#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৬.
সকাল দশটা। নাশতা খেতে বসে ইমতিয়াজ সাহেব ইরাজের খোঁজ করলেন,
“মেঘা মা, রাজকে ডাক দিসনি!ʼʼ
মেঘালয়া গোপনে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে চাইল, “রাতে মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে আছে, আপনার রত্ন।ʼʼ তবে মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নত করে খেতে শুরু করল। ইমতিয়াজ সাহেব তাকিয়ে দেখলেন মেঘালয়ার দিকে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, দুজনের সম্পর্ক মোটেই স্বাভাবিক নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি ছেলেকে জানেন। ওই ঘাঁড় ত্যাড়াকে বোঝানোর সামর্থ তার কোনদিন হয়ে ওঠেনি। তবে এবার কিছু দরকার। প্রিয় বন্ধুর ঘরের আমানত তুলে এনেছেন। সেই আমানতকে সুখে না রাখতে পারলে, নিজেকে বন্ধুর কাছে বড্ড ছোটো মনে হবে যে!
খাওয়া শেষ করে উঠতে যাবেন তিনি, মেঘালয়া ইতস্তত করে বলে উঠল, “বাবাই!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব ফিরে তাকালেন। মেঘালয়ার কথা শুনতে তৎপর হয়ে চেয়ে রইলেন। মেঘালয়া আড়ষ্টতায় কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে। তবুও সকল সংকোচ কাটিয়ে বলে উঠল, ধীর-স্থির স্বরে, “আব্বু হয়ত অনুমতি দেবে না। তবে আমি পড়া-লেখা চালিয়ে যেতে চাই।ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব কেন জানি কথাটা শুনে অপ্রস্তুত বোধ করলেন। তবে মেঘালয়ার সুশ্রী, শ্রী মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রত্যাখান করার সাহস হলো না। জোরপূর্বক মৃদূ হেসে বললেন, “ঠিক আছে। রাজের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তুই খাওয়া শেষ কর।ʼʼ
একরকম এড়িয়ে চলে গেলেন যেন তিনি।
মেঘালয়া রুমে চলে এলো। এসেই দেখল ইরাজ বিছানার সাথে মিশে ঘুমে বিভোর। কেন জানি সহ্য হলো না ইরাজের এমন শান্তির ঘুম দেখে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে পারফিউম হাতে তুলে নিয়ে তা সজোরে শব্দ করে রাখল। তাতে ইরাজ নড়লও না। অথচ মেঘালয়ার ওকে ঘুম থেকে ওঠাতেই হবে। পারফিউমের কৌটা হাতে তুলে নিয়ে বিছানার কাছে এসে বিকট আওয়াজে মেঝেতে ফেলে দিলো। এবার ইরাজ সামান্য নড়ে ওঠে। একটু এপাশ-ওপাশ হয়ে আবার শুয়ে পড়ল। মেঘালয়ার রাগ হচ্ছে। সরাসরি ডাকতে শুরু করল, “ইরাজ ভাই, কানে তুলো গুজে ঘুমান? ইরাজ ভাই? উঠবেন নাকি বাবাইকে গিয়ে বলে আসব, আপনি মাতাল হয়ে পড়ে আছেন!ʼʼ
কাজ হলো খানিকটা, তবে পুরোটা না। এবার ইরাজকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। ইরাজ চোখ মেলে তাকায়। লাল টকটকে হয়ে আছে চোখ। মেঘালয়া ছিটকে সরে দুরে দাঁড়াল। দ্রুত সাফাই গাওয়ার স্বরে বলে উঠল, “রিল্যাক্স, ইরাজ ভাই। কথা বলার আছে আপনার সাথে। নয়ত, আপনি ম রে থাকলে আমারই শান্তি। আই মিন, আপনি ঘুমিয়ে থাকলে।ʼʼ
ইরাজ উঠে বসল। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। ব্যাথায় ভেঙে আসছে যেন। চেপে ধরে বসল। অ্যালকোহলের প্রভাব পুরোটা কাটেনি এখনও। মেঘালয়া ইরাজকে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে, আরও খানিকটা দুরে সরে দাঁড়াল। ইরাজ ওর দিকে না তাকিয়ে হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মেঘালয়া চিন্তিত মুখে, সোফায় গিয়ে বসে। এমন জাহিল পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে আব্বু তাকে কত ঘটা করে এ বাড়িতে পাঠিয়েছে। নিজের ওপরই তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল।
ইরাজ বেশ কিছুক্ষণ পর একেবারে গোসল নিয়ে বের হলো। মেঘালয়া ভেবেছিল, বেরিয়ে চোটপাট শুরু করবে। তবে তেমন কিছুই হলো না। শান্ত পায়ে বেরিয়ে এসে বিছানার ওপর বসল। শীতল, ভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল, “টক জাতীয় কী আছে বাড়িতে?ʼʼ
মেঘালয়া অবাক হয়ে চেয়ে রয়। ইরাজকে নিয়ে কি তার কোন ভাবনা-ই কখনও সঠিক হবে না? এ কেমন অদ্ভুত মানসিকতার মানুষ! বলল, “সকালে ফ্রিজে লেবু দেখেছি।ʼʼ
“শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়, সামান্য পানি দিবি লেবুর রসে।ʼʼ
এমন শান্ত স্বরের আদেশ শুনে, চোখ বুঁজে একটা নিশ্বাস নিলো মেঘালয়া। কেন জানি ইরাজের কথা মানতে ইচ্ছে না করলেও উঠে দাঁড়াল। এখন আর তামাশা না হোক।
লেবুর শরবত এনে দিলে, তা এক চুমুকে শেষ করল ইরাজ। মাথার দুপাশ চেপে ধরে, ওভাবেই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। মেঘালয়া মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করে ওঠে, “এসব না গিললে পাপ হয়? নাকি গিললে, নেকী!ʼʼ
ইরাজ অর্ধখোলা চোখ মেলে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে, শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কি বলবি?ʼʼ
মেঘালয়া প্রায় তেজী কণ্ঠে বলে উঠল, “আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না। প্রশ্ন করেছি উত্তর দিন।ʼʼ
ইরাজ নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল, “তোর প্রশ্নে আমার কোন যায়-আসে বলে মনে হয়, তোর? ধাক্কা মেরে দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেই, তার আগে উপযুক্ত কিছু বল, যা বলতে চেয়েছিলি। তোর বলা কথা প্রয়োজনীয় মনে না হলে, জিহ্বাটা এক টানে ছিঁড়ে ফেলব।ʼʼ
শেষের কথাটুকু শুনতে কেমন হিংস্র শোনাল। মেঘালয়া এসবে অভ্যস্ত। সে আর ইরাজের কাছে অন্যকিছু আশাও রাখে না। চোখ বুঁজে দ্রুততার সাথে বলে ওঠে, “আমি পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে চাই। আর বাবাই আপনার অনুমতি পেলে, অনুমতি দেবে।ʼʼ
এক ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজ। অতঃপর মুখ বেঁকিয়ে হেসে ওঠে। তিরস্কার করে বলে, “পড়তে গিয়ে আবার পালিয়ে গেলে, এবার আমার বাপের মুখ পুড়বে। তোর বাপেরটা কালা করেই এসেছিস।ʼʼ
মেঘালয়ার বুকটা ভার হয়ে উঠল। চোখটা ঝাপসা লাগে। চোখে তরল জমেছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরল। গিলে নেয় কান্নাটুকু। তীর্যক কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে ওঠে, “পালাব না আর। এবার গেলে আপনাদের জানিয়েই যাব। আর যদি আমাকে পড়তে না দেওয়া হওয়া হয়..
কথা শেষ করতে দিলো না ইরাজ। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “না দিলে? না দিলে কী? আমার তো এবার ভয় লাগছে রে মেঘ! না দিলে তুই আবার না কারও সাথে পালিয়ে যাস। প্লিজ যাস না। মেঘ! না দিলে কী?ʼʼ
ইরাজের ঠাট্টা মেঘালয়ার শরীরে জ্বালা ধরায়। চুপ হয়ে গেল একদম। আর কোন কথা না বলে, চুপচাপ উঠে চলে গেল সেখান থেকে। ইরাজও আর ফিরে তাকাল না সেদিকে।
ইরাজ দুপুর বারোটার দিকে, তৈরী হয়ে বাইরে চলে গেল। মেঘালয়া বসার রুমে বসে ছিল। ইরাজের বেরিয়ে যাওয়া দেখল। ইরাজের গাড়ি, বাড়ি থেকে দুর হতেই সে নিজেও বেরিয়ে পড়ল অজানার উদ্দেশ্যে। কোথায় যাবে জানা নেই। অথচ এত অপমান, আর গ্লানি নিয়ে অন্তত এ বাড়িতে থাকতে পারবে না। গভীর ক্ষত অনুভূত হচ্ছে বুকে। ভেতরে যেন রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। প্রায় দিন তিনেক তো কেটে গেল। আব্বু ভুলেও একবার তার খোঁজ নেয় নি। এত ঘৃন্য হয়ে উঠেছে, সকলের কাছে মেঘালয়া! তাহলে তার উচিত, নিজের খারাপ চরিত্র নিয়ে এই সম্মানী মানুষগুলো থেকে দুরে থাকা।
এসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল, নিরুদ্দেশ। কিছুক্ষন পর মনে পড়ল, কাছে চার-আনা পয়সাও নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাছেই এক শিশুপার্ক। সেখানে ঢুকে একটা বেঞ্চির ওপর বসল। রোদ লাগছে গায়ে, তবে সেসবে আর আজ যায়-আসল না মেঘালয়ার। মনে মেঘ জমে আছে। একটু ঢিল দিলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে দু চোখ বেঁয়ে।
_
আনতারা খানম সারাদিন ভেবেছিলেন, হয়ত না বলেই, আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে চলে গিয়েছে। কিন্ত বিকেল হয়ে আসার পরও মেঘালয়াকে ফিরতে না দেখে ভাবলেন, তিনি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসবেন। সাথে বেড়ানোও হয়ে যাবে। তিনি বেরিয়ে পড়লেন। হেলাল সাহেবের বাড়ির পাশেই তার বোনের ননদের বাড়ি। তার বাড়ি পার করে যেতে হয়, হেলাল সাহেবের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে বাকিটুকু হাঁটার পথ। সামান্য খানিকটা রাস্তা। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেই বোনের ননদ মেরিনা শিকদার। আনতারা খানমকে দেখেই মুখটা কালো করে ফেলল সে। একটু এগিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে থামল আনতারা খানম। মেরিনা নিজেই বলে ওঠে,
“কোথায় চললে? ছেলের শশুর বাড়ি?ʼʼ
চোখ-মুখ কেমন বিকৃত করেই বলেছে কথাটা। তা আনতারা খানমের চোখে লাগলেও, তিনি মৃদূ হেসে ঘাঁড় নাড়লেন। মেরিনা আবার নিজেই বলে ওঠে, “তোমরা নেহাত ভালো মানুষ গো বুবু। নইলে ওমন ভেগে যাওয়া মেয়েকে ঘরের বউ করে তুলতে নাকি?ʼʼ
এ পর্যায়ে আনতারা খানম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তার ঠিক বোধগম্য হয়নি মেরিনার কথাটা। হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কার কথা বলছো তুমি?ʼʼ
মেরিনা তাচ্ছিল্য করে বলে, “ছেলে কয়টা তোমার? আর বিয়েই বা কয়টা দিছো?ʼʼ
আনতারা খানম এবার থমকে গেলেন যেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন, “মেঘা। মেঘার কথা বলছো?ʼʼ
“মেঘাকেই তো ছেলের সাথে বিয়ে দিছো না?ʼʼ
“মেঘা পালিয়েছিল? কার সাথে? মজা করছো?ʼʼ— উদগ্রীব হয়ে ওঠেন আনতারা খানম।
যা শুনেছেন, তার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। দৌঁড়ে গেলেন হেলাল সাহেবের বাড়ির দিকে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, মেঘালয়া এখানে আসেনি। আনতারা খানমের মুখটা কেমন কঠিন আকার ধারণ করেছে। ভেতরে তোলপাড় চলছে।
হেলাল সাহেব শুনলেন, মেয়ে ও বাড়িতে নেই। এখানেও আসেনি। তাহলে গিয়েছে কোথায়? অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে তার।
আনতারা খানম আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে। হেলাল সাহেব, আনতারা খানমের মুখ দেখেই বুঝেছেন, এই অসন্তুষ্ট চাহনির পেছনের কারণ। তার বুকটা আবারও ধুক করে উঠল। মেয়ের ঘর ভেঙে যাবে এবার?
আনতারা খানম বেরিয়ে এসে, রাস্তার একপাশে দাঁড়ালেন।
মাগরিবের আজান হচ্ছে আশেপাশের মসজিদে। ইরাজকে কল করলেন। কয়েকবার রিসিভ হলো না। তিনি আবার চেষ্টা করলেন। এবার ইরাজ কল রিসিভ করেই, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, “কী সমস্যা, আম্মা! এতবারে যখন কল রিসিভ করছি না, মানে বোঝো না? আমি ব্যস্ত আছি।ʼʼ
আনতারা খানম কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন, “কোথায় আছিস তুই?ʼʼ
মায়ের কণ্ঠস্বর এমন গম্ভীর শুনে, ইরাজ বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে হয়ত। বিরক্ত হয়ে বলল, “এত শিরোনাম না দিয়ে, আসল কথা বলো।ʼʼ
আনতারা খানম তিরস্কার করে ওঠে, “ভেগে যাওয়া বউ ঘরে তুলেছিস বাপ-ব্যাটা জেনে শুনে। একটু সতর্ক থাকলেও তো পারিস। আবার যেতেই পারে।ʼʼ
ইরাজের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল, “মেঘ, বাড়িতে নেই?ʼʼ
আনতারা খানম আর কোন কথা না বলে, কল কেটে দিলেন। তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে আছে। তাকে না জানিয়ে এমন একটা কাজ করে ফেলেছে সকলে! যেখানে রাস্তায় ধরে লোকে কটু কথা শোনাচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? আজ হেলাল সাহেবের মুখ দেখে ঘৃণা হয়েছে তার। নিজের মেয়ে মুখ পুড়িয়েছে, তা ইরাজের ঘাঁড়ে ঠেলে দিলেন কি করে তিনি? আনতারা খানম বিক্ষিপ্ত পায়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন, এসব ভাবতে ভাবতে।
_
ইরাজ ক্লাবে বসে দলবল নিয়ে আড্ডায় মেতে ছিল। এমন একটা খবর শুনে, বিরক্তিতে মুখ কুঞ্চিত করে উঠে দাঁড়াল। পকেটে হাতরে বাইকের চাবি বের করে, চুপচাপ বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে।
বাড়িতে এসে, ছুটে নিজের রুমে গেল। আলমারী খুলে দেখল, সব ঠিকঠাক। কোন কাপড় বা টাকা কিছুই সরেনি। টি-টেবিলের ওপর মেঘালয়ার ফোন পড়ে আছে। অর্থাৎ মেঘালয়া খালি হাতে বেরিয়ে গেছে।
সেই দুপুর থেকে, এখন সন্ধ্যা পার হয়ে প্রায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। মেঘালয়া প্রানহীণের মতো বসে আছে। চারদিকের ঘটে যাওয়া চলমান পরিবেশের ঘটনা অথবা শব্দ, প্রকৃতির হাওয়া কোনকিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি আজ। প্রাণহীণের মতো বসে আছে সেই ঘন্টার পর ঘন্টা। পার্কের এক কর্নারের একটি বেঞ্চের ওপর বসে আছে সে। পার্কের বিভিন্ন স্থান আলোকিত হলেও মেঘালয়া যেখানে বসে আছে, সেখানে দূর থেকে আসা মৃদূ টিমটিমে আলো। চোখ দুটো শান্ত, অচঞ্চল মেঘালয়ার। ছটফটে, আহ্লাদী, চঞ্চল মেঘালয়া জীবনে ঘটে যাওয়া কয়েকদিনের টানপোড়েনে, কেমন স্তব্ধ, শান্ত আর বাস্তবতার জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে যেন। এ ক’দিনের সবটা যেন মিলছে না তার হিসেবে। কেমন কোথাও একটা গড়মিল রয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে ইরাজের আচরণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে!
আচমকা কয়েকটি ছেলে এসে পাশেই দাঁড়াল ওর। সবগুলোর হাতে সিগারেট, কেউ কেউ আবার স্পিড অথবা টাইগারের বোতলে চুমুক দিচ্ছে। দেখতে অবশ্য ভালোমানের বখাটেই লাগছে সবগুলোকে। মেঘালয়া অত খেয়াল করল না। ছেলেগুলো মেঘালয়াকে ওভাবে একা বসে থাকতে দেখে, নিজেদের মধ্যেই কিছু বলে হাসাহাসি করছে। মেঘালয়া এতক্ষনে সম্বিত ফিরে পায়। এ পাশটা একটু নির্জন প্রায়। আর এটা শিশুপার্ক, বাচ্ছারা নিশ্চয়ই এই রাত করে এখানে আসবে না? পার্ক প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে তাকিয়ে গা শিউরে উঠল, মেঘালয়ার।
কিছুক্ষণ পর ছেলেগুলোর মাঝে দুটো ছেলে উঠে এলো। মেঘালয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। মেঘালয়া মুখ তুলে তাকায় ওদের। বখাটেদের মুখের দিকে চেয়ে কেমন অদ্ভুত এক ভয় জেঁকে বসল বুকের মাঝে।
নিজেকে আজ দ্বিতীয়বার আবার এমন অসহায় লাগছে। প্রথমবার ইরাজ এসে দাঁড়িয়েছিল আল্লাহ প্রদত্ত দূতের মতো। আজও কেন জানি, নিজের অজান্তেই মেঘালয়া ওই চির অপছন্দের, অসভ্য, কঠিন রুক্ষ পুরুষকেই এদের সম্মুখে নিজের ঢাল হিসেবে আশা করল। নিজের ভাবনায়, নিজেই একবার শিউরে ওঠে মেঘালয়া। যার মুখ দেখবে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এই মুসিবতের সম্মুখীন হয়েছে সে, সেই মুসিবত থেকে রক্ষা পেতে তাকেই কেন আশা করছে মেঘালয়া?
চলবে..
[
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#তেজস্মিতা_মর্তুজা
৭.
সন্ধ্যার আকশে বাঁকা চাঁদের পাশে শুকতারা জ্বল জ্বল করছে। চারদিকটা বেশ নিরব প্রায়। মেঘালয়া পুরো শরীর ঘামছে। খুব অস্থির লাগছে। সামনে দাঁড়ানো ছেলে দুটো ওকে আপাদমস্তক পরখ করে দেখছে বারবার নির্লজ্জের মতো। ছেলেগুলোর মাঝে একজন বলে উঠল,
“একা বইসা আছো ক্যান? কোথাও যাইবা নাকি?ʼʼ
মেঘালয়া ঘাঁড় নাড়ল। ভেতরে ভয় কাজ করলেও, বাহ্যিকভাবে নিজেকে যথাসম্ভব দমন করে সামলে রেখেছে। ছেলে দুটো মিটিমিটি হাসছে। পাশে বসে থাকাগুলো নিজেদের মাঝেই কি আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। এদিকেই তাকিয়ে মাঝে মধ্যে হেসে উঠছে। ছেলেটি আবারও জিজ্ঞেস করল, “কোথাও গেলে চলো, আমরা নিয়ে যাই। সহি-সালামতে পৌঁছায়া দিতাম।’ʼ
পেছন থেকে আচমকা হাস্যজ্জল কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, “অথচ সে সহি-সালামত ফিরতে চায়না।ʼʼ
ছেলেদুটোর মাঝে একজন বলে ওঠে, “তুই কে রে? যা এখান থেকে। আমাদের মামলা আমরা বুঝে নেব।ʼʼ
ইরাজ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত ওপরে তুলে মাথা নত করে বলল, “সরি, সরি ভাইজান। তবে এটা মামলা চলছে? উমমম, দেখে তো আদালত মনে হচ্ছে না?ʼʼ
অতঃপর হাত নিচে নামিয়ে, তীর্যক দৃষ্টি মেলে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। ছেলে দুটো সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয়ার। ইরাজ বেঞ্চের পেছনের দিকটায় দাঁড়ানো। ও চাইলেও ওদের পার করে ইরাজের কাছে আসতে পারবে না। ইরাজ কঠিন স্বরে ধমকে উঠল, “ওঠ! উঠে পড় ওখান থেকে, নয়ত আজীবনের মতো পঙ্গু করে দেব।ʼʼ
মেঘালয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। ইরাজ এবার এগিয়ে গেল হাসিমুখে। ছেলেদুটোকে মৃদূ ধাক্কা দিয়ে, সরিয়ে মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরল। মেঘালয়া ইরাজকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়ায়। ইরাজ ওকে নিজের পাশে দাঁড় করাল। এসব এতক্ষণে পাশে বসে থাকা বখাটেগুলো দেখছিল। এবার উঠে এলো। এসেই পকেট থেকে মাঝারি এক ছুরি বের করল। ইরাজ দেখছে সবটা শান্ত চোখে। এসেই ছুরি নাচিয়ে ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কে রে তুই? মাইয়ারডার প্রতি দরদ দেখাইতাছস বড়ো?
ইরাজ হেসে উঠল। হাসিমুখেই বলল, “আমার বুকিংয়ে আছে রে। যা এডভান্স দিয়েছি, তা উসুল করে ছেড়ে দেব। তখন চান্স নিস না হয়। এখন যা।ʼʼ
এরকম একটা বিশ্রী ইঙ্গিতের কথায়, মেঘালয়া মুখ বিকৃত করল। ইরাজ এতক্ষণেও হাতটা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো হাতটা ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্ত কিসের এক জড়তায়, কেন জানি ছাড়তে ইচ্ছে করল না।
ইরাজের বলা কথায় পরে আসা ছেলেগুলোর মাঝে একজনের কেমন কণ্ঠটা পরিচিত ঠেকল। সে ফোনের ফ্লাশ করে ইরাজের মুখ বরাবর ধরল। ইরাজ চোখ বুঁজে, মুখ কুঁচকে বকে ওঠে, “শা লা, মুখ আলো দিচ্ছিস?ʼʼ
ইরাজকে দেখে ছেলেটা থমকে গেল। দ্রুত বলে ওঠে, “ইরাজ ভাই!ʼʼ
ইরাজ শান্ত নজরে তাকাল। খানিকটা এগিয়ে গেল। আচমকা ঠাস করে থাপ্পড় বসাল ছেলেটির গালে। ছিটকে পড়তে নেয় ছেলেটি। তবে সামলে নিলো নিজেকে।
—
ফিরে যাওয়া নিয়ে বিপত্তি বাঁধল। মেঘালয়া বাড়ি ফিরবে না। ইরাজ মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তো তখনই বলতি, ওদের সাথে যাওয়ার ছিল। আমি আর ওদের ভাগিয়ে দিতাম না। ন্যাকা! বাল, যাবি কিনা বল। আমি বাড়ি ফিরব। তোর পেছনে ফালতু সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই।ʼʼ
মেঘালয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজের দিকে। অসন্তুষ্ট চিত্তে বলল, “আমি বলেছি যাব ওদের সাথে?ʼʼ
ইরাজ আর কথা বলল না। চুপচাপ ধীর পায়ে হেঁটে এসে মেঘালয়ার পাশে বসল। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাকে রাতের পরিবেশটা আজব রূপে সেজেছে।বেশ কিছুক্ষণ পর ধীর-স্থির কম্পমান স্বরে মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “আপনি ঘৃনা করেন আমায়?ʼʼ
“দেরী হচ্ছে, যাবি তো চল।ʼʼ
“আমি বাড়ি না গেলেও, আপনি ফিরে যাবেন?ʼʼ
ইরাজ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, বিরক্ত হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ বসে থাকবি এখানে?ʼʼ
“আপনি সোজা জবাব দিতে পারেন না?ʼʼ
“আমি গোটাটাই বাঁকা, উত্তর সোজা হবে কোন দুঃখে?ʼʼ
মেঘালয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর আবার জিজ্ঞেস করল, “কি করে জানলেন আমি এখানে?ʼʼ
“মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি।ʼʼ
মেঘালয়া তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজ পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন জ্বালায়। নাক-মুখ ভরে ধোঁয়া ছাড়ল। মেঘালয়া বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আড়ষ্টতার সাথে প্রশ্ন করে, “আপনি কেন ঘৃনা করেন আমায়?ʼʼ
“তাবিরের কাছে ফিরতে চাস?ʼʼ
মেঘালয়া বিষ্মিত নয়নে চেয়ে রইল। কারণ ইরাজের জানার কথা নয়, সে কার সঙ্গে পালিয়েছিল। তাবির চলে যাওয়ার পর ইরাজ সেখানে পৌঁছেছিল। বলল, “আপনি চেনেন ওকে?ʼʼ
সিগারেটে বড়ো একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটুকু গিলে নিয়ে উত্তর দিলো, “তাবিরের তোর সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।ʼʼ
মেঘালয়া বিষ্মিত চোখ জোড়ায় এবার কৌতুহল ছেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করল, “কিসের চ্যালেঞ্জ?ʼʼ
—
মেঘালয়া ইরাজের বাবার বন্ধুর মেয়ে। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় ছিল দুজনের। তবে ইরাজ একটু ঘাঁড় ত্যাড়া আর বাজে স্বভাবের। তার মুখে সোজা বা মিষ্টি কথা বিরল। মেঘালয়াকে সর্বদা চোখে চোখে রেখেছে। সবকিছুতে হেলাল সাহেবের চেয়ে বেশি কড়া শাসনে রাখত ইরাজ। এমনকি স্কুলের পড়া শেষে, মেঘালয়াকে নিজের প্রাক্তন কলেজে ভর্তি করিয়েছিল। মেঘালয়ার যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। হল থেকে বাড়ি ফিরলে প্রায় দিনই ইরাজ যেত মেঘালয়ার কলেজে ওকে দেখতে।
একদিন যখন কলেজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা ছেলের দল এসে দাঁড়াল সামনে। তাতে ইরাজের কোন যায়-আসে না। সে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত। অথচ হঠাৎ-ই চোখে পড়ল, একটি মেয়ে ওদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, ছেলেগুলোর মাঝে একজন হাত চেপে ধরল। মেয়েটির মুখে চোখে সংকোচ। ইরাজ ভ্রু কুঁচকে দেখছে সবটা। ছেলেটি এবার জোর করে একটা কাগজের টুকরো ও ফুল ধরিয়ে দিলো। মেয়েটি তা ফেলে দেয়। আচমকা ওদের মাঝ থেকে একটা ছেলে সকলের সামনে মেয়েটিকে কষে থাপ্পড় লাগাল। কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, “অতিরিক্ত সাহস দেখাতে নেই। সিনিয়রদের সামনে তো মোটেই না।ʼʼ
ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দ্বিগুন জোরে থাপ্পড় লাগায় ছেলেটির গালে। এবং সেই একই ভঙ্গিতে বলল, “অতিরিক্ত সাহস দেখাতে নেই। সিনিয়রদের সামনে তো মোটেই নয়।ʼʼ
অতঃপর গালের দুপাশ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, “তা সিনিয়র, নাম কি তোর?ʼʼ
ছেলেটি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল ইরাজের দিকে। ইরাজ আরও জোরে চেপে ধরল গালটা। ধমকে উঠল, “বল!ʼʼ
ছেলেটি ওভাবেই জবাব দিলো, “তাবির।ʼʼ
“কোন ইয়ার?ʼʼ
“অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ
“তো সিনিয়র হলে, মেয়েদের এভাবে ট্রিট করবি?ʼʼ
বলে গালটা ছেড়ে দিলো। তাবির দমল না যেন। বলে উঠল, “ভাই, আপনি কেন দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায় দিন এখানে?ʼʼ
ইরাজ ভ্রু উচিয়ে বলে, “তোকে জবাব দিতে বাধ্য নাকি রে আমি?ʼʼ
“আপনি তো প্রতিদিন ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ের জন্য আসেন এখানে।ʼʼ
ইরাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল তাবিরের দিকে। বলল, “তোর মতো রাস্তাঘাটে থাপড়াচ্ছি নাকি তাকে?ʼʼ
তাবির বলে, “ঠিক আছে, আমিও আর থাপড়াব না। এবার আপনার মতোই সুপুষের মতো প্রেম করব তার সাথে।ʼʼ
ইরাজ সিংহর মতো গর্জন করে ওঠে। তাবিরের কলার চেপে ধরে বলল, “মেঘের দিকে তাকালে তোর চোখ দুটো
এ সি ড দিয়ে ঝলসে দেব। ওর ব্যাপারে কোন কথা বলবি তো জ্বিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব।ʼʼ— বিশ্রী ভাষায় বকে উঠল ইরাজ।
তাবির হেসে উঠল। বলল, “ভাই, মাইয়াই যদি দিওয়ানা হয়ে যায় আমার প্রেমে, তো?ʼʼ
ইরাজ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছটফটিয়ে এবার। ওর গলা চেপে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় বকে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “মেঘ ওরকম মেয়েই নয় রে শালা , বুঝেছিস তুই! ওর ধারে কাছে দেখলেও তোকে জীবন্ত পুঁতে রেখে দেব।ʼʼ
কয়েকজন এসে ছাড়াল তাবিরকে ইরাজের থাবা থেকে। তাবির অনবরত কাশতে থাকে। ইরাজকে থামানো যায় না। তাবির কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ওভাবেই বলল, “বুঝলাম, আপনার মনে মেয়েটার জন্য বহুত মায়া। মেয়েটার আছে তো আবার এত মায়া আপনার প্রতি?ʼʼ
জলন্ত ইরাজ যেন ধপ করে নিভে যায় এবার। শীতল নজরে তাকাল তাবিরের দিকে। তাবির ভ্রু নাচায়। ইরাজ ভাবে, আসলেই তো! মেঘালয়ার কাছে তো সে কোনদিন নিজের ভেতরে লুকায়িত নরম অনুভূতি প্রকাশ করেনি। আর মেঘালয়ার মাঝেও ইরাজের জন্য তেমন অনুরাগ পরিলক্ষিত হয় নি। তাবির তো ঠিকই বলেছে। তবুও ওর বিশ্বাস ছিল, মেঘালয়া কখনোই তাবিরকে গ্রহন করবে না।
এখানেই একটা ডিল অথবা চ্যালেঞ্জ তৈরী হয়ে গেল, তাবির মেঘালয়াকে নিজের প্রেমে মজিয়ে, পাগল করে ছাড়বে। এবং শেষ অবধি ইরাজ হেরে গেল। জিতে গেল, জেদি তাবির।
এ পর্যন্ত শুনে মেঘালয়া যেন প্রাণহীন পাথর হয়ে গিয়েছে। প্রাণ-স্পন্দনহীন জড়ো বস্তর ন্যায় বসে রইল বেঞ্চের ওপর। ইশার আজান পড়ছে চারদিকে। মেঘালয়া বেশ কিছুক্ষণ পর একবার ঘুরে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজের দৃষ্টি আকাশের পানে। দ্বিধা-সংকোচে একাকার হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমায় নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাও চ্যালেঞ্জ ছিল?ʼʼ
ইরাজ উত্তর দিলো না। তবে মেঘালয়া এতটাও অবুঝ নয়। নিজের প্রতি আজ নিজেরই বিবেক ঘৃণার বিষাক্ত বান ছুঁড়ছে। কত বোকা আর নির্বোধ মেঘালয়া! তাবিরের প্রতি তার যে অনুভূতিগুলো এই আবেগী বয়সে জন্মেছিল, তা শুধুই কারও অন্যায় জিদকে জিতিয়েছে। ভাবতেই, চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো। নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে, বিরক্ত লাগছে নিজের বোকামিগুলো মনে করে নিজেকে। ভাবল, সে নিজেই যখন সহ্য করতে পারছে না নিজেকে, তাহলে আব্বুর রাগটুকু তো ভালোবাসা। ওর একটা ভালো ভবিষ্যতের আশায় আব্বু কী না করেছে! অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ভেতর চিরচির করে পুড়তে থাকে মেঘালয়ার। আপন মনেই নিঃশব্দে ডুকরে কেঁদে ওঠে, আব্বুর কথা মনে করে। মানুষটাকে কতখানি কষ্ট দিয়েছে, তার সবটুকু যেন আজ মেঘালয়ার বুকে ভারী পাথর রূপে চেপে বসেছে।
আচমকা কিছু একটা মনে পড়ায়, হুট করে ইরাজের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল।
“আপনি কেন যেতেন রোজ আমার কলেজের সম্মুখে?ʼʼ
ইরাজ উঠে দাঁড়াল। সোজা হাঁটতে হাঁটতে কঠিন স্বরে বলল,
“গেলে আয়, নয়ত তোর ফালতু প্যানপ্যানানি শোনার মতো খারাপ দিন আসে নি আমার।ʼʼ
মেঘালয়া ভেবে কূল হারায় যেন। এই মানুষটিকে বোঝা যায় না কেন! কিছু একটা ভেবে কেন জানি আনমনেই হেসে উঠল মুচকি। অতঃপর ইরাজের পেছনে এসে দাঁড়াল।
ইরাজ বাইক স্টার্ট করতে করতে, বিরক্তির স্বরে নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “হাঁ করে মশা গিলছিস? ওঠ!ʼʼ
“পারলে আপনাকে গিলে ফেলতাম।ʼʼ
মেঘালয়ার নিম্নস্বরে বলা কথাটাও ইরাজের কান অবধি পৌঁছায়। মেঘালয়ার দিকে ফিরে, ওর পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলিয়ে দেখল। অতঃপর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“নিজের এই ঝালকাঠির মতো বডিটা আয়নায় দেখিস একবার। আমার রুমের আয়না ঝকঝকে। সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাবি— তোর ওই চিরকুট মার্কা শরীরের
চড়ুই পাখির পেটে আমি আঁটব না।ʼʼ
মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে বলল, “ঝালকাঠি? ঝালকাঠির মতো শরীর আবার কি, ইরাজ ভাই?ʼʼ
“বোন আমার! তোর শরীর কাঠির মতো, অথচ তুই ঝাল। মিলিয়ে নে, ঝালকাঠি হবে।ʼʼ
বাইকে উঠে বসল মেঘালয়া। বলল, “আমি আপনার কোন সম্পর্কের বোন লাগি, ইরাজ ভাই?ʼʼ
ইরাজ কিছুক্ষন পর জবাব দিলো, “কোন সম্পর্কের না, তুই ইরাজ ভাইয়ের বোন লাগিস।ʼʼ
নিজের কথায় ফেঁসে যায় মেঘালয়া। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ‘ভাই’ ডাকতে ডাকতে। অভ্যাস পরিবর্তন করার ইচ্ছেও ছিল না। তবে আজ কেন জানি, ইরাজের মুখে বোন ডাকটা ভালো লাগে নি।
বাইক চলতে শুরু করলেই, ধাক্কায় মেঘালয়া চোখ খিঁচে ইরাজকে খামচে ধরল। ইরাজ তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও, ভালো রাস্তা পেলে কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে, “ছেড়ে বস আমাকে। এখন আর পড়ার চান্স নেই, থাকলেও পেছনে ধরার মতো কিছু আছে, তা ধরে বস।ʼʼ
মেঘালয়ার জিদ হলো ভেতরে। একটু ইগোতেও লাগল। জিদ ধরে বলল, “ছাড়ব না। আপনি বাইকে তুলেছেন কেন? আর চালাচ্ছেন তো হাওয়াই জাহাজের মতো। আমার বাইকে চড়ে অভ্যাস নেই।ʼʼ
“কেন তোর আশীক কোনদিন ঘুরতে নিয়ে বের হয় নি তোকে?ʼʼ
ইরাজের কথায় ঠাট্রা। মেঘালয়া চুপ করে গেল হঠাৎ-ই।
চলবে..
[