#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০১+২
“আপনি না-কি আগেও একটা বিয়ে করেছিলেন?”
বাসরঘরে বসে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউয়ের মুখে আচমকা এমন কথা শুনে খানিকটা চমকালো ফারহান। পরমুহূর্তেই চোখ-মুখ স্বাভাবিক করে বললো, “আশেপাশের লোকজনের মুখেই শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
ফারহানের এমন কথায় একটু কাচুমাচু হয়ে বসলো নিরু। ফারহান তার সামনেই বরবেশে বসা। ফারহান রুমে আসার আগে যখন মুরুব্বীরা তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলো তখন কিছু মহিলাকে ফারহানের আগে বিয়ে করা নিয়ে কানাঘুঁষো করতে শুনেছে সে। তাই কৌতূহলের বশেই এভাবে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।
নিরু হাত কচলাতে কচলাতে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, “আসলে… ওই কিছু মহিলারা বলছিলো তো আর বিয়ের আলোচনার সময়ও তো এমন কিছু শোনা যায়নি তাই একটু কৌতূহলের বশেই আরকি।”
নিরুকে এমন কাচুমাচু করতে দেখে ফারহান মৃদুস্বরে এসে বললো, “আপনি প্লিজ অস্বস্তি বোধ করবেন না। আর একদম নিশ্চিন্ত থাকুন যে আপনার স্বামী আগে কোনো বিয়ে করেনি। পরে একসময় না-হয় সবটা বিস্তারিত বলবো।”
“আপনার স্বামী” কথাটা শুনেই মুখটা লজ্জার আভায় ছেয়ে গেল নিরুর। সামনে বসা লোকটা তার স্বামী। বিয়ে হয়েছে তাদের। তবে অজানা আশঙ্কায় একটু অস্বস্তিও লাগছে।
নিরুকে অস্বস্তি বোধ করতে দেখে ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। এত ভারী শাড়ি পড়ে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই। আপনি ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিন। আর এটা ভাববেন না যে নিজের বিবাহিত বউকে আপনি করে বলছি কেন? বিয়েতে রাজি ছিলাম না-কি না? আসলে দু-এক বারের পরিচয়েই কাউকে তুমি করে বলতে একটু কেমন যেন লাগে। তাই আরকি। আস্তে আস্তে আপনি থেকে তুমিতে পরিণত হয়ে যাবে।”
নিরু লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি দিয়ে লাগেজ থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফারহানের ব্যবহার, কথা-বার্তা বড্ড বেশি-ই ভালো লাগছে তার। একপ্রকার মুগ্ধ হয়েছে বটে।
নিরু ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখলো ফারহান একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে বিছানায় বসে আছে। নিরুকে দেখেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো, “ছাদে যাবেন?”
ফারহানের এমন নিঃসংকোচ আবদারে না করতে পারলো না নিরু। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরু ফারহান। দুজনেই নিশ্চুপ। ঝিরিঝিরি বাতাসে নিরুর শাড়ির আচল হালকা হালকা উড়ছে। চুলগুলোও থেকে থেকে উড়ছে।
নিরবতা ভেঙে ফারহান বললো, “আসলে আপনার সাথে তো আমার তেমন ভালো করে কথা হয়নি তাই এসময়ে ছাদে আসা। খোলামেলা পরিবেশে বেশ জমিয়ে কথা বলা যাবে। আর চাঁদটাও কী সুন্দর জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। আমি তো ভাবছি আজ সারারাত এখানে কথা বলতে বলতেই কাটিয়ে দেব। আপনি কী বলেন?”
নিরুও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো।
ফারহান আবারো বললো, “কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করবেন না প্লিজ।”
নিরু মুচকি হাসলো।
ফারহান হঠাৎ নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই নিরু বললো, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“ওহ, মাদুর আনতে। সারারাত তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে কাটানো যাবে না। পরে পা ব্যথা হয়ে যাবে। আর আমার বউয়ের কষ্ট কী আর আমি সহ্য করতে পারবো? মোটেও না।”
নিরু লজ্জামিশ্রিত হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা হঠাৎ করেই কেমন লজ্জর কথা বলে ফেললো।
কিছুক্ষণ পরে ফারহান ফিরে এসে মাদুরটা দেয়ালের সাথে ঘেষে বিছিয়ে বসে নিরুকেও বসতে ইশারা করলো।
নিরু বসতেই বললো, “এবার বলুনতো আমার সম্পর্কে আপনি কী কী জানেন?”
নিরু লজ্জা পেয়ে বললো, “তেমন কিছু না। আসলে আমি নিজে থেকেই জানতে চাইনি বিয়ের পরে জানবো বলে। আর বাবা-মা নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবেন না।”
ফারহান এভাবে কথায় কথায় নিরুর লজ্জা পাওয়াটা বেশ উপভোগ করছে। লজ্জা পেলে দেখতে বেশ লাগে।
“আচ্ছা,বলুন তাহলে কী কী জানতে চান।”
নিরু নিচুস্বরে বললো, “আপনি বলুন।”
ফারহান স্বভাবতই মুচকি হেসে বলতে শুরু করলো, “আমি ফারহান। পুরো নাম ফারহান শাহরিয়ার। ক’দিন আগেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জয়েন করেছি। মায়ের জোড়াজুড়িতেই বিয়ে করা আরকি। তাছাড়া আর কতকালই বা সিঙ্গেল থাকতাম! হাহা।”
ফারহানকে হাসতে দেখে নিরুও মুচকি হাসলো।
ফারহান হাসি থামিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো, “সেভাবে বলার মতো তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না আপাতত। আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবেন। তাছাড়া আপনার কিছু জানার আছে?”
নিরু খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললো, “আসলে… বিয়ের ব্যাপারটা।”
“সে এক তিক্ত অনুভূতি। আমি চাই না এত সুন্দর পরিবেশটা এখন তিক্ততায় ছেয়ে যাক। একদিন ঠিকই বলবো। তবে আপনার যে কোনো সতিন নেই বা ছিল না এ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।” বলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটালো ফারহান।
নিরু অবাক হয়ে দেখছে ফারহানকে। কী সুন্দর করে হাসে। ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি লেগেই থাকে।
“নিরু।”
ফারহানের ডাকে ঘোর কাটে নিরুর। লজ্জা পেয়ে মাথাটা একটু নিচু করে ফেলে।
ফারহান নিরুকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে বললো, “এত লজ্জা পান কেন? আপনারই তো আমি। যখন ইচ্ছা হবে তখনই তাকিয়ে থাকবেন, যতক্ষ ইচ্ছা ততক্ষণ।”
ফারহানের কথায় নিরুর লজ্জা যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। এভাবে বলতে আছে না-কি! লজ্জার মাঝেও মুচকি হাসলো নিরু যা ফারহানের দৃষ্টিগোচর হলো না।
এটা ভাবতেও ভালো লাগছে নিরুর যে, প্রথম রাতেই লোকটা কী সুন্দরভাবে কথা বলছে৷ মনে হচ্ছে কতকালের চেনা পরিচিত একজন মানুষ। নিরুর লজ্জা ভাবটা বেশ খানিকটা কেটে গেছে।
“আমার সম্পর্কে কিছু জানার আছে আপনার?”
“আপনার সম্পর্কে প্রায় সবই জানা আছে আমার।”
নিরু বিস্মিত হয়ে বললো, “কীভাবে জানেন?”
ফারহান একটু রহস্যময় হেসে বললো, “সেভাবেই।”
নিরু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “তা কী কী জানেন?”
“এই যে আপনি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আছে। আপনি টক জিনিস খেতে ভীষণ পছন্দ করেন, বিশেষ করে সেটা যদি হয় জলপাইয়ের আচার তাহলে তো কথাই নেই। তাছাড়া শাড়ি পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন আর রিকশা নিয়ে ঘুরতেও। প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়ায় চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকেন। স্নিগ্ধতা এসে ভর করে আপনার মুখখানিতে। ফল তেমন একটা পছন্দ করেন না শুধু কাঁচা আম বাদে। আর ফুলের মধ্যে ঘাস ফুল। আরো অনেক কিছু। আপাতত এত মনে করতে পারছি না।”
নিরু নিজের সম্পর্কে এতকিছু শুনে একপ্রকার অবাক চোখেই তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। সে তো নিজের সম্পর্কেও এত কিছু খেয়াল করেনি কখনো। পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে এত ভাবেনি। তাহলে সে জানলো কী করে এতকিছু।
নিরু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারহান বললো, “প্লিজ জানতে চাইবেন না এগুলো কীভাবে জানলাম। নিজেই একসময় জানতে পারবেন।”
নিরু আর এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলো না। তবে মনে মনে ঠিকই ভাবছে, “এত কিছু কীভাবে জানলেন উনি? তাহলে কী আমাকে আগে থেকেই চিনেন? কিন্তু আমি তো চিনি না। যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন সেদিনই তো শুধু দেখেছিলাম।”
____________________
মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসতেই ঘুম ভাঙলো ফারহানের। আবছা আলোয় ভালোভাবে চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো তারা এখনো ছাদেই আছে। কথা বলতে বলতে মাঝরাতেই নিরু কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর ফারহানও নিরুকে আগলে ধরে পাড়ি জমিয়েছিল ঘুমের রাজ্যে। কেন যেন রুমে যেতে ইচ্ছা করছিল না। এখানেই ভালো লাগছিল।
পুনরায় আযানের ধ্বনি কানে আসতেই ফারহান আস্তে আস্তে নিরুকে ডাকতে লাগলো, “নিরু, নিরু।”
নিরু পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো সে ফারহানের কাঁধে মাথা দিয়ে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তাৎক্ষণিক খানিকটা লজ্জা পেয়ে সরে বসলো নিরু। হাই তুলে বললো, “কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।”
ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “রুমে চলো। নামায পড়বে না?”
“হুম, চলুন।” বলে নিরুও ফারহানের পিছু পিছু রুমে চলে এলো। বিছানা এখনো আগের মতোই সাজানো।
নিরু বিছানা থেকে ফুলগুলো সরিয়ে পাশের ঝুড়িতে ফেলে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিল। ফারহানও মসজিদে চলে গেছে ততক্ষণে।
নিরু তার অভ্যাস অনুযায়ী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কাল বিয়ে থেকে শুরু করে এপর্যন্ত হওয়া সব ঘটনাই ভাবছে। এক পলকেই কীভাবে জীবনটা পাল্টে গেল। ফারহানের সাথে অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে। একদিনের দীর্ঘ কথোপকথনেই বুঝতে পেরেছে খারাপ না মানুষটা।
সকাল সাতটা বেজে গেছে। ফারহান মসজিদ থেকে এসে আবার ঘুমিয়েছে। নিরু গোসল করে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে। রুমের বাইরে যাবে না-কি যাবে না এ নিয়ে ভাবছে। নতুন বউ হুট করেই তো আর কোথাও যাওয়া যায় না। আর কেউ তো ডাকতেও আসছে না। বাইরে থেকে মানুষজনের শব্দও আসছে।
নিরুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার থেকে বয়সে বড় কিছু মেয়ে আসলো রুমে। এদের মধ্যে একজনকেই চেনে নিরু। সে হচ্ছে ফারহানের বড় বোন ফারিয়া। সে রুমে প্রবেশ করেই নিরুকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে সাজাতে লাগলো। নতুন বউ একটু সাজগোজ না করলে চলে না-কি? আর বাকিরা সবাই তার পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের লজ্জাজনক কথা বলে যাচ্ছে। ওরকম কিছু না হলেও নিরুর বেশ লজ্জা লাগছে।
ফারহান তাদের কথার শব্দে ঘুমোতে না পেরে বেশ বিরক্তির স্বরেই বললো, “ভাবীরা একটু ঘুমাতে দাও প্লিজ।”
তাদের মধ্যে একজন মুখ চেপে হেসে বললো, “হ্যাঁ, ঘুমাও দেবরমশাই। এখনি তো ঘুমাবে। রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি।”
ফারহান তাদের কথা শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেও নিরুর লজ্জার শেষ নেই। লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। কীসব কথা বলছে উনারা।
,
নিরুকে হালকা সাজিয়ে ফারিয়া আর বাকি সবাই মিলে ওকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। আশেপাশের প্রতিবেশীরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। নিরুকে নিয়ে সোফায় বসাতেই তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল। নিরু হেসে হেসেই সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সবারই পূর্ব পরিচিত সে। এভাবে কথা বলায় সবাই বেশ প্রশংসাও করছে। নিরুর এখন তার মায়ের বলা কথাগুলোই মনে পড়ছে। মা বারবার বলে দিয়েছিলেন যে,
“কেউ যেমন প্রশ্নই করুক না কেন সবসময় হেসে হেসে উত্তর দিবি। তাহলে দেখবি কেউ তোর প্রতি নারাজ হবেন না।”
মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই নিরুর পরিবারের কথা খুব করে মনে পড়ছে। রুমে থাকতে তো ফোন করাও হয়নি। মা-বাবা, ভাইয়া কেমন আছে কী করছে কে জানে।
হঠাৎ নিরুকে মন খারাপ করতে দেখে ফারিয়া ওর পাশে বসে বললো, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”
নিরু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ফারিয়া হালকা হেসে বললো, “বিয়ের প্রথম প্রথম আমারো এমন হতো। তবে এখন মানিয়ে নিয়েছি। মন খারাপ করো না। আজ দুপুরের পরেই তো ওবাড়িতে যাবে।”
বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে নিরুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
প্রতিবেশীরা চলে যেতেই ফারিয়া আবারো নিরুকে রুমে দিয়ে গেল। ফারহানকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করতে যেতে বললো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।
ফারহানকে ডাকতে নিরুর বেশ ইতস্তত লাগছে। কী বলে ডাকবে তাই বুঝতে পারছে না। তবুও আস্তে আস্তে ডাকলো, “এই যে শুনছেন? উঠবেন না? আপু ব্রেকফাস্ট করতে যেতে বলেছে।”
ফারহান একটু নড়েচড়ে আবারো ঘুমিয়ে গেল৷ নিরু এবার ওর এক হাত ঝাঁকিয়ে বললো, “শুনছেন?”
ফারহান এবার চোখ মেলে বললো, “এভাবে ডাকলে কী না শুনে থাকা যায়?”
নিরু এবার বেশ লজ্জা পেল। ফারহানের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে বললো, “উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। আপু ব্রেকফাস্ট করতে যেতে বলেছে।”
ফারহান উঠে বললো, “আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। মা-বাবার সাথে কথা বলেছো সকালে?”
“না। বসার ঘরে দেখিনি উনাদের।”
“আমি তোমার মা-বাবার কথা বলছি। উনাদের কথা মনে পড়েছে নিশ্চয়ই।”
নিরু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ফারহান ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “তুমি কথা বলে নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
নিরু বাবা-মার সাথে কথা বলা শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। ফারহান মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে বললো, “কথা বলা শেষ?”
“হুম।”
“মন খারাপ?”
“উঁহু।”
“তাহলে এমন আনমনা হয়ে আছো কেন?”
“এমনি।”
ফারহান তোয়ালে টা দড়িতে মেলে দিয়ে নিরুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “কিছু তো হয়েছে। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী। তাই আমার মতে কোনো সিক্রেট রাখা উচিত না। তবুও এমন কিছু কথা থাকে যা শুধু নিজের মাঝেই রাখতে হয়। অতি আপনজনকেও বলা যায় না। প্রতিটি মানুষেরই তো প্রাইভেসি আছে। এখন যদি মন খারাপের কারণটা তোমার একান্তই না বলার মতো কোনো কথা হয় তাহলে বলো না। যদি সেরকম না হয় তবে বলতে পারো। মন ভালো করা আমার সাধ্যের মধ্যেও থাকতে পারে।”
নিরু একটু মলিন হেসে বলতে শুরু করলো, “আসলে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাইলাম কিন্তু ভাইয়া আমার সাথে কথা বললো না। রাগ করেছে। ভাইয়া চেয়েছিল আমার বিয়ে যেন তার বন্ধুর বড় ভাইয়ের সাথে হয়। কিন্তু তার আগেই আপনাদের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ যাওয়ায় বাবা-মা তার কথা মেনে নেয়নি। তাই ভাইয়া আমাকে বলেছিল যাতে আমি বাবা-মাকে এই বিয়েতে না করে দেই। কিন্তু আমি বাবা-মার কথার অবাধ্য হইনি। তার বন্ধুর ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হইনি তাই ভাইয়া রাগ করেছে।”
নিরু একটু থেমে নিচুস্বরে বললো, “আসলে ভাইয়া ভেবেছে আমি আপনার সাথে সুখী হবো না কারণ আপনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রেহান ভাইয়া সরকারি চাকরি করে তাই ভেবেছে তার কাছেই আমি বেশি সুখে থাকবো।”
ফারহান একটা লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে তোমার বাবা-মায়েরও ওনার কাছেই বিয়ে দিতে চাওয়ার কথা। যেহেতু সরকারি চাকরি করে।”
নিরু একটু লজ্জিত হলো কিন্তু ফারহান তো ঠিকই বলেছে এখনকার মা-বাবারা সরকারি চাকরিওয়ালা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চান বেশি। নিরু একটু ইতস্তত করে বললো, “বাবা-মা আপনাকে পছন্দ করেছিল বেশি তাই তাদের না করে দিয়েছিল।”
ফারহান একটু শঙ্কিত স্বরে বললো, “তোমার বাবা-মা যদি তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যেত তাহলে কী তুমি তাকেই বিয়ে করে নিতে?”
নিরু না সূচক মাথা নাড়ালো।
ফারহান ভ্রু খানিকটা কুচকে বললো, “কেন?”
নিরু লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, “কারণ আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছিল বেশি। আর তাছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই রেহান ভাইকে পছন্দ নয় আমার। তার তেমন কোনো দোষ কিন্তু নেই। তবুও আপনার সাথে আমার বন্ধন জুড়ে আছে তাই হয়তো তার প্রতি কখনো আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি।”
নিরুর কথায় ফারহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে তো ভেবেছিলো নিরুর মনে তার জন্য কোনো অনুভূতিই নেই। কিন্তু এখন তবুও জানতে পারলো পছন্দ করে। এই অনেক। ভালোলাগা থেকে না-হয় আস্তে আস্তে ভালোবাসাও হয়ে যাবে। ফারহান একদিনেই বুঝে গেছে যে মেয়েটা সংকোচ বোধ করলেও সোজাসুজি কথা বলে। লুকিয়ে রাখতে পারে না।
ফারহানের মামাতো বোন নুপুর ওদের ডাকতে আসায় ওরা দুজনে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেল। কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।
খাওয়া শেষে শাশুড়ি মায়ের সাথে হালকা কথা বলে রুমে চলে এলো নিরু। মূলত ওনার নির্দেশেই আসা। এখন রেস্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে দুপুরের অনুষ্ঠানের সময় অসুবিধা না হয়। দুপুরেই বৌভাতের অনুষ্ঠান। নিরু কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পেরেছে ফারহানের মা মানে তার শাশুড়ি উপরে উপরে একটু কড়া হলেও মনটা বেশ ভালো। সবাইকে সহজেই আপন করে নিতে পারে না কিন্তু যাকে আপন করে নেয় তাকে ছাড়তে চায় না।
বিকালে ওবাড়িতে যেতে পারবে ভেবে ভালো লাগছে নিরুর। একদিনও হয়নি ওবাড়ি থেকে এসেছে তবুও মনে হচ্ছে কতযুগ হয়ে গেল মা-বাবাকে দেখা হয় না। ভাইয়াকেও বোঝাতে হবে। শুধু সরকারি চাকরি থাকলেই কেউ সুখী হয় না, মনের শান্তিও থাকতে হয়।
নিরু রুমে এসে রেস্ট করছে আর ফারহান গেছে ওর কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। একা একা বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না নিরুর। বাইরে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। ভাবীরা আবার কী না কী বলে ফেলে। উনারা সবাই ফারহানের মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী রা। ফারহান ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় বেশ ঝামেলাই হয়ে গেছে নিরুর। বড়রা শুধু লজ্জা দেয়।
নিরু বসে বসে এসব ভাবছে তখনি রুমে প্রবেশ করলো ফারিয়া। সে ফারহানের থেকে দু বছরের বড়। বছর পাঁচেক হলো বিয়ে হয়েছে। তবে এখনো কোনো সন্তান হয়নি। এ নিয়ে তার মন খারাপের শেষ নেই।
ফারিয়া নিরুর পাশে বসে বললো, “একা একা বোর লাগছে?”
নিরু হালকা হেসে বললো, “ওই একটু আরকি।”
ফারিয়া আলমারি থেকে একটা জামদানী শাড়ি আর গয়না বের করে বললো, “কালই এগুলো এখানে রেখে দিয়েছিলাম বৌভাতের জন্য। তোমার জামাকাপড় এখনো লাগেজ থেকে নামাওনি?”
“খেয়াল ছিল না।”
“ওহ, আমি আলমারিতে তুলে রাখছি।”
“না, আপু। আপনি কেন শুধুশুধু কষ্ট করতে যাবেন। আমি করে নেব।”
“তুমি বসো তো নিরু। আমি রেখে দিচ্ছি। এতে আবার কষ্ট কিসের? ফারহান কখন আসবে বলে গেছে?”
“দুপুরের আগেই চলে আসবে বললো।”
“দুপুর তো হয়েই এলো। কখন যে আসবে? বাবা যদি দেখে যে ও এখনো আসে নি তাহলে রাগ করবেন। মেহমানরা তো নামাযের পরেই চলে আসবেন।”
ফারহান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “এখনো অনেক দেরি আছে আপু। সবেমাত্র বারোটা বাজলো। তুমি শুধুশুধুই এত টেনশন করো।”
ফারিয়া গোছানো শেষে আলমারিটা বন্ধ করে বললো, “চলে এসেছিস এখন আর টেনশন করবো না। তোরা থাক আমি যাচ্ছি। তোর দুলাভাই ডাকছিলো।”
ফারিয়া যেতেই ফারহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। বড্ড গরম লাগছে। নিরু পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “নিন, পানি খান। একটু ভালো লাগবে।”
ফারহান উঠে বসে পানি খেয়ে গ্লাসটা নিরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এখন নিজেকে বিবাহিত বিবাহিত লাগছে৷ বাইরে থেকে আসতেই বউ পানি এগিয়ে দিল। এমন সৌভাগ্যই বা কয়জনের হয়।” বলেই মৃদু হাসলো।
নিরু লজ্জা পেল কিছুটা। পানির গ্লাসটা পুনরায় টেবিলের উপর রেখে বললো, “আপনি একটু বাইরে যান।”
ফারহান ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”
“আমি শাড়ি পড়বো। জামদানী শাড়ি তাই ওয়াশরুমে পড়তে অসুবিধা হবে।”
ফারহান দুষ্টু হেসে বললো, “আমি থাকলে কী অসুবিধা। তোমার বর ই তো।”
“লজ্জা লাগবে আমার। আপনি বাইরে যান।”
“আচ্ছা যাচ্ছি। কুচি ধরার প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবে কিন্তু। প্রয়োজন তো অবশ্যই হবে। তবুও যাতে সংকোচ না করো তাই বলে রাখলাম।”
ফারহানের কথায় নিরু অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
_____________________
বৌভাতের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হতে চললো। নিরুর বাবা আর ভাই এসেছে ওদের নিতে। সব মেহমানরা ধীরে ধীরে চলে যেতেই নিরু রুমে চলে এল। পড়নের শাড়িটা বেশ ভারী। এটা পড়ে আর থাকা যাবে না। তাই বাড়িতে যাওয়ার জন্য হালকার মধ্যে একটা শাড়ি পড়ে নিল।
ফারহান বাইরেই আছে৷ তার বাবার সাথে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। কথা বলা শেষে রুমে এসে নক করতেই নিরু দরজা খুলে দিল। নিরুকে দেখে কতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফারহান। নিরুর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো, “তোমাকে আকাশি রঙে কী সুন্দর লাগছে বউ! মাশা আল্লাহ।”
নিরু লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকালো। ফারহান কিছুটা ঝুঁকে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “তুমি এত লজ্জা পাও কেন নিরু?”
এতে নিরুর লজ্জা আরো বেড়ে গেল। কেমন যেন অনুভূতি হতে লাগলো।
নিরুকে আগের মতোই থাকতে দেখে ফারহান বললো, “তোমার নামের মধ্যে কী যেন একটা আছে। ডাকলে শুধু ডাকতেই ইচ্ছা করে। নিরু… মনে হয় নামের মাঝে কোনো সম্মোহনী জাদু আছে। নাম শুনলেও কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মনে হয়, মেয়েটা শুধু একান্তই আমার, শুধুই আমার। নিরু… অন্যরকম শান্তি লাগে।”
নিরুর ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো।
#চলবে__??