#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব___২৩ (অতীত)
জোৎস্নাত দীঘল রজনী। আকাশের বিভিন্ন জায়গাতে ঘন কালো মেঘ। আকাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত উজান, গভীর ঘুমে বিভর হয়ে আছে। এদিকে প্রজ্জ্বলিনীর ঘুম আসছে না। সে সাবধানে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। একসময় বিরক্ত হয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট সময় পর কালো মেঘকুঞ্জ সরে যায়। সুদীর্ঘ রজনী আরো জোৎস্নাময় হয়ে উঠে। জোৎস্নার মৃদু আলো আলিঙ্গন করছে প্রজ্জ্বলিনীকে। প্রজ্জ্বলিনী জোৎস্না উপভোগ করতে বেলকনির ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়। এমন সুখময় সময়ে কিছু তিক্ত বিষণ্নতায় ঘেরা অতীত স্মৃতিতে অকপটে ভেঁসে উঠছে। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী, হ্যাঁ এই নামটা প্রজ্জ্বলিনীর কাছে বিতৃষ্ণাময়, কিন্তু একটা সময় কিশোরী বয়সে এই নামটা তার অতিমাত্রায় পছন্দের ছিল। যা সময়ের ব্যাবধানে তিক্ততার রূপ নিয়েছে। প্রজ্জ্বলিনী স্মৃতিচারণ করে আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগের। সেই সময়টাই অষ্টাদশী প্রজ্জ্বলিনী ছিল দারুণ প্রাণোচ্ছল কিশোরী। তার স্মৃতিতে হানা দেয় সেই দূর্বিষহ দিন যখন আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী প্রথমবার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে জিলাতে এসেছিল। সেই সময় প্রজ্জ্বলিনী ছিল উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কিছুদিন পর যার বোর্ড এক্সাম। পড়াশোনা নিয়েই ব্যাস্ত সময় কাটছিলো প্রজ্জ্বলিনীর। প্রিন্সিপালের মেয়ে হিসাবে বরাবর প্রচন্ড সুযোগ সুবিধা পেতো প্রজ্জ্বলিনী। মাঝে মাঝে সুযোগ সুবিধা এটেনশন নিজ উদ্যোগে কেড়ে নিতো। সুদর্শনী প্রজ্জ্বলিনীর এটেশন পাওয়ার জন্য সবাই যখন মুখিয়ে থাকতো। প্রজ্জ্বলিনী কাউকে পাত্তা দিতোনা সেইসময়। নবযৌবনা কিশোরীর মাঝে এমন উচ্ছসিত লক্ষণগুলো অতিমাত্রায় স্বাভাবিক। সেদিন প্রথমবার প্রজ্জ্বলিনীর জীবনে ঘটেছিল অনাকাঙ্ক্ষীত ঘটনা। প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হতে গার্ডসদের সামনে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল সে। প্রজ্জ্বলিনী জানতো না লোকটির নাম পরিচয়। অতি আধুনিক, বলিষ্ঠ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুপুরুষকে দেখে প্রজ্জ্বলিনী কিছু অনুভব করে। লোকটির গম্ভীর মনোভাব তার কৌতূহল কেড়ে নেয়। প্রজ্জ্বলিনী লোকটিকে দুঃখিত বলেছিলো। কিন্তু লোকটি শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাকে এড়িয়ে চলে গেছিলো প্রিন্সিপালের রুমে। যে প্রজ্জ্বলিনী সবাইকে এড়িয়ে চলতো। তাকে যখন প্রথমবার কেউ এড়িয়ে গেলো স্বাভাবিক ভাবে তার প্রতি কৌতুহল হলো প্রজ্জ্বলিনীর। প্রজ্জ্বলিনী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিল লোকটির আন্তরিকতা। প্রিন্সিপাল আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে কতো ভাব লোকটির। এসব দেখে প্রজ্জ্বলিনীর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মিলে। কলেজের সুন্দরীদের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রজ্জ্বলিনী। এই ব্যাপারটায় অবশ্য সে গর্ব করতো। তাকে ইগনোর করার মতো কোনো পুরুষ তার কল্পনায় ছিলোনা। এক কথায় প্রজ্জ্বলিনীর মতো সুদর্শনী মেয়েকে কেউ ইগনোর করার ব্যাপারে ভাবতে পারবেনা। এখানেই ঘটে বিপত্তি আবিদের তাকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে সে ইগোতে নিয়ে নেয়। আবিদের আচরণ দেখে সে হতভম্ব হয়। হওয়ারই কথা এর আগে এমন ঘটনা কখনো হয়নি তার সঙ্গে। তখন থেকে প্রজ্জ্বলিনী ঠিক করে কঠোর চিত্তের এই অহংকারী লোকটির মনে সে জায়গা করে নিবে। বান্ধুবীদের সঙ্গে ঘটনাটা শেয়ার করার পরে, প্রজ্জ্বলিনীর বান্ধুবীরা সবাই অবাক হয়েছিল। তাদের মাধ্যমে প্রজ্জ্বলিনী ম্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী সম্পর্কে সব জানতে পারে। প্রজ্জ্বলিনী ‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী’ নামটাও শব্দ করে আওড়ায় দু’তিনবার। হঠাৎ কী মনে করে খাতা কলম নিয়ে চিরকুটও লিখে ফেলে লোকটির জন্য। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে কখন আবিদ কলেজ থেকে বের হবে। আধাঘন্টা পর আবিদ গার্ডসদের সঙ্গে বের হয়। প্রজ্জ্বলিনী প্রাণোচ্ছল হেসে সামনে এগোতে থাকে। আবিদ গাড়িতে চড়বে ঠিক এমন সময় প্রজ্জ্বলিনী কৌশলে স্যার বলে ডেকে উঠে। আবিদ থেমে যায় তখনকার সেই মেয়েটিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করে,
‘কিছু বলবেন?’
প্রজ্জ্বলিনী বলে,’আমি নিদ্রিতা প্রজ্জ্বলিনী। বলতে তো অনেক কিছু চাই। আপাতত সরি তখন আমি বেখেয়ালে ছিলাম বুঝতে পারিনি এভাবে ধাক্কা লাগবে।’
‘নো প্রবলেম।’ ____ আবিদের যেন কিছু যায় আসছে না এমনভাবে এড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। প্রজ্জ্বলিনী বারবার আবিদের এড়িয়ে যাওয়ায় অপমানিত বোধ করে। মৃদু রাগ করে মনে মনে বলে,
‘প্রজ্জ্বলিনী তোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে দেখছি। এটা কেমন মানুষ? আমাজনের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মতো। তোর প্রতি কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’
প্রজ্জ্বলিনী সবার অগোচরে আবিদের উদ্দেশ্যে চিরকুট দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। আবিদ উদাসীন হয়ে করে গ্রহণ করে ঠিকই কিন্তু না দেখেই চিরকুটটা ফেলে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে আবিদ কী মনে করে একবার সামনে তাকায়। একটু দূরেই প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে একটা মেয়ে হাত নেড়ে কথা বলছে। হাইটে একটু শর্ট তাই প্রজ্জ্বলিনীর থেকে ছোট হবে আন্দাজ করা যাচ্ছে। মেয়েটি সাদা ইউনিফর্ম, কেডস জুতা পরিহিত। পনিটেল স্টাইলে চুল বাঁধা। সামনে কিছু অগোছালো ব্রাউন মসৃণ চুল বেড়িয়ে আছে। ধবধবে ফর্সা মেয়েটি, লাল টকটকে ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে প্রজ্জ্বলিনীর সামনে সব অভিযোগের পালা সাজিয়েছে। আবিদ আন্দাজ করে নিলো মেয়েটি নিশ্চয়ই প্রজ্জ্বলিনীর আত্মীয় হবে। প্রজ্জ্বলিনী মেয়েটির সামনের কিছু চুল কানের পিছনে গুজে দেয়। মুখটায় হাত দিয়ে একটু আদর করে তারপর হাত ধরে কৃষ্ণচূড়ার গাছের পাশে বেঞ্চে বসিয়ে কথা বলতে থাকে। সেখানে প্রজ্জ্বলিনীর সময় বয়সী আরো কয়েকজন এগিয়ে আসে তাদের পাশে। আবিদের চঞ্চল চিত্ত দূর থেকে মেয়েটিকে একপলক দেখার সুযোগ পেলো। আবিদের তাকিয়ে তেমন সুবিধা হলোনা। ইতিমধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরেই গাড়িটা গেট ক্রস করে গেছে। সেই ছোট মেয়েটিকে একপলক দেখে ভালোলাগা কাজ করছিলো আবিদের। মেয়েটি অনেক বেশি সুদর্শিনী ছিল। সম্ভবত ক্লাস নাইন বা টেনের স্টুডেন্ট হবে। কারণ মেয়েটির পরনে কলেজ ইউনিফর্ম ছিলোনা। বোঝা যাচ্ছে কোন দরকারে মেয়েটি স্কুল বিল্ডিং থেকে কলেজ বিল্ডিংয়ের দিকে এসেছিল। মানুষ স্বভাবসুলভ সুন্দরকে সুন্দর বলতে দ্বিধা করেনা। আবিদের ক্ষেত্রেও সেম ঘটনা। মেয়েটিকে আবিদের মাশআল্লাহ অধিক সুদর্শিনী মনে হয়েছে। তবে আবিদ বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিলোনা।
এরপরের ঘটনা, প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে আবিদের দেখা কিছুটা কাকতলীয় ভাবে। বোর্ড এক্সামের মাসখানেক পর সেই কঠোর চিত্তের ম্যাজিস্ট্রেট, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর দেখা পেয়েছিল প্রজ্জ্বলিনী। রৌদ্রজ্জ্বল বিকালে যখন কোচিংয়ের সামনে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঠিক সেইসময় প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে গাড়ি থেকে নেমে একজন বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে দেখে। প্রজ্জ্বলিনী এবারো মুগ্ধ হয়ে আবিদকে লক্ষ্য করছিল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ সুপুরুষকে চিনতে প্রজ্জ্বলিনীর একটুও অসুবিধা হয়নি। মানুষটা নিজের সমস্ত কুয়ালিটি দিয়ে একটু একটু করে প্রজ্জ্বলিনীর মনে জায়গা করে নিয়েছিল। নাহলে প্রজ্জ্বলিনী প্রথম দেখা হওয়ার এতোদিন পরেও সেই লোকটিকে মনে রেখেছে কেনো? অনেকক্ষণ পর একটা রিক্সা এসে প্রজ্জ্বলিনীর সামনে দাঁড়ায়। এতোক্ষণ রিক্সার জন্য অপেক্ষা করলেও প্রজ্জ্বলিনী এখন মানা করে দেয়। সে হাসিখুশি মুখে আবিদের দিকে এগিয়ে যায়। আবিদ বৃদ্ধাকে খাবার আর কিছু টাকা দিয়ে যেইনা গাড়িতে বসবে এমন সময় প্রজ্জ্বলিনী বলে,
‘হ্যালো স্যার। আমাকে চিনতে পারছেন?’
আবিদ প্রজ্জ্বলিনীকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলো কিন্তু নামটা মনে ছিলনা। তবে এই মেয়েটির সঙ্গে আবারো দেখা হয়ে যাবে আবিদ একদমই ভাবেনি। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীকে চিনতে না পারার অভিনয় করে বলে,
‘আপনাকে সঠিক চিনতে পারলাম না। দুঃখিত!’
প্রজ্জ্বলিনীর মনটা ছোট হয়ে যায়। কতো আশা করেছিল আবিদ তাকে চিনতে পারবে। কিন্তু আবিদ তাকে চিনতে পারছেনা। প্রজ্জ্বলিনী মন খারাপ করে আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘নিদ্রিতা প্রজ্জ্বলিনী। দু’মাস আগে আপনার সঙ্গে কলেজে দেখা হয়েছিল। এখনো মনে পড়েনি?’
আবিদকে শেষে স্বীকার করতে হয়, ‘দুমাস আগে একবার দেখা হয়েছে যদিও চিনতে পারার কথা না। কিন্তু আমার মনে পড়ল। কিছু বলবেন? আমি খুব ব্যাস্ত। আসলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যেতে হবে।’
প্রজ্জ্বলিনী খুশি হয় আবিদ তাকে চিনতে পেরেছে বলে। প্রজ্জ্বলিনী হঠাৎ আবদার করে বসে, ‘স্যার আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবেন প্লীজ। আমার কাছে রিক্সা ভাড়া নেই। আম্মু রিক্সা ভাড়া দিতে ভুলে গেছেন।’
প্রজ্জ্বলিনী ইচ্ছে করে মিথ্যা বললো। যাতে আবিদ তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। তাহলে কিছু সময় পাবে গাড়িতে আবিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এছাড়া পরিচিত হবার ব্যাপার আছে। এদিকে আবিদ মনে মনে বিরক্ত হয়। আবিদ একবার ভাবলো সাহায্য করবেনা। কারণ উশৃঙ্খল মেয়েদের তেমন পছন্দ না আবিদের। পরক্ষণে ভাবলো হয়তো সত্যিই মেয়েটা বিপদে পড়েছে। একটু সাহায্য করলে তেমন সমস্যা হবে না। সেইদিন আবিদ প্রজ্জ্বলিনীকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সেই সঙ্গে জানতে পারে প্রজ্জ্বলিনী জিলার প্রিন্সিপাল আশরাফ মুহতাসিমের মেয়ে। গাড়িতে প্রজ্জ্বলিনী এতো পরিমাণে প্রশ্ন করেছিল আবিদের মেজাজটা গরম হয়ে গেছে। কিন্তু বেচারা নিজেকে সামলে নেয়। প্রজ্জ্বলিনীকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে আবিদ কোন কথা ছাড়া গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যায়! যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। এদিকে আবিদকে প্রজ্জ্বলিনী ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পায়নি। সহসা মন খারাপ নিয়ে বাড়িতে ফিরে যায়। সেদিনের পর থেকে প্রজ্জ্বলিনী আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর উপর দূর্বল হয়ে পড়ে। এরপরের ঘটনা, প্রায় পনেরো-ষোলোদিন বাদে বাবার ঘরে প্রজ্জ্বলিনী কোন এক দরকারে গেয়েছিল। সেখানেই সৌভাগ্যবসত আবিদের একটা কার্ড পায়। সেই কার্ডে ম্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর নাম্বার ছিলো। সুযোগটা প্রজ্জ্বলিনীর কাছে মেঘ না চাইতেও বৃষ্টির মতো। সেদিন আনন্দে প্রজ্জ্বলিনী আত্মহারা হয়ে গেছিলো। অজানা কারণে প্রজ্জ্বলিনী নাম্বার পেয়েও ফোন দিতে ইতস্তত বোধ করছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সাহস করে আবিদকে ফোন দিয়েই ফেলে। ওপাশে যখন রিসিভ হয় প্রজ্জ্বলিনীর আনন্দে চোখ ঝলমল করছিল। আবিদ যখন জানতে পারে ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি অন্যকেউ নয় স্বয়ং প্রজ্জ্বলিনী। আবিদ আহম্মক বনে যায়। প্রচুর বিরক্তি নিয়ে প্রজ্জ্বলিনীকে জিগ্যেস করে,
‘আপনি? আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?’
প্রজ্জ্বলিনী সেদিন হেসে জবাব দিয়েছিল,’বাবার কাছ থেকে পেয়েছি! মানে বাবার ঘরে আপনার কার্ড থেকে।’
আবিদ সেদিন বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেয়। এভাবে প্রজ্জ্বলিনী প্রায় আবিদকে ফোন দেয়। আবিদ সেভাবে পাত্তা দিতো না রিসিভও করতো না। মাঝে মাঝে এরোপ্লেইন মুড চালু করে রাখতো। কারণ প্রজ্জ্বলিনীর একটা নাম্বার ব্লক দিলে প্রজ্জ্বলিনী ঠিক অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিতো। এদিকে আবিদ ফোন রিসিভ না করলে প্রজ্জ্বলিনী ক্রমাগত মেসেজ দিতে থাকতো। আবিদ তখন সিন করে রিপ্লাই করেনা। এখানে আবিদের কিছু করার ছিলোনা। আবিদ বুঝতে পারছিলো প্রজ্জ্বলিনী তার জন্য কিছু অনুভব করে, হয়তো তাকে পছন্দ করে। এজন্য আবিদ একবার ফোন রিসিভ করে প্রজ্জ্বলিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করে প্রজ্জ্বলিনী যা চাইছে সেটা অসম্ভব। কিন্তু প্রজ্জ্বলিনী সেটা মানতে চায়নি। সামনাসামনি থাকলে আবিদ থাপ্পড় মেরে ভালোভাবে বোঝাতে পারতো প্রজ্জ্বলিনীকে। কিন্তু ফোনে তো এভাবে সম্ভব না। সেজন্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে ভালো মতো বোঝানোর সিদ্ধান্ত নেয় আবিদ।
এরপরে বেশকিছুদিন প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে ফোন মেসেজ কিছু করেনি। কিন্তু নিয়মিত আবিদকে চিঠি পাঠায়। আবিদ ভেবেছিল হয়তো প্রজ্জ্বলিনী তাকে ডিস্টার্ব করবে না। কিন্তু তার নামে এতো এতো চিঠি দেখে আবিদের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। প্রজ্জ্বলিনী এডমিশনের জন্য ফোন অফ রেখে আবিদকে কারো মাধ্যমে প্রতিদিন চিঠি পাঠাচ্ছিল। এদিকে আবিদ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয় তার নামে এতোসব চিঠি দেখে। প্রজ্জ্বলিনীর পাঠানো কালারফুল কাগজের চিঠি গুলো আবিদ পুড়িয়ে ফেলতো। প্রজ্জ্বলিনীর এমন বাড়াবাড়ি আচরণের জন্য সে ঠিক করে প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে দেখা করবেই করবে। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীকে চিঠির মাধ্যমে দেখা করার জন্য বলে। সেইসময় প্রজ্জ্বলিনী অন্যকিছু ভেবে জানায় এডমিশন হয়ে গেলে দেখা করবে। আবিদের উদ্দেশ্যে ছিল প্রজ্জ্বলিনীকে বুঝিয়ে নিষেধ করবে এমন আচরণ করতে। অন্যদিকে প্রজ্জ্বলিনীর উদ্দেশ্যে ছিলো এডমিশন পরে আবিদকে প্রপোজ করবে। প্রায় দেড়মাস পর প্রজ্জ্বলিনীর এডমিশন শেষ হয়। প্রজ্জ্বলিনী ঠিক করে এবার আবিদের সঙ্গে দেখা করবে। প্রজ্জ্বলিনী ভেবেছিল এবার তার আর আবিদের প্রণয় হবে। কিন্তু তার আগেই আশরাফ মুহতাসিম বংশের নিয়ম রক্ষার্থে তড়িঘড়ি করে সবার অগোচরে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজ করতে থাকেন। আহমেদ মুহতাসিম এর অর্ধাঙ্গিনী জান্নাতুল বেগম তখন জীবিত ছিলেন। আশরাফ মুহতাসিমের অসুস্থ মা চেয়েছেন নাতনী জামাইকে দেখে যেতে। মূলত তাদের জন্যই আশরাফ মুহতাসিম তাড়াহুড়ো শুরু করেন। এসব কিছু প্রজ্জ্বলিনীর অগোচরে ঘটেছিলো। তারপরই আশরাফ মুহতাসিম খবর পেয়েছিল উজান মাহতাব চৌধুরীর। তুখোড় বিজনেসম্যান প্রভাবশালী উজান মাহতাব চৌধুরী প্রজ্জ্বলিনীকে দেখেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। তৎক্ষণাৎ খোঁজ খবর নিয়ে আশরাফ সাহেবের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয়। এতো ভালো পরিবার দেখে আশরাফ সাহেব অমত করেনি। প্রিয়দর্শিনী, প্রজ্জ্বলিনী দু’বোনই বাবা-মায়ের ভক্ত। তারা বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের উপর কথা বলতে পারেনা। প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল গুরুজনদের প্রতি। তাইজন্য প্রজ্জ্বলিনী যখন জানলো তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে সে চেয়েও সরাসরি অমত করতে পারেনি। কিন্তু প্রচুর কান্নাকাটি করেছিলো আবিদের জন্য। প্রজ্জ্বলিনী ভেবেছিল এতোদিনে আবিদ হয়তো তাকে নিয়ে কিছু ফিল করে। প্রজ্জ্বলিনীর এতো পাগলামি দেখে অন্তত কিছুটা ভালোলাগা থাকবে। এজন্য আবিদকে সবটা জানিয়ে বিয়েটা আঁটকানোর চেষ্টা করতে উদ্ধত হয়। মাঝখানে উজানের সঙ্গে এঙ্গেজমেন্টের পর প্রজ্জ্বলিনী সুযোগ পায় আবিদের সঙ্গে দেখা করার। তবুও প্রজ্জ্বলিনী আবিদের সামনে কান্নাকাটি করে। আবিদকে সবটা খুলে বলে সবশেষে ভালোবাসি বলে দেয়। প্রজ্জ্বলিনী আবিদকে বারবার অনুরোধ করে আশরাফ মুহতাসিমকে বলে বিয়েটা বন্ধ করতে। কিন্তু আবিদ ভাবলেশহীন ছিল সবটা শুনে সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
‘এটা ভালোবাসা নয়, এটা আকষর্ণ প্রজ্জ্বলিনী। আপনি আমার ব্যাক্তিত্বকে পছন্দ করেছেন। এটাকে ভালোবাসা বলেনা। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি আপনাকে ভালোবাসিনা। আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। হ্যাঁ! আমি আমার স্বপ্ন কন্যাকে ভালোবাসি এবং তার
জন্য অপেক্ষায় আছি। তাকে ছেড়ে আপনাকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আপনাকে এর আগেও বুঝিয়েছি। আপনার জন্য আমার কাছে বিন্দুমাত্র কোন অনুভূতি, আকষর্ণ নেই। আপনি নিশ্চয়ই এমন ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবেন না। আপনার বাবা আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিয়েটা করে ফেলুন সুখী হবেন। আপনার বাবা যদি জানতে পারেন আপনার কাছে তার পছন্দের গুরুত্ব নেই তিনি অনেক কষ্ট পাবে। আপনি কী আপনার বাবাকে কষ্ট পেতে দেখতে চান? না চাইলে ফিরে যান। সবকিছু ভুলে গিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক সংসার করুন।’
সেদিন প্রজ্জ্বলিনী আবিদের কথায় মা’রাত্মক আঘাত পেয়েছিল। তার ধারণা আকাঙ্ক্ষা মুহূর্তের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়ে গেছিলো। আবিদের মনে তার জন্য কোন অনুভূতিই ছিলোনা অথচ আবিদের ডেস্পারেটলি দেখা করার কথায় কতো কী ভেবেছিল সে। তার সব ভাবনা নিমিষেই মিথ্যা হয়ে গেলো। অতঃপর প্রজ্জ্বলিনী আবিদের প্রত্যাখান, বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান রক্ষার্থে চুপচাপ ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল। অদ্ভুত হলেও আবিদের কথা শুনে প্রজ্জ্বলিনীর আর কান্না পায়নি। কিন্তু রাগ হয়েছিল। আবিদের সেই স্বপ্ন কন্যার প্রতি ঈষদুষ্ণ ঈর্ষা জন্ম নিয়েছিল। সেদিন আবিদকে কোন প্রকার জবাব না দিয়ে প্রজ্জ্বলিনী ফিরে আসে। হয়তো তৎক্ষণাৎ প্রজ্জ্বলিনীর ভিতরে একরাশ ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল আবিদের প্রতি। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীর চোখে স্পষ্টত ঘৃণা লক্ষ্য করেছে। যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ঘৃণা করা আদেও সম্ভব? আবিদ তখন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাঁকা হাসে। প্রজ্জ্বলিনী ভালোলাগাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিল। এখন প্রজ্জ্বলিনীর আফসোস হয় সেইদিনের ভুলের জন্য।
ব্যাস আর কোন সমস্যা হয়নি আবিদের। আবিদ প্রজ্জ্বলিনীর থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েছিলো। সেসময় আবিদ তখন তার স্বপ্ন কন্যার কল্পনায় স্বতঃস্ফূর্ত ডুবে ছিল। জিলাতে প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে যেই সুদর্শিনী মেয়েটিকে এক ঝলক দেখেছিল আবিদ। সেদিনের সেই সুদর্শিনী মেয়েটিকে আরেকবার দেখার তীব্র ইচ্ছে হয় আবিদের। হয়তো আবিদের অবচেতন মন তার মাঝেই খুঁজতে চাইছে তার স্বপ্ন কন্যাকে।
___
দর্শিনী হৃদিকে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সে হৃদির কাছে গিয়ে বলে উঠে, ‘কার সঙ্গে এতো লুকোচুরি করে কথা বলছিস?’
হৃদি চমকে উঠে। দর্শিনীকে দেখে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। দর্শিনী হৃদিকে ভয় পেতে দেখে নিঃশব্দে হেসে ফেলে। হৃদি মুখটা গোমড়া করে বলে, ‘আমি ভয় পেয়েছি! এখানে হাসার কী আছে প্রিয়?’
দর্শিনী সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ‘সরি, আচ্ছা হাসবো না। কিন্তু কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস?’
হৃদি চেয়ারে বসে বলে, ‘কার সঙ্গে আবার দিয়া, নাদিম, আহানাফ! তোর এঙ্গেজমেন্ট ওরা কেউ এটেন্ড করতে পারেনি কিন্তু বিয়ে সবাই এটেন্ড করবে বলেছে।’
দর্শিনী হৃদির পাশে বসে বলে, ‘কোথায় দেখি! সবাই আছে? সবার সঙ্গে কথা বলে দেখি।’
এভাবে দর্শিনী আর হৃদিতা ফেন্ডদের সবার সঙ্গে বেশকিছু ক্ষণ কথা বলে। চাঁদনী রাত চারপাশে সবকিছু আলোকিত হয়ে আছে। চারপাশ দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। ফোন রেখে দর্শিনী হৃদির সঙ্গে বেলকনিতে বসে জোৎস্না উপভোগ করতে থাকে। এভাবে অনেক সময় পার হয়ে যায়। হৃদিতা চেয়ারের উপর ঘুমে ঢলে পড়লে দর্শিনী তাকে ধরে রুমে নিয়ে শুয়ে দেয়। তারপর এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়। দর্শিনী বিছানার একপাশে বসে পড়ে। হঠাৎ দর্শিনীর মোবাইলটা কাঁপতে থাকে। মোবাইলটা ভাইভ্রেট মুডে ছিল। আননোন নাম্বার থেকে ফোন করছে। দর্শিনী ফোনটা রিসিভ করতেই আদিবার উচ্ছসিত কন্ঠ শোনা যায়।
আদিবা বলে,’প্রিয় আপু তোমার নাম্বারটা আদিব ভাইয়ার কাছ থেকে নিয়েছি। আর এটা আমার নাম্বার! যাইহোক তোমার হোয়াটসএপ নেই? ইন্সটল দিয়ে চেক করো দ্রুত। দেখো তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’
দর্শিনী মৃদু হেসে জিগ্যেস করে, ‘কেনো আদিবা কিছু হয়েছে?’
আদিবা বলে, ‘আজ আইফোন দিয়ে যত ছবি তুলেছি সবগুলো পাঠিয়েছি চেক করে দেখো প্লীজ। ইশশ! আবিদ ভাইয়া আর তোমাকে পাশাপাশি মাশআল্লাহ কতো সুন্দর লাগছিল। আমি এতো এতো ছবি তুলেছি। সব ছবি মাশআল্লাহ সুন্দর হয়েছে। আমার তো এখন ইচ্ছে করছে তোমাদের পাশাপাশি হাত ধরে বসে থাকার ছবিটা বিশাল বড় করে বাঁধিয়ে রাখতে।’
আদিবার কথায় দর্শিনী সামান্য হাসলো। সে হোয়াটসএপ ইন্সটল করে ওপেন করার সঙ্গে সঙ্গে আদিবার নাম্বার থেকে অর্ধশত ছবির নোটিফিকেশন আসে। দর্শিনী কয়েকটা ছবি দেখে বলে, ‘মাশআল্লাহ সুন্দর ছবি! তুমি অনেক ভালো ছবি তুলতে পারো আদিবা।’
আদিবা হাসলো। তারপর আহ্লাদী হয়ে দর্শিনীকে বলে, ‘আচ্ছা তুমি দেখো প্রিয় আপু। আমি রাখছি এখন পরে কথা হবে।’
আদিবা ফোন রেখে দেয়। দর্শিনী সবগুলো ছবি এক এক করে দেখতে থাকে। সব ছবির মধ্যে আবিদ দর্শিনী পাশাপাশি হাত ধরে একে – অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনের হাতেই এঙ্গেজমেন্টের আংটি জ্বলজ্বল করছে। দর্শিনী এই সুন্দর ছবিটা সেভ করে ওয়ালপেপারে দেয়। হঠাৎ কী ভেবে দর্শিনী মিষ্টি হেসে আবিদের ম্যাসেন্জারে ছবিটা পাঠিয়ে দেয়। একটু পর আবিদ সিন করে। সচারচর আবিদ ফেসবুক চালায় না। দর্শিনীর জন্যই ওপেন করেছিল। প্রথম প্রথম আবিদের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার কিছুই ছিলোনা। এজন্যই দর্শিনী অনেক চেষ্টা করেও আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীকে খুঁজে পায়নি। কিন্তু কিছুদিন আগে আবিদ সব অপেন করেছে। আর মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যাবধানে আবিদের এতো ফ্যানফলোয়ার দেখে দর্শিনী বিস্মিত হয়। মাত্র কয়েকদিনের ভিতর এতো ফ্যানফলোয়ার হওয়া কী সম্ভব?
#চলবে
[ দুইপর্ব নিয়ে প্রজ্জ্বলিনী আবিদের অতীত শেষ করবো, তারপর আবিদ দর্শিনীর বিয়ে। সবার ইচ্ছে দ্রুত পূরণ করা হবে ইনশাআল্লাহ 🥹🧡 ভুলত্রু’টি ক্ষমা করবেন। প্লীজ রেসপন্স রেসপন্স রেসপন্স 🧡]