#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১৭
সকাল আটটা। সবেমাত্র বাসে উঠেছে নিরু আর ফারহান। একটু পরেই বাস চলতে শুরু করবে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। নিরু বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শরৎ এর মৃদুমন্দ হাওয়া এসে মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে তার। বাস স্থির থাকায় বাতাসে চুল একটু একটু উড়ছে। ফারহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
নিরু বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
ফারহান ভ্রু ঈষৎ কুঁচকে বললো, “আমার বউ আমি তো তাকিয়ে থাকবোই।”
“এটা বাস। তাও তুমি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে না-কি? মানুষ দেখলে কী বলবে?”
“মানুষ দেখবে কেন? আমার বউ আমি তাকাবো তাতে কার কী?”
নিরু শ্বাস ফেলে বললো, “তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই। যাও দোকান থেকে চিপস নিয়ে এসো। খাবো আমি। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। বাস ছেড়ে দেবে আবার।”
ফারহান উঠে যেতে যেতে বললো, “ছাড়বে না ম্যাডাম। বাস ছাড়তে আরো দশমিনিট লাগবে মিনিমাম।”
“তবুও তাড়াতাড়ি আসবে।”
ফারহান মৃদু হেসে বললো, “আচ্ছা আচ্ছা। এই যাবো আর আসবো।”
______________________
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। অস্ত যেতে আর বেশি সময় বাকি নেই। আকাশের পশ্চিম দিকটা কমলা বর্ণ ধারণ করছে। নিরু একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে আছে। ভাগ্যিস বাসটা এসময়ে ঠিক উত্তর দিকেই যাচ্ছে। তাই তো পাশ থেকে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে নিরু। পাহাড়ি রাস্তায় অন্যরকম সৌন্দর্য রয়েছে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। খাদ দেখে একটু ভয়ও লেগেছিল। তবে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে তা অতি তুচ্ছ। ফারহান নিরুর চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে ব্যস্ত। তাদের পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। সর্বোচ্চ আধঘন্টা।
প্রায় দশ ঘন্টার জার্নি শেষে গন্তব্যে এসে পৌঁছালো নিরু ফারহান। দুজনেই ক্লান্ত হলেও চোখে-মুখে খুশির ঝলক বিদ্যমান। একজনের প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ দেখে আর অপরজনের প্রিয়তমার স্নিগ্ধ শীতল রূপে।
বাসস্ট্যান্ডের কাছেপিঠেই একটা রিসোর্ট বুক করলো ফারহান। তিনদিন থাকবে এখানে। রুমে এসেই ফ্রেশ হয়ে নরম গদির বিছানায় শুয়ে পড়লো দুজনে। দীর্ঘসময় ভ্রমণে ক্লান্তিতে দুজনের চোখেই ঘুম নেমে এসেছে।
ফারহান হাই তুলে বললো, “এই বান্দরবান কিন্তু আগে ‘ম্যাঅকছি ছড়া’ নামে পরিচিত ছিল।”
নিরু বুঝতে না পেরে বললো, “কী নামে?”
“ম্যাঅকছি ছড়া।”
“এটা আবার কেমন নাম?”
“মারমা ভাষায় ম্যাঅক মানে বানর আর ছিঃ মানে বাঁধ।”
নিরু স্পষ্টভাবে বুঝতে না পারলেও মাথা নাড়ালো।
ফারহান আবারো বললো, “তবে মারমাদের ভাষায় কিন্তু বান্দরবানের নাম ‘রদ ক্যওচি ম্রো’।”
নিরু কৌতুহল নিয়ে বললো, “তুমি এসব জানলে কী করে? এত কঠিন নাম মনে থাকে?”
ফারহান হেসে বললো, “এর আগে একবার এসেছিলাম। তখন খোঁজ নিয়েছিলাম। একটা জায়গায় আসবো আর সেই জায়গা সম্পর্কে জানবো না তা একটু বেমানান লাগে না? তাই আরকি কৌতুহলের বশেই জেনেছিলাম। এখন কিছু কিছু মনে আছে।”
নিরু হাই তুলে বললো, “ওহ।”
“হুম, এখন ঘুমাও। আমারো প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।”
নিরু ফারহানের বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান বাড়িতে ফোন করে তাদের পৌঁছানোর কথা জানিয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। রিসোর্টে আসার আগেই রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিয়েছে।
_____________
পরেরদিন খুব সকালে উঠলো ওরা। উদ্দেশ্য নীলগিরি যাওয়া। বান্দরবান আসবে আর নীলগিরি যাবে না এরকম কী হয় না-কি? ভোরেই বেরিয়ে পড়লো ওরা। সকাল সকাল না গেলে মেঘেদের সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে উপভোগ করা যাবে না। অনেক দূরে হওয়ায় যেতেও বেশ সময় লাগবে।
নীলগিরি এসেই নিরু ছুটোছুটি করে আশেপাশে দেখতে লাগলো। পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় চারপাশে শুধু সবুজের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজ। ফারহান নিরুকে নিয়ে একটু কিনারার দিকে গেল। সেখান থেকে নিচে তাকাকেই নিরু বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো।
মেঘের ভেলারা ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘেরও যে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এত ক্ষমতা আছে তা জানা ছিল না নিরুর। আকাশে মেঘ দেখতে ভালো লাগতো। তবে সেটা শুধু দূরে থেকেই দেখা সম্ভব হতো। মেঘ এত কাছ থেকে দেখে চোখের পলকই পড়ছে না নিরুর। ফারহান নিরুর চেহারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মেয়েটা কত খুশি হয়েছে যে কিছু বলতেই পারছে না।
নিরু প্রথমবার এমন সৌন্দর্য অবলোকন করায় তার মাঝে আনন্দানুভূতিটা সবচেয়ে বেশি। সবকিছু দেখেই চমকে যাচ্ছে। বাংলাদেশেই কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে অথচ সে কোনোদিন আসেইনি।
দূর থেকে সর্পিলাকারে সাঙ্গু নদী দেখা যাচ্ছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে পথ চলছে। নিরু ফারহানের হাত শক্ত করে ধরে আছে। কিনারায় আসায় তার একটু ভয়ই লাগছে বটে।
নিরু কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা, পাহাড়ের চূড়ায় এরকম পর্যটন কেন্দ্র কেন? যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়?”
“এটা সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীদের আওতায়। তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ জোরদার। দুর্ঘটনা হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।”
ওরা আশেপাশে একটু ঘুরে আবারো ফেরার পথে রওনা দিল। যাওয়ার পথে আবার শৈলপ্রপাত দেখে যাবে। একটু সময় তো লাগবেই।
আজকের দিনের মতো ঘুরাঘুরি শেষে ওরা বিকেল চারটার দিকে রিসোর্টে ফিরে এল। আজকে আর কোথাও ঘুরার মতো শক্তি নেই। কালকে আবার ঘুরা যাবে না-হয়। একদিনেই কী আর সব দেখে শেষ করা যায় না-কি। তাছাড়া তিন দিন যখন থাকবেই তখন একটু ধীরে-সুস্থেই থাকা ভালো।
_______________
রাতে রিসোর্টের রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করে ওরা একটু বাইরে বেরোলো রাতের পরিবেশ দেখতে। রাত হলেও কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে চারপাশটা বেশ উজ্জ্বল।
ফারহান আর নিরু একে অপরের হাত ধরে সামনের দিকে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য এই জনবহুল অঞ্চল ছেড়ে একটু নিরিবিলিতে যাওয়া। কোনো পাহাড়ের চূড়ায় যেখান থেকে মনে হবে পুরো আকাশটাই দেখতে পাওয়া যায়। মাঝে কোনো বাঁধা থাকে না।
কাঙ্ক্ষিত স্থান পেয়েও গেল খুব সহজেই। পাহাড়টা খুব বেশি উঁচু নয় তবে আশেপাশের পাহাড়গুলোর চেয়ে একটু বড়ই হবে। তাইতো মনে হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠে পড়েছে।
ফারহান নিরুকে ঘাসের উপর বসিয়ে নিজে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তার দৃষ্টি আকাশের অসংখ্য তারকারাজির দিকে। প্রায় পরিপূর্ণ এক চাঁদও দেখা যাচ্ছে। হয়তো দু’দিন পরেই পূর্ণিমা।
নিরু স্থির দৃষ্টিতে ফারহানের মুখটার দিকে চেয়ে আছে। চাঁদের আলোয় কত্ত সুদর্শন লাগছে ফারহানকে। চোখের মণিটা চিকচিক করছে। চুলগুলো এলোমেলো। নিরু আলতো স্পর্শে ফারহানের চুলগুলো ঠিক করে দিল। ফারহান এবার নিরুর দিকে তাকিয়ে আছে।
নিরু ফারহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “প্রকৃতিটা কত্ত সুন্দর তাই-না?”
“হুম। প্রকৃতি সবসময় সব জায়গাতেই মনোমুগ্ধকর থাকে। তবে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। চেষ্টা করি না। না-হয় তুমি যেখানেই থাকো না কেন যদি প্রকৃতিকে মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারো তবে মনে হবে পুরো পৃথিবীটাই সুন্দর।”
নিরু কোনো জবাব না দিয়ে দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। যদিও আবছা অন্ধকারে দূরের কিছুই স্পষ্ট নয় তবুও দেখতে ভালো লাগছে। কল্পনা করেই সামনের প্রকৃতিটা সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের স্বপ্নের রাজ্য হিসেবে। যেখানে শুধু সে আর তার মনের রাজা থাকবে। তাদের সুন্দর জীবনের অন্তরায় হয়ে আর কেউ থাকবে না।
ফারহানের ডাকে নিরু কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। ফারহান ডাকছে। রিসোর্টে ফিরে যেতে হবে। বেশ রাত হয়েছে। এখন ফিরে যাওয়া উচিত।
নিরু একটু মন খারাপ করতেই ফারহান ওর কপালে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো, “কাল আবার আসবো। এখন চলো।”
নিরু মাথা নেড়ে মায় জানায়। ফারহান উঠে পড়তেই তার সাথে পা বাড়ায় রিসোর্টের দিকে। এখানে আর কতক্ষণই বা থাকা যাবে। রাত গভীর হলে যদি আবার কোনো সমস্যা হয়।
পরেরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল দুজনের। নিরু একটু মন খারাপ করে ফেললো। কেননা ওরা নীলাচল যেতে চেয়েছিল সূর্য ওঠার আগেই। প্রকৃতির মাঝ থেকে সূর্যোদয় দেখবে বলে। কিন্তু তা আর হলো কই? সব এলোমেলো হয়ে গেল। এলার্ম দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। কখন কে বন্ধ করেছে কারোর মনেই নেই।
ফারহান নিরুর মন ভালো করতে বললো, “শরৎকালে বিকেলেও কিন্তু নীলাচলের সৌন্দর্য কোনো অংশে কম নয়। আমরা বরং বিকেলে যাবো নীলাচলে ঘুরতে। সূর্যোদয় না দেখতে পেলাম, সূর্যাস্ত দেখবো। মন খারাপ করো না লক্ষ্মীটি।”
নিরু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “তাহলে তো মেঘ ধরতে পারবো না।”
ফারহান ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “সকালে গেলেই যে মেঘ ধরতে পারবে বা মেঘ তোমাকে ছোঁবে এর কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি আমরা যেতাম আর দেখা যেত যে সরকম মেঘ নেই তাহলে তো তোমার মনটা আরো খারাপ হয়ে যেত তাই-না?”
“হুম।”
“তাহলে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এখন ফ্রেশ হয়ে এসো। ব্রেকফাস্ট করতে যাবো।”
সারাদিন রুমে বসেই কাটিয়ে দিল ওরা। বাইরে তেমন বের হয়নি। বিকেল হতেই নীলাচলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
জিপ গাড়ি নিয়েই নীলাচলে পৌঁছে গেল ওরা। নিরু প্রথমে সমতল জায়গা গুলো একটু ঘুরলো। দোলনায় বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর চূড়ার দিকে যেতে লাগলো।
ফারহান নিরুর হাত ধরে উপরে উঠতে উঠতে বললো, “আমি আগে যখন এসেছিলাম তখন আশেপাশে এতো রিসোর্ট ছিল না শুধু সামনের এই বড় রিসোর্টটাই ছিল। এটার ছাদে উঠলে পুরো অঞ্চলটাই দেখা যায়। সেখানে পরে যাবো আগে আরেকটু উপরে উঠবো।”
ওরা আরেকটু উপরে উঠে দাঁড়ালো। এখান থেকেই পুরো অঞ্চল দেখা যাচ্ছে। সামনে সবুজ বড় বড় ঘাস আর কিছু কমলা রঙের বনফুলও দেখা যাচ্ছে। নিরু নিচু হয়ে ফুলগুলো স্পর্শ করলো। আবারো উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নীল আকাশ ক্রমে ক্রমে আবছা হয়ে যাচ্ছে। গোধূলির আবির্ভাব হচ্ছে।
#চলবে__??
[
#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১৮
সূর্য অস্ত গেছে। কিছুক্ষণ আগের আলোয় প্রজ্জ্বলিত পৃথিবীটায় আঁধার নেমে এসেছে। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে নিরুর ছাই রঙা শাড়ির আঁচল উড়ে চলেছে ক্রমশ। চুল গুলো প্রচুর পরিমাণে এলোমেলো হওয়ায় হাত খোঁপা করে রেখেছে। তবুও সামনের চুলগুলো বেরিয়ে গেছে।
ফারহান হাত খোঁপাটা খুলে চুলগুলো ছড়িয়ে দিল। নিরু আঁড়চোখে তাকাতেই মুচকি হেসে বললো, “খোলাই থাক। একটু বিরক্ত করুক বরং। ওই বিরক্তিমাখা মুখশ্রী দেখতেও তো বেশ লাগে।”
নিরু কিছু না বলে মুচকি হাসলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ওরা রিসোর্টে ফিরে এলো। কালকে আবার চিম্বুক পাহাড় আর স্বর্ণমন্দিরে যাবে। আর তারপরের দিনই বাসায়।
____________
নিধি রুমে আস্তে আস্তে পায়চারি করছে আর ভাবছে সিয়ামকে কী এখন তার প্রেগন্যান্সির কথা বলবে না-কি। গত দু-দিনে বলার অনেক চেষ্টা করেছে তবে সিয়ামকে সেভাবে বাড়িতেই পায়নি। ওর ঘুমিয়ে যাওয়ার পরেই বাসায় আসতো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে। তবে আজ সন্ধ্যায়ই ফিরে এসেছে। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে আর কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
নিধি বারান্দায় গিয়ে দেখলো সিয়াম ফোন রেখে আরেকটা সিগারেট ধরালো। সিয়ামের এমন ছন্নছাড়া মনোভাবে নিধির বিরক্তি লাগছে প্রচুর। বাসায় এসেছে থেকে একটা কথাও বলে নি তার সাথে। এসেই বারান্দায় চলে গেছে। তার বউ যে ঘরে আছে সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। মনে হচ্ছে সে ছাড়া এবাড়িতে আর কোনো মানুষই নেই।
নিধি চোখ-মুখ শক্ত করে সিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “তুমি ঠিক কী চাইছো বলবে আমায় প্লিজ?”
“কী চাইছি মানে? আমি কী তোমার থেকে এ পর্যন্ত কিছু চেয়েছি না-কি? এই সিয়ামের কখনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয় না, যা চাই সেটা আদায় করে নিতে জানি।”
“তোমার এইসব বাজে কথা তোমার কাছে রাখো। আমি সোজাসাপ্টা উত্তর চাইছি। মানে তুমি কোন ধরনের জীবন-যাপন করছো? তোমার যে ঘরে একটা বউ আছে সে খেয়াল আছে তোমার? কেন এরকম ছন্নছাড়া হয়ে থাকছো?”
সিয়াম কোনো উত্তর দিল না। কোনো উত্তরই যে নেই তার কাছে। আগে জীবনটা এরকম ছিল না। গুন্ডামী করতো ঠিকই তবে সুখী ছিল। বাবা-মা মারা যেতেই সব সুখ যেন তাদের সাথেই চলে গেছে। এইতো কয়েকমাস আগেও সে কত্ত হাসি-খুশি ছিল।
নিধির কান্না পাচ্ছে এবার। সিয়ামের নীরবতা মেনে নিতে পারছে না। কিছু তো বলুক অন্তত। নিধি কান্না চেপে ভেজা স্বরে বললো, “কেন করছো এরকম? এভাবে কী জীবন চলে? আর কতদিন এভাবে চলবে?”
সিয়াম তাচ্ছিল্য হেসে বললো, “আমি কী চাইছি সেটা আসি নিজেই জানি না।”
“তাহলে তোমার এই অনিশ্চিত জীবনে কেন জড়ালে আমাকে? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি?”
“তুমি আমার আর নিরুর মাঝে এসেছিলে।”
“নিরু কী কখনো ভালোবেসে ছিল তোমাকে যে তোমাদের মাঝে আসার প্রশ্ন উঠছে? আর তোমাদের মাঝে আসার কথা যখন বললেই তখন কেন আমাকে না করে দাওনি তখন? কেন গ্রহণ করে নিয়েছিলে। না করে দিলে তো আমি আর কখনোই আসতাম না তোমার সামনে। আর আমি তো এটাও জানতাম না যে তুমি নিরুকে পছন্দ করতে। আর এখনো কেন নিরুর কথা ভাবছো তুমি? ও বিবাহিতা আর ওর জীবন নিয়ে অনেক সুখীও। ওরা থাকুক না ওদের মতো।”
“আমি তখন না করতে পারিনি তোমাকে কারণ আমি জানতাম নিরু আমাকে কখনো আপন করে নেবে না। ও আগে থেকেই অপছন্দ করতো আমায়। আমার তখন একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল। একটু ভালোবাসার দরকার ছিল বাবা-মায়ের কষ্ট ভুলে থাকার জন্য।”
“ওহ, তারমানে যখন আমার ভালোবাসায় বাবা-মায়ের কষ্ট ভুলে গেলে তখন আমি ফেলনা হয়ে গেলাম? এখন আর আমার কোনো গুরুত্বই নেই? বিয়ের কয়েকদিনও তো খুব ভালোই ছিলে। কী হলো তারপর?”
সিয়াম মাথা নিচু করে নিল। এই বিষয়টা নিয়ে এতদিন ভেবে দেখেনি সে। নিধির কথা ভাবেনি। ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেছে। শুধুমাত্র নিজের কথাই ভেবে গেছে। নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করেছে। তবে থাকতে তো আর পারেনি।
সিয়াম বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি তোমাকে আগেই বলতে চেয়েছিলাম সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু তুমি আমাকে এতটাই ভালোবাসতে যে বলিনি। তবে নিরুকে প্রতিনিয়ত দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। বারবার মনে হতো ও আমারও হতে পারতো। অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। চলছিলো কোনোমতে। তবে তুমি যেদিন তোমাকে দেখতে আসার কথা বলে কান্নাকাটি করছিলে তখন হুট করেই বলে ফেলি পালিয়ে যাওয়ার কথা। কিছু না ভেবেই বলেছিলাম। কিন্তু তুমি রাজি হবে এটা কখনো ভাবিনি।”
সিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলো, যা কখনো ভাবিনি তাই হয়েছিলো। তবুও বিয়ে যখন করেছিলাম তখন একটু স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা করতাম। তবে পুরোপুরি পারতাম না। মনে মনে জেদ ছিল প্রচুর। কোনোকিছু না ভেবেই তোমাকে দোষারোপ করতাম আমার জীবনে আসার জন্য। তবে প্রকাশ করতে চাইতাম না। কিন্তু নিরুর বিয়ের কথা শুনেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। তখন আর এটা ভাবিনি যে আমি বিবাহিত। তোমার জীবন আমার সাথে জড়িয়ে আছে। জেদটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এটাই ভাবছিলাম শুধু, ও কেন অন্য কাউকে বিয়ে করলো। বাইরে গেলে রুদ্র যখন বলতো, নিরু আজ ওর বরের সাথে এখানে ঘুরেছে। কাল ওখানে। খুব ভালোবাসে একে অপরকে। তখন মাথাটা অনেক গরম হয়ে যেত। বাসায় এসে অযথা কারণেই রাগারাগি করতাম। হাতও উঠিয়েছি তোমার উপর। রাগের বশে কী করেছি নিজেরই খেয়াল থাকতো না। নিরু ফারহানকে একত্রে দেখলে কেমন যেন রাগ হতো প্রচুর।”
নিধি অবাক হয়ে এতক্ষণ সিয়ামের কথা শুনছিল। সিয়াম কোনোদিনও ওর সাথে এত কথা বলেনি।
নিধি কঠোর স্বরে বললো, “নিরু তোমার ভালোবাসা নয়। ও তোমার জেদ। তুমি ওকে ভালোই বাসো না কোনোদিন। আমার জন্য বলতে কষ্টকর হলেও তুমি শুধু ওকে পেতে চেয়েছো।”
সিয়াম কিছু বললো না। অপরাধবোধ হচ্ছে তার। নিচুস্বরে বললো, “সরি।”
“শুধু সরি দিয়েই সব ঠিক হয়ে যাবে?”
“আমি কখনো এত কিছু ভাবিনি। তোমার সাথে খুব বেশিই অন্যায় করে ফেলেছি তাই-না? অবশ্যই করেছি। তুমি যদি চাও তাহলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। আর কখনো তোমাদের কারোর জীবনেই আসবো না। দূরে চলে যাবো। নিরু থাকুক ওর মতো ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে। তুমি নতুন কারো সাথে ঘর বেঁধো। আমি তো মা-বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই একা হয়ে গেছি। আশেপাশে অনেকজন থাকলেও মনটা ফাঁকা-ই লাগে।”
নিধির এবার সিয়ামের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিছু কী হয়েছে আজ ওর? এভাবে কথা বলছে কেন? বড্ড অসহায় লাগছে চোখ-মুখ।
নিধি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “তোমার আজ কী হয়েছে হঠাৎ? এরকমভাবে কথা বলছো কেন? কিছু কী হয়েছে?”
সিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আজ আবার একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। হয়তো আমার মতোই কোনো সন্তান তার বাবা-মাকে হারিয়েছে। হয়তো একদিন আমার মতো তাদের জীবনও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।”
নিধি সিয়ামের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “আমরা কী আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারি না। পারি না একটা সুখী সুন্দর জীবন কাটাতে।”
সিয়াম কোনো উত্তর না দিয়ে বাইরে তাকালো।
নিধি আবারো বললো, “তুমি কী এটা অস্বীকার করতে পারবে যে আমার প্রতি তোমার কোনো টান নেই, মায়া নেই? আমার জন্য না হলেও আমাদের বাচ্চার জন্য কী সবকিছু ঠিক করে নেয়া যায় না?”
সিয়াম সচকিত হয়ে নিধির দিকে তাকালো। তার চোখে-মুখে প্রশ্নের ছড়া ছড়ি।
নিধি মাথা নেড়ে সায় জানায়।
সিয়াম নিধিকে জড়িয়ে নেয় নিজের বাহুবন্ধনে। বাবা হবে সে। এর চেয়ে আনন্দ কী আর কোথাও আছে না-কি? ছোট্ট একটা ফুটফুটে শিশু বাবা বলে ডাকবে তাকে।
সিয়াম নিধিকে জড়িয়ে রেখেই বললো, “ক্ষমা করে দাও আমায়। আমি আর কখনো কষ্ট দেব না তোমাকে। ভুলেও যদি কষ্ট পাও তাহলে শাস্তি দিয়ে দিও। কখনো ভালোবাসার কমতি রাখবো না। পৃথিবীতে তো আর কেউই নেই আমার। তোমাদের নিয়েই আমার পৃথিবীটা নতুন করে সাজাবো। ক্ষমা করবে আমায়?”
নিধি মাথা নেড়ে সায় জানালো। সে তো এটাই চেয়েছিলো সব ঠিক হয়ে যাক। সবার মতো সে-ও যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। বিচ্ছেদ তো চায়নি। চোখের কোণে অশ্রু জমেছে নিধির। তবে তা তো শুধুই আনন্দের অশ্রু। এই অশ্রুতে কোনো দুঃখ নেই, রয়েছে একরাশ সুখের অনুভূতি।
___________________
কালকের মতো আজও সেই পাহাড়টার চূড়ায় এসেছিল নিরু আর ফারহান। তবে চাঁদের দেখা পায়নি। কালো মেঘের আস্তরণে ঢেকে আছে আকাশ। হয়তো বৃষ্টি হতে পারে। তবুও প্রকৃতির নিশ্চুপ পরিবেশের মাঝেই বেশ লাগছিলো।
নিরু হাঁটতে হাঁটতে বললো, “পায়ে ব্যথা করছে আমার। এখানে কোনো রিকশা নেই?”
ফারহান আশপাশ দেখে বললো, “কোনো রিকশা বা অটো কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। মানুষজনও বেশি নেই। দু-এক জন। এদের মাঝে তোমার লজ্জা করবে না তো? অবশ্য লজ্জা করলেও তাতে আমার কিছু করার নেই।”
নিরু ভ্রু কুঁচকে বললো, “মানে?”
ফারহান কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে নিরুকে কোলে তুলে নিল। সামনের দিকে যেতে যেতে বললো, “লজ্জা লাগলে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখো। নামিয়ে দিতে বললে কিন্তু নামাবো না। আমি থাকতে আমার বউ এখানে কষ্ট করবে কেন?”
নিরু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো, “আমার বর আমাকে কোলে নিয়েছে এতে লজ্জা পাবো কেন? এটা তো একটা ভালো ব্যাপার। আমার বরই তো। পরপুরুষের কোলে তো আর উঠিনি।”
“তারমানে তোমার লজ্জা কমেছে না-কি মানুষজন নেই বলে এমন কথা বলছো?”
নিরু ফারহানের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, “একটা ভাবলেই হলো।”
#চলবে__??