বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
২১.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
মিথিলাকে পড়িয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে যেই বের হবে। অমনি এক সুঠাম দেহি লোক সামনে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের চোখ জোড়া ছোট ছোট হয়ে এলো। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে সামনের মানুষটা বলল,
‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
চাঁদের কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। কঠোর স্বরে বলল,
‘ না, কে আপনি?’
আইমান নিরাশ হলো না। চাঁদের থেকে এমন কিছু শুনবে আশা ছিলো। নিজের থেকে পরিচয় দিতে লাগলো,
‘ ভুলে গেলেন? আপনার বোনের বাড়িতে ছাদের উপর দেখা হলো। আরে ওইযে রাজিব ভাইয়াদের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন, পড়ন্ত বিকালে আমাদের দেখা হলো, আপনি রাগ দেখিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলেন।’
চাঁদের বিরক্তি বাড়লো। খানিক চিন্তা করতেই, মনে পড়লো। ওইযে সেই আলাপী লোকটা! চাঁদ ভদ্রতা সূচক হাসলো। বলল,
‘ চিনেছি। কেমন আছেন?’
আইমান হাফ ছাড়লো।
‘ যাক, অবশেষে আপনার মনে পড়লো। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘ ভালো।’
‘ জানেন আপনাকে কত খুঁজেছি? কোথায় কোথায় আপনার খোঁজ করেছি! ভাগ্য ফেরে এভাবে দেখা হবে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি।’
চাঁদ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘ কেন খুঁজছিলেন? কোনো প্রয়োজন ছিলো কি?’
আইমান মৃদু হাসলো। বলল
‘ অনেক বেশি প্রয়োজন। আজ নয় ঠাণ্ডা মাথায় বলবো।’
চাঁদ আর কথা বাড়ালো না। ক্লাসের জন্য দেরি হচ্ছে তার। কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বলল,
‘ ক্লাস আছে যেতে হবে আমার। আসি।’
আইমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল চাঁদ।
আজ শুক্রবার। ক্লাস নেই, টিউশন নেই সকাল থেকে হলে আছে চাঁদ। সকাল সকাল রান্নাবান্না সেরে সারাদিন আজ আরাম করবে বলে ঠিক করেছে। সাপ্তাহ ঘুরে এই একটা আরামের দিন আসে। বৈশাখ মাসের হ্ঠাৎ ঝড়ে সারা দুনিয়া অন্ধকারে ডুবে। ভোর থেকে ধুপধাপ বৃষ্টি নামছে। এই থামছে আবার নামছে। বেগতিক আবহাওয়ার চাহিদা মাথায় রেখে নরম খিচুড়ি মুরগির ঝাল ঝোল রেঁধেছে। তটিনী আর বাকি রুমমেটকে দুপুরের রান্না করতে বারণ করেছে। তিনজন মিলে আজ এক সাথে খাবে। কতদিন এমন আয়োজন করে এক সাথে খাওয়া হয়না তাদের।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়েছে চাঁদ। যেই চোখ লেগেছে অমনি শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠে। তিতা মুখ নিয়ে উঠে বসলো। এই অসময়ে কার ফোন আবার? সবে চোখ লেগেছে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ফোনের স্কিনে আননোন নাম্বার দেখে মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে অচেনা পুরুষালী আওয়াজ শোনা গেল। কুরিয়ারের লোক। চাঁদের জন্য পার্সেল এসেছে। কোথা থেকে কি এসেছে বুঝতে বাকি রইল না। গতকাল আষাঢ়ের অফিসের ঠিকানায় ব্যাগটা ফেরত পাঠিয়েছিল। নিশ্চয়ই আষাঢ় ব্যাগটা আবার পাঠিয়েছে। চোখ বুজে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল চাঁদ। ফোনের অপর পাশের লোকটাকে বলল,
‘ আপনি প্রান্তিকে থাকেন, আমি আসছি।’
অলস ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো। খোলা অবিন্যস্ত কেশ খোপা করে কাঠি ঢুকিয়ে নিলো। হলের স্যান্ডেল পরেই বেরিয়ে গেল। প্রান্তিক গেইটের সামনে লোকটা থেকে পার্সেল রিসিভ করল। উপরে আষাঢ়ের অফিসের ঠিকানা। তার ধারণা ষোলআনা মিলে গেল।
প্যাকেট খুলতে হতভম্ব চাঁদ। শুধুমাত্র পাঠানো ব্যাগ ফিরত আসেনি। সাথে ডার্ক রেড কারচুপি কারুকাজ করা আড়ং এর জামদানী। আর ছোট একটা কাঠের বাক্স। চাঁদ বাক্স খুলল। বাক্সের ভেতর অথেন্টিক, ট্রেডিশনাল ভাইবের, নিদারুণ একজোড়া ম্যাচিং কানের দুল। এন্টিকের ময়ূর ঝুমকা। ময়ূরের গায়ে নিখুঁত নকশা করা। শরীর আর পাখার মাঝামাঝিতে প্রদীপের মত রাণী গোলাপি সুন্দর একটা পাথর বসানো। আষাঢ়ের রুচি ভীষণ উন্নত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব নিয়ে রুমে যাওয়া যাবে না। তটিনীরা দেখলে, নানারকম প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করবে। এখানে এসে প্রথম দিকে আষাঢ়ের সাথে তার কোনোরকম যোগাযোগ ছিল না। না আষাঢ় নিজ থেকে যোগাযোগ করেছে। ভেবেছিল হয়তো সম্পর্কটা এভাবে এভাবেই ইতি টানবে। তাই কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। নাহয় পরবর্তীতে শখানেক প্রশ্ন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে। এতবছরে ওরা কেউ আষাঢ়ের কথা জানে না। হুট করে জানালে ভালো ভাবে নিবে না। আর মাত্র কয়েকটা মাস তারপরই তো ক্যাম্পাস ছাড়বে। অজানা জিনিস নাহয় অজানাই থাক।
কাঠের বাক্সটা ধপ করে বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। মোবাইল নিয়ে আষাঢ়ের নাম্বারে ফোন করল। একবার বাজতেই রিসিভ হলো। যেন চাঁদের ফোনের অপেক্ষা ছিলো। অপর পাশ হতে আষাঢ়ের আমোদ ঢালা কণ্ঠ শোনা গেল,
‘ হ্যালো, আমার অমূল্য চাঁদ। কেমন আছো? গিফট পেয়েছ?’
চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করল চাঁদ। বলল,
‘ সমস্যা কি আপনার? আমাকে না জ্বা/লিয়ে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না?’
আষাঢ়ের অসার আওয়াজ,
‘ হজম হওয়া দূর। আমি তো মুখে ভাতই তুলতে পারছি না।’
হতাশ শ্বাস ফেলল চাঁদ। মানুষটি কথা ঘুরানো নিদারুণ কৌশল জানে। সেদিকে কান দিলো না। চাঁদ কথার তাল ঠিক রেখে অকপটে বলল,
‘ কেন বারবার এসব পাঠাচ্ছেন? আপনার দেওয়া কিছু চাইনা আমার।’
আষাঢ়ের কঠিন আওয়াজ শোনা গেল। বোধহয় খানিকটা রেগেই বলল,
‘ তুমি চাও আর না চাও, এসব কিছু তোমার প্রাপ্য। আমার কর্তব্য সেসব তোমার কাছে পৌঁছানো। এতবছর আমার দেওয়া সব ফিরিয়ে দিয়েছ আমি মেনে নিয়েছি। এবার থেকে যা ফেরত পাঠাবে ঘুরে তার দ্বিগুণ তোমার কাছে যাবে।’
নিরাশ শ্বাস ফেলল চাঁদ। চোখ বুজে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। আষাঢ়কে বুঝানোর স্বরে বলল,
‘ আমি হলে থাকি। আট দশজন মেয়ের সাথে আমার চলা ফেরা। আপনার পাঠানো এক্সপেন্সিভ গিফট চোখে বাঁধবে সবার। নানারকম কথা ছড়াবে। এসব স্ক্যান্ডাল আমি চাইছি না। আমার সাদামাটা জীবনে একটুখানি শান্তির প্রয়োজন। এই সহজ বিষয়টা আপনি কেন বুঝতে চান না আষাঢ়?’
আষাঢ় চুপ রইল। চাঁদ আবার বলল,
‘ এখান থেকে অনেকখানি যেয়ে আমার পার্সেল পাঠাতে হয়। আমি শেষবারের মত পাঠিয়ে দিচ্ছি।এবার আর ফেরত পাঠাবেন না প্লিজ।’
আষাঢ় কিছু একটা ভেবে বলল,
‘কুরিয়ার করতে হবে না। আমি আসছি, তবে একটা শর্ত আছে। রোমান্টিক ওয়েদার তোমাকে খুব মনে পড়ছে। আমার সাথে এককাপ চা খেতে যেতে হবে। কি রাজি?’
চাঁদ তড়বড় করে উঠল। অকপটে বলল,
‘ আমি যাবো না।’
আষাঢ়ের গা হেলানো ছন্নছাড়া আওয়াজ,
‘ ঠিক আছে, এজ ইউর উইশ। পার্সেল আদান-প্রদান এমনি নিরন্তর চলুক।’
রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে চাঁদের। রাগ দমিয়ে কিড়মিড় করে বলল,
‘ আচ্ছা, আমি রাজি।’
অপর প্রান্ত হতে আষাঢ়ের উচ্ছাসীত আওয়াজ শোনা গেল,
‘ দ্যাটস মাই গার্ল। আমি আসছি, ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষা করো।’
চাঁদ ফোন কে/টে পাশের ছাউনিতে গিয়ে বসলো। রুমে যাবে না। আষাঢ় আসলে কোনোরকম ছলচাতুরী দিয়ে তার গাড়িতে ব্যাগ রেখে পালাবে। কিভাবে কি করবে এখানে বসেবসে মাথায় ছক টানছে।
বর্ষণের দিন। জ্যামজট মুক্ত ভেজা শহর। ঠিক একঘন্টা আটাশ মিনিটের মাথায় আষাঢ় প্রান্তিক গেইটে এসে পৌঁছালো। চাঁদের মোবাইলে ফোন করল। চাঁদ ধরলো না কে/টে দিলো। ছাতা হাতে ছাউনি থেকে গুটিসুটি পায়ে বেরিয়ে এলো। ধীরেধীরে আষাঢ়ের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। কোনো রকম কথাবার্তা বিহীন ব্যাগটা আষাঢ়ের কোলে ফেলে একপ্রকার দৌড়ে পালাতে চাইলো। কয়েক সেকেন্ডে জন্য আষাঢ় থমকে গেল। হুঁশ ফিরতে চেঁচিয়ে উঠলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
‘ এমন কিছু কথা ছিলো না!’
চাঁদ থামলো। পেছন ফিরে আষাঢ়ের দিক এগিয়ে এলো। ছাতা মাথায় আলতো ঝুঁকে বলল,
‘ প্রমাণ আছে কোনো? ‘
আষাঢ় ক্ষেপে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘ চাঁদ ভদ্রভাবে গাড়িতে উঠো। নয়তো…
‘ নয়তো কি? কি করবেন শুনি? এটা আমার ক্যাম্পাস। আমার এক চিৎকারে কি হতে পারে জানেন তো?’
ঠোঁট মেলে হাসলো আষাঢ়।বলল,
‘ জানি তোমার ক্যাম্পাস। তুমি আমাকে এখনো ভালো করে চিনো না চাঁদ। আমি ক্ষেপে গেলে কি করতে পারি ধারণা করতে পারবে না তুমি। এক্ষুণি তোমার হলের সামনে যেয়ে বড় একটা সাইনবোর্ডে ‘ মেহজাবিন চাঁদ, আমার বউ আমাকে পাত্তা দেয় না’ লিখে দাঁড়িয়ে থাকবো। বিয়ের কথা ফাঁস করবো।’
চাঁদের চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। এটা কি রকম ব্লা/কমেইল! লোকটার মাথার কি দুইএকটা তার ছিঁড়ল!
আষাঢ় আবার বলল,
‘ আমি জানি তো তোমার আসল ভয় কোথায়! ক্যাম্পাসে সিনক্রিয়েট চাইছ?’
অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদ। মুখ ফুলিয়ে গাড়ির পেছন সিটে উঠে বসলো। পেছনে ফিরে আষাঢ় কপাল কুঁচকে তাকাতে, চাঁদ ঠোঁট ছড়িয়ে কৃত্রিম হেসে উত্তর দিলো,
‘ যাওয়ার কথা হয়েছিলো, পাশের সিটে বসবো এমন কিছু বলিনি।’
মুখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকালো চাঁদ। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা। আষাঢ় হাসলো। মেয়েটির রাগ, জেদ, এটিটিউড মারাত্মকরকম সুন্দর।
গাড়ি পল্লী বিদ্যুৎ ওভারব্রিজ ছাড়িয়ে ভেতরের রাস্তায় ঢুকল। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো চাঁদ,
‘ কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ ভয় নেই, তোমায় খেয়ে ফেলবো না।’
আষাঢ়ের ত্যাড়া কথায় কথা বাড়ালো না আর। গাড়ি নলাম ব্রিজ মাড়িয়ে। গ্রাম্য রাস্তার পথ ধরে নদীর তীরে যেয়ে থামলো। ততক্ষণে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। ছোট ছোট চোখ মেলে চারিদিকে তাকালো চাঁদ। ক্লান্তিহীন বৃষ্টিকারণে আশেপাশের দেখা মিলছে না কিছু। চারিপাশ ঘোলাটে হয়ে আছে। বিকালের শেষ প্রহর! অথচ গভীর রাতের রুপ নিয়েছে। চাঁদের ভাবনার জোয়ারে আচমকা ফোঁড়ন পড়লো। যখন নিজের কোলে আষাঢ়ের মুখখানা দেখলো। বিস্মিত চোখজোড়া আরো বড়বড় হতে এলো। ঘটনা বুঝতে খানিক সময় লাগলো। তারপর আচমকা তিড়বিড়িয়ে উঠলো। চিৎকার করে বলল,
‘ আমার কোলে কি করছেন আপনি?’
আষাঢ়ের সোজাসাপটা জবাব,
‘ বউয়ের কোলে শুয়ে আছি।’
‘ সরুন, এক্ষুণি সরুন।’
চাঁদ আষাঢ়কে সরাতে চাইলো আষাঢ় সরলো না। আরো পাকাপোক্ত ভাবে শুয়ে, চাঁদের গলায় ঝোলানো স্কার্ফ দিয়ে মাথা মুছে নিলো। চাঁদের দুর্বল শরীর, চিকন ঠ্যাংয়ের উপর হতে কোনোভাবেই শক্তপোক্ত শক্তিশালী আষাঢ়কে সরাতে পারলো না। অনেক চেষ্টার পর ক্লান্ত হয় হাল ছাড়লো চাঁদ। গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ এসব করতে এখানে এনেছেন?’
‘ কোয়ালিটি টাইম কা/টাতে এনেছি। শুনেছি বৃষ্টির দিনে এখানকার নদী ভীষণ সুন্দর দেখতে।’
চাঁদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ মিথ্যুক!’
আষাঢ় আবারও হাসলো। নিগূঢ়, নিমজ্জিত দৃষ্টিতে চাঁদের মুখপানে চেয়ে রইল। হরিণটানা ঘন ঘন আঁখিপল্লব, চন্দ্রসুধার সবটা আলো যেন এই মুখটায় মাখা, দুধের আলতা গায়ের রঙ, চিকন সুন্দর ঠোঁট, গালে, নাকের মাথায় খানিক লালচে ভাব। অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটি। আগুন সুন্দরী! যদি রূপের আগুনে কাউকে ভস্ম করা যেত, এতক্ষণে আষাঢ় নির্ঘাত জ্বলসে যেত। দিনদিন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়েটির সৌন্দর্য বাড়ছে। আষাঢ়ের তৃষ্ণা, প্রতিক্ষার কঠোরতা বাড়ছে। হাত বাড়ালো আষাঢ়, চাঁদের উজ্জ্বল গতরে কালোজামা বড্ড মানিয়েছে। গলার কাছে ভেসে থাকা কলার বোন আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। চাঁদের গাঁ আচমকা শিরশির করে উঠলো। অদ্ভুত এক আবেশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো। চোখজোড়া অনবরত কাঁপছে, অস্থিরতা বাড়ছে।
চাঁদের পেটের দিকে ফিরে মুখ গুজে দিলো আষাঢ় । চোখবুজে গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা শুষে নিতে শুরু করল। আচমকা পেটের দিকে কামিজে ফাঁকে আষাঢ়ের উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করল চাঁদ । ধীরেধীরে সেই স্পর্শ গভীর হচ্ছে আরো। চাঁদ চোখ বুজে ভারী নিশ্বাস ফেলল। বুকের ধুকপুক বাড়ছে তার। আষাঢ়কে থামাতে চাইলো। আষাঢ়ের চোখজোড়া ঘোর লাগানো, শুনলো না সে। চাঁদের অস্থিরতায় নিজের হুঁশ হারালো। আরো ক্ষি/প্ত হয়ে পড়লো। উন্মদনা বাড়লো। তড়াক করে সে উঠে বসলো। তড়িৎ গতিতে চাঁদের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিলো। আষাঢ়ের বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চাঁদ আটকাতে চাইলো। আষাঢ় দমলো না। বাঁধা কাটিয়ে, গতি বাড়িয়ে দিলো আরো। ব্যস্ত হাতে চাঁদের খোপার কাঠি খুলে ছুঁড়ে ফেলল কোথাও। মেঘবরণ লম্বা কেশ সুড়সুড় করে আষাঢ়ের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লো। গাড়িতে বেলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণটা ঘুরঘুর করতে লাগলো। আষাঢ়ের পাগলামো, হাজার বছরের তৃষ্ণার মত গভীর হলো। চাঁদের খোলা কেশে মুখ ডুবালো। অবাধ্য হাত জোড়া তার গালে গলায় ছুঁয়ে দিয়ে আলতো করে আদুরে ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দিতে লাগলো। চাঁদের চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত, নিশ্বাসের অস্থিরতা প্রখর তখন। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। অগোছালো বিড়বিড় সুরে বলল,
‘ আপনার কাছে শরীরী ছোঁয়াই ভালোবাসার নাম?’
আষাঢ় ঠোঁট মেলে হাসলো। গালে আলতো চুমু দিয়ে, চোখবুজে আবারও চাঁদের চুলের ভেতর মুখ ডুবালো, ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল,
‘ তোমার দেওয়া কোনো অপবাদ আজ আমাকে আদর করা থেকে আটকাতে পারবে না চাঁদ। ‘
কথা শেষ করে আবারও চাঁদের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিলো। বাহিরে ঘন বর্ষণ, ভেতরে উষ্ণ ছোঁয়ার উত্তাপ। ধীরেধীরে চাঁদের জেদ পড়ে গেল। হার মেনে নিস্তেজ হয়ে রইল। আষাঢ় একটু বাদে দূরে সরে এলো। চোখ বুজে চাঁদের কপালে কপাল মিলিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলল,
‘ আমার অমূল্য চাঁদ।’
খানিকক্ষণ এভাবেই কা/টলো। বৃষ্টির ঝোপ কমে এসেছে। জানালার কাচে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিকনা ছুঁয়ে আছে। আষাঢ় চাঁদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে, তার নিগূঢ় চোখজোড়া চাঁদের মুখপানে। হাতের পিঠে থেমে থেমে চুমু দিচ্ছে। চাঁদের চোখে অভিমান, ক্রাধ। তা ধরতে পেরে আষাঢ় বলল,
‘ তুমি আমার দিকে তাকাও না কেন! জানো চাঁদ? কারণ তুমি জানো! আজও আমাকে ভালোবাসো। মুখ মিথ্যা বললেও, দৃষ্টিতে সত্যিটা স্পষ্ট।’
চাঁদ হাত ছাড়াতে চাইলো, আষাঢ় ছাড়লো না। মুঠোবন্দি করে কয়েকবার চুমু খেলো।
দিনের গুমোট আলোটা মিলিয়ে এসেছে। অন্ধকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এবার চাঁদ জেদ করলেও, শুনেনি আষাঢ়। পাশে বসালো। মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে চাঁদ। যত পথ এগোচ্ছে, চাঁদের কুঁচকানো কপালটা মিলিয়ে আসছে। অন্ধকার ঢাকা সন্ধ্যা ছেয়ে আছে চারিপাশে। জানালা মাড়িয়ে বৃষ্টির পর হিমশীতল স্নিগ্ধ হাওয়া চাঁদের চোখেমুখে লাগছে। মুক্ত, বিস্তৃত অবাধ্য কেশ এসে চোখেমুখে পড়ছে। চাঁদ আটকাচ্ছে না চোখবুজে প্রাণবন্ত হয়ে অনুভব করছে।
জাহাঙ্গীরনগরের খানিকটা দূর গাড়ি থামলো। চাঁদ কপাল কুঁচকে আষাঢ়ের মুখপানে চাইলো। গাড়ির বাতি নেভানো। সামনের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আষাঢ়ের মুখটা স্পষ্ট। আষাঢ় পেছন থেকে ব্যাগটা এনে কানের দুলের বাক্সটা বের করলো। চাঁদের দিক বাড়িয়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার সব কথা মানলাম, এই ঝুমকা জোড়া তোমার কাছে রাখার আবদার রাখলাম। যখন এতে নজর পড়লো! মন বলল, শুধু তোমার জন্যই বানানো।’
চাঁদ বিবস চেয়ে। আষাঢ়ের গভীর চোখে বিমূঢ় ডুবে। চাঁদের উত্তরের অপেক্ষা করলো না আষাঢ়। বাক্স খুলে ঝুমকা জোড়া বের করে নিজের হাতে পড়িয়ে দিলো। চাঁদ তখনো স্তব্দ, অচেতন ডুবে।
প্রান্তিক গেইটের সামনে আষাঢ় গাড়ি রাখলো, যেই চাঁদ নামতে যাবে হাত থামিয়ে নিজের দিকে টানলো। চাঁদের কপাগভীর করে চুমু এঁকে, গালে আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসো। আমি, আমাদের ছন্নছাড়া সংসার অপেক্ষা করছি তোমার।’
উত্তরে কিছু বলল না চাঁদ। খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। গাড়ি থেকে নেমে গেল। চাঁদের যাওয়ার দিকে আষাঢ় অপলক চেয়ে রইল। চাঁদ পেছন ফিরে তাকালো না। ধীরেধীরে অন্ধকারের গভীরে মিলিয়ে গেল। হ্ঠাৎ মনে হলো, নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করে চাঁদ যেন পেছনে ফিরে চাইলো।
বাড়িতে এসে আষাঢ় শাড়ির প্যাকেটটা চাঁদের জন্য রাখা সেপারেট আলমারিতে তুলে রাখলো। আলমারির ভেতর এমন ফেরত আসা আরো অনেক প্যাকেটে পূর্ণ। ছুটিতে দুইতিনের জন্য এসে চাঁদ সবসময় মায়ের ঘরে থাকে। কোনো দিন এই ঘরে পা রাখেনি। না কখনো অধিকার খাটিয়েছে। তাতে কি! আষাঢ় ঘরের প্রত্যেক দেয়ালে চাঁদের স্মৃতি জড়িয়ে রেখেছে। হোক অগোচরে, এই ঘরের সবকিছুতে চাঁদের মায়াতে মুখরিত যে।
চলবে……