বামনের ঘরে চাঁদ পর্ব ১৪

0
616

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

১৪.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতে চাঁদের মনে অদ্ভুত অনুভূতি হলো। শৈশবের স্মৃতিরা তিড়বিড়িয়ে চোখের সামনে এসে হানা দিলো। কিছু স্মৃতি প্রীতিকর, কিছু ভীষণ অপ্রীতিকর। চাঁদের বাড়ি আসা নিয়ে কারো কোনো রাগ নেই। সবকিছু কেমন জানো অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক।
আচমকা পৃথা এসে চাঁদকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। দৃষ্টিতে মমতাবোধ স্পষ্ট ভেসে। ভেজা কন্ঠে অভিযোগ মিশিয়ে বলল,
‘ অবশেষে তোর মান ভাঙলো। কেমন আছিস বোন?’
মলিন হাসলো চাঁদ বলল,
‘ ভালো ভাবি।’
একবার ভেতরের দিক চোখ বুলালো। এই কয়েক মাসে বাড়িতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বসার ঘরে পুরো পরিবারের একটা বড় ছবি ছিলো। ছবিতে চাঁদও ছিল, কিন্তু সেই ছবিটা নেই। বসার ঘরে চাঁদের পছন্দ মত আর্টিফিশিয়াল জিনিসে সাজিয়েছিল। সেসব নেই। একুরিয়ামের মাছ গুলো অযত্নে কমে এসেছে। দূর থেকেই তা বুঝা যাচ্ছে। নিজের চিরপরিচিত বাড়িটা আজ ভীষণ অচেনা লাগছে। চারিদিকে সব নতুন নতুন জিনিসে সাজানো। সবকিছুর চকচকে ঝকঝকে রঙ।সাজসজ্জা দেখে বোঝা যাচ্ছে ফুপুর পছন্দ অনুযায়ী সব। তিনি সাজিয়েছেন নিশ্চয়ই।
ফুপুকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে দেখলো। সবসময় চাঁদকে দেখে কপাল কুঁচকানো মানুষটা, অদ্ভুত ভাবে আজ খুশি হয়ে গেল। চাঁদের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ বোকা মেয়ে! কাউকে কিছু না বলে এভাবে বাড়ি ছেড়ে যায় কেউ? আমাকে আষাঢ়ের কথা আগে বললে, তোর বাবাকে বুঝিয়ে ঠিক রাজি করিয়ে নিলাম।’
চাঁদ হতভম্ব। তার বিস্ময় কা/টেনি তখনো। কি আশ্চর্য! ভাবির আলিঙ্গনে কথাবার্তায় কতটা মায়া জড়ানো ছিল। কিন্তু ফুপুর আহ্লাদটা শুধুমাত্র দেখানো। অনুভূতি হলো না কোনো। অথচ কোথায় যেন শুনেছিল রক্তের সম্পর্কের জোর বেশ জোড়ালো হয়। আদৌ কি কথাটা পূর্ণ সত্য।
নিমিষ দৃষ্টিতে ফুপুর মুখপানে চাইলো একবার। ফুপুর ঠোঁটের হাসি কেমন জানো কৃত্রিমতায় মাখানো। দেখানো মমতাবোধটাও বানোয়াট, ঠুনকো। খানিক পূর্বে ভাবির জড়িয়ে ধরা আর ফুপুর জড়িয়ে ধরার মাঝে পার্থক্যটা খুব সহজেই বুঝলো। ভাবির আলিঙ্গনে ছিল মমতাবোধ, ভালোবাসা। যা ফুপুর মাঝে ছিঁটেফোঁটা খুঁজে পেলনা।

ভেতরে প্রবেশ করতেই বাবার মুখোমুখি হলো। চাঁদের বাড়িতে ফিরে আসায় উনার কোন অনুভূতি নেই। না রাগ, না জেদ বা অন্যকোনো অনুভূতি। যেন খুব দায়বদ্ধতায় পড়ে চাঁদকে বাড়িতে আনা। তিনি বেশ মনযোগ দিয়ে সকালে আসা নিউজপেপারটায় চোখ বোলাচ্ছেন। চাঁদের মুখপানে একপলক চেয়ে বললেন,
‘ আসছ! বিকালে পীরের বাড়ি থেকে কিছু গেস্ট আসবে উনাদের সাথে দেখা করিও।’
বাবার আচরণ আর কথাবার্তায় হতভম্ব চাঁদ। এত মাস পরে দুজন মুখোমুখি হয়েছে রাগ ঝাড়তে পারতো বা ভালোমন্দ কিছু বলতো। চাঁদ স্বাভাবিক ভাবে সবটা মেনে নিতো। তার দাম্ভিক বাবার আত্মসম্মানে টান পড়েছে সেখানে তিনি এত স্বাভাবিক। ব্যাপারটা চাঁদের হজম হচ্ছেনা। পীরের বাড়ির মানুষের কথা শুনেই চাঁদের ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো। বাবার পীরকে চাঁদের বিন্দুমাত্র পছন্দ না। পুরো বাড়ির লোক তার বাবা, ফুপু, ভাইয়েরা তার মুরিদ হলেও, চাঁদ সহ্য করতে পারেনা ওই লোকটাকে। শিকদার সাহেব স্ত্রীর মৃ/ত্যুর জন্য চাঁদকে মানলেও, চাঁদের মায়ের মৃ/ত্যুর জন্য এই ভণ্ড লোকটা দায়ী।
কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস স্লো পয়/জনের মত। যা ধীরেধীরে মানুষের মন, মস্তিষ্ক, বিবেক সবটা দখল করে নেয়। ভুল, অন্যায়, পাপ এসব তখন চোখে পড়ে না, খুব সহজেই লিপ্ত হয়ে যায়। শিকদার সাহেব আর রুকাইয়া বেগমের শেষ বয়সের সন্তান চাঁদ। দুই ছেলের পর কন্যা সন্তানের আশায় হন্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ডাক্তার কবিরাজের বাড়ি ঘুরাঘুরি শুরু করে। কমলাপুরের পীরের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। পীরের প্রতি তার ভক্তি, বিশ্বাস ছিল অগাধ। যখন রুকাইয়া বেগম সন্তান সম্ভবা হলো। তখন শিকদার সাহেবের পীরের বাড়ির আনাগোনা বাড়লো। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসে জড়িয়ে পড়লো। একমাত্র পীর-ই তাকে কন্যা সন্তান দিতে পারবে মনে গেঁথে নিলো। তার কথামতো চলতে শুরু করল। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ঔষধির নাম করে বিভিন্ন অদ্ভুত গাছপালা, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি রুকাইয়া বেগমকে খেতে দিতো। প্রথমে নাকচ করলেও স্বামী’র পিড়াপীড়িতে খেতে শুরু করল। শিকদার সাহেব কুসংস্কারে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিলো যে, প্রিয় স্ত্রী’র অসুবিধা, অসুস্থতা তার চোখে পড়তো না। ডাক্তারের হাজার বারণ নি/ষেধাজ্ঞার পরও রুকাইয়া বেগমকে খেতে বাধ্য করতো। মানসিক চাপ, শারীরিক অস্বচ্ছন্দতায় ধীরে ধীরে রুকাইয়া বেগমের নাজুক হয়ে পড়লো। চাঁদের ডেলিভারির সময় মা/রা গেল। এখানেই থেমে থাকেনি। নিজেকে ঢাকতে রুকাইয়া বেগমের মৃ/ত্যুর পর, দুইদিনের শিশু চাঁদকে অলক্ষ্মী, দুর্ভাগিনী কারণ হিসাবে দায়ী করে। এসব ভণ্ড মানুষের অদ্ভুত এক গুণ থাকে, প্র/তারণা ব্রেনওয়াশ যেন তাদের রক্তের সাথে মিশে। ভীষণ নিখুঁতভাবে এই কাজ পারে। শিকদার সাহেব পীরের কথা মত সদ্য মা হারা শিশু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অলক্ষ্মী, অশুভ প্রতীক হিসেবে মানতে শুরু করে। যেই কন্যা সন্তান পাওয়ার জন্য এত কিছু। সেই কন্যাকেই দূরে ঠেলে দেয়। ব্যাপারটা চাঁদের নানি বাড়ির লোকেদের কানে গেলে, তারা চাঁদকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু দাম্ভিক, অহংকারী শিকদার সাহেবের দৃঢ় নাকচ। মেয়েকে দিবেন না। এই অশুভ, অলক্ষ্মী মেয়েকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। লোকে হাসিঠাট্টা করবে, তা শুনতে নারাজ সে। এই নিয়ে চাঁদের নানি বাড়ির লোকেদের সাথে বেশ ঝামেলা হয়। সেই থেকেই শ্বশুর বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এসবকিছু খালা থেকে শুনেছে চাঁদ।
অ/ত্যাচার শুধু শারীরিক আঘা/ত নয়, মানসিক আঘা/ত ও হয়। ছোট থেকে অবহেলা, একাকীত্বে বেড়ে উঠা চাঁদের। আপন জনের দেওয়া আঘা/ত, অবহেলা গুলো তাকে এতটা বুঝদার, সাহসী বানিয়েছে।

বাবার কথার পিঠে কোন উত্তর দিলো না। নিজের ঘরে চলে গেল। চারিদিকে চোখ বুলাতে যেয়ে হ্ঠাৎ বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। শৈশব, কৈশোর পুরোটা সময় এই ঘরে কে/টেছে চাঁদের। এই ঘরের দেয়ালে চাপা পড়ে আছে হাজারো স্মৃতি, ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ। বুক চিড়ে নিশ্বাস ফেলল চাঁদ। আষাঢ়কে ফোন করবে বলে, মোবাইলটা হাতে নিলো। হ্ঠাৎ চাপা অভিমানে বুকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। ফোন দিলোনা আর। মোবাইল টেবিলের উপর রেখে দিলো। অমনি হালকা নাস্তা নিয়ে পৃথা ঘরে ঢুকলো। অনেক দিন চাঁদের সাথে কথা হয়না তার। বহু কথা জমে। ননদ ভাবি গল্পে মজে গেল।
বিকালে পীরের বাড়ি হতে কালো বোরকা পরিহিতা কয়েকজন মহিলা এলো। ফুপু ঘরে এসে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে উনাদের সামনে চাঁদকে নিয়ে গেল। মহিলারা নিজেদের ভেতর কিছু ফিসফাস করছে। সবাই চাঁদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ব্যাপারটা চাঁদের বেশ খটকা লাগলো। গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে চাইলো, ভদ্রতার খাতিরে পারল না। ফুপুর কথা মত কাঠের পুতুলের মত বসে রইল।
খুব অদ্ভুত ভাবে সেদিন রাতে চাঁদের ঘর থেকে তার ফোন চুরি হলো। চারিদিকে ভীষণ খোঁজখবর তল্লাশি করল। কোথাও খুঁজে পেল না। দুইতিন দিন কা/টলো, বাড়িতে সবাই ভীষণ স্বাভাবিক। চাঁদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে কারো কোন রাগ জেদ অভিযোগ দেখলো না। সবকিছু ভীষণ স্বাভাবিক। যেন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে চাঁদ।
চাঁদের মোবাইল চুরি হবার পর ভাবির মোবাইল থেকে শাশুড়ীর সাথে দুদিন কথা হয়েছে। মালা বেগমের মন কু ডাকছে।তিনি এখানে এসে কথাবার্তা বলে, তাড়াতাড়ি চাঁদকে ঘরে তুলতে চাইছেন। কিন্তু শিকদার সাহেব নানারকম তালবাহানা দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছে। আজ নয় কাল, সময় নেই, ব্যস্ত বলে দিন পেছাচ্ছে।
চারপাশে কি ঘটছে বুঝে উঠতে পারলো না চাঁদ। বাড়ির প্রত্যেকের আচার-আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত, রহস্যজনক। চাঁদের আড়ালে কিছু একটা চলছে, যা ধরতে পারছে না সে।

আজ জুম্মার দিন। সকাল থেকে বাড়িতে রান্নাবান্নার এলাহি আয়োজন চলছে। ফুপুর মুখে শুনেছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোকজন আসবে। কে বা কারা আসবে এখনো জানে না চাঁদ। নাস্তা করে ঘরে আসার সময় ভাবির রুম থেকে চিৎকার, চেঁচামেচির আওয়াজ শুনেছিল। রুবেল স্ত্রীকে চাপা স্বরে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পৃথা ক্ষান্ত হলো না। চড়াও সুরে নিজের মত বলে যাচ্ছে। চাঁদ একবার ভাবলো, কি হয়েছে ঘরে যেয়ে দেখবে। পরক্ষণেই মন পাল্টে নিলো। এটা তাদের স্বামী স্ত্রী’র ব্যক্তিগত সমস্যা। সেখানে না যাওয়াটা ভালো।
ঘরে যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। জায়গা পরিবর্তন হওয়ায় ঘুম হচ্ছেনা ঠিকঠাক। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে, চোখজোড়া নেতিয়ে পড়ছে। যেই চোখ বুজলো অমনি ধরফরিয়ে পৃথা ঘরে ঢুকলো। দরজা খোলার ভারী আওয়াজে চাঁদ চমকে উঠল। চোখ মেলে তাকালো। পৃথা এসেছে, অশ্রুভেজা চোখমুখ তার। গালে থাপ্পড়ের চিহ্নের মতো। অগোছালো এলোমেলো চুল। চোখের জলে অনবরত গাল ভিজছে। ভাবির এমন দশা দেখে লাফিয়ে উঠলো চাঁদ, কাছে যেয়ে হতভম্ব সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে ভাবি! কাঁদছ কেন? গালে কিসের দাগ।’
চাঁদ হাত বাড়িয়ে দেখতে গেলে পৃথা সরে গেল। হাতের পিঠে চোখ মুছে। নিজের ব্যাগের থেকে কিছু টাকা বের করে, চাঁদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ এখনি এখন থেকে পালা চাঁদ। সময় কম। আমি বাহিরে সব ব্যবস্থা করে এসেছি, তুই সুযোগ বুঝে বেরিয়ে যাবি।’
ভাবির কথায় হতভম্ব চাঁদ। বিহ্বল সুরে বলল,
‘ কি হয়েছে ভাবি? তুমি কাঁদছ কেন! আর আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো কেন?’
পৃথা দুহাতে মুখ চেপে কান্না চাপতে চেষ্টা করল। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল,
‘ তোকে আষাঢ় সাহেবের কাছে ফিরিয়ে দিতে এখানে আনেনি চাঁদ। বাবা কেবল নিজ স্বার্থে এনেছে তোকে। বহুদিন যাবৎ বাবা দুস্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্নে মায়ের বিদঘুটে চেহারা, আহাজারি বারবার তাকে বিরক্ত করছিল। চারিদিকের মানুষজন আত্মীয়দের নানারকম কথাবার্তায় তিক্ত হয়ে উঠেছিল। সমাধানের জন্য পীরের স্মরণাপন্ন হলে, তিনি বাবার আর তোর ভাইদের ব্রেনওয়াশ করে। জানিস তো অন্ধবিশ্বাস কতটা ভ/য়ানক! যার বশিভূত হয়ে, মানুষ হয়ে জ্যান্ত মানুষকে বলি দিতেও দ্বিধাবোধ করেনা কেউ। তোকে ফিরিয়ে এনে বিয়ে ভেঙে ,আবার বিয়ে দিতে বলে। এতে নাকি মায়ের আত্মার, তুষ্টি ,শান্তি মিলবে। ওই ভণ্ড পীর টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কায়দা করে তার বউ ম/রা বড় ছেলের সাথে বিয়ের কথা বলল। সেই সাথে এটাও বলল, তাদের পরিবারে মেয়ে দিলে তার সারাজীবনের সব পাপ ধুয়ে যাবে।’
চাঁদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। দুনিয়া পাল্টে গেছে অথচ মানুষের মাঝে পুরানো অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এখনো রয়েই গেছে। রোজ পত্রিকায় এমন নানা ভন্ড প্রতারক মানুষের খবর ছাপছে। যাদুবিদ্যা, মন্ত্র তন্ত্র নিয়ে নানারকম অপ/রাধ, খু/ন হচ্ছে। এতেও মানুষের চোখ খুলছেনা। অন্ধবিশ্বাস করে প্রতারক মানুষের কাছে নিজের সবটা বিলিয়ে দিচ্ছে। বাবা ভাইদের প্রতা/রণায় ভীষণ কষ্ট পেল চাঁদ। চোখজোড়া ভিজে এলো। তার জীবন কি তাদের কাছে এতই মূল্যহীন! যে সংসার ভাঙতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ কেমন অমানবিক যুক্তি তাদের। বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে! আইন, ধর্ম সব নিয়ম লঙ্ঘন করে? অন্ধবিশ্বাসে বিবেকহীন হয়ে পড়েছে তারা। দুনিয়াতে কি আদৌ সম্ভব এসব! চাঁদের মনে হলো এসব তারা রাগের বসে করছে। বাড়ি ছেড়েছে বলে চাঁদকে শাস্তি দিতে এসব করছে।
শরীরের সব শক্তি যেন কেউ শুষে নিলো। নিস্তেজ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল চাঁদ। চোখজোড়া থেকে পানি ঝরছে অনবরত। নিমিষ সুরে ভাবিকে জিজ্ঞেস করল,
‘ এসব ব্যাপারে কি আষাঢ় ভাই জানে?’
পৃথা চুপ। খানিক নীরব থেকে বলল,
‘ রুবেল বলল, উনাকে সব জানিয়ে তোকে নিয়ে এসেছে। সেপারেশনের কথাবার্তা নাকি আগেই হয়েছে। বিয়ে হবার পরপরই সব মিটিয়ে নিবে।’
এতটুকু বলে পৃথা চাঁদের কাছে এগিয়ে এলো। হাত চেপে কান্নাভেজা ভীতু স্বরে বলল,
‘ আমি তোর ন/রকের মতো জীবন দেখতে পারবো না চাঁদ। এখান থেকে চলে যা, বহুদূর পালিয়ে যা।’
চাঁদ হতভম্ব। বুক চিড়ে দুইভাগ হলো তার। প্রচন্ডরকম যন্ত্রণা হচ্ছে। চারিপাশের পৃথিবীটা মিথ্যা মনে হলো। বাপ ভাইয়ের প্রতি কোন কালেই তার কোনো প্রত্যাশা ছিল না। ছোট থেকে তাদের অবহেলায় বড় হয়েছে। কিন্তু আষাঢ়! তার ভালোবাসার মানুষটা, যার জন্য নিজের বিলাসিতা ঐশ্বর্য জীবন ছাড়লো। সেই মানুষটা তার সাথে এভাবে প্র/তারণা করল! কিভাবে পারলো তার বুক কাঁপলো না একবার। তাহলে সেদিন আড়ালে যেয়ে তাদের এই চুক্তি হয়েছিল? এরজন্যই কি সেদিন আষাঢ় এমন বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছে চাঁদকে। শক্ত চাঁদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আষাঢ়ের কথা, মায়া, যত্ন সবকিছুই কি ঠুনকো মিথ্যা ছিল। মাথা কাজ করছেনা। হৃদপিণ্ড ধুকেধুকে চলছে। শরীর অসার হয়ে এসেছে। ঘোলাটে চোখজোড়ায় আষাঢ়ের স্মৃতি ভেসে উঠছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে, ঘৃ/ণা বাড়ছে কি করে মানুষ চিনতে ভুল করল। এমন একটা ঠুনকো মানুষকে মনপ্রাণ দিয়ে চাইলো। ভাবি থেকে মোবাইল নিয়ে আষাঢ়ের নাম্বারে ফোন দিলো। দুবার বাজতেই আষাঢ় ফোন তুললো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অসার কন্ঠে বলল চাঁদ,
‘ কেন এমন করলেন? আমি কি আপনার কাছে খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম। আপনাকে ভালোবাসা কি অ/ন্যায় আমার! যার শাস্তি বা/জে ভাবে ঠকতে হলো আমাকে।’
আষাঢ় হতভম্ব। চাঁদের কথার আগাগোড়া বুঝলো না সে। মাকে নিয়ে অনুষ্ঠানের কথা বলতে বিকালে চাঁদদের বাড়িতে আসবে বলে কারখানার কাজ গুলো কুদ্দুসকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। এমন সময়ই ফোন এলো।
আষাঢ় হতভম্ব সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এসব তুমি কি বলছ? কে ঠকালো, কি হয়েছে চাঁদ!’
চাঁদ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। অধৈর্য সুরে বলল,
‘ এখনো এত অভিনয়! কেন? কেন অবুঝ সাজছেন। আমি জেনে গেছি সব। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিয়ে দিচ্ছেন! প্রতা/রণা করে বাড়ি পাঠালেন। কেন করলেন এমন? আমি আপনার কাছে কি এতটাই য/ন্ত্রনার ছিলাম! আপনি স্পষ্ট ভাষায় একবার বলতেন, আমি আপনার জীবন থেকে চিরকালের জন্য সরে যেতাম। এসব ছলচাতুরীর কোন দরকার ছিলনা। আমি ক্লান্ত, অবসন্ন আমার ভালোবাসা হেরে গেল আজ। জানিনা কি হবে এরপর ! যদি বেঁচে থাকি দ্বিতীয়বার আপনার মুখ দেখতে চাইনা। এক আকাশ ঘৃ/ণা করি আপনায়। ঘৃ/ণা করি আষাঢ় ইয়াসির।’
রাগ চেপে কথাগুলো চেঁচিয়ে কান্নাভেজা সুরে বলল চাঁদ। অমনি দরজা খুলে রুবেল, শাওন, ফুপু ভিতরে এলো। চাঁদ সবটা জেনে গেছে। পৃথাকে এখানে দেখে তা বুঝতে বাকি রইল না তাদের। চাঁদের হাত থেকে মোবাইল বিছানায় পড়লো। ফোনের অপর পাশে অনবরত হ্যালো, হ্যালো করে যাচ্ছে আষাঢ়। কোণঠাসা হয়ে পড়লো চাঁদ। কি করবে? এখান থেকে কিভাবে পালাবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা। যাইহোক না কেন কারো সামনে কিঞ্চিৎ মাথা নত আপোষ করবে না। তার ‘না’ মানে ‘না’। বিয়ের বদলে যদি মৃ/ত্যুকে বেছে নিতে হয় নিবে। তবুও মানবে না। নারী কারো সামনে আপোষ মানার জন্য নয়।
রুবেল চাঁদের দিক এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
‘ যা হবার হয়েছে। এখান থেকে পালাবার কোনো পথ নেই আর। ঝামেলা না করে ভালোয় ভালোয় সব মেনে নিলে তোর জন্য ভালো চাঁদ।’
চাঁদ পিছিয়ে যেতে যেতে ড্রেসিং টেবিলের সাথে যেয়ে ঠেকলো। মাটির ভারী ফুলদানিটা হাতে তুলে, শক্ত করে মুঠিবন্ধ করে নিলো।বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানলো। তাচ্ছিল্য হেসে, শক্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ কারো সামনে আপোষ মানার জন্য জন্ম-ই হয়নি আমার। হয়তো মুক্তি নয়তো চিরকালের মুক্তি!’
বলেই হাতে থাকা ফুলদানিটা আয়নার দিক ছুঁ/ড়ে মা/রল। আয়না ভেঙে টুকরো গুলো সারাঘরে ছড়িয়ে পড়লো। রুবেল কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। চাঁদ ভাঙা আয়নার বড় একটা টুকরো মুঠিবন্ধ করে নিজের গলায় ধরল। হাত কে/টে চুঁয়ে চুঁয়ে র/ক্ত ঝরছে। গলায় আঁচড় লেগে অনেকটাই কে/টেছে। সেদিকে খেয়াল নেই চাঁদের। নারী যখন অগ্নিশিখা রূপ ধারণ করে, জগতের সকল ব্যথা য/ন্ত্রণা তার অন্তদহনের সামনে নগণ্য তখন। কাঠকাঠ স্বরে শক্ত কণ্ঠে বলল চাঁদ,
‘ যেতে দেও, নয়তো ম/রতে দেও।’
সারা ঘরের লোক স্তব্ধ। মোবাইল বিছানায় পড়ে। মোবাইলের অপর পাশের মানুষটা তখনো ফোনে। থমকে গেছে। নিজের হাবভাব হারিয়েছে। চিৎকার চেঁচামেচি করে চাঁদকে ডাকছে। চলন্ত রোডে পাগল পাগল হয়ে ছুটছে। আষাঢ়ের আহাজারি আদৌ কি চাঁদের কানে পৌঁছাচ্ছে। বাঁচাতে পারবে চাঁদকে?

চলবে………

আড়চোখে সাধনার মুখপানে একপলক তাকালো আরাধ্য। উজ্জ্বল মুখখানা মন খারাপের কালো মেঘে ডাকা। কি হয়েছে মেয়েটার? সে চলে গেলে একা হয়ে যাবে। এই কারণে কি মন খারাপ!
গোছানো কাপড় গুলো পাশে রেখে সাধনার হাত টেনে মুখোমুখি দাঁড় করালো আরাধ্য। মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে মেঘবরণ কেশে আটকে আছে। জানালা ডিঙিয়ে আসা সোনালী আলো সাধনার সুশ্রী সরল মুখখানা ছুঁইছে। সামনের অবাধ্য কেশে কপাল ঢেকে। নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। চিবুক ছুঁয়ে আলতো হাতে আরাধ্য তার মুখখানা উঁচু করল। হরিণটানা টলমল চোখজোড়ায় দৃষ্টি মিলালো। নিগূঢ়, গভীর কন্ঠে বলল,
‘ মাত্র কয়েকটা দিন। কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে আসব।’
কথাটা শুনে সাধনার আরো মন খারাপ হলো। কয়েক ফোঁটা জলে চোখ ভিজলো। আরাধ্য যতবার বিজনেস ট্যুরে গেছে সাধনার মন বিষন্নতায় ডুবেছে। নাকেমুখে কাঁথা চেপে লুকিয়ে প্রবাসীর প্রেমিকা, বউদের মত কেঁদেছে। এতদিন শুধু মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আজকের দুরত্বকে সাধনার ভয় হচ্ছে। আরাধ্যের সাথে সানিয়া যাচ্ছে। ভেবেই মন কু ডাকছে। অশান্তি লাগছে।
সাধনার গালে আরাধ্য আদুরে হাত রাখলো। চোখের জল আলতো হাতে মুছে দিয়ে। বুকে জড়িয়ে কপালে গাঢ় করে চুমু এঁকে দিলো। আদুর ঢালা গভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমার বউ’
আরাধ্যের গভীর আদুরে আওয়াজটা সাধনার বুকে বিঁধল। মুহূর্তের সব খারাপ লাগা, অশান্তি ভুলে গেল। মন জুড়ে প্রশান্তির এক শীতল হাওয়া বইল। বুকের ভেতর টিমটিম জ্বলতে থাকা পুরনো প্রেমের আগুনে বাতাস পড়লো।আরাধ্যের বুকে মাথা গুঁজে সাধনা দাড়িয়ে আছে স্তব্ধ। বুক কাঁপছে। হৃদয়ের গতি বাড়ছে অনবরত……….

পড়ুন ইবুক ‘সেনিওরিতা’

উপন্যাসটি পাবেন ‘ বইটই’ অ্যাপে। প্রমোকোড ব্যবহার করে ৫০ টাকার বই মাত্র ৩৮ টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন। ঝটপট অর্ডার করে ফেলুন। অর্ডার করেছেন তো?

প্রোমোকোড – EBOOKMELA2023

বিস্তারিত তথ্য, লিংক কমেন্টবক্সে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)

টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here