#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৪
আরো একদিন নিরুদের বাসায় থেকে পরেরদিন ফিরে এল ওরা। ফারিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে সেখানে যেতে হবে। তবে দু-তিন দিন পরে।
সকালবেলার নাস্তা করছে সকলে। সকলে বলতে ফারহান, নিরু আর ওর শ্বশুর-শাশুড়ি। ফারহানের আর কোনো ছোট ভাই-বোন নেই। তাছাড়া সব আত্মীয়-স্বজনরাও যার যার বাড়িতে চলে গেছে তাই বাড়ি এত ফাঁকা।
নিরু বসে বসে খাচ্ছে আর আনমনা হয়ে ভাবছে, “ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার ডেট তো প্রায় পেরিয়েই যাচ্ছে। ভর্তি হবো কবে? উনি তো আগে থেকেই রাজি কিন্তু বাবা-মা কী পড়ালেখা করার অনুমতি দেবেন?”
নিরুর ভাবনার মাঝেই ওর শশুরমশাই রায়হান সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নিরু মা, তুমি কী পড়ালেখা করতে চাও?”
নিরু প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে অতিদ্রুত মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নিরুর এমন কান্ডে মুচকি হাসলো সবাই।
নিরু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে উত্তর দিল, “জ্বি, বাবা।”
রায়হান সাহেব উনার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মুক্তা তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”
ফারহানের মা মিসেস মুক্তা ভ্রু কুচকে বললেন, “আমার আবার কিসের আপত্তি থাকবে? আমার মেয়েকেও তো আমি অনার্স অবধি পড়ালেখা করিয়েছি। সেখানে আমার বউমা কেন করবে না? সবাই যখন জিজ্ঞেস করবে আমার বউমা কোন ক্লাস অবধি পড়েছে তখন কী বলবো যে ইন্টার পাশ করেছে শুধু? অবশ্যই উচ্চ শিক্ষিতা হতে হবে। আর মেয়েদের পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক বেশি জরুরী। আমি নিজে পড়ালেখা করেছি তাই আমি বুঝি। এখন তো এই বয়স বাড়ার কারণেই চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে।”
নিরু তো মনে মনে ভীষণ খুশি। পরিবারের সবাই কত্ত ভালো। অবশ্য তাদের সাথে না থাকলে, না মিশলে সহজে বোঝার উপায় নেই যে এই গুরুগম্ভীর মানুষগুলোও কতটা খোলামেলা স্বভাবের। বাইরে থেকে বাবা-মা দুজনেই বেশ গম্ভীর। তাই নিরুর প্রথমে ভয় লাগতো মানিয়ে নিতে পারবে না-কি এই ভেবে।
রায়হান সাহেব ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ফারহান, কালই গিয়ে ভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য ফর্ম পূরণ করে আসবে।”
ফারহান সম্মতি জানাতেই আবার সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে নিরু রুমে এসে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “অফিসে যাবেন আজ?”
ফারহান না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “উঁহু, সাতদিনের ছুটি নিয়েছি। আরো দুইদিন আছে।”
“ওহ, তাহলে ফারিয়া আপুদের বাসায় যাবো কবে?”
“পরশু দিনই যেতে হবে। নাহলে আর সময় হবে না। আমি আপুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি।”
নিরু বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “ওহ, আচ্ছা।”
“হুম,আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। লাঞ্চের আগেই চলে আসবো।”
“কোথায় যাবেন?”
“মেহেদি বাড়ির সামনের দোকানটায় অপেক্ষা করছে। ওর সাথেই দেখা করতে যাবো। অনেকদিন পর দেশে এসেছে। এতদিন আমেরিকা ছিল। আবারো চলে যাবে।”
“ওহ, আচ্ছা।”
“হুম, বাই।” বলেই ফারহান মানিব্যাগটা পকেটে গুঁজে বেরিয়ে গেল।
নিরুও তার শাশুড়ির কাছে চলে গেল। উনি সোফায় বসে বসে সিরিয়াল দেখছেন। রায়হান সাহেবও বাড়িতে নেই।
ফারহানের মা ওকে দেখে বললেন, “আমার পাশে এসে বসো। ঘরে একা একা কী-বা করবে।”
নিরু মুচকি হেসে বললো, “মা, চা খাবেন? চা নিয়ে আসি?”
“আচ্ছা যাও।”
নিরু রান্নাঘরে গিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এসে ওর শাশুড়ির পাশে বসলো।
চায়ে চুমুক দিয়ে ওর শাশুড়ি বললেন, “বাহ, তুমি তো বেশ ভালো চা বানাতে পারো।”
বিনিময়ে নিরু শুধু হাসলো।
ওর শাশুড়ি আবারো বলতে শুরু করলেন, “বুঝেছো বউমা, মেয়েদের জীবনে পড়ালেখার গুরুত্ব অনেক। তোমার শ্বশুর আর আমি ক্লাসমেট ছিলাম। কলেজ থেকেই অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। একপর্যায়ে সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। দুজনে একসাথে একই ভার্সিটি থেকে অনার্স শেষ করি। তারপর যখন ও একটা ছোটখাটো চাকরি পায় তখন বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর বাড়ি থেকেও কেউ রাজি ছিল না বলে ও নিজেই যায়। কিন্তু আমার বাবা-মাও রাজি ছিলেন না। অনেক বোঝানোর পরেও রাজি হয়নি কেউ। তাই দুজনে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পরেও কেউ মানেনি। তাই বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করলাম।”
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করলেন, “তখন তোমার শ্বশুরের অত কম বেতনে সংসার চলতে চাইতো না। ভীষণ অভাবের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তাই আমিও চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকি। একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়েও যায়। দুজনে মিলে সংসার চালাতে শুরু করি। তারপর তোমার শ্বশুর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে। তারপর থেকে সংসারের উন্নতি শুরু হয়। আরো বেশ কয়েকবছর পরে সবাই আমাদের মেনে নেয়। তাই পড়ালেখা বাদ দিও না। দেখবে এক পর্যায়ে না এক পর্যায়ে ঠিকই কাজে আসবে। তাছাড়া মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখতে পড়ালেখা করা অনেক জরুরী।”
নিরু এতক্ষণ একমনে শুনছিলো ওর শাশুড়ির কথা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো, “আমি পড়ালেখা ছাড়বো না মা। প্রতিষ্ঠিত হবো। শুধু আপনাদের দোয়ার প্রয়োজন।”
“আমরা তো দোয়া অবশ্যই করবো। তুমি এখন আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে এসেছো। আমার মেয়ের মতোই। বাড়িতে তো আর কেউ নেই। ফারিয়া তো সেই কবেই পরের বাড়ি চলে গেছে। বাড়িতে সারাদিন আমাদেরই থাকতে হবে মিলেমিশে। মা-মেয়ে হয়েই থাকবো। আমার একটা ছোট মেয়ের শখ ছিল ভীষণ। এখন পেয়েছি। ফারহানের পছন্দ করা মেয়ে তুমি তাই আমাদেরও ভীষণ পছন্দের।”
নিরুর শেষের কথাগুলো শুনে কেমন যেন সন্দেহ হলো। তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “মা, উনি কী আমায় আগে থেকে চিনতেন?”
“সে তো আমি বলতে পারবো না মা। ফারহান নিষেধ করেছে। সে না-কি নিজেই তোমাকে বলবে। এ ছেলের মতিগতি বুঝি না বাপু।”
নিরু খুব ভালো করেই বুঝতে পেরে গেছে ফারহান ছাড়া আর কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেবে না। তাই নিজেও চিন্তা করা বাদ দিয়ে দিল।
আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন কথা বলে নিরু আর ওর শাশুড়ি রান্নাঘরে চলে গেল। দুপুরের রান্না আজ নিরু করবে সাথে ওর শাশুড়িও সহযোগিতা করবে।
রান্নাবান্না শেষে নিরু রুমে এসে গোসল করে নিল। ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। গরমও পড়েছে বেশ। নিরু গোসল করে বেরোতেই দেখলো ফারহান রুমে ঢুকছে। ফারহান নিরুকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো, “তোমাকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে নিরু।”
ফারহানের এভাবে তাকিয়ে থাকায় আর কথা বলায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো নিরু। ফারহান মৃদু হেসে বললো, “প্রচুর খিদে পেয়েছে আমি গোসল করেই আসছি।”
দুপুরের খাওয়া শেষে নিরুর সবকিছু গুছিয়ে রুমে এল। ফারহান বিছানায় বসে আছে। নিরুকে আসতে দেখেই বললো, “এখানে এসে বসো।”
নিরু ওর পাশে গিয়ে বসতেই ফারহান ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ক্লান্তস্বরে বললো, “প্রচুর ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাবো।”
নিরু ফারহানের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর ফারহান এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। একপর্যায়ে নিরুও বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
বিকেল পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙেছে নিরুর। ফারহান এখনো ঘুমাচ্ছে। নিরু ওর মাথাটা বালিশে রেখে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। বাবা-মা এসময়ে উঠানে বসে চা খান।
নিরু উনাদের চা দিয়ে এসে ওর আর ফারহানের জন্যও রুমে চা নিয়ে এল। ফারহান ঘুম থেকে উঠে গেছে। নিরু ওর হাতে চা দিয়ে বললো, “কখন উঠলেন?”
“তুমি যখন উঠেছো তখন।”
সারাটা বিকেল ওরা বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিল। পরিবেশটা বেশ সুন্দর। একটু একটু রোদ আবার বাতাসও আছে। যার ফলে রোদটা বেশি প্রভাব ফেলছে না। পাশের গাছে দুটো নাম না জানা পাখি খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধছে। নিরু গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
___________________
পরেরদিন সকাল সকাল নিরু আর ফারহান ভার্সিটিতে গিয়ে ফর্মপূরণ করে এসেছে। বেশ ভীর ছিল তাই বাসায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেছে।
নিরুকে বাড়ির সাসনে নামিয়ে দিয়ে ফারহান কী যেন জরুরি একটা কাজে গেছে। বলেছে ফিরতে দেরি হবে। তাই নিরুও এসে ফ্রেশ হয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিল। তারপর শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একসাথে লাঞ্চ করে কাল ফারিয়াদের বাসায় যাওয়া নিয়ে কথা বলছে। ফারিয়া না-কি নিজে আসতে চেয়েছিল ওদের নিতে কিন্তু বাড়িতেও তো কম-বেশি আয়োজন করতে হবে তাই আসতে পারেনি।
বিকাল চারটার দিকে বাসায় ফিরলো ফারহান। নিরু তখন আলমারি খুলে বসে আছে। কালকে কোন শাড়ি পড়বে সেটা ঠিক করতে পারছে না। বিয়েতে কেনা, মায়ের দেয়া, শাশুড়ি মায়ের দেয়া সব শাড়িতে আলমারির একপাশ ভর্তি হয়ে আছে। এত শাড়ির কারণে মূলত সিলেক্ট করতে অসুবিধা হচ্ছে নিরুর।
ফারহান ফ্রেশ হয়ে এসর নিরুর এমন অবস্থা দেখে হেসে ফেললো।
নিরু একটু রাগীস্বরে বললো, “আমি সিলেক্ট করতে পারছি না। কোথায় আপনি সিলেক্ট করে দেবেন। তা বাদ দিয়ে উল্টো হাসছেন। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না।”
ফারহান হাসি থামিয়ে বললো, “কী করবো বলো? তোমার রিয়্যাকশন দেখেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।”
“হয়েছে আর হাসতে হবে না। এবার আমাকে একটু সাহায্য করুন।”
ফারহান একটু ভেবে বললো, “তোমাকে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে বেশি মানায়। ওই কালার দেখে একটা পড়ো।”
“হালকা গোলাপি রঙের দুটো শাড়ি আছে। কোনটা পড়বো?”
“আগে দেখাও, তারপরে বলছি।”
নিরু আলমারি থেকে হালকা গোলাপি রঙের দুটো শাড়ি বের করতেই ফারহান একটা শাড়ি সিলেক্ট করে দিল। নিরুরও বেশ পছন্দ হয়েছে শাড়িটা।
নিরু শাড়িটা আলাদা করে রেখে বললো, “আচ্ছা কালকে আমরা কখন যাবো?”
“আপু তো সকালেই যেতে বলেছে। কিন্তু একটু দেরি তো হবেই।”
#চলবে__??