হঠাৎ হাওয়া, পর্ব:১৯

0
1258

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১৯

পরেরদিন সকালবেলা নিরু আর ফারহান আগে চিম্বুক পাহাড়ে গেল তারপরে স্বর্ণমন্দিরে। নিরু তো বরাবরের মতো অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু। প্রকৃতির কতো রূপ আবার মানুষের তৈরি নিদর্শনেরও কতো রূপ। সবকিছুতেই কতো সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।

ঘুরাঘুরি শেষে ওরা দুপুরেরই রিসোর্টে ফিরে এল। আজকে রাতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে ওরা।

রিসোর্টে এসে শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করে নিল দুজনে। তারপর রুমে এসে নিরু জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। ফারহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি হাতে থাকা ফোনের দিকে। নিরু সব গোছানো শেষে বিছানায় এসে বসতেই ফারহান ফোন রেখে নিরুর দিকে তাকালো।

নিরু প্রশ্ন করলো, “বাড়িতে কী জানে যে আমরা আজকেই রওনা হবো?”

ফারহান উঠে বসে বললো, “বলেছি কালকে যাবো। আমাদের যেতে যেতে তো কাল সকাল হয়েই যাবে।”

“হুম।”

ফারহান নিরুকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “মন খারাপ করো না। আবার অন্য কোথাও ঘুরতে যাবো।”

“হুম।”

ফারহান আদুরে স্বরে বললো, “নিরু? শোনো না।”

নিরু ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো, “হুম, শুনছি তো। বলো।”

“আজ ওই আকাশী রঙের শাড়িটা পড়বে।”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা, আমি আজকে ওই শাড়িটাই পড়তে চেয়েছিলাম।”

“শুধু পড়লেই হবে না।”

নিরু ভ্রু কুঁচকে বললো, “তাহলে?”

“আমি পড়িয়ে দেব।”

“তুমি পড়িয়ে দেবে? শাড়ি পড়াতে পারো তুমি?”

ফারহান মাথা চুলকিয়ে বললো, “তোমাকে শাড়ি পড়তে দেখতে দেখতে শিখে গেছি মানে পারবো।”

নিরু মৃদু হেসে বললো, “আচ্ছা, পড়িয়ে দিও।”

ফারহান টুপ করে নিরুর গালে একটা চুমু দিল।

_________________

বিকেলবেলায় ওরা রিসোর্টের আশেপাশে ঘুরতে বেরোলো। ফারহান-ই নিরুকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। যদিও একটু অগোছালো হয়েছিল কিন্তু নিরু ঠিক করে নিয়েছে। ফারহানও আকাশী রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়েছে।

আজকে আকাশটাও তার প্রকৃত রূপ ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে।

নিরু আর ফারহানকে দেখে মনে হচ্ছে আজকে আকাশের সাথে পাল্লা দিয়েই সেজেছে তারা। সবকিছুই আকাশীময়। আশেপাশে সবুজেরও কোনো কমতি নেই। দূরের পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে গাঢ় সবুজ আর কালো রঙের মিশ্রণে রং করা কোনো চিত্রশিল্প। খুবই যত্ন নিয়ে তাদের প্রকৃতির পাতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

নিরু-ফারহান কিছুদূর হেঁটে গিয়ে একটা ছোট টিলার উপরে গিয়ে বসলো। নিরু খোলা চুলগুলো সামনে এনে রাখলো। মৃদু হাওয়ায় বারবার সামনে এসে পড়ে তাই একেবারে সামনে থাকাই ভালো। ততোটাও বিরক্তি লাগবে না।

নিরু চোখ পাকিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। ওর জন্যই তো এই দশা। নিরু চেয়েছিল চুলগুলো খোঁপা করতে কিন্তু ফারহান বায়না ধরেছিল খোলা রাখার জন্য।

ফারহান নিরুর ওরকম চাহনির প্রতিত্তোরে মেকি হাসলো।

পড়ন্ত বিকেল। রোদ একেবারেই নেই। শুধুমাত্র দূরের পাহাড়চূড়ায় রোদের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। বিচিত্র রকমের পাখিরা উড়ে চলেছে তাদের আপন ঠিকানায়। কিছু কিছু পাখি এখনো গাছের ডালে বসে খাবার সংগ্রহের চেষ্টায় আছে।

সন্ধ্যা হয়ে আসতেই ওরা রিসোর্টে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলো।

নিরু হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে পরিচিত কোনো মুখশ্রী দেখে ফারহানকে ইশারায় দেখিয়ে বললো, “ওটা শ্রাবণী আপু না?”

ফারহান ওদিকে না তাকিয়েই ভ্রু কুচকে বললো, “ও এখানে কী করবে?”

“আরে আগে দেখো তো।”

ফারহান নিরুর ইশারা অনুযায়ী তাকাতেই দেখলো নিরু ঠিকই বলছে। কিছুটা দূরে শ্রাবণী দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে।

ফারহান ওদিকে মনোযোগ না দিয়ে বললো, “থাকতেই পারে। আমাদের কী? চলো আমরা ফিরে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তায় তেমন লাইটও নেই। রোড লাইট একটা আছে তাও মনে হয় নষ্ট।”

“হুম, চলো।”

ওরা শ্রাবণীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগেই শ্রাবণী ‘ফারহান’ বলে ডাকলো।

ফারহান পাশ ফিরে তাকাতেই বললো, “কেমন আছেন?”

ফারহান সৌজন্যসূচক হেসে বললো, “ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“এইতো ভালো। বউ নিয়ে হানিমুনে এসেছিলেন না-কি?”

ফারহান হেসে বললো, “জ্বি, ওইরকমই। আপনি এখানে?”

“আজকেই এসেছি। চাকরির বদলি সূত্রে। মাসখানেক হলো অনার্স শেষে চাকরিতে জয়েন করেছি। আজ এখানে বদলি হয়ে এলাম।”

“ওহ, আচ্ছা। আমরা যাই তাহলে। ভালো থাকবেন।”

“হুম, আপনারাও।”

ফারহান আবারো নিরুর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করতেই নিরু কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিলো আমি ছিলামই না আপনাদের মাঝে। এত হেসে হেসে কথা বলার কী ছিল? না হেসেও কথা বলা যেত।”

নিরুর আচরণে ফারহান মুখ চেপে হাসলো। কিছু না বলে নিরুর নাক টেনে দিল।

নিরু ভেংচি কেটে আবারো ফারহানের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

নিরু-ফারহান চোখের আড়াল হতেই শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো, “অবশেষে চলেই এলাম তোমাদের জীবন থেকে। অযথা মাঝে আটকে থেকে কী লাভ হতো? আমি তো শুরু থেকে কখনো তোমাদের মাঝে ছিলামই না শুধুশুধু মাঝখান থেকে জড়িয়ে কী লাভই বা হতো? হ্যাঁ চেয়েছিলাম তোমাদের মাঝে আসতে। আমার যা হওয়ার কথা ছিল, যা নিজের দোষে হারিয়েছিলাম সেটা ফেরত পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বদলি হয়ে চলে এলাম এই অচেনা শহরে। হয়তো সৃষ্টিকর্তাই চাননি আমি তোমাদের মাঝে থাকি। তাহলে আর থেকে কী করতাম? থাকো তোমরা তোমাদের মতো।”

__________________

রাত সাড়ে নয়টায় রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়লো ওরা। বাস দশটায়। বাসস্ট্যান্ড কাছাকাছি হওয়ায় বেশ ধীরেসুস্থেই যাচ্ছে।

নিরু রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সবটা দেখে নিল। তিনদিন এখানে থেকে মনে হয়েছে নিজের বাড়িতেই ছিল। মাঝে মাঝে ওর নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হয়, সব কিছুতেই এত সহজে মায়া পড়ে যায় কেন?

বাসে উঠেই ফারহানের একহাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো নিরু। ঘুম পাচ্ছে তার। চোখ জোড়া ক্লান্ত হয়ে আছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

ফারহানও পরম যত্নে নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। বাসের জানালাটা একটু করে খুলে দিল। এতেই বেশ বাতাস আসছে। বেশি খুলে দিলে যদি নিরুর আবার শীত লাগে। যতই গরম হোক বেশিক্ষণ বাতাসে থাকলে শীত লাগবেই।

ফারহান নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই তিনদিন কতো খুশি ছিল মেয়েটা। সবসময়ই মুখে হাসি লেগেই থাকতো। কোনো কিছু দেখে অতিরিক্ত মাত্রায় অবাক হলে কী সুন্দর গোল গোল চোখ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। যতক্ষণ না অবাক ভাবটা কাটছে ততক্ষণ মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরোতো না। আবার যখন রাগ হতো তখন চোখ পাকিয়ে তাকাতো। তাতেই তো ফারহানের রফাদফা হয়ে যেত। অতিরিক্ত শান্ত মানুষ যখন রেগে যায় তখন ভয়টা অনেক বেশিই কাজ করে তবে ফারহান ভয় কখনোই পেত না। তার তো হাসি পেত। হাসি আটকে রাখতেই অবস্থা খারাপ হতো।

ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো ফারহানের। এই ছোট্ট মেয়েটার প্রেমেই সে বহুবার পড়েছে। নিরু প্রাপ্তবয়স্ক হলেও ফারহানের হিসেবে অনেক ছোট। আট বছর তো হবেই।

ফারহান নিরুর কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে ওর মাথাটা বুকে নিয়ে সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কাল সকালেই বাড়িতে পৌঁছে যাবে। পরশু থেকে আবারো সব আগের মতো হয়ে যাবে। কাজের সাথে সম্পর্কটা আবারো মজবুত হবে। ব্যস্ত জীবনের সাথে আবারো নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। তবুও কিছুদিন এই ঘুরাঘুরির রেশটাই মনের ভেতরে থেকে যাবে। মনে হবে, এইতো সেদিন ঘুরে এলাম। আবারো যেতে ইচ্ছা করছে। কত মনোরম পরিবেশ ছিল।

সকাল আটটায় বাড়িতে এসে পৌঁছালো ওরা। নিরু সারা রাস্তাই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। বাস থামার পর ফারহান ডেকে তুলেছে।

বাবা-মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে ওরা রুমে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। নিরুর ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। রুমে এসেই আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো।

ফারহান ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “নিরু ওঠো। তুমি কী আবার ঘুমাবে না-কি? ফ্রেশ হবে না?”

নিরু ঘুমঘুম কণ্ঠে উত্তর দিল, “উঁহু, ঘুমাবো না এখন আর। তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর আমি যাচ্ছি।”

ফারহান ফ্রেশ হয়ে আসতেই নিরুও আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ হয়ে এলো। ব্রেকফাস্ট করতে যাবে। সেই কাল সন্ধ্যায় খেয়েছিল তারপরে ঘুমের জন্য আর কিছু খাওয়াই হয়নি।

সবার খাওয়া শেষে নিরু টেবিল গোছাচ্ছে এমন সময় ফারিয়া আর ওর হাসবেন্ড আতিক এলো। দুজনেরই ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসির রেখা। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে ওরা সোফায় বসলো। এখনি না-কি চলে যাবে আবার।

এত হুলস্থুল করে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই আতিক সহাস্য মুখে বললো, “আসলে আপনাদের দাওয়াত দিতেই এত সকাল সকাল আসা। কাজ থাকায় আবার এখনি চলে যেতে হবে।”

ফারহান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কিসের দাওয়াত ভাইয়া?”

“রাত্রির বিয়ে। আগামী সপ্তাহেই। বুঝতেই তো পারছো অনেক কাজ। তবুও ফারিয়াকে তো আর একা পাঠাতে পারি না তাই আমিও এলাম।”

আরো বিভিন্ন ধরনের কথা বলে ওরা চলে গেল। ফারিয়াকে থাকতে বলেছিল কিন্তু সে ও আতিকের সাথেই চলে গেছে। বিয়ে বাড়ির সব কাজ তো আতিক একা সামলাতে পারবে না। শপিং করতে হবে।

রাত্রির বিয়ের কথা শুনে ফারহান বেশ খুশিই হয়েছে শেষ পর্যন্ত তো তাও মেয়েটা মুভ অন করতে পেরেছে। হোক না দেরিতে। তাও তো পেরেছে। ফারহানের আর অপরাধবোধ থাকবে না যে তার কারণে কেউ নিজের জীবন নষ্ট করেছে।

#চলবে__??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here