বোবা টানেল পর্ব ৬

0
130

#বোবা_টানেল (০৬)
“আরেহ বাহ! সমাজ সেবা শুরু করে দিয়েছ দেখছি! হঠাৎ এত মানবতা জাগলো যে তোমার মনে? ওহ হ্যা। সামনে তো এমপি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছো নাকি শুনলাম।”
পেছন থেকে এক পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসতেই দ্রুত সেদিকে ফিরে তাকায় জয়। কিছুটা দূরেই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে মুখে হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিখন। তার এই হাসিতে একদম স্বাভাবিকতা নেই। জয়কে বি’স্ফো’রি’ত নয়নে তার দিকে তাকাতে দেখে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায় শিখন।
“তুমি হঠাৎ এখানে? দুদিন ধরে নাকি তোমাকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না? কোথায় ছিলে তুমি এই দুদিন?” (জয়)
“তুমি দেখছি ভালোই খোজ খবর রাখো আমার। তা তোমাকে কে বলল আমাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা? আমার একদম ক্লোজ দুজন ভাই বন্ধু ছাড়া তো কেউ এই খবর জানতো না! আজকাল লোকজন দিয়ে আমার ওপর নজর রাখছ নাকি জয়?”
থতমত খেয়ে যায় জয়। মিনমিনে সুরে বল ওঠে,
“কিসব বলছ? তোমার ওপর নজর রেখে আমার লাভ কি?”
“কি লাভ তা নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন করো। তা ধেয়েপেয়ে আমার সব জিনিসের দিকে হাত বাড়াচ্ছো কেন তুমি? এই স্বভাব কিন্তু আমার একদম পছন্দ না। শি ইজ মাই ফিয়োন্সি। মাইন্ড ইট জয়।”
কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না শিখন। জয়ের বুকের ডানপাশে নিজের ডান কাধ দ্বারা ধা’ক্কা দিয়ে চলে যায় সে। ধা’ক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে এক কদম পেছনে সরে যায় জয়। পেছনে ঘুরে রা’গে ফুসতে ফুসতে শিখনের যাওয়ার পানে তাকায় সে। গুনগুন করতে করতে গা ছাড়াভাবে শিখনকে হেটে যেতে দেখে রা’গ যেন দশগুণ বেড়ে যায় জয়ের। সে বুঝে যায় আজকের ধা’ক্কাটি ছিল তার জন্য রিটার্ন গিফট স্বরূপ। সেই সাথে এটাও বুঝে যায় যে, শিখন তাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেছে ইনডিরেক্টলি। আচমকা হেসে উঠেই জয় বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড ভিপি সাহেব।”
——-
এক অপরিচিত নাম্বার থেকে একটানা কলের ওপর কল আসছেই। বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে রেখে হাতে ফোনটা তুলে নেয় অসিফা। আসিফ খন্দকারের কড়া নির্দেশ, কখনোই অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা কল রিসিভ করা যাবেনা। বাবার বাধ্য মেয়ে হওয়ায় কল রিসিভ করে না অসিফা। ট্রু কলারের সাহায্যে নাম্বারটা চেক দিতেই চমকে ওঠে সে। নাম্বারটা আর কারো না শিখনেরই। চোখ-মুখ কুচকে অসিফা ভাবতে থাকে, “এই নাম্বার শিখন পেলো কিভাবে?”
অসিফা ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই যাবে ওমনি রাস্তার পাশের খোলা জানালাটা থেকে ইটের টুকরোসহ একটা মোড়ানো কাগজ তার রুমের মেঝেতে এসে পড়ে। অসিফা ছুটে গিয়ে কাগজটি তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। কাগজটা খুলতেই ভেতরে কিছু লেখা আছে দেখে তা পড়া শুরু করে সে,
“একটু জানালার কাছে আসবে প্লিজ?”
লেখাটুকু পড়ে কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে রুমের বাতি নিভিয়ে জানালার কাছে ছুটে যায় অসিফা। দোতলার দক্ষিণ পাশের রুমের জানালার সামনে অসিফাকে এসে দাড়াতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে দুই-তিন কদম সামনে এগিয়ে এসে দাড়ায় শিখন। অসিফা গম্ভীর মুখ করে শিখনের দিকে তাকিয়ে থাকে। চারদিক থেকে আগত আলোর মিশ্রণে মানুষটাকে একদম স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এই শিখনকে সে তো আগে কখনো দেখেনি! দুদিনে একটা মানুষের চেহারায় এত পরিবর্তন কিভাবে আসতে পারে? কি হয়েছে তার সাথে এই দুইদিনে! নিশ্চয়ই তার নেতা সাহেব ভালো নেই! চোখে পানি টলমল করতে থাকে অসিফার। শত চেষ্টা করেও কেন সে পারছে না শিখনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে! শিখন হুটহাট সামনে চলে এলে কেন তার বুকের মধ্যে ধুকপুক করে? ভেবে পায়না অসিফা। তবে সে বুঝে গেছে, সে যে মায়ায় বাধা পড়েছে তা থেকে বের হওয়া কোনো কালেও সম্ভব নয়।
শিখন পুনরায় অসিফার নাম্বারে কল দেয়। এবার অসিফা কি ভেবে যেন কল রিসিভ করে কানের কাছে ফোনটা নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“রাত এখন কয়টা বাজে দেখেছেন? এত রাতে এখানে কেন এসেছেন?”
“দেখেছি। মাত্র একটা বাজে। এত রাতে তোমাকে এক পলক দেখতে এসেছি।”
“ফিল্মি ডায়লগ কম বলুন। বাসায় ফিরে যান এখন। অনেক রাত হয়েছে।”
“সত্যি বলতে, তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। হয়তো শুনতে বেমানান লাগবে তোমার কাছে। তবে এটাই সত্যি। তোমার নেতা সাহেবের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই প্রিয় তন্দ্রাহরণী। আমাকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না।” (শিখন)
চুপ হয়ে যায় অসিফা। বুকের ভেতর এক চাপা ব্য’থা অনুভব করছে সে। কি যে এক ভ’য়া’ন’ক ব্যথা এটা! তা যে অনুভব করেছে একমাত্র সে ছাড়া কেউ বুঝবেনা। আচমকা ফুপিয়ে কে’দে ওঠে অসিফা। চমকে গিয়ে শিখন বলে ওঠে,
“কেদো না অসিফা। তোমার মা-বাবার ঘুম যাবে কিন্তু!”
সতর্ক হয়ে ওঠে অসিফা। কা’ন্নাভেজা চোখে দরজার দিকে তাকায় একবার। দরজা বন্ধ আছে দেখে স্বস্তির দম ফেলে। চোখ মুছে হঠাৎ কঠিন কন্ঠে অসিফা শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আপনাকে আমার আর সহ্য হয়না। প্লিজ আপনি চলে যান। আর সামনে আসবেন না প্লিজ। ভুলেও আমার নাম্বারে কল দেবেন না আপনি।”
ঠা’স কল কেটে দেয় অসিফা। জানালা হতে দেখতে পায় শিখন এখনো ফোন কানে নিয়ে “হ্যালো হ্যালো” বলে যাচ্ছে। অসিফা ঠোট চেপে কান্না থামিয়ে জানালা আটকে দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ে। শিখন অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে দেখে ফোন বন্ধ করে রেখে দেয়। কান্নারা এবার আর বাধ মানতে চায়না। অসিফা হাউমাউ করে কেদে উঠে বলতে আরম্ভ করে,
“আমি নিজের সাথে বে’ঈ’মা’নি করতে পারব না নেতা সাহেব। আপনার দিকে তাকালেই আমার সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। কিভাবে আমি দিনের পর দিন পু’ড়ে’ছি, যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আপনাকে আমি আর কখনোই চাইবোনা। কেন বারবার সামনে এসে আমাকে য’ন্ত্র’ণা দিচ্ছেন? আমি আপনাকে আর চাইনা।”
ছটফট করতে করতে নিজের চুল খা’ম’চে ধরে অসিফা।

এদিকে অসিফার ফোন বন্ধ পেয়ে বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে যায় শিখনের। মেয়েটা কোনো উল্টো-পাল্টা কিছু করে না বসে সেই ভয়ে হাত-পা জমে আসে তার। বারবার পায়ের গোড়ালি উচু করে অসিফার রুমের জানালার দিকে উঁকি-ঝুকি দিতে থাকে। নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ পর রাস্তার পাশেই বসে পড়ে সে। দোতলার অন্ধকার বারান্দা দিয়ে যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তা আর জানতেও পারেনা শিখন। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বারান্দা হতে রুমের ভেতরে চলে যান আসিফ খন্দকার। রুমের ভেতরে অস্থিরতায় পায়চারী করছেন নিলুফা বেগম।
“তুমি দিলেনা আমায় মেয়েটার কাছে যেতে।” অভিমানের সুরে বলে ওঠেন নিলুফা বেগম।
“নিলুফা তুমি এতটা দূ’র্ব’ল আগে তো কখনো ছিলে না? উল্টো সবসময় আমাকে বোঝাতে।”
“মেয়েটাকে তিনটা বছর ধরে কাছ থেকে য’ন্ত্র’ণায় ছটফট করতে দেখছি। একজন মা হয়ে কিভাবে আমি ঠিক থাকব আমার মেয়ের অমন অবস্থা দেখে? যতই বলি আর বোঝাই। ভালোবাসা যে কি মা’রা’ত্ম’ক এক অনুভূতি তা তো তুমিও জানো। একবার এতে বাধা পড়লে সহজে মুক্তি পাওয়া যায়না। মেয়েটা কিভাবে রুমের মধ্যে বসে কাদছে! এটা যে আমার আর স’হ্য হচ্ছে না।”
“শান্ত হও নিলুফা। ছেলে-মেয়ে দুটোই ক’ষ্ট পাচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে দেখো ছেলেটা কিভাবে ছ’ট’ফ’ট করছে! এই ছেলে সত্যিই আমার মেয়েকে ভালোবাসে নিলুফা।
এখন অসিফার রুমে গেলে ও অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। ওকে কাদতে দাও আপাতত। এই কারণটার জন্য কাল হতে আমার মেয়ে আর কাদবে না।”
——
সকাল হতেই অসিফাদের বাসায় হাজির হয় শিখন। আসিফ খন্দকার শিখনকে দেখে বুঝে যান সারারাত ছেলেটা রাস্তার পাশেই বসে ছিল।
আসিফ খন্দকার কিছু বলে ওঠার আগেই শিখন দ্রুত ভংগিতে সোজাসুজি বলে ওঠে,
“আসসালামু আলাইকুম আংকেল। আমি অসিফাকে বিয়ে করতে চাই।”

চলবে…

#আফিয়া_অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here