ্ছিলো। আদিবা বিরক্ত হয় আবিদের কার্যক্রমে তবুও ভাইকে ঠিকই কো-অপারেট করছিলো। এদিকে দর্শিনীর প্রতি মেজাজ হারিয়ে ফেলে আবিদ।
বিকেলের দিকে দর্শিনীকে কাঁচা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। ধবধবে ফর্সা শরীরে কাঁচা হলুদ লেহেঙ্গা, লাইট মেকআপ, রজনীগন্ধা গোলাপ সংমিশ্রণে তাজা ফুলের গহনায় দর্শিনীকে অপ্সরার মতো সুন্দর লাগছিল। সবার নজর ছিল তার উপরে। দর্শিনীর সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে গেছে। আবিদের যেহেতু মেহেদী অনুষ্ঠান হবে না। তাই সবাই নিদ্বির্ধায় দর্শিনীর মেহেদী অনুষ্ঠানে থেকে গেছে। পার্লার থেকে চার পাঁচজন জন আর্টিস্ট এসেছে। দর্শিনীকে নিপুণ ভাবে মেহেদী পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু’হাত ভর্তি মেহেদীর মাঝে আবিদ নামটা জ্বলজ্বল করছে। দর্শিনী মৃদু লজ্জা পায়। এভাবেই আবিদ তার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে মিশে যাচ্ছে। প্রতিটা মোমেন্টের ছবি তুলে আদিবা আবিদকে পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে আবিদ দর্শিনীকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
দর্শিনীর মেহেদী সন্ধ্যায় বিভিন্ন আইটেমের খাবার দাবার, নাচ-গান, আনন্দ উৎসবের সবরকম ব্যবস্থা ছিল। আবিদের আত্মীয়দের মধ্যে আদিবা, মিথিলা, ইশিতা এছাড়া দর্শিনীর ফেন্ডসদের মধ্যে দিয়া, হৃদিতা, মিহিরিমা সবাই একসঙ্গে সুন্দর গানে ডান্স পারফরম্যান্স করে। একদিকে সবাই মেহেদী সন্ধ্যা দারুণভাবে উপভোগ করে। অন্যদিকে নাদিম সহ দুজন ক্যামেরা ম্যান সবকিছু ফ্রেম বন্দি করতে থাকে। সবাই আনন্দ উৎসবে মেতে থাকলেও প্রজ্জ্বলিনী দূরুত্ব বজায় রেখেছিল। এসবকিছু তার জন্য চক্ষুশূল হয়ে গেছে।
.
মেহেদী উৎসব শেষ হতেই আদিবারা চলে যায়। রাত হয়ে এসেছে। আত্মীয়স্বজনরা ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়মা বেগম এবং বেশ কিছু কাজের লোকজন কালকের জন্য যাবতীয় কাজকর্ম সেরে নেয়। উজান আর আশরাফ মুহতাসিম, তারাও বসে নেই। একেরপর এক ফোনকল দিয়ে সবাইকে সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ভালোভাবে। কমিউনিটি সেন্টারের যাবতীয় কার্যাবলী এখন শেষ। এবার শুধু কালকের অপেক্ষা, বিয়েটা ভালোয় ভালোয় সম্পূর্ণ হোক সবার একটাই প্রত্যাশা।
দর্শিনী রাতে ফ্রেশ হয়ে এসে দ্রুত ফোনে চার্জ দেয়। একটু চার্জ হতেই তড়িঘড়ি করে ফোনটা অপেন করে। সে আবিদের অনেকগুলো ফোনকল, মেসেজ পায়। মূলত আদিবা যাওয়ার আগে বলে দিয়েছে ভাইয়া খুব রেগে আছে তুমি ফোন রিসিভ করোনি তাই। ব্যাস! আদিবার কথা শুনে দর্শিনী বুঝতে পারে ফোনে চার্জ না দিয়ে সে কতোবড় ভুল করেছে। তৎক্ষণাৎ ফোন দেয় আবিদকে। আবিদ ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করেনা। একবার, দুবার, দশবার দেওয়ার পরও রিসিভ করেনি আবিদ। দর্শিনীর মনটা কেঁদে উঠে। এমন পরিস্থিতিতে আবিদ তাকে অহেতুক ভুল বুঝুক সেটা দর্শিনী চায়না। এতোকিছু ভাবনার মাঝে লাস্ট মোমেন্টে ফোনটা রিসিভ হয়। দর্শিনী উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করে,
‘রাগ করেছেন আমার উপর?’
‘তাতে কার কী এসে যায়? আমার জন্য তো কারো কাছে পর্যাপ্ত সময়ও নেই। আমি রাগ করলেই বা কী দর্শিনী? কারো কাছে আমার আকুলতা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবকিছু নিছক উপহাস মাত্র।’ ___আবিদের ভাবলেশহীন উত্তর।
দর্শিনীর এখন মাথা ঠুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে কী ইচ্ছে করে ফোন অফ করে রেখেছিল? নাকি সে বলেছে আবিদের জন্য তার কাছে সময় নেই? তার স্বপ্ন পুরুষ অকারণে তার উপর অভিমান করছে।
‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী!’
দর্শিনীর কাঁপাকাঁপা শীতল কন্ঠস্বর। হঠাৎ আবিদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। ফোনটা কানের কাছে নিয়ে সে নিশ্চুপ থাকে। দর্শিনী এবার আবিদের গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে। দুজনের নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। দর্শিনী একটু থেমে বলে,
‘সরি! ফোনে চার্জ ছিলনা। আজকে অনেক আত্মীয়স্বজন ছিল সবাইকে রেখে উপরে যেতে পারিনি, ফোনে চার্জটাও দেওয়া হয়নি। আমার উপর রাগ করবেন না। আপনার জন্য আমার সবচেয়ে বেশি যায় আসে। এগুলো নিছক উপহাস নয়, ভালোবাসি!’
আবিদ নিঃশব্দে হাসে। দর্শিনীর উপর প্রথমে অভিমান করেছিল সে। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর কোন অভিমান স্পষ্ট নেই। মেয়েটা যে আবিদের ভালোলাগা এবং ভালোথাকার মাধ্যম। তার উপর এতো সুন্দর করে মেয়েটা ভালোবাসি বলল আবিদ কীভাবে রাগ করবে? আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘একটা শর্তে রাগ করবো না।’
দর্শিনী উদগ্রীব হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জিগ্যেস করে,
‘কী শর্ত?’
‘এখন এই মুহূর্তে গার্ডেন এড়িয়ায় আসবেন। আমি আপনার জন্য অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি। ফোন ধরছিলেন না বলে অনেক টেনশনে ছিলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে আপনাকে দেখতে আসতে হলো নাহলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। এভাবে আপনাকে দেখার ইচ্ছে আমার আজীবন থাকুক দর্শিনী।’
দর্শিনী অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে! আবিদ এখন এখানে কী করছে? দর্শিনী আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘কিহহ! আপনি এখানে?’
‘হ্যাঁ কোন সমস্যা?’
‘সমস্যা নয় কিন্তু….!’
‘কোন কিন্তু নয়। আপনি আসবেন নাকি চলে যাবো?’
দর্শিনী বিচলিত হয়ে বলে,
‘আসছি একটু অপেক্ষা করুন।’
দর্শিনী সোনালী পাড়ের মসৃণ হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত। আবিদ বলেছিলো বিয়ের পর দর্শিনীকে প্রতিদিন শাড়িতে দেখতে চায়। মূলত সে শাড়িতে অভ্যস্থ হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। দর্শিনী মাথায় একটা চাদর পেচিয়ে ধীরে ধীরে সবার অগোচরে নিচে নামতে থাকে। বাড়ি ভর্তি মেহমান রয়েছে। কেউ যদি আবিদকে এখানে দেখে কী ভাববে সবাই?এটা ভেবেই দর্শিনীর প্রেশার ফল করছে। আবার আবিদের সঙ্গে দেখা না হলে মানুষটা রাগ করবে। সবশেষে ভেবেচিন্তে দর্শিনী গার্ডেনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে আসে।
#চলবে