বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
২৫.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
আজ ঈদ। চারিদিকে যেন পবিত্রতার সুগন্ধ। নিকষ কালো রাতের মায়া ছাড়িয়ে, ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত দিনের শুরু। চাঁদ আড়মোড়া ভেঙে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। ঈদ নিয়ে ছোট থেকেই তার ভীষণ উত্তেজনা। যখন স্কুলে পড়তো, রমজান মাসের প্রতিটা দিন গুনে গুনে পাড় করতো। চাঁদ রাত তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। সারারাত জেগে মেহেদী পড়ে ভোর সকালে উঠতো। সাজগোছ করে সকলের থেকে সালামি তুলতো। ভাইদের কাছে যেয়ে কোমরে দুহাত রেখে বলতো, ‘ ঈদি কই? আমার ঈদি দেও’। ছোট বেলার কথা মনে করে আপন মনে হেসে ফেলল চাঁদ।সেই সময় চলে গেছে, সবকিছু এখন অতীত। সময়ের সাথে সাথে জীবন রঙ বদলায়। খুব কাছের মানুষ গুলোও পাল্টায়, মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, নিজ স্বার্থসিদ্ধি জন্য তাদের কুৎসিত রূপ বেরিয়ে আসে। সবকিছু অভিনয়, মিথ্যা মনে হয়। বুক চিড়ে নিশ্বাস ফেলল চাঁদ। ঘরের বাহিরে যেতেই রান্নাঘর থেকে খটখট শব্দ শুনতে পেল। সেদিকে উঁকি দিতে, শাশুড়ীকে সেমাই নাস্তার প্রস্তুতি নিতে দেখলো। মালা বেগমের সাথে চাঁদের চোখাচোখি হতেই, তিনি ঠোঁট মেলে বিস্তৃত হাসলো। বলল,
‘ এত সকাল সকাল উঠলি কেন? সারাবছর পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকিস। আরেকটু আরাম কর।’
রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকলো চাঁদ। সবকিছু রান্নাবান্না শেষ প্রায়, চুলায় পাস্তা সিদ্ধ হচ্ছে। সে হতাশ সুরে বলল,
‘ একাএকা এসবকিছু করতে গেলে কেন? আমাকে ঢাকতে এক সাথে সব করতাম।’
‘ আরাম করে ঘুমাচ্ছিলি তাই ডাকতে ইচ্ছে হয়নি।’
চাঁদ চোখজোড়া ছোট ছোট করে নিলো। আহ্লাদ ঢালা কণ্ঠে বলল,
‘ গত একমাস অনেক আরাম করেছি। বেশি আরাম করলে শরীরে জং লেগে যাবে। হলে যেয়ে থাকতে কষ্ট হবে। সকাল থেকে অনেক কাজ করেছ। এবার তুমি যাও আমি দেখছি এদব।’
মালা বেগম নাকচ করল। বলল,
‘ দুপুরে আরশিরা আসছে, বেশ কয়েক আইটেম রান্না।ঝামেলা অনেক। তুই এতসব পারবি না।’
চাঁদ মালা বেগমকে রান্নাঘর থেকে একপ্রকার ঠেলে বের করলো। আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল,
‘ ভরসা পাচ্ছো না? তোমার কাছ থেকেই সব শেখা। হাতেকলমে শিখিয়েছ। কি কি রান্না করতে হবে বলো! আমি সবকিছু সামলে নিবো।’
মালা বেগম হাপ ছাড়লো। অসার সুরে বলল,
‘ আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি রান্না ঘরে আসছি না। বাহিরে আছি কোনো কিছু প্রয়োজন পড়লে ডাকবি।’
ঠোঁট মেলে মিষ্টি হেসে মাথা নাড়াল চাঁদ।
আষাঢ় ঘুম থেকে উঠেছে। আটটার জামাত, সাড়ে সাতটা বাজছে। আরেকটু দেরি করলে মসজিদে জায়গা পাওয়া যাবে না। ঘর থেকে তড়িঘড়ি বের হবার সময় আচমকা একটা লেশ চোখে পড়লো। আষাঢ় এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। হল ঘরে গুনগুন শব্দ বাজছে, শব্দের অনুসরণ করে ভেতরে উঁকি দিলো, কয়েক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয় স্পন্দন থেমে গেল। শাড়ি পরিহিতা এক নীল অপ্সরী হাঁটছে। সদ্যস্নাত লন্বা কেশ রোদের ঝলকানিতে ঝিলমিল করছে। উজ্জ্বল মুখশ্রীতে উৎফুল্লতার রেশ। নরম হাত জোড়ায় কুশন কভার। শাড়িটা চিনতে আষাঢ়ের বিন্দুমাত্র সময় লাগল না। বারো রোজায় যখন বাড়ির সবার জন্য কেনাকা/টা করতে বেরিয়েছিল, চাঁদ নিবে না জেনেও, তার জন্য এই শাড়িটা পছন্দ করে এনেছিলো। বিনাবাক্য, বিনাপ্রত্যাশায় ছোট একটা চিরকুট লিখে মায়ের ঘরে বিছানার উপর রেখে এসেছিলো। চিরকুটে লিখেছিল,
‘ প্রত্যাশা বিহীন খোলা উপহার, যোগ্য মনে করলে গায়ে জড়িয়ে নিও একবার।’
চাঁদ শাড়িটি পরবে আষাঢ় কল্পনা করেনি। হ্ঠাৎ বুকের মাঝে পুরানো সেই স্মৃতি নতুন আবেশে অনুভব করলো। ওদের বিয়ের পর প্রথম ঈদটাও এমন ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে, চাঁদ আষাঢ়ে আনা শাড়িটি পরেছিল। ঠিক এতটাই মুগ্ধতা জড়িয়ে নিমগ্ন ভাবে আষাঢ় চাঁদের মুখপানে চেয়েছিল। সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেলের রেশ আজ অবধি কা/টেনি আষাঢ়ের। খুব মনে পড়ে সেই অভিমানী, অভিযোগকারী, অধিকার খাটানো ছোট্ট চাঁদকে। যদি সময়টাকে আবার পেছনে নিয়ে যাওয়া যেত! তাহলে আষাঢ়ের করা সব ভুল জাদুলাঠি দিয়ে মুছে ফেলত।চাঁদের সাথে সুন্দর মিষ্টিমধুর স্মৃতি তৈরি করতো। আফসোস পৃথিবীতে এমন কোনো জাদু নেই। আষাঢ় বুক ভরে নিশ্বাস টানলো নামাযের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
বেলা বারোটায় আরশিরা এলো। সাইফা মামনিকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি। আশেপাশের কোনোকিছুর তার খেয়াল নেই। আরশি বেশ আফসোস জুড়েই বলল, ‘ মাঝেমধ্যে মনে হয় এটা আমার না চাঁদের মেয়ে। ওর মতই জেদি অকপটে মেয়েটা।’
চাঁদ স্মিত হাসলো। দুপুরে সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া করলো। খাবার টেবিলে নানারকম সুস্বাদু ব্যঞ্জন দেখে সবাই চাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পুরো দিন সবাই এক সাথে হেসেখেলে পাড় করল। বিকালে সাইফা বায়না ধরল, তার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে, আর তা এখনি খেতে হবে। ভাগ্নীর মন রাখতে আষাঢ় সাইফাকে নিয়ে আইসক্রিম আনতে বের হলো।
তেজস্বী রোদ জেদ ছেড়ে মিয়িয়ে এসেছে সবে। চারিদিক অদ্ভুতরকম শান্তি। বিকেলের প্রথম প্রহর যেন! দুই ননদ ভাবি চায়ের কাপ হাতে বেশ আড্ডা দিচ্ছে। মালা বেগম খানিক পূর্বে বিশ্রাম নিতে গেছে। আচমকা ডোর বেল বাজলো। আষাঢ় এসেছে ভেবে দরজা খুলতে গেল চাঁদ। দরজা খুলে অপর প্রান্তে থাকা মানুষগুলোকে দেখে থমকে গেল চাঁদ। বিস্ময়ে চোখজোড়া বড়বড় হয়ে এলো। দরজার অপর পাশে মিথিলার আম্মা আর আইমান দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে তাদের চমৎকার হাসি। হাতে মিষ্টান্নের প্যাকেট। এখানকার ঠিকানা উনারা কোথায় পেল? আরশি আপার সাথে যোগাযোগ করে এসেছে কি? এসব ভাবনার মাঝেই, ‘কে এসেছে চাঁদ?’ বলতে বলতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো আরশি। আইমান, মিথিলার আম্মাকে চিনতে তার ভুল হলো না। যখন নতুন নতুন ওই বাড়িতে উঠেছিলো, ওদের দুইভাই বোনের সাথে অনেক আড্ডা দেওয়া হতো। কিন্তু এখানকার ঠিকানা কিভাবে জোগাড় করলো? চাঁদের কাছ থেকে কি! একবার ফোনে ওদের কথা বলেছিলো চাঁদ। ভেবেই চাঁদের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। চাঁদের চোখেমুখে অজান্তার আবরণ! যার অর্থ সেও জানে না। মিথিলার মায়ের ডাকে দুজনের ভাবনাচ্ছেদ ঘটলো।মিথিলার আম্মা মজার ছলেই বলল,
‘ কি ভাবি ভিতরে আসতে বলবে না?’
আরশি বিনীত হাসলো, দরজার সামনে থেকে সরে ভিতরে যেতে পথ দেখালো। চাঁদকে মালা বেগমকে ডেকে আনতে বলল। চাঁদের বিস্ময় তখনো কা/টেনি। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই মালা বেগমের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষ হলো। মিথিলার আম্মা বেশ ক্লান্ত সুরেই বলল,
‘ তোমাদের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে যা ভুগতে হয়েছে! শেষমেশ চাঁদের রুমমেড তটিনী থেকে ঠিকানা নিলাম। কত করে আইমানকে বললাম, যে চাঁদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নে একবার! কিন্তু না! শুনলোই না। বলল, এখানে এসে চাঁদকে সার্প্রাইজ দিবে।’
‘চাঁদকে সার্প্রাইজ দিবে’ শুনেই আরশির ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগল। কিছু জিজ্ঞেস করবে, অমনি মালা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আইমান সালাম জানালো। মালা বেগম এসে আরশির পাশে বসলো। আরশি পরিচয় করিয়ে দিলো। চাঁদ চা গরম করে সেমাই নাস্তা নিয়ে এলো। আইমান আড়চোখে চাঁদের দিকে একবার তাকালো। চাঁদের চাহনি স্পষ্ট। চোখাচোখি হতেই, ভদ্রতা সূচক মৃদু হাসলো। মিথিলার আম্মা চাঁদকে নিজের পাশে বসিয়ে বেশ জোর খাটিয়ে বলল,
‘ আন্টি আপনার বাড়িতে বিশেষ কারণে আসা। আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। সরল মনে সরাসরি বলি সব। আমার ভাই কয়েকদিন আগেই বিলেতের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে। বাবার বড় ব্যবসা আছে, তবুও নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর প্রস্তুতি চলছে। আত্মনির্ভরশীল ছেলে! ঘটনা হচ্ছে, চারবছর আগে আপনার ছোট মেয়েকে আরশি ভাবিদের বাড়িতে দেখেছে। সেই থেকে জেদ ধরে আছে বিয়ে করবে তো এই মেয়েকেই করবে। কত বড়বড় বাড়ির সুন্দরী মেয়েদের ছবি দেখালাম! কাউকে পছন্দ হয় না তার। জেদ ধরে বসে তার চাঁদকেই লাগবে।’
ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। মা মেয়ে দুজন দুজনের দিকে চোখাচোখি করছে। চাঁদ হতভম্ব! বিস্ময় ঘোর মাথা থেকে কাটছে না এখনো। তাহলে এই কারণেই কি তটিনী সকাল থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে সার্প্রাইজ সার্প্রাইজ বলে মাথা খারাপ করছিলো! চাঁদ ফোঁস করে উঠলো, কিছু বলতে যাবে অমনি ডোরবেল আবারও বেজে উঠলো। রাগ চেপে হনহন করে চাঁদ দরজার দিকে পা বাড়ালো।
মালা বেগম আড়ষ্ট মুখ করে মিনমিন করে বলল,
‘ চাঁদ আমার ছেলে আষাঢ়ের বউ।’
এবার অবাক হওয়ার পালা আইমানদের। হতভম্ব দৃষ্টিতে দুই ভাইবোন তাকিয়ে রইল। নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
চাঁদ দরজা খুলল। আষাঢ় সাইফা দাঁড়িয়ে আছে। সাইফা হাত মেলে চাঁদের দিকে ছুটে এলো, জড়িয়ে ধরে টেডি হেসে বলল,
‘ আমরা চলে এসেছি মামনি।’
চাঁদ উত্তর দিলো না। ভোতা মুখখানা নিয়ে আষাঢ়ের দিকে তাকালো। আষাঢ় টেডি হেসে চোখ টিপ দিলো। প্রতিত্তোরে চাঁদ রাগলো না। বেশ স্বাভাবিক! অথচ নিয়ম অনুযায়ী চাঁদের রেগে যাওয়াত কথা ছিল। সবসময় এমনই হয়!
চাঁদ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। আষাঢ় ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
‘ বাড়িতে কেউ এসেছে?’
চাঁদ উত্তর দিলো না। ভীতু দৃষ্টিতে আষাঢ়ের দিকে তাকালো। আষাঢ় তেমন তোয়াক্কা করল না। হল ঘরের দিকে উঁকি দিলো, অমনি আইমানকে দেখে থমকে গেল। আইমান আষাঢ়কে দেখে একই রকম বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে। পৃথিবী যে গোল তা এক মুহূর্তে প্রমাণ হলো। আষাঢ়ের ব্যাপারটা বুঝতে একটুও সময় লাগলো না। আইমান সেদিন এয়ারপোর্টে তার চাঁদের কথাই বলেছিলো!
কোনো কাঙ্ক্ষিত জিনিসের খুব কাছাকাছি যেয়ে, তা থেকে ফিরে আসা বেশ কষ্ট সাধ্য! চাঁদ বিবাহিত, তার চাঁদ আর আষাঢ়ের চাঁদ একজন! এতগুলো ব্যাপার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে মানতে হচ্ছে। এত গুলো ধাক্কা এক সাথে নিতে পারলো না। চাঁদকে সে কত জায়গায়, কত রকম করে হন্যহন্য করে খুঁজেছে। এখন যখন পেয়েছে এভাবে যেতে দিবে? না কখনোই পারবে না সে। আষাঢ় চাঁদের সম্পর্ক শেষ! আষাঢ় নিজে বলেছে চাঁদ তাকে ঘৃ/ণা করে। এই সম্পর্কে আশার আলো নেই কোনো। মৃ/ত!
আইমান খুব অল্প সময় বেশ বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এক প্রকার জোর খাটিয়েই বলল,
‘ চাঁদ বিবাহিত আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। আষাঢ় চাঁদের সম্পর্ক প্রায় শেষ। কোনোরকম ঝুলছে। এরচেয়ে বরং শেষ করে দেওয়াই ভালো। আমি চাঁদকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই!’
আইমানের এমন কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো আষাঢ়। রাগে তিড়বিড় করে উঠলো। ক্রোধের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো। ক্ষি/প্ত পায়ে এগিয়ে এলো। এক হাতে আইমানের কলার চেপে অন্যহাত মুঠিবন্ধ করে নিলো, মুখের উপর এলোপাতাড়ি দুইচারটা ঘু/ষি মা/রলো। রাগে চেঁচিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ চাঁদ আমার স্ত্রী। ও শুধু আমার চাঁদ, শুধুই আমার!’
চলবে…….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক করা হয়নি।
টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺