বামুনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
৯.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
সারাদেশে এডমিশন টেস্টের হৈচৈ চলছে। আজকাল চাঁদের বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে। সারাক্ষণ বইপত্রে ডুবে থাকছে। প্রায় সবকটা পাবলিক ভার্সিটির এডমিশন ফ্রম তুলেছে। মালা বেগম আষাঢ় যতটা পারছে সাহায্য করছে। নাওয়াখাওয়া ভুলে একপ্রকার পড়াশোনায় বিলীন সে। জেলায় জেলায় আষাঢ় নিজে সাথে যেয়ে চাঁদের এডমিশন টেস্ট ক্লিয়ার করছে। ঢাকা ভার্সিটিতে খুব সামান্য নাম্বারের জন্য হয়নি। সেই থেকে নিরাশা ভয় যেন আরো আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে তাকে।
আগামীকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। জ্যাম এড়াতে আগের দিন রাতেই বন্ধু আশরাফের বাড়িতে এসে উঠেছে। ভার্সিটি এরিয়ার পাশেই তাদের বাড়ি। সারাদেশে ভর্তি পরিক্ষা চলছে। আষাঢ়দের বাড়ি থেকে সরাসরি আসতে গেলে সকালে জ্যামের মুখোমুখি হতে হবে। এত ভীড় জ্যামের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়বে চাঁদ। তাই পরিক্ষার এই দুইদিন এখানেই থাকবে তারা। আশরাফ আষাঢ়ের অনেক বছরের বন্ধুত্ব। আষাঢ়ের ব্যাপারে আগাগোড়া সবটা জানে আশরাফ। চাঁদ এখানে পরিক্ষা দিতে আসবে শুনে, বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছে। প্রথমে আষাঢ় মানা করলে, একপ্রকার পিড়াপিড়ি করে তাকে রাজি করিয়েছে।
বিকালের দিকে আশরাফের সাথে তার চাষের পুকুর দেখতে বাহিরে বের হয়েছিল আষাঢ়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখে, মাথা চেপে বসে আছে চাঁদ। চোখমুখ র*ক্তিম। কেমন যেন বুজে বুজে আসছে। তবুও মেয়েটি শরীর উপর একপ্রকার জোর খাটিয়ে জে/দ চেপে বই খুলে বসে। পুরো ব্যাপারটা আষাঢ়ের চোখে পড়ল। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে মাথা ব্যথা?’
চাঁদের অসার আওয়াজ,
‘ তেমন কিছু না। বিকাল থেকে মাথা টিপটিপ করে ব্যথা করছে। হয়তো গরমে জার্নির কারণে।’
আষাঢ়ের কপালের চিন্তার ভাঁজ আরো গভীর হলো। দ্রুত চাঁদের দিক এগিয়ে এলো। কপালে হাত ছুঁয়ে বলল,
‘ কপাল গরম জ্বর আসবে বোধহয়। একটা নাপা খেয়ে নেও। সন্ধ্যায় নাস্তা করেছ?’
চাঁদ মাথা ঝাকিয়ে বলল,
‘ ঔষধ খেয়েছি। ঠিক হতে একটু সময় লাগবে। মাথায় তেল দিয়ে হালকা মালিশ করলে ব্যথা চলে যাবে।’
চাঁদের কথা শেষ হতে, না হতে আষাঢ় বলল,
‘ আমি মালিশ করে দিচ্ছি এদিকে আসো।’
চাঁদ হতভ্ম্ব। চোখজোড়া গোল গোল। বিহ্বল সুরে বলল,
‘ আপনি?’
আষাঢ় চোখ লুকাল। কিছু হয়নি এমন হাবভাব করে, বেশ স্বাভাবিক আওয়াজে বলল,
‘ হ্যাঁ আমি। কেন কোন সমস্যা?’
চাঁদ সন্দিহান দৃষ্টিতে আষাঢ়ের মুখপানে চেয়ে নারকেল তেলের বোতল এগিয়ে দিলো। আশরাফের স্ত্রী জুলেখা ভীষণ বুঝদার সংসারী মানুষ। মাত্র কয়েক ঘন্টায় চাঁদকে আপন করে নিয়েছে। চাঁদের মাথা ব্যথার কথা শুনে আগেই তেলের কৌটা ঘরে রেখে গেছে। বলেছে পড়া শেষ করে যেন তাকে ডাকে।
চাঁদ আষাঢ়ের সামনে যেয়ে বসলো। দুহাত চপচপ করে তেল ঢেলে চাঁদের মাথায় দিয়ে আলতো করে মালিশ করে দিচ্ছে। খুব একটা দক্ষ না। তবে নিজের সর্বস্ব চেষ্টা করছে। ভালোলাগার পাশাপাশি চাঁদের সামান্য হাসি পেল। এত যত্ন এত দায়িত্ব তার। তবুও নাকি ভালোবাসেনা চাঁদকে! মানুষটা শুধু ক/ঠোর হতেই শিখেছে। ঠিকঠাক অনুভূতি লুকাতে শেখেনি এখনো। শাশুড়ীর কাছে শুনেছিল। আষাঢ় ছোট থেকেই ভীষণ দায়িত্ববান। সারাদিনের পরিশ্রম, ক্লান্তির পর যখন মালা বেগম বাড়ি ফিরতেন ছোট্ট আষাঢ় তার মাথা টিপে দিতো। মায়ের য/ন্ত্রণা ক্লান্তি গুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করত। শুনেছে পুরুষ মানুষ কেবল দুজন নারীর সামনে ঝুঁকে। প্রথমে মা, দ্বিতীয় তার শখের নারীর সামনে। তবে কি চাঁদ ধরে নিবে আষাঢ়ের শখের নারী সে!
সামনের আয়নায় দুজনের প্রতিবিম্ব ফুটে। আষাঢ়ের মনযোগী মুখখানা চাঁদ নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখছে। মিষ্টি হাসলো সে। চোখে তার মুগ্ধতা ছড়িয়ে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ আপনি আমার আষাঢ়। একান্তই আমার। এইযে আপনার লুকিয়ে রাখা ভালোবাসাটা এর উপরও শুধুই আমার অধিকার।’
লাখ লাখ মানুষের সমাগম। দেশের দূরদূরান্ত থেকে একটা সুযোগের আশায় এসেছে। সকলের একটাই স্বপ্ন। একটা সিটের জন্য শতশত পরীক্ষার্থীর ল/ড়াই। পরিক্ষা শেষ করে হল ছেড়ে বের হলো চাঁদ। এতএত মানুষের ভিড়ে আষাঢ়কে খুঁজে পেলনা। তার সাথে ফোন নেই। হলে ঢোকার আগে আষাঢ়ের কাছে দিয়ে গেছে। এর পরের ইউনিটের পরীক্ষার্থীরা বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি তাদের আত্মীয়স্বজন আর বাহিরের পরিদর্শক। এত এত লোকের ভিড়ে আষাঢ়কে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একটু একটু করে যেতে যেতে চাঁদ বটতলার দিকে গেল। সেখানে খাবার দাবারের দোকানে ভিড় প্রচন্ড। চাঁদ উঁচু বটের কাছে বেঞ্চে গিয়ে বসলো। তার ক্লান্ত চোখজোড়া আষাঢ়কে খুঁজছে। হ্ঠাৎ কলমের ব্যাগে খুচরা টাকার কথা মনে পড়তে উঠে দাঁড়াল চাঁদ। ফ্লেক্সিলোডের দোকানে যেয়ে ফোন করবে বলে পা বাড়ালো। অমনি কিছু ছেলেপেলেদের দা লাঠি নিয়ে ছুটে আসতে দেখলো। তাদের দেখে এখানকার শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী মনে হচ্ছেনা। হাবভাব চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বাহিরের। চাঁদের গা শিরশির করে উঠলো। ভেতরে অদ্ভুত এক ভয় আড়ি পেতে। তাদের পাশ কা/টিয়ে দোকান থেকে মোবাইল নিয়ে আষাঢ়ের নম্বর উঠিয়ে ফোন ঢুকাতেই সেখানে মা/রামা/রি শুরু হয়ে গেল। তুমুল ঝা/মেলা বেঁধে গেছে। মানুষজন যে যার মত পালাচ্ছে। দোকানীরা তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করছে। চাঁদ ভ/য়ে কাঁপছে। ফোনের অপরপাশ থেকে আষাঢ়ের গলার স্বর ভেসে আসছে। দিশাহীন হয়ে পড়ল চাঁদ। এতবছরের জীবনে প্রকাশ্যে এমন ভয়াবহ মা/রামা/রি কা/টাকা/টি কখনো দেখেনি সে। ভয়ে তার হাতপা কাঁপছে। ফোন কানে তুলে কিছু বলবে সেই হুঁশ হারিয়েছে। আষাঢ় অপরপাশ হতে অনবরত ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলে চলছে। দোকানী তড়িঘড়ি করে চাঁদকে দোকানের ভেতরে টানলো। আশেপাশে ছুটাছুটি করা আরও কয়েকজন লোক নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে এলো। দোকানী তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করল। ততক্ষণে ফোন কে/টে গেছে।
কী ঘটেছে তা বুঝতে বাকি রইল না আষাঢ়ের। পরিক্ষা চলাকালীন সময় সেখানেই ছিল আষাঢ়। চাঁদের জন্য পানি আনতে গিয়ে সেখানকার লম্বা সিরিয়ালে আটকে যায়।ফিরে এসে দেখে পরিক্ষা শেষ। আশেপাশে চাঁদ কোথাও নেই।বটতলার দিকে ছুটে এলো। যেখানে সাধারণ মানুষ সবাই এখন থেকে পালাচ্ছে। আষাঢ় ছুটে এসে এই মা/রামা/রি ঝঞ্জা/টে ঢুকছে। পাগল পাগল হয়ে চাঁদকে আশেপাশে খুঁজছে। যেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে সেই নম্বরে ফোন দিলো। ঢুকছে না। বারবার ব্যস্ত বলছে ফোন। ভয়ে আষাঢ়ের শিরদাঁড়া শীতল হয়ে আসছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এদিক থেকে সেদিক সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছে। কোথায় খুঁজে পাবে চাঁদকে? নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পাগল প্রায় অবস্থা তার। ইতোমধ্যে মা/রামা/রির ভেতর দুই এক ঘাঁ তার শরীরে পড়েছে। সেদিকে খেয়াল নেই। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরঘুর করছে। কোন ক্ষ/তি হয়নি তো তার চাঁদের?
মা/রামা/রি আটকাতে পুলিশ এসেছে। এতে ঝামেলা কমেনি বরং আরো বেড়েছে। বি/শৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আষাঢ় সকল কিছু উপেক্ষা করে চাঁদকে খুঁজছে। আশেপাশের দোকান গুলোতে দেখছে। পুলিশ এসে আটকাতে চাইল। আষাঢ় শুনলো না। জোর খাটিয়ে সেদিকে ঢুকতে চাইল। পুলিশ আটকাতে চাইলে আষাঢ় ক্ষেপে উঠল। রাগের বসে একপ্রকার কলার চেপে ধরল পুলিশের। চিৎকার করে বলল,
‘ আমার স্ত্রী কোথাও আটকা পড়ে গেছে। জানিনা কোথায় আছে। আমাকে যেতে দিন। বাঁধা দিলে মে/রে ফেলব’
আষাঢ়ের মাথা ঠিক নেই। র/ক্তিম চোখ কথার ধাঁচে পুলিশ কর্মকর্তা ঘাবড়ে গেল। কয়েক কদম পিছনে সরে গেল। একই সুরে প্রাণ নেওয়ার হু/মকি পাশাপাশি আবার সম্মান! কেবল সাধারণ মানুষ দ্বারাই সম্ভব। পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের মত হিং/স্র কিছু নেই। তারা পরিবারের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর সকল সীমানা চি/ড়তে প্রস্তুত। পুলিশের ঘেরাও ডিঙিয়ে ছুটে গেল আষাঢ়। সামনের ফ্লেক্সিলোডের দোকানের দরজাটা সামান্য ফাঁকা দেখলো। দ্রুত সেদিকে ছুটে গেল। দোকানের সামনে চাঁদের নাম ধরে ডাকতেই, ভেতর থেকে একটা নরম জড়সড় চিরপরিচিত আওয়াজ ভেসে এলো। আষাঢ়ের নিশ্বাস খানিকক্ষণের জন্য আটকে গেল। দোকানের ভেতর থেকে চাঁদ বেরিয়ে এলো। ছুটে এসে আষাঢ়কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। চোখে মুখে তখনো ভয় তার। নিজের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান পেয়ে ভেতরের জমে থাকা ভয়, ভীতি কান্নার সাথে বেরিয়ে এলো। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। চাঁদের কান্নার আওয়াজে আষাঢ়ের হুঁশ হলো। দেহে যেন প্রাণ ফিরল। আষ্টেপৃষ্টে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরল। স্বস্তির শীতল নিশ্বাস ফেলল। এই প্রথমবার শক্তপোক্ত চাঁদকে এমন হাউমাউ করতে কাঁদতে দেখছে। এমনটা এর আগে কখনো দেখেনি।
কান্নার কারণে হেঁচকি উঠে গেছে চাঁদের। অশ্রুসিক্ত মুখ আষাঢ়ের বুকে ঠেকিয়ে। কান্নাভেজা অভিযোগের সুরে বলল সে,
‘ কোথায় চলে গেছিলেন আপনি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম..আ..আমি..’
চাঁদের কথা আটকে আটকে আসছে। আষাঢ় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শান্ত করতে চেষ্টা করল। বলল,
‘ সরি! প্লিজ শান্ত হও চাঁদ। এইতো আমি আর কোনদিন ছাড়ছিনা তোমার হাত।’
রিকশা চলছে। চাঁদের চোখ তখনো অশ্রুতে ভিজে। আষাঢ় চাঁদের বাহু টেনে আলতো করে জড়িয়ে নিলো। বিড়ালছানার মত আষাঢ়ের বুকে চাঁদ গুটিসুটি হয়ে রইল। দমকা হাওয়ায় চাঁদের খোলা কেশ উড়ছে। যত্ন করে গুছিয়ে দিলো আষাঢ়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করে বুকটা আঁতকে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,
‘ শিক্ষা হয়েছে আমার। একমুহূর্তের জন্যে আর কোনদিন একা ছাড়ছিনা।’
চলবে….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Afroja Akter jhuma বান্ধবী ❤️🌺