#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#অন্তিমপর্বের প্রথমাংশ
#মোহনা_হক
-‘মেহরুবা আমি তোমার কাছে একটা আবদার করছি। বলতে পারো ছোট বোনের কাছে বড় ভাইয়ের একটা আবদার রইলো। তোমার মেয়েটা কে আমার ছেলে পছন্দ করে। রুয়াত কে আমি আমার ছেলের বউ করে ঘরে তুলতে চাই।’
মেহরুবা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। প্রথম ফজলুল চৌধুরী আবদার করলো তার কাছে। যা আগে কখনো করেনি। তাও এই সেই আবদার না। আয়াজের জন্য বউ হিসেবে রুয়াত কে নিতে চায়। কি বলবে মেহরুবা! এমন মুহূর্তে ফজলুল চৌধুরী এরকম আবদার করে বসলো? আয়াজ কে কোনো দিক দিয়ে খারাপ মনে হয়নি তার। যথেষ্ট ভদ্র, সুশীল ছেলে। তাহলে না বলার কথা না। মায়া চৌধুরী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন উত্তর শোনার জন্য। মনে মনে ভয় হচ্ছে মেহরুবা আবার মানা করে দেয় কিনা! ফজলুল চৌধুরী ও তাকিয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য। মেহরুবা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। অতঃপর বললো,
-‘আমার কোনো আপত্তি নেই ভাই। আমিও আমার মেয়ের জন্য এমন একজন কে চেয়েছিলাম। আয়াজ কে আমি চিনি সে ছোট্টবেলা থেকে। কখনো খারাপ কিছু দেখিনি। আমার নিজের ছেলে কে যেভাবে দেখি, যেরকম ভাবে দেখি আয়াজকে ও। সে তার বিপরীত নয়। এখন সরাসরি হ্যাঁ ও বলে দিতে পারছি না। কারণ রুয়াত কে আপনাদের পছন্দ হবে কিনা!’
শেষের কথাগুলো বলতে মেহরুবা সংকোচ বোধ করে। রুয়াত তার মেয়ে। আর সে কেমন এটা মেহরুবা ভালো জানে। মেয়েটা কে তাদের পছন্দ হবে কিনা তাও শুনতে হবে। শুধু আয়াজ পছন্দ করে তা শুনলে হবে না। যাদের ঘরের বউ হয়ে যাবে তাদের ও তো পছন্দ হতে হবে। ফজলুল চৌধুরী কিছুটা হাসে এমন কথায়। রুয়াত কে তার অপছন্দের নয়। শুধু যে আয়াজ পছন্দ করে বলে এই সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে তা নয়। তিনি নিজেও রুয়াত কে বেশ পছন্দ করেন। প্রথম যেদিন আয়াজের থেকে কথাটি শুনলো সেদিন অমত পোষণ করলেও পরবর্তী সময়ে সবটা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় যে আয়াজের বউ হিসেবে রুয়াত কেই আনবে। মায়া চৌধুরী আর কিইবা বলবে? সে প্রথম থেকেই রাজি হয়েছিলো যখন আয়াজ তার মনের কথা মায়া চৌধুরীর কাছে শেয়ার করেছিলো। সেদিন থেকেই মায়া চৌধুরী রাজি।
ফজলুল চৌধুরী শান্ত স্বরে বললো,
-‘আমাদের মতামত নিয়ে দ্বিধাবোধ করছো? আমি রাজি দেখেই তোমার কাছে আজ এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আর মায়া সে তো অনেক আগেই রাজি। তুমি আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিও না।’
মেহরুবা দ্বিধায় পড়ে যায়। সে কি হ্যাঁ বলে দিবে? আর আয়াজের সাথে বিয়েটা হলে তার মেয়েটা তার কাছেই থাকবে। মেয়েকে দূরে কোঁথাও পাঠাতে হবে না। তেমন কষ্ট ও হবে না। সারাক্ষণ রুয়াত তার চোখের সামনে থাকবে। মেহরুবা কে চুপ করে থাকতে দেখে মায়া চৌধুরী বললো,
-‘কি রে কি ভাবছিস এতো? শুন ইনিমা কে বিদায় দিতে আমার যেমন কষ্ট হয়েছে তার এক ভাগ ও তোর হবে না। কারণ রুয়াত তো এই বাড়িতেই থাকবে। তোর সাথে সাথে থাকবে। তাহলে চুপ করে আছিস কেনো? রুয়াত কে আমার ভীষণ পছন্দ। আমি চাই তোর মেয়েটা আমার ঘরেই আসুক।’
মেহরুবা হেসে ওঠে। তার আর না বলার উপায় নেই। যেটার জন্য দ্বিধাবোধ কাজ করছিলো সেটা দূর হয়ে গিয়েছে। ফজলুল চৌধুরীর আবদারটা ও ফেললেন না। সব দিক চিন্তা ভাবনা করে সে সম্মন্ধটা তে সম্মতি দিয়ে দেয়। আর না করবেই বা কিভাবে? রুয়াত কে তাদের পছন্দ হয়েছে। যেহেতু রুয়াতের বাবা নেই। এখন বর্তমান অভিভাবক হিসেবে মেহরুবাই আছে। সেহেতু সব দিক ভেবে অতঃপর এই প্রস্তাবে রাজি হয়।
(*)
চৌধুরী বাড়ি তে প্রায় আট মাস পর আবার বিয়ের আমেজ এসেছে। সেই যে ইনিমার বিয়ে হলো। এখন আয়াজের। সেদিন বাড়িতে আসার পর ফজলুল চৌধুরী জানায় আয়াজ কে সব কথা। সে ভেবেছিলো অনেক কষ্ট করতে হবে এটা নিয়ে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। একদম সহজ ভাবে রুয়াত কে পেয়ে গেলো। ফজলুল চৌধুরী যে মেনে নিয়েছে এটা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিলো। ইনিমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এখন প্রকাশ করা হয়েছে।
আয়াজ চেয়েছে বিয়েটা একদম সাদামাটা করে করতে। কারণ সে আপাতত বিয়েটা করে রাখতে চায়। পরে বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে। প্রথম ফজলুল চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী রাজি না হলেও পরে রাজি হোন। সব দিক চিন্তা ভাবনা করার পরের সপ্তাহে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। এই কয়েকদিনে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রুয়াত আয়াজের সাথে দেখা করেনি।
বাগানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। আশেপাশে থেকে মানুষ আসলে দেখার উপায় নেই। এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে। বিকেলে তার আর রুয়াতের বিয়ে। তাই ঠিক করেছে আজ সে কোঁথাও যাবে না। ইনিমার বিয়ের সময় যেরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো এবার সেরকমটা হয়নি। তবে বাসার ভেতর থেকে মায়া চৌধুরীর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য আয়াজ বাগানে এসেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে রুয়াতের সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি। মেয়েটাও কেমন ভূত দেখার মতো চমকে গিয়েছে। সে যেনো এটা আশা করেনি। আয়াজ সম্পূর্ণ নিশ্চিত না যে রুয়াত সম্মতি দিয়েছে কিনা বিয়েতে। কারণ কাজের চাপে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি একদম। সে সত্যিই জানতে চায় রুয়াত কি মত আছে কিনা। তাই দাঁড়িয়ে না থেকে সরাসরি রুয়াতের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে খানিকটা ঘাবড়ে যায় মেয়েটা। আয়েশা চৌধুরীর কড়া আদেশ রুয়াত যেনো ভুলে ও বিয়ের আগে আয়াজের সাথে দেখা না করে কিংবা কথা বলে। কথাটি কি সত্যি বলেছে কিনা মিথ্যে মজা করার জন্য বলেছে সেটুকু আর যাচাই করেনি রুয়াত। শুধু মাথা নেড়ে চলে এসেছিলো তখন। কারণ সবাই উপস্থিত ছিলো সেখানে।
রুয়াত চলে যেতে নিলেই আয়াজ বললো,
-‘কথা আছে যেও না।’
-‘বলা আছে বিয়ের আগে যেনো আপনার সাথে আমার দেখা বা কথা না হয়। আমার মোটেও ধারণায় ছিলো না যে আপনি এই সময়ে এখানে থাকবেন। নাহলে আমি কখনো এখানে আসতাম না।’
রুয়াতের এরূপ কথায় আয়াজ বিরক্ত হয়। সে মুলত জিগ্যেস করবে অন্য কিছু। তার আগেই এসব শুনে বিরক্তি প্রকাশ করলো। কথাটি সেও জানে আয়েশা চৌধুরী মানা করেছেন। কিন্তু তার যে জানা দরকার। তাই সরাসরি বললো,
-‘তোমার সাথে আমি সেরকম কোনো কথা বলবো না। ভয় নেই। একটু দূরত্ব বজায় রেখেই কথাগুলো বলবো। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনতে পারো।’
আয়াজ একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। পকেটে হাত রেখে বললো,
-‘বিয়েতে রাজি তুমি?’
রুয়াত অবাক হয়ে আয়াজের দিকে তাকায়। আজ বিয়ে অথচ আজই জিগ্যেস করছে বিয়েতে রাজি কিনা। এ কেমন কথা!
-‘এতোদিন পর জিগ্যেস করার কারণ? আজ বিয়ে আর আপনি আজ জিগ্যেস করছেন এটা?’
আয়াজ তার চুলগুলোতে হাত বুলায়। যদিও রুয়াতের কথায় যুক্তি আছে। এতোদিন জিগ্যেস করতে পারেনি প্রথমত তার ভীষণ কাজের চাপ ছিলো। দ্বিতীয়ত আয়েশা চৌধুরী মানা করেছে। আর বাসায় থাকাকালীন সময়ে রুয়াত সামনে আসতো না। সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। তাহলে আয়াজ কিভাবে কথাটি জিগ্যেস করবে? আর এমন দিনেও কথাটি বলে কোনো লাভ হবে বলে মনেহয় না। কারণ আজ বিয়ে। আর রুয়াতের অমত থাকলে সে নিশ্চয়ই না বলে দিতো। শুধু যে আয়াজ কে জিগ্যেস করা হয়েছে তা না রুয়াত কে ও জিগ্যেস করা হয়েছিলো। এটুকুই জানে সে। এর বাহিরে আয়াজ আর কিছু জানে না।
-‘তুমি সামনে এসেছো একবারও? আমায় দেখলেই তো নিজেকে গুঁটিয়ে রাখতে। তাহলে আমি কিভাবে তোমাকে জিগ্যেস করবো কথাটা?’
নিমি রুয়াতের নাম ধরে ডেকে ওঠে হঠাৎ। এখন যদি সে ডাকতে ডাকতে এখানে চলে আসে দেখে ফেলবে আয়াজের সাথে রুয়াত কথা বলছে। রুয়াত ব্যাপারটা নিমি কে জোরজবরদস্তি করে লুকাতে পারবে এখন। কিন্তু এক সময় মেয়েটা ঠিকই আয়েশা চৌধুরী কে বলে দিবে। অধর কামড়ে ধরে রুয়াত অসহায় দৃষ্টিতে আয়াজের দিকে তাকায়। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। আয়াজ ইশারা করে বোঝায় চলে যাওয়ার জন্য। উত্তর আগেই পেয়ে গিয়েছে। এখন জানার প্রয়োজন নেই। তবে কিছুক্ষণ আগেও জানার ইচ্ছেটা ছিলো। এই মুহুর্তে তা উধাও হয়ে গিয়েছে। প্রেয়সীর চোখমুখ দেখে বুঝে গিয়েছে সে রাজি বিয়েতে। তাই এখন আর আটকে রেখে কিইবা করবে। এজন্য আয়াজ রুয়াত কে চলে যাওয়ার ইশারা করে। তৎক্ষণাত আর চারপাশে না তাকিয়েই রুয়াত সোজা দৌড় দেয়।
(*)
-‘আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে মিসেস বিউটিফুল। শাড়িতে ভীষণ ভালো লাগছে।’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছে ইনিমা। বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে আরাম আয়েশ করে বসে আছে সায়হান। দৃষ্টি তার একমাত্র বউয়ের দিকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে ইনিমা কে। এবং বিয়ের পর ইনিমা আরও বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছে সায়হানের ধারণা এটা। শাড়ির আঁচল ঠিক করে সে পেছনে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-‘আমি আগেও অনেক বার শাড়ি পড়েছি তখন কি ভালো লাগতো না?’
-‘আমি সেরকমটা উল্লেখ করিনি মিসেস বিউটিফুল। আমার চোখে আপনি সব সময়ের জন্য সুন্দর। বিয়ের আগে যেমন এক সুন্দরী রমণী দেখেছিলাম ঠিক সেরকম এখনো লাগছে। তবে এখন আমার বউ হওয়ার পর থেকে আরও বেশি সুন্দর এবং ভালো লাগছে।’
শেষের কথাটি বলার সময় সায়হান হেসে ফেলে। খানিকটা ভ্রু কুচকায় ইনিমা। সায়হানের কথাটি কেমন ঘোলাটে লাগলো তার কাছে। তার বউ হওয়ার পর আরও সুন্দর হয়ে গিয়েছে? এটা কেমন কথা!
-‘হয়েছে এসব কথা রাখুন। আমার কুচি ঠিক করে দিবেন। তাড়াতাড়ি আসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’
আজ আয়াজের বিয়ে সেজন্য ইনিমা শাড়ি পড়েছে। তার ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। যেমনটি হোক অবশ্যই সুন্দর করে সাজতে হবে তাকে। সে উদ্দেশ্য পরিকল্পনা নিয়ে আজ শাড়ি পড়া। যদিও অনেক আগে থেকেই শাড়ি পড়া বাদ দিয়েছে। আজ তার ভাইয়ের বিয়ে বলে আর এই সুযোগ হারাতে চায় না। আসার সময় অনেকগুলো শাড়ি নিয়ে এসেছিলো। সেখান থেকেই একটা পড়ে নিয়েছে। ইনিমার এমন তাড়া দেখে সায়হান হাসে। দ্রুত গতিতে তার স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসে কুচি ঠিক করে দেয়। এই কাজ আরও অনেক বার করেছে। যতবার ইনিমা শাড়ি পড়েছে ততবার সায়হান শাড়ি ঠিক করে দিয়েছে। কুচি ঠিক করা শেষে সায়হান সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
-‘হয়েছে। এবার এই সুবাদে আমায় কিছু দিন। যেহেতু আমি আপনার কুচি ঠিক করে দিলাম।’
অধর মেলে হাসে ইনিমা। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
-‘মাথাটা একটু নিচু করুন।’
সঙ্গে সঙ্গে সায়হান মাথা নিচু করে। ইনিমা তার মাথাটা উঁচিয়ে সায়হানের কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়। আর একটুও না দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। ইনিমার অধরের ছোঁয়া পেতেই সায়হান মাথা তুলে তাকায়। তখনই নজর পড়ে লজ্জায় তার বউয়ের বের হয়ে যাওয়াটা। মনে মনে আওড়ায়,
-‘আমার মিসেস বিউটিফুল।’
(*)
ইনিমা নিমি মিলে যেভাবে পেরেছে সেভাবে রুয়াত কে সাজিয়েছে। তবুও খুব জোর করে সাজিয়েছে তারা। মোটেও এভাবে সাজার ইচ্ছে ছিলো না। এক প্রকার জোর করে সাজানো হয়েছে তাকে। রুয়াত কে সাজিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎ নিমি মন খারাপ করে বললো,
-‘সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’
রুয়াত অবাক চাহনিতে নিমির দিকে তাকায়। মেয়েটার চিবুক ধরে প্রশ্ন করে,
-‘ঘুরে ফিরে কি বলতে চাচ্ছিস সেটা বললে আমরা খুশি হবো। আমি আর ইনিমা আপু কি বলবো মেজো মা কে যাতে তোকেও বিয়ে দিয়ে দেয়। একবার শুধু হ্যাঁ বল আমি এক্ষুনি গিয়ে বলছি।’
জিহ্বা কামড়ে ধরে নিমি। তার এই কথাটি মোটেও উচিৎ হয়নি রুয়াত আর ইনিমার সামনে বলার। সে তো মজা করে বলেছে। এটা কি রুয়াত সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো নাকি! কথা এড়ানোর জন্য বললো,
-‘আরে আমি সেরকম কিছু উদ্দেশ্য করে বলিনি। তোর তো সাজ শেষ হয়েছে। এবার আমি গেলাম রেডি হতে। কেমন দেখাচ্ছে আমায় দেখেছিস তো। তোমরা থাকো। আমি যাচ্ছি।’
নিমি চলে যায়। ইনিমা কিছুক্ষণ রুয়াতের সাথে কথা বলে সেও চলে আসে সেখান থেকে। রুয়াত এক জায়গায় সুন্দর করে বসে হাতে থাকা চুড়িগুলো বাজাচ্ছে। ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে তাতে। একটু পর মায়া চৌধুরী আর মেহরুবা এসে স্বর্ণ পড়িয়ে দিয়ে যায়। মেহরুবা কিছু সময় রুয়াত কে বুঝিয়ে শুনিয়ে সে ও তার কাজে চলে যায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চারপাশে আযান দেওয়া হচ্ছে। রুয়াত বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মায়া চৌধুরী তাকে নিয়ে যেতে এসেছে। তিনি রুয়াত কে নিয়ে নিচে আসেন। কিছু কিছু আত্মীয় স্বজনদের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যারা একদম খুব কাছের তাদের শুধু বলা হয়েছে। আয়াজ তার অফিসের কাউকেই বলেনি। সে নিজ ইচ্ছেতেই বলেনি।
সুষ্ঠুভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। মেহরুবা ব্যস্ততার কারণে আর তার মেয়ের কাছে যেতে পারেননি। সাধারণত মেয়ের বিয়ের সময় যেরকম কষ্ট হয় সেরকম কোনো কষ্টই হয়নি মেহরুবার। ইনিমা রুয়াত কে আয়েশা চৌধুরীর রুমে নিয়ে যায়৷ বিয়ে শেষ হওয়ার পরই আয়াজ বাহিরে চলে আসে। আয়েশা চৌধুরীর পাশে বসতেই তিনি রুয়াতের চিবুক ধরে বললেন,
-‘মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে আমার নাতবউ কে।’
পরক্ষণেই রাহীম চৌধুরী বললো,
-‘আয়াজ বলেছিলো বিয়ে করবে না। কতবার আমি বললাম তাও বলেছে করবে না অথচ এখন সরাসরি বিয়ে করে ফেললো।’
রুয়াত মুখে আঁচল চেপে হাসে। সেই মনেহয় একমাত্র মেয়ে যে কিনা বিয়ের সময় কাঁদার পরিবর্তে হাসছে। আয়াজের বাসায় ফিরতে রাত হয় একটু। জরুরী কাজে বাহিরে যেতে হয়েছিলো। অবশ্য ফজলুল চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী কে বলে গিয়েছে। তারা একদম রাজি ছিলো না পরে কথাটি শুনে রাজি হয়েছে। আয়াজ বাসায় ফিরতেই দেখে নিমি, ইনিমা, আরহাম আর রূহান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুলত ধান্ধা আজ আয়াজ টাকা দিবে তারপর রুমে ঢুকবে। অনেক্ক্ষণ যাবত একপ্রকার ঝগড়াঝাটি করার আয়াজ তাদের দাবি করা টাকা পরিশোধ করেই তবে রুমে ঢুকলো। বিছানার মধ্যিখানে রুয়াত চুপিসারে বসে আছে। নতুন বিয়ে করা বউ তার। মিটমিট করে হাসে আয়াজ। ধীর পায়ে সামনে এগোয়। আচমকা রুয়াতের হাত ধরে টেনে তার সম্মুখে দাঁড়া করায়। স্বাভাবিক স্বরে বলে,
-‘এখন আর পালাবে না?’
ঘাবড়ে যায় মেয়েটা। ফের আয়াজ বললো,
-‘আগে বলো খেয়েছো কিছু?’
-‘জ্বী।’
-‘ফ্রেশ হবে না? অস্বস্তি লাগছে তাইনা? যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।’
রুয়াত ফ্রেশ হতে যায়৷ ইনিমা একটা শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো। সেটাই পড়ে আবার বের হয়। আয়াজ তার গায়ের পাঞ্জাবী খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছে। সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ মুখ ভীষণ কুচকানো। রুয়াত সামনে এগিয়ে এসে বললো,
-‘মাথা ব্যাথা করছে আপনার?’
মাথা তুলে আয়াজ রুয়াতের দিকে তাকায়। মেয়েটার হাত টেনে ধরে তার পাশে বসায়। এক হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘কিছু কথা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। সর্বপ্রথম কথা তোমাকে আমি ভালোবাসি। আজ কথাটি বলতে দ্বিধাবোধ কাজ করবে না কারণ তুমি আমার বিয়ে করা বউ। ভালোবাসি সেটা একদিনের না বহুদিনের বলতে পারো। আর তোমার কাছ থেকে কিছু লুকাবো না। সেদিন তুমি যা শুনেছো সেটা সত্যি ছিলো। তবে সাহেদ তোমায় যা বলেছে সেটাও সত্যি। দুটোর মধ্যে কোনো ভুল নেই। আমি মারার চিন্তাভাবনা করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আমি মারিনি। একদম কিছু না করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে কেনো হঠাৎ এসব বলছি কারণ তোমার বিশ্বাস সবচেয়ে জরুরী আমার কাছে। সেদিন তারা আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিলো ভবিষ্যতে এমন হবে হুট করে মেরে ফেলেছে। সাহেদ বলেছিলো না আমি নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্য চেষ্টা করছি এটাও মিথ্যে নয়। যদি কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে নিজেকে সামলে রেখো। তোমার কথা চিন্তা করে আমি সব ছেড়ে দিলাম। এবার নিজেকে বোঝানোর দায়িত্ব তোমার।’
শেষের কথাগুলো শুনে রুয়াত থমকে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে চোখ দিয়ে পানি পড়ে কয়েক ফোঁটা। আজ যে তাকে এসব শুনতে হবে মোটেও কল্পনা করেনি। আয়াজ রুয়াতের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
-‘কাঁদার জন্য এসব বলিনি। নিজেকে আগে বুঝতে শিখো। তারপর মন খুলে কেঁদো। যদিও তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। অন্তর পোড়ায় ভীষণ।’
আয়াজ উঠে দাঁড়ায়। রুয়াতের জন্য কেনা গিফট বের করে তার হাতে দেয়। ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে,
-‘এটা কি?’
-‘তোমাকে যে আমি এতো কষ্ট দিলাম তার জন্য উপহার বলতে পারো। আপাতত পুষিয়ে নাও। অন্যগুলো ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিবো।’
রুয়াত বক্স খুলে দেখে একটা হিরার রিং। আয়াজ কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই রুয়াতের হাতে তা পড়িয়ে দেয়। হাতের উপর ছোট ছোট চুমু খায়। রুয়াত নিজেকে গুটিয়ে ফেললো না বরং উল্টো চেয়ে থাকলো। অনেক সময় নিয়ে তারপর আয়াজ মুখ খুলে বললো,
-‘ তোমাকে আজ ভালোবাসার অধিকার দিবে প্রেয়সী?’
লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় রুয়াত। আয়াজ প্রেয়সীর কোমড় জড়িয়ে ধরে। এক হাত ঘাড়ে রাখে। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। আয়াজ বুঝে গিয়েছে। মেয়েটার পাতলা অধরে অধর ছুঁয়ে দেয়। তৎক্ষনাত মুখ সরিয়ে নেয়। বক্ষে আবদ্ধ করে নরম স্বরে বললো,
-‘ভালোবাসি আমার প্রেয়সী। খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়।’
❝কেঁটে যাবে হাজার হাজার বছর
শেষ হবে না ভালোবাসার প্রহর।❞
সূচনা হয় নতুন এক ভালোবাসার। বহু বছরের জমিয়ে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় নতুন রূপে। উন্মাদনার চাঁদরে মুড়িয়ে যায় দু’জন।
#চলবে…