বামুনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
৮.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
সূর্যের তাপ একটু একটু করে মিয়িয়ে আসছে। সচ্ছ আকাশটায় ধীরে ধীরে মেঘেদের আনাগোনা বাড়ছে। জানালার পাশে হাঁটু ভাঁজ করে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে চাঁদ। দূর আকাশে নিগূঢ় দৃষ্টি তার। পাশে আষাঢ় ঘুমে আছে। মাত্রই চোখ বুঝেছে। চাঁদদের বাড়িতে বেশ ঘটা করে ঈদের দাওয়াতের আয়োজন হয়। বাড়ির সামনের বাগানে বাবা ভাইদের বন্ধু বিজনেস পার্টনারদের জন্য ব্যবস্থা করে। বাড়ির মেয়েদের আর নিকট আত্মীয়দের জন্য ছাদবাগানে আয়োজন করে। ঈদের আগের রাত থেকে মেহেদী পড়া, রান্নাবান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। শহর থেকে বাবুর্চি ভাড়া করে খাবার দাবারের বিশাল আয়োজন করা হয়। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হৈহল্লা চলে সারাক্ষণ। পৃথা ভাবির বিয়ের আগে ফুপু এসব দেখাশোনা করলেও, বিয়ের পর ভাবি দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু তিনি একা হাতে সামলায়। নিশ্চয়ই আজও বাড়িতে দাওয়াতের ব্যবস্থা হয়েছে। সব আত্মীয়রা বাড়িতে এসেছে। তারা চাঁদের খোঁজ করছে নিশ্চয়ই! ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল। হ্ঠাৎ কিছু একটা ভেবে সেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। কন্ঠে দ্বিধা জড়িয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,
‘ আদৌ কেউ কি মনে করছে ?’
ভারী তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হ্ঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। চোখের কোন ভিজে এলো। আবেগ অনুভূতি গুলো ভীষণ অদ্ভুত। এসব জিনিস লুকাতে চাইলেও, লুকানো যায় না।
বিকালে আষাঢ়ের ডাকে চাঁদের ঘুম ভাঙলো। ঘুমে টলমল চোখজোড়া পিটপিট করে মেলল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে দেখল তৈরি হচ্ছে আষাঢ়। কোথাও যাবে হয়তো। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়ায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বড় হাই টেনে। চোখ টানটান করে সামনে তাকালো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ কোথাও যাচ্ছেন?’
পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে আষাঢ় উত্তর দিলো,
‘হ্যাঁ! আর সাথে তুমিও যাচ্ছ।’
কপাল কুঁচকে নিলো চাঁদ। চাহনিতে আশ্চর্য ভাব। বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায়?’
‘ বাহিরে বেড়াতে যাবো।’
চাঁদের বিস্ফোরিত চোখজোড়া আরও বড়বড় হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বলল,
‘ কেন? মা নিয়ে যেতে বলেছে! প্রয়োজন নেই আষাঢ় ভাই। আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। আপনি নাহয়…
রাগে কিড়বিড় করে উঠলো আষাঢ়। চোখমুখে তার বিরক্ত ভাব। কথা কে/টে গম্ভীর সুরে বলল,
‘ এত বেশি বুঝো কেন। মায়ের বলতে হবে! আমি নিজে থেকে নিয়ে যেতে পারিনা তোমায়?’
চাঁদ আরো বেশি আশ্চর্য হলো। আষাঢ়ের হাবভাব উদ্ভট লাগছে তার। কেমন জানো অদ্ভুত পরিবর্তন তার। চাঁদকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকতে দেখে তপ্ত নিশ্বাস ফেলল আষাঢ়। ঘর ছেড়ে বের হতে হতে বলল,
‘ ঘর খালি করে যাচ্ছি তাড়াতাড়ি তৈরি হও। সময় দশ মিনিট।’
ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়ে চলে গেল আষাঢ়। যাওয়ার দিক তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল চাঁদ,
‘ দশ মিনিটে কি করে তৈরি হয়? আমি মেয়ে মানুষ আপনার মত মেশিন না আষাঢ় ভাই।’
ঘড়ি ধরে পুরো বত্রিশ মিনিট পর তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হলো চাঁদ। মাঝে দিয়ে কয়েকবার তাড়া দিয়ে গেছে আষাঢ়। ভয়ে গুটিসুটি পায়ে বসার ঘরে গেল চাঁদ। নিশ্চয়ই প্রচন্ড রেগে আছে আষাঢ়। সামনে যেয়ে দাঁড়ালো চাঁদ। কাচুমাচু সুরে বলল,
‘ সরি আসলে শাড়ি পড়তে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। নতুন নতুন শিখছি তো তাই প্যাঁচিয়ে ফেলছিলাম বারবার।’
ফোন থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি উঁচিয়ে তাকালো আষাঢ়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আটকে গেল সে। মানবী রূপে কোন পরি যেন দাঁড়িয়ে। পরনে সকালের সেই কালো জামদানী। মুখশ্রীতে কৃত্রিমত্তার কোন ছোঁয়া নেই। চোখে গাঢ় কাজল ল্যাপটানো। ঠোঁট জোড়ায় হালকা করে গোলাপি রঙের আভা। চোখেমুখে অদ্ভুত দীপ্তি তার। মেঘবরণ কেশ খোপায় আটকে। সোফা ছেড়ে উঠলো আষাঢ়। মন্ত্রমুগ্ধ যন্ত্রের মত পা বাড়ালো। চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খোপার কাঠি খুলে দিলো। বর্ষার বর্ষণের মত ঝরঝর করে কোমর ছুঁইল কেশ। আষাঢ় বিমোহিত সুরে বলল,
‘ খোলা চুলে তোমায় বেশি মানায়।’
বলেই সামনের দিক পা বাড়ালো। হতভম্ব চাঁদ দাঁড়িয়ে আছে তখনো। আষাঢ় পেছনে ফিরল। তাড়া দিয়ে বলল,
‘ দেরি হচ্ছে। বেলা পরে যাবে। চলো!’
গুমোট আকাশ। ব্যস্ত শহর। ইটপাথরের শহরটা আলোকসজ্জায় সাজানো। চারিদিকে নানা রঙে মাখানো। চলন্ত রিকশা দমকা হাওয়া চোখেমুখে এসে লাগছে। গোছানো চুল বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির অন্দরমহলের বাহিরে এই প্রথমবার এমন ঈদ উদযাপন দেখছে। চারিদিকে নানা রঙের ছড়াছড়ি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। বাবার কড়া শাসনের বাহিরে এই প্রথম এমন মুক্ত প্রাণবন্ত শ্বাস ফেলছে। আড়চোখে একবার আষাঢ়ের মুখপানে চাইলো। সাদা পাঞ্জাবি, ফর্সা মুখশ্রীতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সুঠাম দেহি গম্ভীর ব্যক্তিত্ব সুলভ পুরুষ। যাকে বলে রূপবান সুদর্শন। নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চাঁদ। রিকশার ঝাঁকুনিতে হ্ঠাৎ ধ্যান ভাঙলো তার। দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। রিকশা মেলার সামনে থেমেছে। আষাঢ় ভাড়া মিটিয়ে এক হাতে চাঁদের বাহু জড়িয়ে ধরল। চাঁদের কাচুমাচু মোলায়েম শরীরটা নিজের সাথে মিশিয়ে, আয়ত্তে নিয়ে নিলো। হতভম্ব দৃষ্টি উঁচিয়ে তাকালো চাঁদ। আষাঢ় হয়তো সেই চাহনির অর্থ বুঝল। চারিদিকে চেঁচামেচি গানবাজনার আওয়াজ। নিজের কথার আওয়াজ কানে আসতেও অসুবিধা হচ্ছে। চাঁদের দিক ঝুঁকে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
‘ আশেপাশে অনেক ভীড়। গায়ে ধা/ক্কা লাগতে পারে। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরো।’
সাথে সাথে শক্ত হাতে চেপে ধরল চাঁদ। আষাঢ় তাকে আগলে রেখে গেট পাড় করেছে। কাউকে কিঞ্চিৎ পাশ ঘেঁষতে দেয়নি তার।
মেলার ভেতর রমরমা পরিবেশ। চারিদিকে নানারকম দোকানপাট। খাবারের স্টল বসেছে। চটপটি, ফুসকা, হালিম সহ নানারকম খাবার। গরম গরম পেঁয়াজু, জিলাপি ভাজার ঘ্রাণে মো- মো করছে চারিপাশ। আনমনেই বাড়ির জন্য চাঁদের মন খারাপ ভাবটা কে/টে গেল। উচ্ছাসীত দৃষ্টিতে চারিপাশে চোখ বুলালো। চুড়ির দোকানে চোখ আটকালো। আষাঢ় জানে চাঁদের কাচের চুড়ি ভীষণ পছন্দ। এই জিনিসটার প্রতি চাঁদ ভীষণ দুর্বল। আচমকা হাত টেনে সে দিকে নিয়ে গেল আষাঢ়। চাঁদকে সামনে বসিয়ে চুড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোনটা পছন্দ তোমার?’
‘ আপনি কি করে জানলেন চুড়ি পছন্দ আমার!’
মৃদু হাসলো আষাঢ়। রহস্যময় সুরে বলল,
‘ কোন একভাবে জানলাম। এমন আরও অনেক কিছু আছে তোমার অজানা। কিন্তু আমার জানা।’
কপাল কুঁচকে তাকালো চাঁদ। তাড়া দিলো আষাঢ়। তড়িঘড়ি করে হাতে চুড়ি ঢুকাতে যেয়ে আটকে গেল চাঁদ। হাত বাড়িয়ে চুড়ি পড়িয়ে দিলো আষাঢ়। চাঁদের চেহারায় উচ্ছাস। চোখমুখে অদ্ভুত চমক তার। মাঝেমাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছে। নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখছে আষাঢ়। ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে। চাঁদের অজান্তে ফিসফিসিয়ে বলল সে,
‘ এই হাসি দেখে বহু যুগ পাড় করা যায়। আমার অমূল্য চাঁদ।’
আকাশ ভার দেখে তাড়াতাড়ি মেলা থেকে বের হলেও, মাঝ রাস্তায় এসে বৃষ্টির খপ্পরে পড়লো। গগন ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। রিকশা চালক ভিজে নেয়ে একাকার। তাই রিকশা থামিয়ে টঙ্গের দোকানের সামনে আশ্রয় নিলো। চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে। ঘন জঙ্গলের মাঝে আ/টকে। টঙ্গের দোকানে দুচার জন বসে। চাঁদকে একা রেখে রিকশা থেকে নামল না আষাঢ়। গা মোটা পলিথিনে ডেকে দুজন। তবুও কোথা থেকে যেন চুয়েচুয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। চাঁদের শাড়ির আঁচল ভিজছে। বিভ্রান্তিতে পড়ল চাঁদ শাড়ির আঁচল গুছিয়ে বাঁচতে চাইল। খুব একটা লাভ হলোনা। এদিকে চেপে বসতে বলল আষাঢ়। ঠান্ডায় জড়সড় বসে কাঁপছে চাঁদ। আষাঢ় বুঝল, চায়ের অর্ডার করল। দোকানী এসে চা দিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ ধরে ঠোঁট ছোঁয়াল। পাশে টিনের চালে বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটার ঝনঝন শব্দ বাজছে। খানিকক্ষণ নিরবতায় কাটলো। নীরবতা ভেঙে চাঁদ হুট করে বলল,
‘ আজকের দিনটার জন্য ধন্যবাদ। এই রিফ্রেশমেন্টের দরকার ছিল।’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আষাঢ় মজার সুরে বলল,
‘ বাহিরে বের হবে আমাকে বললেই হতো। কান্নাকাটি করার কি প্রয়োজন ছিল।’
চাঁদ কপাল কুঁচকে নিলো। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ আমি মোটেও কান্নাকাটি করিনি আষাঢ় ভাই।’
আষাঢ় হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। চাঁদ মুখ ফুলিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চা খাচ্ছে। আচমকা কারো গভীর চাহনি অনুভব করল। পাশ ফিরে তাকাতে দেখল নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আষাঢ়। যেন কোন গভীর বিমোহিত নেশায় ডুবে আছে। ধীরেধীরে চাঁদের দিক এগিয়ে এলো। আলতো হাতে চাঁদের কপালে ভেজা পড়ন্ত চুল গুছিয়ে দিলো। বিড়বিড় আওয়াজে আওড়াল,
‘ আমি নিয়ন্ত্রণহীন, পাগল হচ্ছি চাঁদ। অদ্ভুত অনুভূতি। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। বুক কাঁপছে। আমি পারছিনা নিজেকে আটকাতে। কেন এমন হচ্ছে? এমন তো আগে হয়নি কখনো।’
আষাঢ়ের দৃষ্টিতে আটকে রইল চাঁদ। বিমূঢ় সুরে বলল,
‘ কেন নিজেকে আটকাচ্ছেন? আমি তো আপনার। শুধুই আপনার।’
একটু একটু করে চুলে হাত বুলিয়ে কপাল ছুঁয়ে দিলো আষাঢ়। আবেশে চোখ বুজে নিলো চাঁদ। গভীর করে অনুভব করল। চেতনা ফিরতে আষাঢ় হাত সরিয়ে নিলো কিন্তু আদুরে অনুভূতিটা যেন রয়েই গেল। চাঁদ চোখ বুজে আছে তখনো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
‘ সময় থেমে যাক, এই বর্ষণ অনন্তকাল চলতে থাক।’
( ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন প্লিজ। রিচেক করা হয়নি।)
চলবে……
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Afroja Akter jhuma বান্ধবী ❤️🌺